>

মেঘ অদিতি।




মুখোমুখি মেঘ অদিতি !



[বহুমুখী প্রতিভার একটি নাম মেঘ অদিতি, শুধুই কবিতা নয়, শুধুই কথাসাহিত্য নয়, লব্ধপ্রতিষ্ঠ এই চিত্রকরের হাতে তুলি আর কলম সমান দক্ষতায় বঙ্গসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। আজ আমরা কথা বলবো তাঁর সাহিত্যভাবনা বিষয়ে।]



সংশপ্তকঃ মেঘ অদিতি, নামের মধ্যে দুটি শব্দের এই বৈপরিত্য ছন্দের যে একটা আবহ তৈরী করে, সেটা কতটা সচেতন ভাবনাপ্রসুত?
মেঘ অদিতিঃ  একেবারেই সচেতনতার সৃষ্টি এ নয়। আমি মানুষটা যেমন বড্ড এলোমেলো ধরণের, তেমনই নামের এ বৈপরিত্ব নিয়েও কখনই ভাবা হয়নি।  যে বৈপরীত্যের সন্ধান পেয়েছ সে তার নিজের মতো করেই এসেছে

সংশপ্তকঃ মনের নিভৃততম প্রদেশে সুর্য না মেঘ কে ডাক দিয়ে যায় বেশী?
মেঘ অদিতিঃ সূর্য নয় সূর্য নয়, মনে প্রাণে আমি মেঘের বন্দনাই করি

সংশপ্তকঃ  রোজকার ছকবাঁধা নাগরিক জীবনে প্রকৃতির ডাক শোনার মতো কান থাকাটা একজন কবির জীবনে কতটা জরুরী?
মেঘ অদিতিঃ কবির ভেতরে নিয়ত ভাঙ্গা গড়া। কবিকে যে কোনো তুচ্ছ বিষয়ও আন্দোলিত করে। আর কবিতা সে তো নানা বিষয় নিয়েই হতে পারে। নানা আঙ্গিকে তার বুনন হয়। প্রকৃতি কবিতায় এক বাড়তি মাত্রা যোগ করে নিঃসন্দেহে

সংশপ্তকঃ অমাদের জীবনযাপনের পরতে পরতে জীবনযুদ্ধের কাহিনীর বিস্তারে কবিতার যে বুনন থাকে সঙ্গোপনে, মেঘ অদিতির ঘরবাড়ি তে তার প্রভাব কতটা?
মেঘ অদিতিঃ প্রকৃতি বলো, আমার যাপিত জীবন বলো বা তোমার প্রয়োগকৃত শব্দ ঘরবাড়িই যদি বল আমার সকলই কবিতাময়

সংশপ্তকঃ  তোমার জলডুমুরের ঘুম অনেক পাঠকের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল সন্দেহ নাই। এই যে গল্পের আবহে কবিতা, আর কবিতার শরীর জুড়ে গল্প: এই প্রকরণ কিভাবে তুলে আনতে পারেন একজন সমাজসচেতন নাগরিক?
মেঘ অদিতিঃ প্রথম বই হিসেবে বড্ড বেশিই সাহস দেখিয়েছিলাম বলতে পারো শুরুতে সচেতনভাবে লিখিনি। বেশ কিছু লেখা আপনি যখন শরীর পেল তখন একদিন হঠাৎই মনে এল গদ্য আর পদ্যের সীমানা ভেঙে দিয়ে কবিতার আঙ্গিকে গল্প শোনাতে বা গল্পের আঙ্গিকে কবিতা জুড়ে দিতে। পাঠকের ঘুম ভেঙেছে কি না জানি না তবে কাজটা করতে আমার তখন খুব ভালো লেগেছিল। ধরো বিকেলে পার্কে হাঁটতে গেছি, রাস্তা পারাপারের সময় হঠাৎ একটা গাড়ি যেন উড়ে এল সামনে। খুব সামান্যর জন্য সেদিন আমি প্রাণে বেঁচে যাই। সন্ধ্যা নামার মুহূর্ত, আমার সামনে দিয়ে এক বেদেনি হেঁটে চলে গেল, রাস্তায় আলোগুলো জ্বলল। সেই আলোর সাথে তার হেঁটে যাবার ভঙ্গিটিকে যখন আমি তুলে আনছিলাম আমার শব্দতে, গল্পের আদল মেখে সে হয়ে উঠেছিল কবিতা। কবিতাটার নাম কাঙ্খা
আর সমাজ সচেতন নাগরিক না বলে যদি কাব্যপ্রেমী পাঠকের কথা বলো তবে বলতে পারি, এ প্রকরণটি পাঠমাত্রই তো বোধগম্যতা পায়। এখানে কবিতার শরীরে সে ছন্দ হয়ে ওঠেনি। স্রেফ কাব্যিক মেজাজটা ধরে রেখে একটা ঘটনাকে সামনে এনে দিয়েছে।
জলডুমুরের ঘুম এর পর পরবর্তীতে এ নিয়ে আর কোনো কাজ আমি করিনি। হয়তো আবার কখনও এ নিয়ে নতুন করে ভাবব

