" মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক......."
গুরু গুরু ফাটিয়ে দিয়েছ গুরু! একদম ফাটাফাটি, সুপারহিট, কী দিলে গুরু!
সাব্বাশ! এই না হলে হিরো! শা......।। তোমরা
আছো বলেই না আমরা আছি! কী
ডায়ালগ, কী বডি ল্যাঙ্গুয়েজ! গুরু গুরই আছে! তালিয়া তালিয়া! হ্যাঁ, ঠিক এইভাবেই
সেদিন হাততালির ছররা উঠেছিল সাংসদ তাপস পালের বারফট্টাই ভোকাল টনিকে। নেতা কাম
অভিনেতার চড়া সংলাপে মদির তখন নদিয়ার চৌমাহা গ্রাম। হাতের কাছে ফিলমি হিরো তখন
আসলি হিরো। তাতেই মজে তৃণমূল কর্মী সম্প্রাদায়! মুহূর্মুহ হর্ষধ্বনির সঙ্গে পাল্লা
দিয়ে চড়ছে নায়কের গলা। কী মুড, কী মেজাজ, অসাধারণ শব্দচয়ন, অবিশ্বাস্য ভষাপ্রয়োগ।
কানে অঙুল চলে গেলেও সরিয়ে নিতে হয়। আরে এ তো চিৎপুরের যাত্রাপালাতেও শোনা যায় না।
হুঁ- হুঁ, এ যাত্রাশিল্পী কিংবা টলি হিরো তাপস পাল নয়, এ যে সাক্ষাৎ এমপি তাপস
পাল!
যাত্রায় নির্দেশকের ছক বাঁধা নির্দেশেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। এখানে সে সব নির্দেশ ফির্দেশের
বালাই নেই। এখানে তার কথাই শেষ কথা। কারণ তিনি কৃষ্ণনগরের দু-দুবারের নির্বাচিত
সাংসদ। হক আছে। অবশ্যই হক আছে নিজের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে তার নিজেকে মেলে ধরার।
পাবলিক যদি নাই চিনল, তবে কিসের জনপ্রতিনিধিত্ব? নিজেকে যত চেনানো যাবে, তত
মানুষের মনে নিজেকে গেঁথে দেওয়া যাবে। এভাবেই তো জনপ্রিয়তা বাড়াতে হয়! আর এ কথা
বিলক্ষণ জানেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিগত তিন দশকের পোড়খাওয়া নায়ক সদ্য ‘বঙ্গবিভূষণ’
প্রাপ্ত শ্রীমান তাপস পাল। সেই অভিজ্ঞতা আছে বলেই না তাকে নায়ক থেকে সটান জননায়ক
হিসেবে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড় করানো। সেই জনপ্রিযতাকে কাজে লাগিয়েই তো। তার একটু
আধটু নিদর্শন না রাখলে দলের এই কর্মী সমর্থকরাই তো গাল দেবে দলের সাংসদকে হাতের
কাছে পাওয়া যায় না বলে। তো সোদিন কাউকে নিরাশ করেননি তিনি। ছপ্পর ফাড়কে নিজেকে
উজার করে দিয়েছেন। সেই হটকেক ক্লিপিংস সামনে চলে আসায়, শুধু দলের কর্মীরাই নন,
রাজ্যবাসীর সঙ্গে সঙ্গে দেশবাসীও তার অসামান্য প্রতিভার পরিচয় ইতিমধ্যেই পেয়ে
গেছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ‘রিল লাইফ’ আর ;রিয়েল লাইফের’ মধ্যে
পার্থক্যটা কতখানি। তিনি যে শুধু লালটুসটুস পর্দার মেকি হিরো নন, নিজেই আস্ত একটা
‘মাল’, সে কথাও জানাতে কসুর করেননি। দলের সঙ্গে, বাস্তবের সঙ্গে কতখানি
‘একাত্ম’বোধ করলে যে এমন পাবলিক ফিগার হওয়া যায়, বুঝিয়ে ছেড়েছেন সেটাও। তিনি যে
