>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • শাকিলা তুবা

    SongSoptok | 5/09/2014 |
    (ধারাবাহিক) স্মৃতিচারণ – ১

    ছেলেবেলার ছেলেরা

    আমাদের বাসাটা ছিল জল্লার পাশেই। জল্লার চিকন রেখার এপাড় থেকে ওপাড়ে লাফ দিয়ে যাওয়া যেত। আর হেঁটে গেলেও পানি মাত্র গোড়ালীর একটু উপরের অংশ পর্যন্ত ভিজিয়ে দিত। পানিও ছিল তেমনি নোংরা যা কহতব্য নয়। ব্যস ওটুকুই ছিল জল্লার কারিশমা। তবে দৈর্ঘ্যে এতটুকুন হলেও লম্বায় ছিল একেবারে সাত রওজা থেকে বংশাল পর্যন্ত। কেউ কেউ বলত, জল্লা গিয়ে মিশেছে নাকি বুড়ীগঙ্গার সাথে। আমাদের মহল্লার গামলা শহীদ, যে কিনা একবার ঘুড্ডি ওড়াতে ওড়াতে নুরুল হকদের তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়েও অম্লান বদনে নাটাইয়ের সুতো গোটাতে গোটাতে ঘরে ফিরে গিয়েছিল। সেই শহীদ একবার হারিয়ে গেল। তিনদিন পরে ওকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ম্যানহোলের ভেতর। অবাক লাগে ভাবতে, ম্যানহোলের ভেতর তখন সেকি পানির স্রোত। একটু উঁচু এক কোনায় গামলা শহীদ গিয়ে পড়েছিল। তখনই শুনেছিলাম, এই ম্যানহোলের সংযোগ জল্লার সাথে আর জল্লাটা বুড়ীগঙ্গার গরীব বোন।

    একটু বৃষ্টি হলেই জল্লাটা পানিতে উপচে উঠত। জল্লার চারপাশের উঁচু বস্তির ঘরগুলোতে ঢুকে যেত পানি। বস্তির লোকগুলো তখন আমাদের বাসার বারান্দায় এসে ঠাঁই নিত। আমাদের বাসাটা ছিল একবিঘা জমির উপর। পাঁচকাঠা জায়গা জুড়ে বড় বড় চার রুম, তিনভাগে বিশাল বারান্দা আর সিঁড়ির নীচেকার কিছু অংশ। বাকী সবটা জায়গা বেশুমার খোলা উঠান। জল্লায় বন্যা হলে আমাদের এই বিশাল উঠোনও পানির নীচে ডুবে যেত। আমরা বারান্দার সিঁড়িতে বসে জমা পানি দেখতাম। মা আফসোস করত, আহা গাছগুলো সব মরবে এবার। বন্যা হলে লাভের চেয়ে আমাদের মানে ছোটদের ক্ষতি হত বেশী। বস্তির লোকগুলো উঠে আসত আমাদের বারান্দায়। শুরু হত এদের হৈচৈ, চেঁচামেচি। বাচ্চাগুলোর অশ্লীল খিস্তি শুনতে শুনতে আমরাও মুখস্ত করে নিতাম কিছু। এখনো আমার গালির স্টক এত যে যদি গালির কম্পিটিশন হয় কখনো, আমি ফার্স্ট হব বিনা দ্বিধায়। তো আমার বিধবা মা তখন কোত্থেকে, কি ম্যানেজ করতেন জানিনা। বিশাল ডেকচি ভর্তি করে রান্না হত খিঁচুড়ি। সাথে সরিষার তেল অথবা ঘি কিংবা একটা ডিম ভাজার চার ভাগের এক ভাগ। এগুলোই খেতে হত অম্লান বদনে। একটু অনুযোগ তুললে মা খর চোখে তাকাতেন তবে নরম গলায় বলতেন, ‘তুমি বড় হয়েছ না? ওরা যা খাবে তোমাকেও তো তাই খেতে হবে, ওরা যে এখন আমাদের মেহমান মা।‘ আমি মনে মনে এইসব অতিথিদের গুষ্ঠি উদ্ধার করতাম। তা বলে আমিই কি খুব ভাল মেয়ে ছিলাম? আমিও কি বন্যা না থাকাকালীন সময়গুলোতে ছুটে যেতাম না বস্তিতে?

