এক আত্মপরিক্রমা : বাংলাসাহিত্যের প্রতিবাদী কবি, কৃষ্ণা বসু
আমার প্রিয় কবিতা স্রষ্টা বলেন, ‘অস্তিত্বের উৎস থেকে উৎসারিত কিছু উচ্চারন দেখি মাঝে মাঝেই কবিতার রূপ নেয়।‘ কবিতার সংজ্ঞার শেষ নেই। পৃথিবীতে অনন্তকাল রচিত হবে কবিতা, আবৃত্তি হবে, শ্রুত হবে কবিতা। কবিতা-অনুরাগী, কবিতা-কর্মী ও কবিতা-স্রষ্টা দিয়ে যেতে থাকবেন নিজেদের বোধ ও অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ অন্তহীন সংজ্ঞা । কবি না বলে কবিতা-স্রষ্টা বললাম। কারণ, কবিতার বিপরীতে অবস্থান যার, সেই বিজ্ঞানের সাধকরাও কবিতা রচনা করে গেছেন, নতুন সৃষ্টির আনন্দে। পৃথিবীর তাঁবৎ বাস্তববাদী ও পরাবাস্তববাদী কবিতা-কর্মী ও কবিতা-স্রষ্টারা, কবিতা নিয়ে তাঁদের হাজারো ভাবনার কথা বলে গেছেন অকপটে, নানা অনুষঙ্গে। আমার স্বল্প বিদ্যায়, স্বল্প পরিসরে আজ তাই নিয়ে একটু ফিরে দেখা, আমার প্রিয় কবির কবিতার রাজ্যের এক অবিস্মরণীয় পরিক্রমা।
নিজের বক্তব্য সমাজে অন্যান্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য কবিতা একটি শক্তিশালী মাধ্যম। একজন মানুষের মনের ছবি কবিতা পড়ে দেখা যায়। মনের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে লেখায় লেখায়। সব মানুষের মনেই কবিতা থাকে। আবার কোনো মানুষের মনেই কবিতা থাকে না। কবিতা একটা মুহূর্তেই মানুষের মনে আসে আর এই কবিতা মুহূর্তে সেই কবিতাটি ধরে রাখতে পারেন একা কবিই।
“মাংস বিক্রয়ের মূল্যে বেঁচে থাকো,
নারী শ্বতকেতু নিবন্ধে ব্যক্তিগত পুরুষের কাছে নয়,সমাজের আরো দশ বারো
পুরুষের কাছে হয়,গৃহগণিকার বেশে গৃহবধূ নাম নাও,নয়,বাহির বেশ্যা পরিচয়ে
বেঁচে থাকো,এর বেশী মূল্য সমাজ দেয়নি তোকে,মেয়ে।“
( জীবন সংগীত )
নারীজীবনকে, তার যন্ত্রণা, লড়াই ও মহিমাকে, কৃষ্ণা বসুর আগে কবিতায় ধরেছিলেন পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তর দশকের বেশ কয়েকজন মহিলা কবি৷ কিন্ত্ত তাঁরা কেউই বিষয় ও ভাষায় ওনার মতো অতখানি স্পষ্ট ছিলেন না৷ আর্থসামাজিক কারণেই তাঁরা অতখানি স্পষ্ট হতে পারেননি৷ প্রথাগত ভাবে কবিতা বলতে বাঙালি যা বোঝে সেই শুদ্ধ কবিতা রচনার দায়ও অনেক সময়েই তাঁদের প্রতিবাদের পায়ে পরিয়েছিল বেড়ি, তাঁদের রাগকে করে তুলেছিল সাংকেতিক৷ সেই কমজোরীকে লেখনী দিয়ে জয় করে নরম পেলব ভাষায় মেয়েদের কথা লিখতে শুরু করেন কবি কৃষ্ণা বসু।
“মাথায় জয়ের মুকুট নিয়ে
ঐ মিছিলে চলছে আমাদের নারী জন্ম,
হৃত জন্ম,ম্লান জন্ম, হেয় জন্ম,
মাগো দ্যাখ,মিছিল চলেছে বিশ্বময়,
মারে তুই শোন,জন্মাবার সময়
শাঁখ যদি নাও বাজে,
প্রতিটি মেয়েকে আমরা শাঁখের সমান
ধ্বনিময়ী,প্রতিবাদী,সুগর্জনী করে তুলে
দ্যাখ মাগো, আজ সত্যিকার কলম ধরেছি।“
(দাদার জন্মের সময় শাঁখ বেজেছিল)
পুরান উপকথা থেকে মহাভারত লোকগাঁথা, সবর্ত্র সেই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি। আমাদের চোখে সর্বংসহা, দুখজয়ী মহতী সেইসব নারীদের জীবনের লাঞ্ছনা অপমান, ফুটে উঠেছে শব্দের অলঙ্কারে, ছাপা অক্ষরে, কবির ভাষায়।
“স্ত্রীলিঙ্গ দেবতা আমি পূজা নাহি করি,
পুরুষ শিবের ভক্ত চাঁদ বলে ওঠে,
হেলা দেয় চাঁদ, লাথি দেয় ভরা ঘটে,
ভাঙা ঘট থেকে অশ্রু ঝরে,রক্ত পড়ে,
দিনরাত্রি রক্ত পড়ে, টুপ টাপ টুপ!