রায়দিঘির মতো ‘অতিথি শিল্পী’ নন, দলনেত্রী কেন যে তাকে এত ভরসা করেন, দলের
অন্যান্য শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে একদম তৃণমূলস্তরের কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও সে ধারণা
ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। বার্তা দিয়েছেন বিরোধীদেরও। হুমকি বলুন কিংবা হুঙ্কার,
তাতে কিছু যায় আসে না। সিপিএমের বিরোধিতাই যে তার দলের একমাত্র সংবিধান, অনুগত
সৈনিকের মতো সেটা যে তিনি মনে প্রাণে মেনে চলেন, খুল্লামখুল্লা বুঝিয়ে দিয়েছেন
সেটাও। কোথায় লাগে জ্যোতিপ্রিয়র সাপ মারা, প্রকৃত হিরোর মতো মানুষ মারতেও তার হাত
কাঁপবে না- সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন। ‘অস্ত্র আইনে’ অভিযুক্ত হতে পারেন জানা
সত্ত্বেও তার স্পষ্ট স্বীকারক্তি সঙ্গে থাকা বন্দুক দিয়ে গুলি করতেও তিনি পিছপা হবেন
না। যেহেতু তিনি নিজে রংবাজি করেছেন, তাই বিরোধীদের কোনো রকম রংবাজিও তার পছন্দ
নয়। কর্মী সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করা, তাদের পাশে থাকার আশ্বাস, সাহস জোগানোই তো
নেতার কাজ। কোনো রকম রাখঢাক না করে সেই সামান্য কাজটাই তিনি করে দেখাতে চেয়েছেন।
কোনো রাজনৈতিক নেতার মতো ‘অভিনেতা’ সেজে না থেকে, অভিনেতা থেকে নিজেকে পুরোদস্তুর
নেতাতে রূপান্তরিত করতে পেরেছেন, পরিস্কার করেছেন সে কথাও। স্বচ্ছতার এক জলজ্যান্ত
নিদর্শন হয়ে থাকল তার এ হেন জলন্ত অঙ্গীকার। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে ‘বিরোধী’
মা বোনেদের প্রতি প্রকৃত সাংসদ হিসেবে তার কমিটমেন্ট। তার দায়বদ্ধতা!
গ্রামে থেকে বিরোধিতা করলে যে তিনি তার সুদক্ষ
কর্মী-সমর্থকদের ধর্ষণের কর্মসূচী পালন করতে পাঠিয়ে দেবেন, সে কথাও অগ্রিম ঘোষণা
করেছেন এই বয়স্ক ‘সুপুরুষ’। এতখানি আন্তরিকতার পরেও বিতর্ক দানা বেঁধেছে তার পেশ
করা এই হলফনামায়। বিরোধীদের কীভাবে জুতোবেন সেটা বোঝাতে যিনি পায়ের জুতো
সর্বসমক্ষে হাতে তুলে নিতে পারেন, তবুও তাকে বোঝার জন্যে এত বাগবিতন্ডা, আবার দলীয়
তদন্তের নির্দেশ! তিনি নিজে বলেছেন তিনি যা-তা করতে পারেন, তবু তার বক্তব্য নিয়ে
চলছে যা-তা কাণ্ড।
এমন তো নয়, তিনি এমন কথা এই প্রথম বললেন। সেই একই
দিনে তিনি আরও তিন-তিনটি সভায় এরকমই হুঙ্কার ছাড়েন। টাঙ্গি দিয়ে বিরোধীদের মাথা
দুভাগ করে দেওয়া থেকে তাদের বাড়ি ঘরদোর ভঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া ইত্যদি। এর আগে বিগত
পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারেও তো তিনি বিরোধীদের ‘কেলিয়ে’ সোজা করার দাওয়াই
দিয়েছিলেন। পাবলিকের দোষ হল, অভিনেতাদের চড়া মেকআপে দেখতে দেখতে সেটাকেই ‘চরিত্র’
