বিজয়ের মাস - ফিরে দেখা।
১৯৪৭ ২২ মার্চ, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের ভাইসরয় হয়ে আসেন। তিনি যখন ভাইসরয় হয়ে আসেন, তখন এদেশের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল খুব জটিল। কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের মধ্যে মতানৈক্যের ফলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত অকেজো। বিভিন্ন জায়গায় ঘটছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা । এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ভারতের বিভক্তি ছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়। কিন্ত এর আগে অখন্ড বাংলা গঠনের একটা প্রয়াস চলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার বিষয় নিয়ে করাচি যান জিন্নাহর সাথে দেখা করতে, কিন্ত জিন্নাহ কী বলেছিলেন তা আজ কেউ জানে না। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলীম লীগের অনেক নেতা সেদিন অবিভক্ত বাংলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। অন্যদিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নেতা শরৎবাবু আর কিরণশঙ্কর রায় ব্যতীত সব হিন্দু নেতাই যুক্তবাংলার বিরোধিতা করে । শেষ পর্যন্ত বাংলা বিভক্ত হয়ে যায়। অখন্ড বাংলা গঠনের ক্ষেত্রে গান্ধীজীর নিষ্ক্রিয় ভুমিকা ছিল সত্যি রহস্যজনক।
মুসলিম লীগের পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ শুধু উপনিবেশ হিসেবে শোষণ করার উদ্দেশে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে চেয়েছিলেন। এদের অসৎ উদ্দেশ্যের মদদ জুগিয়েছে খাজা নাজিমুদ্দীন , নুরুল আমীন, মৌলানা আকরাম খাঁ প্রমুখ। তারা জানতেন, সোহরোওয়ার্দীকে অতিক্রম করে অবিভক্ত বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা শুধু ক্ষমতার লোভেই খন্ডিত পূর্ব বাংলাকে স্বাগত জানান। অথচ, একদিন, মৌলানা আকরাম খাঁ হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, কেবলমাত্র বাংলার মুসলমানদের লাশের উপর দিয়েই বাংলা ভাগ হতে পারে।
বাঙালির সব চেয়ে দুর্দিন নেমে এলো বাংলার সীমানা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে। দু টুকরো বাংলার সীমানা নির্ধারণ হয় ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সনে। দিল্লিতে বসে মানচিত্র দেখে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল বলে সেদিন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়ার মুসলমান ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করে, কিন্ত পরবর্তীতে জানতে পারলো, সাধের পাকিস্তান নয়, তা্রা এখন ভারতের অধিবাসী। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার অধিবাসী দেখলো, সীমানা নির্ধারণের কোপে কোন গ্রাম দ্বিখন্ডিত , কারো আঙিনার অর্ধেক পাকিস্তানে, অর্ধেক ভারতে, কারো ঘরের দরজা পড়েছে ভারতে, তো জানালা পড়েছে পাকিস্তানে। বাংলা আর বাঙালির সেই দুর্দশার দিনে তাদের পাশে কেউ এসে দাঁড়ালো না। বরং দেশত্যাগ, দাঙ্গা আর লুটপাটের মুখে বাঙালিকে রেখে মুসলিম লীগের হাই কমান্ড বাঙালি নেতারা চলে গেলেন পাকিস্তানে।
পাকিস্তান ছিল এক অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। বিশাল ভারত বর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম দুই প্রান্তে হাজার মাইলের ব্যবধানে দুই ভূ-খন্ড নিয়ে এর অস্তিত্ব ও বিস্তৃতি। দেশটির মোট আয়তনের শতকরা ৮৪.৩ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে, আর ১৫.৭ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ জনসংখ্যার শতকরা ৪৩.৭ ভাগ লোকের বাস পশ্চিম পাকিস্তানে, এবং ৫৬.৩ লোক ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। বাংলার উচ্চবিত্তরা ছিলেন জমিদার গোষ্ঠী। তারা দেশ বিভাগের সময় ভারত চলে যায়। এরপর ১৯৫০ সালে বাংলায় জমিদারী প্রথা বাতিল করা হলে এখানকার মুসলমান জমিদারদের পতন ঘটে, এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ থেকেই পূর্ববাংলার রাজনীতি ছিল মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নিয়ন্ত্রনে, আর এদের সমর্থক ছিল গ্রামীন জন সাধারণ। অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমাজ ব্যবস্থায় ছিল সামন্তপ্রথা। সেখানে নেতৃত্ব প্রায় পুরোটাই ছিল সামন্তবাদী জমিদারদের নিয়ন্ত্রনে। তাই কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতায় শক্তিশালী এলিটশ্রেণী আমলাবর্গ এবং সেনাবাহিনী স্থান পায়।