রক্ত থেকে, মার থেকে, অপমান থেকে,
মাটি ধরে ফের উঠে দাঁড়াই সটান,
ধীরে ধীরে প্রতিশোধপরায়না হই,
ধীরে ক্রমে বিষ জমে শীরে আমার।
-------------------------------------
বিষে ভরা ফণা তুলে হিসহিস দুলি,
তীব্র বিষ ছোবলের সামনে দাঁড়িয়ে
বাম হস্তে পূজো দেওয়া পুরুষ সভ্যতা।
( মনসা জীবন: মানব জীবন )
আমাদের ‘পারিবারিক বন্ধন’ হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য। আর এই‘পারিবারিক বন্ধন’ রক্ষা ও পালনের জন্য নারীকে বিভিন্ন ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। ছোট্ট গৃহকোণে শান্তির নীড় রচনার দায়িত্ব নারীর। কখনও মা, তো কখনো মেয়ে, কখনো স্ত্রী, কখনো প্রেমিকা, বান্ধবী, বোন, আলাদা রূপ, আলাদা দায়িত্ব, । সন্তানকে লালন-পালন ও শিক্ষাদানের দায়িত্ব মায়ের। 'মা' হলো সন্তানের প্রথম শিক্ষক। তাই সন্তানের সুশিক্ষায় মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো এদেশে এখনও বহু সন্তান রয়েছেন, যারা মায়ের জন্য জীবন উত্সর্গ করতে পারেন। কিন্তু তার বিপরীতে মায়ের প্রতি সন্তানদের চরম অবহেলা-অবজ্ঞার চিত্র ধরা পড়ে বৃদ্ধাশ্রমসহ সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত।
“বুড়ি মা রয়েছে ভাঙা গ্রামের বাড়ীতে,
নাগরিক ছেলেটি তার মাসে মাসে
মাসোহারা দেয়, দু দশ টাকার পূণ্য
জানি তোলা আছে তার নাম এ বাবদ।“
------------------------------------
“তের দিন পর সেই মাতৃশোকাতুর
বাড়ী বাড়ী বিলি করে গাড়ী নিয়ে শ্রাদ্ধ
বাসরের চিঠি,তলায় নিজের নাম,
তার আগে লেখা আছে ‘ভাগ্যহীন’, ঠিক।“
(বুড়ী মা)…
আর কবির ‘সমস্ত মেয়ের হয়ে বলতে এসেছি’তো সব সময়ের কবিতা। চারপাশে যখন ক্ষমতার চাটুকার ও কীর্তনিয়াদের ভিড়, তখন সেই দল থেকে ভিন্ন থেকে, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকারেও প্রস্তুত থেকে যিনি ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনার অধিকার সমুন্নত রাখতে পারেন তিনিই তো প্রকৃত কবি। এ কবিতা অনেকখানি আমারই কবিতা। কোনও দলে গ্রুপে গোষ্ঠীতে না থেকে, সকল আক্রমণ সহ্য করে, নিজেকে অব্যাহত রাখার আত্মনাদ এ কবিতা:
“সমস্ত মেয়ের হয়ে বলতে এসেছি,-
হাজার বর ধরে যেসব মেয়েরা
মার খেয়ে মুখ বুজে সহ্য করে গেছে,
জ্বলন্ত চিতায় যাকে পুড়িয়ে মেরেছ,
বিবাহসঙ্গীটি মারা গেলে অবশেষে
বিনা অপরাধে যারা বিধবা হয়েছ,
---------------------------------
সেই সব করুণাময়ীর হয়ে
আজ বলতে এসেছি, একা নিরালায় যাকে
পেয়ে পৌরুষ বিস্ফার করো ভয়ঙ্কর;
-ধর্ষিতা সে মেয়ে কোন সুবিচার পায়?