    মনে পড়ে, সাফিয়া বুজি যে কিনা আমাদের বাসায় আগে রান্নার কাজ করত, পরবর্তীতে বস্তির এক জোয়ান ছেলেকে বিয়ে করে নিয়ে সুখেই ছিল। তবে ওর স্বামী জোয়ান হলে কি হবে, ছিল তো এজমার রোগী। ফি হপ্তায় দুএকদিন কামাই যেত রিকশা চালানোর কাজে। তখন বস্তিতে ঢুকলেই সাফিয়া বুজি ছুটে আসত আমার কাছে, হাত ধরে বলত, ‘ছোট আপা তোমার দুলাভাই তো কামে যায় নাই, ঘরেও কিছু নাই, আইজ খামু কি?’ তাই তো ওরা খাবে কি? নো চিন্তা, ম্যায় হুঁ না! আমি ছুটে চলে যেতাম বাসায়। বাড়ীর সবার চোখ এড়িয়ে চাল-ডাল-নুন-আলু কোঁচড়ে ভরে বিজয়ীর ভঙ্গিতে নিয়ে যেতাম সাফিয়া বুজির কাছে। বুজি জিগ্যেস করত, ‘আমি রান্ধলে তুমি খাইবা?’ আট বছরের মেয়ে আমি তখনো বুঝি না জাত-পাত, শুচি-অশুচি। তেলচিটে কাঁথা বিছানো চৌকিতে দুলাভাইয়ের পাশে শুয়ে বুজির ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুমাবার আগে শুনতাম দুলাভাই বলছে, ‘সাফিয়া তুমি কামটা ভালা কর নাই। ও ছোট মানুষ, ঘরের জিনিষ না কইয়া আনলে তো ওর অভ্যাস খারাপ হইব। তুমিই যদি এট্টু যাইতা আম্মার কাছে, আম্মা তো না করনের মানুষ না।‘ সাফিয়া বুজি ছোট্ট করে কেবল বলত, ‘আমার শরম করে।‘ এই দুলাভাই লোকটা ছিল অসাধারন রকমের একজন ভাল মানুষ। আজো তার কথা ভেবে চোখে একটু যেন জলই আসে।

    ঘুম ভাঙ্গত সাফিয়া বুজির ডাকে। কলাই করা লাল-হলদে-সাদা ফুলতোলা বাসনে বুজি পাতলা খিঁচুড়ি ঢেলে আমাকে খেতে দিত। ওরে সে কি ঝাল! আমি উহ আহ করে খেতাম। আর হয়তো ঠিক সে সময়েই আমাকে খুঁজে খুঁজে আমার আয়া মা আর জাকিরের মা এসে হাজির হত মঞ্চে। আয়া মা তো ঠাস করে এক চড়ই বসিয়ে দিত গালে। জাকিরের মা আমাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত মা’র সামনে। ততক্ষনে চ্যাংদোলা অবস্থায় ওদের হাত, চুল টেনে টেনে আমিও হয়ে পড়তাম ক্লান্ত। জাকিরের মা গর্বিত ভঙ্গিতে ফিরিস্তি দিত কত জায়গায় খুঁজে অবশেষে আমাকে কোথায় খুঁজে পেল। বলত, ‘আম্মাগো আমি যাইয়া দেখি আপা ওগোর বাসুন থিক্যা কাদার মতন কালা কালা ঢলঢলা খিচুড়ি খাইতাসে।‘ আশ্চর্য মা কিন্তু আমাকে বকতেনও না। শুধু বলতেন, ‘বুড়ি এভাবে ঘরের জিনিষ নিতে নেই, এটা অসৎ কাজ। সবই তো তোর, এই বাড়ীঘরদোর সব। আর মা আমি তোমার বন্ধুও, আমাকে বললেই বরং আমি তোমাকে দিয়ে আরো বেশী করে খাবার ওদের জন্যে পাঠাতাম।‘ কথাটা সত্যি। জীবনে পরের জন্যে মা’র কাছে যা চেয়েছি তা তো পেয়েছিই, নিজের জন্যে চাওয়া কোনো আশাও মা অপূর্ণ রাখেননি। মা’র জন্যে সালাম।