বৃটিশ আমলে পূর্ব বাংলায় কোন শিল্প কারখানা ছিল না । পাটের জন্য এ দেশ বিখ্যাত হলেও পাট কল গড়ে উঠেছে কলকাতার আশেপাশে। পাক সেনা বাহিনীর প্রায় পুরোটাই গঠিত ছিল পাঞ্জাবি, পাঠান ও বেলুচদের নিয়ে। পাক সিভিল সার্ভিসেও বাঙালি ছিল না বললেই চলে। এমন কি পূর্ব বাংলার সরকারের উচ্চপদস্ত আমলারও ছিলেন অবাঙালি মুসলমান। উকিল ডাক্তার, শিক্ষক পেশাতে হিন্দুর সংখ্যা ছিল বেশি। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে তারা ভারতে চলে গেলে এই প্রদেশে দক্ষ প্রশাসন ও পেশাজীবী শ্রেণীর অভাব দেখা দেয়। এই শূন্যস্থান পুরণ করে ভারত থেকে আগত বাঙালি-অবাঙালি রিফুজি এবং পাঞ্জাবি আমলা বৃন্দ। এ জন্যও পাকিস্তানি শাসকবৃন্দের কেন্দ্রে ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের অনীহা ছিল। বরং তারা পূর্ববাংলাকে তাদের কাঁচামাল যোগানদার ও তৈরি পণ্যসামগ্রীর বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ঐ উদ্দেশেই রচিত হয় দেশের অর্থনৈতিক নীতি।
এদেশের অর্থে পাকিস্তানে বৃহদায়তন বাঁধ ও পানি প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হয়, সেখানে গড়ে উঠে শিল্প কারখানা, এবং সব কেন্দ্রীয় অফিস। এতে ঐ দেশেরই লোক জনের শুধু কর্মসংস্থান হয়, বারো হাজার পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে যেয়ে বাঙালির পক্ষে জীবিকা সংস্থান করা সম্ভব ছিল না । নেতারা সব পাকিস্তানী। ভারত থেকে আগত নেতারাও পাকিস্তানে গমন করেন। এমন কী সোহরোওয়ার্দীও করাচীবাসী হন। ভারত থেকে আগত নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তান গণপরিষদের আসন দেয়া হয় পূর্ববাংলার কোটা থেকে এবং এ ভাবে গণপরিষদেও পূর্ব বাংলাকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই প্রথম বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই চেতনাই পরবর্তী সময়ে অগ্নিস্ফুলিঙের মত ছড়িয়ে যায় । ১৯৪৭ সনের ১৫ জুলাই মাস থেকেই ভাষা বিতর্কের সূত্রপাত। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দীন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করলে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানগর্ভ যুক্তি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পাল্টা প্রস্তাব দেন। পরবর্তী সময়ে খাজা নাজিমুদ্দীন,মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে। অবশেষে জীবন দানের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সনে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রথম দিকে এটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। পরে এর সাথে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রশ্নও যুক্ত হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় বাংলায় রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তিভূমি ।
তাই দেখা যায়, এ দেশের অতীতের রাজনীতি, আন্দোলন, সংগ্রাম শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের রাজনীতি, সংগ্রাম বা আন্দোলন নয়, এর সাথে মিশে আছে অস্তিত্ব রক্ষার এক জীবন-মরণ পণে্র ইতিহাস।
ভারত স্বাধীনতা আইনে (১৯৪৭) উল্লেখ ছিল, পাকিস্তানে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে প্রয়োজনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনকর্ম পরিচালিত হবে। এ আইনে প্রদেশের শাসন বিভাগ ও আইনসভা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত ছিল। রাজার প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর প্রদেশের প্রধান শাসনকর্তা ছিলেন। গভর্নরের কার্য পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রীসভা ছিল, যে সকল ক্ষেত্রে গভর্নরকে সুবিবেচনায় কাজ করতে হত বা যে সকল বিষয়ে তার বিশেষ দায়িত্ব থাকতো সে সকল ক্ষেত্র ছাড়া গভর্নর মন্ত্রীগণের পরামর্শে কাজ করতেন। তবে দেশে জরুরী আইন ঘোষিত হলে কেন্দ্র প্রাদেশিক বিষয়ে আইন প্রনয়ন করতে পারতো।