সেইসব মেয়েদের কান্না রক্ত ঘাম
এই কলমে ভরেছি, - বলতে এসেছি।“
(‘সমস্ত মেয়ের হয়ে বলতে এসেছি)
রাষ্ট্র পরিবারের প্রধান পুরুষের মাধ্যমে শাসন করে নাগরিকদের। তিনি মনে করেন এ শাসনের বিশেষ শিকার নারীরা। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষাধিপত্যের অধীনে রাখার প্রক্রিয়াটি তাঁর কবিতায়, তাঁর লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। টিঁকে থাকার জন্য পিতৃতন্ত্র কিভাবে পরিবারের পুরুষটিকে সমস্ত কর্তৃত্ব দিয়েছে এবং তার সমাজতাত্ত্বিক বা লৌকিক বিবরন রয়েছে তার কন্যাভ্রূণ কবিতায়। তাঁর ভারত জননী কবিতায়।।
“ভ্রূণহত্যার দেশে এসেছি হঠাৎ,
শিশুকন্যা ভ্রূণগুলো খুন হয় নিঁখুত আঙ্গুলে,
সুসভ্যতা উঠে এসে প্রানপনে টিপে ধরে
অজাত কন্যার কচি টুটি,”
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, শোক নয়,দুঃখ নয়, হাহাকার নয়, কবিতার শেষে অদ্ভুত এক নিরাসক্তিতে কবি উচ্চারণ করেনএক অমোঘ প্রার্থনা (নাকি অভিশাপ?) ,যা পড়তে পড়তে শিউরে উঠি, অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে এক অজানা আশঙ্কায়, দেশীয় মারণ প্রথা ও পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কবি সোচ্চারে বলেন-
“শুধু এক প্রার্থনা রেখে যাই মহাকালের নিকট,
‘নারীহীন, মাতৃহীন, কন্যাহীন যোষিত সংসর্গহীন
বান্ধীবিহীন হয়ে বেঁচে থাক,আগামী প্রজাতি।‘ “
(কন্যাভ্রূণ )
মেয়ে হয়ে মেয়েদের এই অসহায়তায় দু চোখ জ্বালা করে, ক্ষোভে মুষ্ঠিবদ্ধ হয় দুই হাত। কবির চিন্তা কবির প্রতিবাদ আমার মনেও ছায়া ফেলে। আমার ভাবনাকে প্রভাবিত করে। আমিও কলম তুলে নেবার প্রয়াস পাই। অনুপ্রানিত হই আমার অগ্রজা কবির রচনায়।একাধিক কবিতায় বারংবার এসেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মেয়েদের কথা, কখননো বুড়িমা হয়ে, কখনো তোমাদের শিশুকন্যায় কখনো একটি সামান্য চিঠিতে। সেই সব কারণেই হয়তো তাঁকে ‘নারীবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু এই দাগানো ছেঁদো ব্যাপার। এতে কবি এবং কবিতাকেই অসম্মান করা হয়। কৃষ্ণাদির কবিতাগ্রন্থগুলির ধারাবাহিক পাঠ থেকে এটা বেশ বোঝা যায় যে দিন যত গিয়েছে কবি ততই চেয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর কবিতা কেবল একটি মেয়ের বন্ধুই নয়, হয়ে উঠুক তার হাতিয়ারও, মেয়েদের দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, লাঞ্ছনা, উপেক্ষা,সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে, তৃতীয় বিশ্বের কান্না নিয়ে, বারবার সরব হয়েছে তাঁর লেখনী।
“সেখানে কন্যাভ্রূণ
হত্যার খবর,সেখানে পণের সর্বস্ব শোধ না দেবার অদ্ভুত অপরাধে
গৃহবধূ ঝুলে পড়ে সিলিং ফ্যানের থেকে নীচে, সেখানে শিরীষ
ফুলের মত সুকুমারী কিশোরীকে ছিঁড়ে খুড়ে নষ্ট করে বলবান
চারজন যুবকের পুরুষ- গরিমা।