    আমি যখন এগারোয় তখন আট আর দশ বছর বয়সী দু’জন সাঙ্গাত জুটে গেল আমার। একজন মিন্টু অন্যজন পন্ডিত। এরা ছায়ার মত আমার সাথে লেগে থাকত। যদি বলতাম ‘কারো ঘরে আগুন দিয়ে আয়’ ওরা বুঝি তাও পারত। আমাকে এত বস মানবার কারন ছিল নানাবিধ। যেমন আমি আমগাছের মগডালে উঠে দুই পা কোনো ডালে আটকে নিয়ে সার্কাসের মেয়েদের মত মাথা নীচের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে গান গাইতে পারতাম দিব্যি, চিকন দেয়ালে তিরতির করে দৌঁড়ুতে পারতাম। আবার এককোপে কারো লাট্টু ভেঙ্গে দেয়া ছিল আমার বাঁ হাতের কাজ। লাট্টু ভেঙ্গে কোঁচড় ভর্তি করতাম বাজী জেতা রঙ চঙে মার্বেল দিয়ে। তবে সবচেয়ে ভাল যা পারতাম তা হল ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেয়া। আমার সুতো ভাঙত না কিনতু হত এমন শক্ত! কত ঘুড্ডি যে কাটা পড়েছে সেই সুতোর ধারে আর আমাকে গাল দিয়েছে ঘুড়ি হারানো ছেলেরা তার ইয়াত্তা নেই। আমি ভাড়ায় খেটেও দুপুরের চড়া রোদে অন্যের সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে দিয়েছি। আমার দুই সাগরেদ মাঠের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে নাটাইয়ের সুতো চালাচালি করত আর মাঝখানে কাঁচের গুঁড়ো, শিরিষ আঠা এসব মুঠো থেকে আমি সুতোয় মাখিয়ে দিতাম অক্লান্ত ভাবে।

    ক্লাস নাইনে পড়বার সময়ে মা যখন পুরুষালী ভাব আর জিন্স ছাড়ার জন্যে গালাগাল করত তখন একদিন আমার দুই সাগরেদ এসে বলল, ‘আপা তুমি যখন উঠানে আমগো লগে ব্যাডমিন্টন খেলো তখন চুড়িয়ালা গল্লির একপোলা তোমারে দেখে অগো তিনতলা ছাদ থিক্যা’......আমি টাসকি খেয়ে পড়লাম, বলে কি! আমাকে দেখবে কেন কেউ খামোখা? তারপর থেকে আমিও লক্ষ্য করলাম ছেলেটাকে। পন্ডিত খবর এনে দিল, এই ছেলের নাম শানু। ছেলেটা সিনেমা করে। নায়ক জসিমের গ্রুপের ডান্সার। দেখলাম, প্রতিদিন বিকেল হলেই হিরো হিরো চেহারার শানু তার দলবল নিয়ে জোরে ডেকসেট ছেড়ে ছাদেই খুব কসরত করে নাচ প্র্যাকটিস করে আর মাঝে মাঝে আমাদের উঠোনে তাকায়। আমার মনে কোনো রঙ লাগেনি তখনো কারন আমি বয়সের তুলনায় ছিলাম পুরোই ইম্ম্যাচিওর। যাহোক সেজভাইয়ার চড় চাপড় খেয়ে বুঝলাম নারী জন্ম আসলেই ভয়াবহ। সে থেকে বারান্দা বা উঠোনে যাওয়াও আমি নিজেই বাদ দিয়ে দিলাম। নিজের রুমে বসেই আমি ক্যারাম খেলি, তাস খেলি মিন্টু, পণ্ডিত আর আমার ভাই হাসানের সাথে।