পাকিস্তান শুরু থেকেই কিছু আইন ও অ্যাক্ট এর মাধ্যমে প্রদেশের উপর কেন্দ্রের খবরদারি জোরদার করে। আইন করা হয়, যদি গভর্নর জেনারেল মনে করে প্রাদেশিক সরকার দায়িত্ব পালনে অপারগ এবং দেশের কোন অংশ হুমকির সন্মুখীন তাহলে সে ক্ষেত্রে গভর্নর উক্ত প্রদেশের ক্ষমতা নিজ হাতে নিতে পারবেন, এবং কোন্ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনিয়ম বা দুর্নীতি প্রমানিত হলে তাকে সে পদের জন্য এবং সরকারী যে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তাকে অযোগ্যমনে করা হবে। এর ফলে প্রাদেশিক মন্ত্রীগণ কেন্দ্রের তাবেদারে পরিণত হয়।
কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সিভিল সার্ভিসের সদস্যগণ প্রদেশের ক্ষমতা নিয়ন্রন করতো। তারা ছিল কেন্দ্রের অধীন।তাই তারা প্রাদেশিক সরকারকে তোয়াক্কা করতো না । ফলে আমলাগোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠে। এই আমলাগোষ্ঠীতে বাংলাদেশের কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না ।১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা সচিবালয়ে কোন বাঙালি সচিব ছিল না ।অবাঙালি সচিবগণ কখনোই বাংলার স্বার্থকে বিবেচনায় আনেন নাই। সামরিক বাহিনীতেও বাঙালির প্রতিনিধিত্ব ছিল না বললেই চলে। পরবর্তী সময়ে মেজরের উপরে বাঙালিদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সনে প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী মুসলীম লীগের সাথে বাংলার অন্যান্য পার্টি একত্রিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এদের ২১ দফা দাবীর মধ্যে অন্যতম ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে, প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন এবং শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদাকরণ। এ সময়ে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষক-শ্রমিক পার্টি গঠন করে যুক্তফ্রন্টে যোগ দেন। এ নির্বাচনে ভাসানী সোহরোওয়ার্দী প্রার্থী হন নি। ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগাঠনিক দায়িত্ব পালনকেই বেশি প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন। সোহরোওয়ার্দী জাতীয়পর্যায়ে রাজনীতি করবেন বলে প্রার্থী হননি।এতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে শেরে বাংলা পার্লামেন্টারি বোর্ডের নেতা নির্বাচিত হবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে জয়লাভ করলে শেরে বাংলা সরকার গঠনের আমন্ত্রন পান।
কেন্দ্রের বিরুদ্ধেই যেহেতু এই নির্বাচন, তাই যুক্তফ্রন্টের শরীক দলের যেমন সতর্কতার প্রয়োজন ছিল, তেমনি প্রয়োজন ছিল শেরে বাংলার দুরদর্শিতা। কিন্ত সেদিন তারা কেউই তার পরিচয় দিতে পারেন নি। ক্ষমতা বন্টনে শুরুতেই শরীক দলের সাথে মনমালিন্য হয়। শেরে বাংলা মন্ত্রী পরিষদ থেকে আওয়ামী লীগকে বাদ দেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত সদস্যদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান আর আতাউর রহমান খানের নাম ছিল। শেরে বাংলা এই দুজনকে মন্রী সভায় অন্তর্ভুক্ত করতে রাজী ছিলেন না । এ বিষয়ে ফয়সালা না হতেই শেরে বাংলা কলকাতা সফরে যেয়ে কিছু আবেগাপ্লুত কথা বললে কেন্দ্রীয় সরকার তার বিরুদ্ধে ভারতের কাছে পূর্ববাংলার বিক্রির অভিযোগ তোলেন।
এমতবস্থায় শেরে বাংলা নিজের পতন ঠেকাতে আওয়ামী লীগের সাথে আপোস করতে বাধ্য হন, এবং তার দুই অপছন্দের নেতা শেখ মুজিব ও আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রীসভার অন্তর্ভুক্ত করেন। কেন্দ্রীয় সরকার ইতোমধ্যেই ষড়যন্ত্র কাজে অনেক দূর এগিয়ে যায়। তারা পুর্ব বাংলার শিল্প কারখানাগুলোতে বাঙালি অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে নতুন মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অযোগ্যতার অভিযোগ তুলে। এ সময় কালাহান নামে এক সাংবাদিক শেরে বাংলার একটি বক্তব্যকে বিকৃত করে রিপোর্ট করলে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী তাকে দেশোদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করে। এ ভাবে কুচক্রীরা শেরে বাংলার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ এনে যুক্তফ্রট মন্ত্রীসভা বাতিল করে প্রদেশের উপর গভর্নেরর শাসন জারি করে।