অন্যসব সংবাদের মাঝে মাঝে এখানে সেখানে এইসব সামান্য সংবাদ
বিস্বাদ ব্যঞ্জনের সমাচারে লবণের কিংবা চাটনীর কাজ করে যায়।
নাহলে সংবাদপত্র নিতান্ত আলুনী মনে হত। সারাদিন ঘুরি –ফিরি,
জীবিকা ও জীবনের দিকে ঝুঁকে থাকি; মাথার ভিতর নাছোড়
মাছির মত ঘোরে ঘ্যানঘ্যান করে শুভার্থী পুরুষ প্রশ্ন, ‘নারীবাদ
ছাড়া কিছু ভাবতে পারো না?’ “
(নারীবাদ )
কৃষ্ণাদির কবিতার বিষয় আমাদের সবাইকেই কম বেশি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অনেকদূরে.. নিজের বাড়ি, একান্নবর্তী সংসার, মায়ের স্নেহ-ভালবাসার সে এক অভিন্ন আকর্ষণ.. সে তো আর কেউ না বুঝুক আমরা বুঝি। যারা জীবনের তাড়নায় মায়ের আঁচল ছেড়ে অথবা মা পাড়ি দিয়েছেন জীবনের সকল মমত্ববোধ থেকে পরপারে…! আমার ভেতরের কবি মানুষটি যেন জেগে উঠল মুহুর্ত্বে। কবিতায় রয়েছে স্পষ্টতর আবেদন, বেদনা, বিশ্বাস, ভালবাসা আর হারানোর কষ্ট। খুব ভাল লাগার উপাদান বিন্যস্ত কবিতার শরীরজুড়ে।এটাই কবিতার পরম্পরা।
“প্রেতের মত পিতার মত পিতামহীর মত
ওই ডেকেছেন পরম্পরায় অতীত দিন গত।
গত হলেও যায় না সখা, অতীত টেনে ঘরে,
পরম্পরা ও বর্তমানে টানছে পরস্পরে।“
(পরম্পরা ও বর্তমানে )
কবি হিসাবে শুধু প্রতিবাদী কবিই তিনি নন, তিনি প্রেম ও প্রকৃতির কাছেও সমর্পিত। তাঁর কবিতা যেন মায়াবী জ্যোৎস্নার রাত।তার কবিতা, শুধু কবিতাই নয়,যেন ফুল্লরার বারোমাস্যা, আমাদের খুব চেনা খুব জানা দৃশ্যপট মানবজীবনের অঙ্গাঙ্গী রূপ হয়ে বাঁধা পড়ে কবি- কল্পনায়।
বৈশাখ / হাত জ্বলে যায় পা জ্বলে যায় ও বোশেখ তুই কি।
তুই কি আমার গত জন্মের নষ্ট ঠাকুরঝি?
জৈ্যষ্ঠ / নির্জলা দিন মন উচাটন মারণমন্ত্রে কে
রাত্রি জাগায় দিন পোড়ায় সহ্য হয় না রে।
আষাঢ়/ আষাঢ় আমার আষাঢ় ওরে ছেলেবেলার সই,
তোর পীরিতির তীব্র ধারার দেখা পেলাম কই?
(বারোমাস্যা)
কৃষ্ণা বসু’র কবিতা প্রাঞ্জল, সহজ সরল জীবনবোধ ও মানবচেতনায় উজ্জ্বল। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নির্মাণ করেন কবিতাকে।কবিতা তাঁর কাছে শীর্ষ শিল্প। তাঁর কবিতার উচ্চারণ সাহসী, গতি সাবলীল। এ বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর সমকালীনদের থেকে কতখানি স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করবে তাঁকে তা বলা মুশকিল, কিন্তু সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ কাব্যপঙ্ক্তি তাঁকে নিশ্চয়ই অলোচিত ও উদ্ধৃত রাখবে বিভিন্ন উপলক্ষে। তাঁর নির্মাণ মেধান্বিত, শব্দবয়ন নিপুণ, ভাষা প্রসাধিত, অন্ত্যমিল অপ্রত্যাশিত আনন্দ জাগায়: এমন কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধার করছি এখানে:
“সারাক্ষণই সঙ্গে ঘোরে নাছোড় সন্দেহ
কে ছুঁয়েছে কে ধরেছে ঘরের নারীর দেহ
সারাক্ষণই কষ্ট ঘোরে অবিশ্বাসের দাহ,
ার সঙ্গে বল ছিল তোর নিজস্ব সংবাহ?
আমার মুঠোয় থাকবি ধরা উড়বি কেন তুই?