    অনেক মানুষই যেমন অবসট্যাকল দেখে মনের দুঃখে দমে যায় আমি তাদের দলে ছিলাম না কখনো। মনে আছে, খুব ছেলেবেলায় মানে আট/নয় বছর বয়সে আমি ভিড়ে গিয়েছিলাম আমার দুই বছরের বড় ভাই হাসান আর ওর বন্ধুদের সাথে। ওদের গ্রুপে ওরাও আমাকে কখনো মেয়ে বলেই গণ্য করেনি। ওরা বিড়ি ধরাত আমাদের বাসার পেছনের চিপা গলিতে। একটা বিড়িই ঘুরত হাসান, নুরু, আসলাম, শাহাবুদ্দিন, জয়নাল আর আমার হাতে। একদিন ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে প্যান্টের জিপার খুলে একযোগে পেশাব করতে শুরু করল। পেশাব গিয়ে লাগছে দেয়ালে আর ওরা সেই চিহ্ন ধরে পেশাব কাটাকাটি খেলা খেলছে। আমিও প্যান্টের চেইন খুলে যেই করতে গেলাম সেই একই কাজ, দেখি আমার পেশাব দেয়াল না ছুঁয়ে দুই উরু হয়ে প্যান্টটাকেই ভিজিয়ে দিল। নুরু হোহো করে হাসতে হাসতে বলল, ‘ঐ তোর কি নুনু আছে? তুই না ছেড়ি? তুই ক্যাল্লা আমগোর মতন মুতবার চাস?’ সেদিন আমি চমকে গেলাম। সেদিন প্রথম বুঝলাম, আমি লিঙ্গবিহীন মানুষ! তবে বড়দের চেয়ে ছোটরা অনেক বেশী সহানুভুতিশীল বলে পরবর্তীতে ওরা আর আমার সামনে এই খেলাটা খেলেনি বরং আমি যে ওদের সব কাজেই একাত্ম হতে পারি না এটাকেই ওরা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিত। আমাকেও ওরা ট্রিট করত ছেলে হিসেবেই। অনেক পরে অবিশ্যি ক্ষোভ জমেছিল আমার ভেতরেও, মনে হয়েছিল, ছেলে হিসেবেই ট্রিট কেন পাব? মেয়ে হিসেবে কেন যোগ্যতার স্বীকৃতি পাব না? কিনতু সেগুলো অনেক পরের কথা। রঙিন দিনের কথায় আপাততঃ কালি ঢালছি না।

    ইন্টারমিডিয়েট পরবার সময়ে আমার ভেতরে যাকে বলে ম্যাচিওরিটি, সেটা এল। আমি সালোয়ার-কামিজ পড়ি, নরম স্বরে কথা বলি আবার কাউকে কাউকে দেখলে লজ্জায় লালও হয়ে উঠি। মিন্টু আর পণ্ডিত তবু আমার সঙ্গ ছাড়েনি। মিন্টুটা পড়ালেখা করছিল তখনো কিনতু পণ্ডিত হাজিসাহেবের লেদমেশিন চালানোর কাজে যোগ দিয়েছিল। উপায়ও ছিল না কারন ঘরে ওর সৎ মা। জ্বালিয়ে ওর হাড়মাস একাকার করে দিচ্ছিল। তারপরও সন্ধ্যে হলেই ওরা দুজনে এসে হাজিরা দিয়ে যেত। আর শানু তখন নেশা করে, হেরোইনের নেশা। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি, রিকশা থেকে নামতেই দেখি শানু দাঁড়িয়ে আছে। হাড় জিরজিরে এ কোন শানু, এটা ভাবতে ভাবতেই আমি বাসার গেট পর্যন্ত চলে এলাম। দেখি শানু পাশের একটা ড্রেনের সামনে অবলীলায় লুঙি উঁচিয়ে বসে পড়ল প্রস্রাব করতে। যে আমি ছেলেবেলায় ছিলাম দারুন নিলাজ সেই আমিই আজ লজ্জায় পড়িমরি করে বাসায় ঢুকে গেলাম।