গভর্নর শাসনের শুরুতেই যুক্তফ্রন্টের ৬৫৯ কর্মীসহ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী শেখ মুজিব এবং ১৩জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। শেরে বাংলা গৃহবন্দী হন। কম্যুনিস্ট পার্টিকে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এই দলের অনেক নেতা কর্মীকে বন্দী করা হয়। এ সময় ভাসানী এবং সোহরোওয়ার্দী বিদেশে অবস্থান করায় পূর্ববাংলায় কোন প্রতিবাদ বা মিছিল মিটিং হয়নি। তবে শেরে বাংলাকে বরখাস্তের দু মাসের মাথায় শাসকগোষ্ঠী তাকেই আবার কেন্দ্রীয় সরকা্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার দায়িত্ব দেয়।
আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর সাথে দেখা করে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগদানের পক্ষে যুক্তি পেশ করেন।এতে মোহম্মদ আলী বলেন, আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে এ দাবী করতেই পারেন। কিন্ত আমি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কী করে একজন কম্যুনিস্টকে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সুপারিশ করি ? আতাউর রহমান খানকে কম্যুনিস্ট বলার কারণ তিনি ১৯৫২ সালে শান্তি সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে পিকিং গিয়েছিলেন। উক্ত সম্মেলনে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য নেতারা যোগদান করলেও তারা কিন্ত কম্যুনিস্ট খেতাব পাননি। অথচ তাকে কম্যুনিস্ট বলা হল। উদ্দেশ্য একটাই, পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিয়ে শেরে বাংলার দলকে ক্ষমতা দেয়া এবং যুক্তফ্রন্টকে খন্ডিত করা । অচিরেই শাসকগোষ্ঠীর এ প্রচেষ্টা সফল হয়। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দুই টুকরো হলো। এর অংশে থাকেন শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক পার্টিসহ অন্যান্য দল অন্য অংশে সোহরোওয়ার্দী্র আওয়ামী লীগসহ বাকি দল।
যেহেতু যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় শেরে বাংলা পার্লামেন্টারি দলের নেতা হিসেবে যখন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে পূর্ববাংলার সরকার গঠনের জন্য চেষ্টা করেন, সেহেতু সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যবৃন্দ ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি নেতা হিসেবে শেরে বাংলার প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে। এতে হিতে বিপরীত হয়, ৩২জন আওয়ালীগ সদস্য পার্টি পরিবর্তন করে শেরে বাংলার দলে যোগদান করে। এ সময় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দিলে আরো ২০জন সদস্য আব্দুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলবদ্ধ হয়ে শেরে বাংলার দলকে সাপোর্ট করে। সাথে থাকে নেজামে ইসলামী। আর আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করে গনতন্ত্রী দল ও কম্যুনিস্ট পার্টি। এ ভাবে যুক্তফ্রন্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ধারাটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে গ্রহণ করে আর শেরে বাংলার জোট দল রক্ষণশীল ধারার রাজনীতি গ্রহণ করে মুসলীম লীগের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার শুধু যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গেই ক্ষান্ত হয়না ,তারা সোহরোওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রী করে পুর্ববাংলায় আওয়ামী লীগকে বামপন্থীদের সমালোচনার সম্মুখীন করে । ১৯৫৫ সালের জুন মাসে কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবুল হোসেন সরকারকে পুর্ববাংলায় মন্ত্রীসভা গঠনের অনুমোদন দেয়। আবুল হোসেন সরকারের নবনিযুক্ত কোয়ালিশন মন্ত্রী্সভার প্রতি প্রাদেশিক আইনপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা ও সমর্থন আছে কিনা তা প্রমান করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিষদের অধিবেশন দাবী করা হলেও সরকার পরিষদের অধিবেশন আহবান করতে অস্বীকার করেন। পরবর্তী আট মাসেও কোন সভা আহবান করা হয়নি। উপরন্ত আবুল হোসেনের মন্ত্রীসভার অস্থিত্ব রক্ষার জন্য ১৯৫৬ সালের ৫ মার্চ শেরে বাংলা পূর্ববাংলার গভর্নর পদ লাভে সক্ষম হন। শেরে বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহবান করেন। কিন্ত সংক্ষিপ্ত নোটিশদানের কারণে পরিষদের স্পিকার বাজেট বিবেচনা করতে অস্বীকার করেন। বাজেট পাস করাতে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীসভার পতন হবে --- এই আশংকায় গভর্নর শেরে বাংলা আইনসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখেন। পূর্ববাংলার মন্ত্রীসভা সংবিধান অনুযায়ী চালানো যাচ্ছে না -- এই কারণ দেখিয়ে জরুরী ক্ষমতাবলে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। সাতদিন পর কেন্দ্রের শাসন প্রত্যাহার করে আবুল হোসেনের মন্ত্রীসভাই পূনর্বহাল করে ।
শেরে বাংলার গভর্নর পদ লাভ এবং তার দলের মন্ত্রীসভা গঠনের অনুমতির পিছনে মুসলিম লীগের দেয়া দুটি প্রতিশ্রুতি ছিল। এক, পাকিস্তান গণপরিষদে পাস করার জন্য যে খসড়া সংবিধান পেশ করা হবে তা তার দল সমর্থন করবে, দুই, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবী তারা সমর্থন করবে না । শেরে বাংলার দল উপরিউক্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল।
যৌথ নির্বাচনীব্যবস্থায় বিরোধিতা করলে পুর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যালঘু সদস্যবৃন্দ কৃষক-শ্রমিক পার্টির সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং তারা আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করে। আবুল হোসেন সরকারের মন্ত্রীসভা বারবার অধিবেশন স্থগিত করে সংসদীয় গনতন্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে, ইতোমধ্যে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোয়ালিশন সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সেই প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান ।
পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠনের পর কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এই নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী। ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা, রমনা পার্ক, রাস্তা নির্মান, ওয়াপদা , এফ ডি সি , ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটি ঘোষণা, বাংলা একাডেমি কর্তৃক বই প্রকাশনা, শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণসহ পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক অবদান রাখে। তারপরেও ভাসানীর নেতৃত্বে অনেক বামপন্থী নেতা কর্মী সোহরোওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি ও পূর্ববাংলার লাইসেন্স পারমিট বিতরণ নীতির কঠোর সমালোচনা শুরু করে। মওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে বলেন, আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র নীতি পার্টির মেনিফেস্টো বিরোধী । এ ভাবে আওয়ামী লীগের ভিতরে দুটি ভিন্ন মতালম্বী গ্রুপের সৃষ্টি হয়। ভাসানী পার্টির সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৫৭ সালের ২৪ জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। ১৯৫৮ সালের ১৮ জুন বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করলে আবুল হোসেন সরকার একটি কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। এর কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ পররাষ্ট্র নীতি পরিবর্তন করে ন্যাপের সমর্থন আদায় করে অনাস্থা ভোটে আবুল হোসেন সরকারের মন্ত্রীসভাকে পরাজিত করে। পূর্ববাংলায় আবার কেন্দ্রের শাসন জারি হয়। দুইমাস পর কেন্দ্রের শাসন প্রত্যাহার করলে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হয়।