সংশপ্তকঃ  গল্প আর কবিতার এই আলোছায়ার ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে একজন কবি যখন অনুভুতির গভীরতম তলদেশ থেকে তুলে নিয়ে আসেন জীবনের সারাৎসার, কবির নিজের কাছে তখন ঠিক কি অনুভুতি হয়; এবং পাঠকের কাছে কবির প্রত্যাশাই বা তখন কি থাকে?
মেঘ অদিতিঃ এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, একটা লেখা- কালো কুকুর, অন্ধকার ও শিকার বিষয়ক (জলডুমুরের ঘুম) এর কথা। চারপাশে তখন একটা অস্থিরতা চলছে। মনেও যে চলছে না তা তো নয় কিন্তু আমার করণীয় তো কিছু নেই। কী পারি আমি! কতটা পারি! অথচ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। এই যে দংশন, সেটা থেকে সেই অসহায় বিবেক তাড়না থেকে এই লেখাটা লিখেছিলাম।
কবির কাছে সে প্রাকমুহূর্তটুকু যত যন্ত্রণার, প্রকাশকাল তার চাইতে কম আর অনুভূতিগুলো যখন শব্দে ধরা দিল তখন সে রিলিভড, অন্তত নিজের ক্ষেত্রে আমি এমনটাই বলি। প্রকাশের পর পাঠক যদি তা নিজের মতো করে অনুভব করে তবেই সবচাইতে ভালো লাগে


সংশপ্তকঃ  আমাদের বাংলাদেশের জলবায়ুর মধ্যেই যেন কবিতার বাঁশি বাজতে থাকে নিরন্তর, আর ঘরগেরস্থলীর উঠান ভরা গল্পের ঝুড়িতে হাতছানি দিতে থাকে অনন্ত সময়। এই দুয়ের প্রেমে পড়লে কিভাবে, কবে থেকে?
মেঘ অদিতিঃ একেবারে শৈশব থেকে। আমার বাড়ির লোকেজন ভীষণ পড়ুয়া ছিল। দিদিরা স্কুল কলেজ থেকে ফিরেই পুরো দুপুর বই পড়ে কাটাত। মাকেও তাই দেখেছি। ওদের মতো পড়তে শিখিনি তখনও কিন্তু বই সামনে এনে বানান করে করে বই পড়তে শুরু করলাম। একদিন অবাক হয়ে দেখি আমি ওদের মতো নীরবে পাঠ করতে শিখে গেছি। পড়ার বইয়ের বাইরে পৃথিবী বলতে আমি কেবল বইয়ের পৃথিবীটাই বুঝতাম। বাবা প্রচুর অনুবাদ করা বই কিনে দিতেন ফলে দ্য এ্যাম্ফেবিয়ান ম্যান, ট্রেজার আইল্যান্ড, মালাকাইটের ঝাঁপি, এ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট এরকম অনেক বই আমার সেই ছোট্টবেলাতে পড়া হয়ে গেছে। আর কবিতা যদি বলো সে বেশ দেরিতেই,  ধরো স্কুলের শেষদিকে এসে কবিতার প্রেমে পড়ি আমি। মাকিদ হায়দার দিয়ে বোধহয় শুরু ছিল। আর কলেজ যেতে যেতে দাউদ হায়দার, রফিক আজাদ, সুনীল, পূর্নেন্দু পত্রীতে ডুবেছিলাম