    এর কিছুদিনের ভেতরেই আমি প্রেমে পড়লাম, চরম প্রেম। আমার প্রেমিক আমাকে জানল দারুন রূপবতী এক নরম পুতুল হিসেবে। সে তাই পুতুলটাকে নিজের করে যখন পেতে চাইল প্রেমে আকুল আমিও কোনো বাঁধা দেইনি। চারপাশে বেজে উঠল সুখের সানাই। আমি সানাইয়ের টুকরো টুকরো সুরগুলো কিছু চোখে, কিছু বুকে, কিছু ললাটে ঢুকিয়ে নিয়ে শুরু করলাম জীবনের নতুন পথচলা। আমার বর লনি তখনো ছাত্র। তাই বাস্তবতার নিরিখে জীবনকে দেখতে শুরু করলাম আমরা আরো অন্য ভাবে। আমি পড়ালেখা করি আবার চাকরীও করি, লনিও তাই। আমাদের জীবনজুড়ে এল ছেলে অর্ণব। এ সময়ে আমার ছেলেকে দেখাশোনা করবার জন্যে যে আয়া রেখেছিলাম তার ছেলে আজিজুলও এসে জুটল আমাদের জীবনে। এই আজিজুল এখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বলা যায়, নিজের ছেলের চেয়েও আমার এই পালিত পুত্রটি আমাদের কাছে একটু বেশী প্রশ্রয়ই পায়। যাহোক অর্ণবকে রেখে চাকরী করাটা দুঃসাধ্য ছিল তাই আবারো ফেরত গেলাম পুরনো ঢাকায়। অর্ণব সারাদিন আমার মার কাছে থাকবে, সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসব এইসব সাতপাঁচ চিন্তা করে বাপের বাড়ীর কাছেই শানুদের বাসার ঠিক পাশের তিনতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম আমরা। ততদিনে শানুটাও মরে গেছে। শুনেছি, অতিরিক্ত নেশা করত বলে ওর মা ওকে দুইদিন বেঁধে রেখেছিল ঘরে। আফটার শক এড়াতে পারেনি ছেলেটা, মরেই গিয়েছে। অসৎ সঙ্গে ও আগেই পড়েছিল। নিজের জীবন দিয়ে সেই দায় সে পূর্ণ করে দিয়েছে। শুধু আফসোস হয় ওর মা’টার জন্যে। এই মহিলা নাকি কাঁদত আর বলতো, ‘ছেলেরে বাঁচাইলাম নাকি মারলাম আমি তো বুঝি না।‘ আমি কিনতু বুঝি, বেশ বুঝি, ও ছেলে মরেই বেঁচেছে।

    পুরনো ঢাকায় প্রত্যাবর্তন আমাকে আবারো নতুন উদ্যোম দিল, শক্তি পেলাম আমার শৈশবের পদচারনায় মুখর এই ছোট্ট জায়গাটিতে ফিরে। অনেকেই এসে দেখা করে গেল। একদিন রাত একটায় হাসান এসে ডাক দিল নীচ থেকে। আমি বারান্দার রেলিং এ ঝুঁকে ওকে দেখলাম ওকে। দেখি ওর সাথে নুরু, জয়নালসহ আরো ক’টা পরিচিত মুখ। হাসান হাত নেড়ে বলল, ‘বুড়ি নেমে আয়, নেমে আয়’......আমি উড়ে যেতে থাকলাম। পাশ থেকে লনি বলল, এই আমিও কি যাব? আমি তখন আর লনিকে দেখছি না। আমি কারো কথা শুনছি না। আমাকে নামতে হবে নুরুদের সারিতে। আমার ভাই হাসান আমাকে ডেকেছে। ডাকছে আমার শৈশব, ডাকছে কৈশোর।

    আমার বাসার ঠিক নীচেই মাজেদ সরদার কমিউনিটি সেন্টারের দেয়াল ঘেঁষে মিনুর ঠেলাগাড়ীটা রাতের বেলা পড়ে থাকে। আমরা সেই ঠেলাগাড়ীর উপর উঠে বসলাম। চা এল, সিগারেট এল। আমরা ধুমিয়ে ওসব খাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি। মহল্লার মামা-চাচারা হাসিমুখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কুশল জিগ্যেস করছে। আমরা সিগারেট লুকিয়ে ফেলছি, সব মিলিয়ে অসাধারন সুন্দর একটা রাত। আমি কৃতজ্ঞ আমার ভাই হাসানের কাছে, কৃতজ্ঞ নুরু, গেসুদের কাছে। এই ছেলেগুলো আমাকে মেয়েজন্ম ঘৃণা করবার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এই ছেলেগুলো আমাকে পুরুষ বিদ্বেষী হতে দেয়নি। আমি জেনেছি কর্মদোষে যে কোনো মানুষই খারাপ হতে পারে তাতে জেন্ডার লাগে না। আবার এও জেনেছি, ভাল বা মন্দ বোধটাও বড়ই আপেক্ষিক, যে তোমার কাছে ভাল সে আমার কাছে মন্দও হতে পারে তা বলে একটা মানুষ মাথা থেকে পা অব্দি ভালও যেমন হতে পারেনা, তেমনি পারে না শুধুই মন্দ হতে। আমাদের এই আড্ডা চলেছিল ম্যালা রাত অব্দি। পরে লনিও গুটিগুটি পায়ে নেমে এসে বসেছিল আমাদের পাশে।