এ ভাবে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাস থেকে ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত সময়ে পূর্ববঙ্গ প্রদেশে দুই ভাগে বিভক্ত যুক্তফ্রন্টের দ্বারা সাতটি মন্ত্রীসভা ও তিনবার কেন্দ্রীয় গভর্নরের শাসন চালু হয়। এই সময় আওয়ামী লীগের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও তার সমর্থক দলের সদস্যদের দ্বারা আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হলে পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
মুসলিম লীগ ও কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্ত এবং সর্বোপরি যুক্তফ্রন্টের শরিক দল গুলোর আভ্যন্তরীন কোন্দল, সংখ্যালঘু সংসদ সদস্যদের ঘন ঘন সমর্থন বদলের কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার ঘন ঘন বদল হতে থাকে। মাত্র চার বছরে সাতটি মন্ত্রীসভার পতন ঘটে, তিনবার কেন্দ্রীয় শাসন জারি হয়। ফলে বহু প্রত্যাশিত ২১ দফার দাবীগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নি। দেশের উন্নয়নের যে সুযোগ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ পেয়েছিলেন তা তারা নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের কারণে কাজে লাগাতে পারেন নি। বরং তাদের দুর্বলতা গুলোই তারা পাকিস্তানী শাসকদের সামনে উন্মোচিত করেছেন । রাজনৈতিকবৃন্দ ভুলেই গিয়েছিলেন কেনো তারা যুক্তফ্রন্ট করেছিলেন ।
আইয়ুব শাহী ১৯৫৯ সালে মৌলিক গনতন্ত্র ব্যবস্থা (Basic Democracy) নামে দেশে এক অদ্ভুত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন জারি করেন। এটা ছিল চার স্তরীয় । এই স্তরের সর্বনিম্নে ছিল ইউনিয়ন কাউন্সিল তার উপরে যথাক্রমে থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল,বিভাগীয় কাউন্সিল। এর নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ছিল উভয় প্রদেশ মিলিয়ে ৮০ হাজার। এরা প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটারে পরিণত হন।
১৯৬২ সালের সংবিধান ১ মার্চ ঘোষণা করা হয় এবং কার্যকর করা হয় ৮ জুন থেকে। আইয়ুব শাহী ১৯৬০ সালে হা না ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন । ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী তার মেয়াদ কাল ১৯৬৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করেন।
প্রাদেশিক ও জাতীয় নির্বাচনে দেশের অনেক অভিজ্ঞ রাজনীতিক অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি Elective Bodies Disqualification Order 1959 ( ইবিডো) এবং Public Office Disqualification Order(পডো) এর কারণে। কারণ তারা ইবিডো ও পডো এর আওতায় অযোগ্য বিবেচিত হন। যারা ইবিডো ,পডো এর আওতায় পড়েন নি তাদের কাউকে কাউকে দেশের নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬১ সালের শেষের দিকে মুজিব ও মানিক মিয়া এবং খোকা রায়ের মধ্যে এক গোপন বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে আইয়ুব কর্তৃক শাসনতন্ত্র ঘোষণার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করেব এবং তা ক্রমে ক্রমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। আরো সিদ্ধান্ত হয় ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়ন একসাথে কাজ করবে। এই বৈঠকের পরপরই ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারিতে সোহরোওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়, এর প্রতিবাদে ছাত্ররা ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ ছাত্রধর্মঘট আহবান করে। ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিব, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ অনেক রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাকে সরকার গ্রেফতার করে। ৬২ তে ছাত্ররা তিনটি ইস্যুতে আন্দোলন করে। এক, সোহরোওয়ার্দী গ্রেফতারের প্রতিবাদে, দুই, সংবিধান বিরোধী আন্দোলন। তিন, শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন।