ছড়িয়ে দিই আমার শাসন স্বর্গ থেকে ভুঁই।“
(পুরুষ – পুরাণ)
অথবা,
তখন আমার ছেলেবেলা তখন আমার খেলা,
খেলার জন্য রাত্রি দিনে সাজিয়ে তুলি ঢেলা,
ইস্কুলেতে মন ছিল না মন ছিল না সাজে
খেলার জন্য ফুল ফুটে রয় কুমারডুবির মাঝে।
কুমারডুবির শান্ত দহে অন্ধকারের টান,
জলের তলায় কে জেগে রয় প্রাণেতে আনচান।
( সেবাদাসীদের পদাবলী )
কবি মানেই কি দু:খ বিলাসী! কবিদের নিয়ে এমন সব জিজ্ঞাসা নতুন নয়। কবিরা আবেগপ্রবণ, তাদের ভেতরের চিরায়িত অবক্ষয় হচ্ছে বেদনা আর আখাঙ্খার মধ্যদিয়ে স্বপ্নালিত বিশ্বাস। সেখানে দু:খ-বিলাসিতা হচ্ছে তাদের একান্ত সুপরিকল্পিত ভাবাবেগ। কবির সাথে সংগ্রাম করে, কবির চেতনাকে ভেঙেচুরে কবিতার আবহ-সংবাদ একটি ভিন্ন মঞ্চ তৈরি করে; কবিতার পটভূমি অদেখায়-অগোচরে তাঁর নিজের (কবির) রংতুলিতে চিত্রকল্প, উপমা, প্রতীক, রহস্য, ইত্যাদি যা-কিছু দ্যুতিময় তার সমস্তকে ধারণ করে।
“পুরানো ভিটের মায়া, ঘুঘু ডাকা দিন,
বাজায় বুকের মধ্যে হা হা করা বীণ,
বীণা কি বাজায় কেউ? পা ছড়িয়ে কাঁদে,
আকুলি বিকুলি করে স্মৃতি-জব্দ ফাঁদে।
বিকেলবেলার মায়া, ছায়া দীর্ঘ হয়,
প্রাণের ভিতর জাগে গূঢ় প্রাণভয়,
মায়ামাখা পৃথিবীটা ছেড়ে যেতে হবে?
ছেড়ে যাবো? কেন যাবো? কবে, যবো কবে?
এত তাড়াতাড়ি কেন শেষ হল খেলা?
ছায়া দীর্ঘতর হল! পড়ে আসে বেলা!”
(স্মৃতি-জব্দ কবিতা )
উপরোক্ত পঙতিগুলো বিভিন্ন কবিতার অংশবিশেষ, কিন্তু ছন্দের কারুকাজ বর্ধিত করেছে কাব্যময়তার গতি ও ধ্বণিগাম্ভীর্যতা। অনায়াসে কবির দর্শনেরও গভীরতাকে উপলব্ধি করা যায় সহজে।
তাঁর কবিতার মূল সুর প্রকৃতি, বিদ্রোহ, প্রেম, নারীর ভালোবাসা, দুঃখ, ও দুঃখ থেকে পরিত্রাণ,তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে নারীবাদ, প্রতিবাদ এবং মানবিকতা। এখান থেকেই ফিরতে থাকি আমরা, চলি নতুন পথে, যে পথে 'মৃত্যুঞ্জয়ী নারী' গেয়ে ওঠে 'স্বপ্ন ফেরাবার রীতি উচাটন গান'।
‘দুই হাতে তাকে আগলে রাখিস,
ওই দ্যাখ নিচু হয়ে আসে ধূর্ত চিল,
গ্রাম- শকুনের দল মাথার ওপর
চক্রাকারে উড়ে উড়ে বেড় দেয় সুখ,
তোমার সঙ্কল্প ওরা খাবে বলে
ঠিক নিচু হয়ে নেমে আসে মেধার ওপর ||
তুই তবে জেনেছিস কীভাবে
মৃত্যুর গভীর মারের থেকে পচনের থেকে
গলিত শবের থেকে জেগে ওঠে প্রেম ফের,
জেগে ওঠে মায়া, স্থাপত্য বিলাস জাগে, ভাঙনের মুখ ...’
ডবলিউ এইচ অডেন (১৯০৭-১৯৭৩) কবিতাকে বলেছেন ‘স্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা’ - সে হিসেবে অমন অনেক পঙ্ক্তি রচনা করে কবি-অঙ্গীকার পূরণ করেছেন কবি কৃষ্ণা বসু। তিনি সম্পন্ন কবি। ভাল কবিতা রচনার আদি-অন্ত তাঁর আয়ত্তে - তাই জীবন ও জগতের আরও মহত্তর পরিসরে নতুন-নতুন নিরীক্ষায় তাঁর কবিতা উদ্ভাসিত হোক আরও - এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সলমন রুশদি’র একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি এ প্রসঙ্গে - “A poet's work is to name the unnameable, to point at frauds, to take sides, start arguments, shape the world, and stop it going to sleep.” একই কথা আমারও।