    একদিন সকালে আমি অফিস যাব বলে নীচে নেমেছি দেখি এক কলাওয়ালার সাথে পন্ডিত ঝগড়া করছে। ওকে দেখে আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। সেও আমাকে দেখে পালাবার পথ পায় না। এ কি অবস্থা ওর? টেনে ধরলাম ওর শার্টের কলার, ‘হারামজাদা একি হাল করেছিস নিজের?’ টপটপ করে জল গড়াল পন্ডিতের চোখে। বলল, ‘আপা তুমি তো জানোই ঘরে আমার সৎ মা। অত্যাচার আর সইতে পারি নাই তাই কখন যে এই নেশায় ডুবছি নিজেই জানিনা।‘ আহা, আমার পণ্ডিত! ওরে পণ্ডিত!! তোকেও হেরোইনের নেশায় খেলো!!! বললাম, ‘শোন আমি অফিস থেকে ফিরলে আজকে বিকেলে অবশ্যই আমার কাছে আসবি, কথা আছে।‘ বলে ওকে ক’টা কলা কিনে দিতে চাইলাম, ও নেবেই না। অথচ ওর চোখ-মুখ দেখেই আমি জেনে গেছি কতটা অভুক্ত এখন সে। প্রায় জোর করেই ওগুলো পণ্ডিতের হাতে গুঁজে দিয়ে আমি গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। যতদূর দেখা যায় আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়েই ছিলাম শুধু। আমার চোখে ছিল কান্না, ওর চোখে শূন্যতা।
    গাড়ীতে বসে ভাবছিলাম, পন্ডিতের কথা ভুলে গিয়েছিলাম কি? কেন গিয়েছিলাম? ভুলে যাওয়াটা কি অপরাধ? ও কে আমার? ভাই? বন্ধু? নাকি তারো বেশী কিছু ছিল কোনোদিন? ছেলেবেলার নিষ্কলুষ এ সব সম্পর্কের কি আদৌ কোনো নাম দেয়া যায়? শুধু বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্নেহের এক কলকলে নদীর ছলাত ছলাত শুনি। আমাদের সেই জল্লার মতন সরু অথচ আবর্জনায় ভরা।

    অফিস থেকে বাসায় ফিরতে গুলিস্তানের জ্যাম পেরুতে হয়। তাই বেশ বিরক্তি নিয়েই যখন ফিরছি তখন দেখলাম কমিউনিটি সেন্টারের পাশে রাখা মিনুর সেই ঠেলাগাড়ী ঘিরে ছোট্ট একটা জটলা। আরো বিরক্তি নিয়ে ওদেরকে পাশ কাটিয়ে তিনতলায় উঠে এলাম। বাব্বাহ যা গরম! হাতমুখ ধুয়ে, হাতে পেপারটা নিয়ে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম নিজেকে বেশ সুখী সুখী মনে হল। নীচে ঠেলাগাড়ীর সামনে বুঝি অনেক মানুষ, হৈ চৈ চলছে এখনো। এবার খানিক কৌতুহল নিয়েই উঁকি দিলাম রেলিং এর ঐ পাশে। উপর থেকে স্পষ্ট দেখলাম পণ্ডিতের ভাবলেশহীন মুখটা, নিথর শরীর নিয়ে শুয়ে আছে ঠেলাগাড়ীর উপর। তবে ওর চোখ এখন আর সকালের মত শূণ্য নয়, অনেক অনেক কথা নিয়ে সে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে।

    ক্রমশঃ 



    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.