১৯৬২ সালের ৮ জুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে। ঐদিন সামরিক আইন তুলে নেয়া হয়। এরফলে রাজনীতিকবৃন্দ প্রকাশ্যে বিভিন্ন দাবীনামা উত্থাপন করেন।পার্লামেন্টের বাইরে ৯ জন রাজনৈতিক নেতা সংবিধানকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এরা হলেন, নুরুল আমীন, আতাউর রহমান খান, আবুল হোসেন সরকার, শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, হামিদুল হক চৌধুরী,ইউসুফ আলী চৌধুরী, মাহমুদ আলী, পীর মোহসীন উদ্দীন।
১৯৬২ সালে সোহরোওয়ার্দী মুক্তি পান। তিনি এক সমাবেশে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমি আওয়ামী লীগের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরোধী।তিনি দেশের গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সকল দলেরসমন্বয়ে ফ্রন্ট গঠনের আহবান জানান। এতে সবাই সাড়া দেয়। তার নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ( এন ডি এফ )গঠিত হয়। এখানে ঘোষণা দেয়া হয়, তারা কেউ আইয়ুব সরকারের অধীনে কোন পদ গ্রহণ করবে না ।
১৯৬৩ সালে সোহরোওয়ার্দী ইন্তেকাল করলে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুন;প্রতিষ্ঠিত হয়। নবাবজাদা খাজা নসরুল্লাহ খান এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন।
১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলীম লীগ, জামায়েতে ইসলামী মিলে সম্মিলিত বিরোধীদল (কপ) গঠন করে । তারা জাতীয় পরিষদের নির্বাচিনে ফাতেমা জিন্নাহ কে প্রার্থী নির্বাচন করে ৯ দফা নির্বাচনী ম্যানিফোষ্টো ঘোষণা করে। কপ এর পক্ষ থেকে লেঃ জেনারেল মোহম্মদ আজম খানকে প্রেসিডন্ট পদপ্রার্থী করার ইচ্ছে থাকলেও ভাসানীর বিরোধিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি। অথচ তিনি আইয়ুবের বিরুদ্ধে ভাল প্রার্থী হতে পারতেন, তিনি পুর্ব বঙ্গে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। পাকিস্তানের মত ধর্মভিত্তিক দেশে ফাতেমা জিন্নাহ পরাজিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর কপ নিষ্ক্রীয় হয়ে যায় ।
১৯৬৫ সনে পাক ভারত যুদ্ধে বুঝা গেল পূর্ব পাকিস্তানের অরক্ষিত অবস্থা । ফলে স্বায়ত্ত শাসনের দাবী নিয়ে আবার এগিয়ে আসে আওয়ামী লীগ। সঙ্গে ৬ দফা দাবী । ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলসমুহের নেতৃবৃন্দের এক কনভেনশনে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবী উত্থাপন করেন। এতে উপস্থিত ৭৩৫ জন প্রতিনিধি তা তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে দিলে শেখ মুজিব তার প্রতিনিধি দল নিয়ে সম্মেলনস্থান ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি আগে থেকেই ৬ দফা দাবী সম্পর্কে ওউয়াকিবহাল নন বলে এ দলের প্রবীন নেতা এর বিরোধিতা করেন। কিন্ত দেশ ব্যাপী জনগণ এ দাবীর স্বপক্ষে আন্দোলনের ঢেউ তুলে। ৬ দফা দাবীর ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ মুজিব বলেন,পাক ভারত যুদ্ধের পর এটা পরিস্কার হয়েছে যে, পাকিস্তানের সংহতি এবং অখন্ডতা রক্ষা করতে হলে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এর উভয় অংশকে স্বায়ত্ত শাসন দিতে হবে। একটি রাষ্ট্রের কেন্দ্রকে শক্তিশালী করলেই যে রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হবে --এমনটি ঠিক নয়। অন্যান্য দল ও দলের নেতা শেখ মুজিব বিরোধী ছিলেন কিন্ত তার স্বায়ত্ত শাসনের দাবীকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। বরং সবাই দলমত নির্বিশেষে সমর্থন করেছেন। জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের নেতা নুরুল আমীন বলেন, দেশের অখন্ডতা ও সংহতি নির্ভর করে ১৯৫৬সালের সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার একমাত্র উপায় হল দেশে সংসদীয় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার শাহ আজিজুর রহমান বলেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন প্রদান ও দুই প্রদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার মাধ্যমেই পাকিস্তানকে শক্তিশালী করা সম্ভব। এ ভাবে দলমত নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবী সর্বজনীন দাবীতে পরিণত হয়। এই দাবীকে সাংগাঠনিকরূপ দেয়া ও দাবী বাস্তুবায়নের জন্য একটি গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
(পরবর্তী সংখ্যায়)