ভেবে ফেলে, তার মধ্যেও যে ‘অন্য মানুষ’ থাকতে পারে কে বোঝায়! শিক্ষামন্ত্রী
পার্থবাবু তো ঠিকই বলেছেন, শুধু দলনেত্রীর সমালোচনা করে কি হবে, কৃষ্ণনগরের সাধারণ
মানুষও তো তাকে দু-দুবার নির্বাচন করেছেন। আর এখন সবাই কৃষ্ণনগরের সুমহান রুচি,
শিক্ষা, সংস্কৃতি ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের নির্বাচিত সাংসদের তুলনা টানছেন। সাংসদ কী
কেন্দ্রের? সে তো দলের এমপি! এই তো রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত বোলপুরে বীরভূমের জেলা
তৃণমুল সভাপতি অনুব্রত মন্ডল। রাবীন্দ্রিক শিক্ষাগ্রহনের কোনো ব্রত তিনি তো গ্রহণ
করেননি! তিনি তার আয়ুর্বেদিক টোটকায় নিজের জেলাকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন। বীরভূমের
জোড়া ফুল অনুব্রত-মনিরুল। আপন ক্যারিশমায় নিজেরাই নিজেদের তুলে এনেছেন পাদপ্রদীপের
আলোয। সে পথেই হেঁটেছেন ভাঙড়ের আরাবুল। সেই পথেরই পথিক হতে চেয়েছেন ‘পথভোলা’ তাপস
পাল। এভাবেই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন দু-দুবারের মনোনয়ন প্রাপ্তির ধন্যবাদ স্বরূপ
‘গুরুদক্ষিণা’।
অনেকের কাছেই আশ্চর্য ঠেকে, যেখানে তাদের দলনেত্রী
জীবনভোর হাজারো বিরোধীতা সহ্য করেও, বিধানসভায় ঐতিহাসিক পালাবদলের পরেও
রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে শান্ত রেখেছিলেন, এই লোকসভা নির্বাচনে
অভূতপূর্ব সাফল্যের পরেও কোনোরকম বিজয় মিছিল না করার নির্দেশ দিয়ে রাজনৈতিক
পরিস্থিতির ব্যাঘাত ঘটাতে চাননি, সেখানে অনুব্রত, আরাবুল, তাপস পালদের মধ্যে এত
উগ্রতা আসে কোথা থেকে? ‘অক্সিজেনের অভাব’ কিংবা ‘নার্ভের ওষুধ’ না খাওয়ার অজুহাত
তো সর্বদা মেনে নেওয়া যায় না। একজন দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা করবেন বাংলার সংস্কৃতিকে উন্নতি
প্রদানের, আর, আর একদল আবিবেচকের মতো অপসংস্কৃতির ‘মুকুল’ ধরাবেন, এটা তো হওয়া
উচিত নয়। তবে কি গোড়ায় গলদ না কি সর্ষের মধ্যেই ভুত? এ ভাবনাই আজ সংশয়ে ফেলেছে
রাজ্যের চিন্তাশীল মানুষকে।
কোনটা কৃত্রিমতা আর কোনটা প্রকৃত স্বরূপ, সেটা ঠাওর
করতেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন রাজ্যবাসী। তাই, পরিহাস নয়, একজন নবনির্বাচিত সাংসদ যখন
তার লোকসভা কেন্দ্রে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে এমন নিম্নরুচির ভাষায় নিজেকে মেলে ধরেন,
তখন ব্যক্তিগত রুচি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, যোগ্যতার কাটাছেঁড়া করার থেকেও গভীর
চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বর্তমানে এই রাজ্যের রাজনীতি কোন অন্ধগলির সামনে দাঁড়িয়ে!