সংশপ্তকঃ  বাংলাসাহিত্যের ওপর বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব অপরিসীম। তোমার নিজের লেখালেখিরর মধ্যে এই প্রেরণার রূপ ও তার বিকাশের সরূপ সম্বন্ধে তোমার পাঠকদের যদি অবহিত কর।
মেঘ অদিতিঃ বিশ্বসাহিত্য তো বিশাল এক ব্যাপার, প্রভাবিত হবার কথা যদি বলো তার শুরু আর শেষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।। মার্ক টোয়েন বা টলস্টয় যেমন মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলেছিল, তেমন কাফকা, মার্কেস কমলকুমার, সিলভিয়া প্লাথ, মাহমুদ দারবিশ, লোরকা সবেতেই আমি মুগ্ধ।


সংশপ্তকঃ  আমাদের সাহিত্যসাধনায় সাধারণভাবে পূর্ববর্তী লেখকদের প্রভাব বেশি পড়ে, না সমসাময়িক লেখকদের প্রভাব বেশি পড়ে বলে তোমার মনে হয়? কারণ আমরা তো বিশেষ ভাবেই সামনের দিকে এগোতে থাকি, এবং সেটিও বর্তমান সময়েরই হাত ধরে, তাই না? তোমার নিজের লেখার ক্ষেত্রে কোন প্রভাবটি বেশি বলে তোমার নিজের মনে হয়?
মেঘ অদিতিঃ প্রভাব ছাড়াও ধরো সাহিত্যের ধারা, সেটা বোঝার জন্যও পূর্ববর্তী লেখকদের লেখা পড়া জরুরী।  আর এই পাঠ তোমাকে আমাকে প্রভাবিত করবেই। আবার সমসাময়িক লেখকদের লেখা না পড়লেও তুমি ট্রেন্ডের বাইরে থেকে যাচ্ছ। সময়টাকে ধরতে পারছ না। নতুন ফর্মটা অজানা থেকে যাচ্ছে। আমার ক্ষেত্রে যদি বলো আমি পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক লেখক কারো প্রভাব থেকেই মুক্ত নই।


সংশপ্তক: বর্তমান বাংলাসাহিত্যের অভিমুখ সম্বন্ধে এখনই কি স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব বলে তোমার মনে হয়?
মেঘ অদিতিঃ স্পষ্ট করে কিছু বলা আসলে সম্ভব কিনা, জানি না।  আমি শঙ্কা আর আশা দুদিকেই রাখি। যেমনটা আমি আমার মতো করে বুঝি তাই বলি,  একেবারে খুব ছোট্ট একটা বিন্দু থেকেও যদি ধরি, মানে বলতে চাইছি এই আমার কথাই। ব্যক্তি আমি। আমি আমার ছেলেটাকে পড়াচ্ছি ইংরেজি মাধ্যমে। কারণগুলো একাধিক। এবং তুমি আমি সকলেই জানি, বুঝি যে দৌড়ে তাকে টিকে থাকতে হবে তাতে ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া উপায় নেই। এই এক থেকে একাধিক, আমরা এভাবেই তো সরে যাচ্ছি বাংলা ভাষা থেকে। আরও আছে প্রবাস জীবন যেখানে সাড়ম্বরে ঈদ-পূজা নানা পার্বণ পালন করা হলেও, প্রজন্ম বাংলা ভাষা ভুলে যাচ্ছে। কবছর আগে কলকাতা গিয়েও দেখেছিলাম ছোট ছোট শিশুদের মুখে বাংলার বদলে হিন্দি ভাষা। তবে আঁধার দেখে থমকে গেলে কি চলে বলো! আঁধারের সাথে সাথে চলে আলোর ইশারাও। তরুণ প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যখন সাহিত্যচর্চা করে সে পশ্চিম বাংলা, প্রবাস বা আমাদের দেশেই হোক, তখন মনে আশা কিন্তু জাগে। আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা এই একটি ভরসাও আমাদের আছে, যাকে কেন্দ্র করে আমরা বাংলা ভাষাভাষি সাহিত্যপ্রেম মানুষেরা একে বাঁচিয়ে রাখতে পারি যুগ যুগ ধরে, আমার আশার দিকটা এখানেই।

সংশপ্তকঃ  বাংলাসাহিত্যের নতুন কলমচীদের কাছে তোমার সুস্পষ্ট কোনো দাবী আছে? কিছু বলতে চাও তাদের বিশেষ করে?
মেঘ অদিতিঃ দাবী নয় শুধু একটা বিনম্র অনুরোধ করবার আছে, যারা লিখতে চান তাদের সকলের পাঠের অভ্যাস যেন গড়ে ওঠে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া






 
Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.