এর আগেও বহু কদর্যতার সাক্ষী থেকেছে রাজ্যবাসী। হয়তো তা এতখানি কুরুচিকর নয়,
কিন্তু সঠিক পদক্ষেপের অভাবে সেই সমস্ত ঘটনা পরম্পরাই প্রতিস্থাপিত হয়েছে পরবর্তী
অবক্ষয়ের ভরকেন্দ্রে। বিগত বিধাসভা ভোটের আগে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি
আরামবাগের প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসুর মুখনিঃসৃত গরল বাণীধারা এখনও কানে বাজে
অনেকেরই। সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে। এক বিষাক্ত বাস্প ধারায় আজ দমবন্ধকর অবস্থা
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির। দুঃখের বিষয় এইসব লাগামছাড়া বেফাঁস ফোঁসফাঁসের যত না চর্চা
হয়, সেই তুলনায় দলীয় বা প্রশাসনিক স্তরে কোনো কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। অনিল
বসুকে তবু দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। করা হল না তাপস পালকে। বামপন্থী
আনিসুর রহমানই হোক, কিংবা অনুব্রত, আরাবুল, মনিরুল- হাজারো প্রতিবাদ সত্ত্বেও দলীয়
সংগঠনের কথা মাথায় রেখে এদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা
নিতে পারেন না দলীয় শীর্ষনেতৃবৃন্দ! উল্টে এদেরকেই ‘দলের সম্পদ’ থেকে ‘ভালো
সংগঠকে’র বিশেষণে ভূষিত করা হয়, ঐ শীর্ষনেতৃত্ব থেকেই। আর সেকারণেই বাড়বাড়ন্ত ঘটে
এইসব রাজনৈতিক আগাছার। শুধু তো দলের প্রয়োজনেই নয়, ব্যক্তিগত আখের গোছানোর
প্রয়োজনেও রাজ্য জুড়ে দেখা যাচ্ছে এইসব ‘অনু’গামীর দৌরাত্ম্য। বিরোধী পক্ষকে
আক্রমণই হোক কিংবা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, এতে সুনাম লঙ্ঘিত হয় দলেরই। আবার উল্টো দিকে
দলও যখন সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে উল্টে এদের হয়েই সাফাই দেয় তখন প্রশ্রয়ের
মাত্রা গুণোত্তর পদ্ধতিতে বৃদ্ধি পায়। অন্যায় কে অন্যায় হিসেবে মেনে নেওয়ার মতো
ন্যায়বোধ দেখতে পাওয়া যায় না। পুলিশকে ‘ব্যোম’ মারার কথা বলে যদি কেউ ভালো সংগঠকের
শংসাপত্র আদায় করে নেয় তখন সমাজের সর্বস্তরে বার্তাটা ভিন্ন অর্থে পৌঁছায়। দলীয়
সাংসদ তাপস পালের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দলনেত্রী কি ব্যবস্থা নিলেন কি নিলেন
না, তার থেকেও বড়ো কথা প্রকাশ্যে অস্ত্র রাখার স্বীকারক্তি সহ বিভিন্ন উস্কানিমূলক
বিবৃতির পর প্রশাসনিক স্তরে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে যেখানে বাবুল
সুপ্রিয়র বিরুদ্ধে অভিযোগে তৎপরতার উদাহরণ হাতের কাছে মজুত! আশার কথা এটাই রাজ্যের
শিক্ষামন্ত্রী সূত্রে জানা গেছে দল অন্তত তাপস পালের বিবৃতির সমর্থন জানাচ্ছে না।
আর হতাশার কথা এটাই এ হেন সাংসদের হাত থেকেই আগামী পাঁচ বছর প্রয়োজনে চারিত্রিক
শংসাপত্র বা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট গ্রহণ করবেন কৃষ্ণনগরবাসী, কারণ দল তার
সাংসদকে নিঃশর্তে ক্ষমা করেছে শেষ খবর পাওয়া পর্য্যন্ত!
শুধু ভারতেই নয়, রাজনীতিতে পচন ধরেছে বাংলাদেশেও। সত্যিকা্র গণতন্ত্র তথা আমজনতা্র সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থার থেকে নিস্তার নেই আমাদের। --
ReplyDeleteভালো লাগলো লেখাটি। -
মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর