রম্যরচনা: তালা
"ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে" গানটি আজকাল একটু বিতর্কিত হয়ে পড়েছে - গানটির কলিতে ‘চাবির’ বদলে ‘তালা’ শব্দটিই হয়তো যুক্তিসংগত হোত। আর তালার সঙ্গে শালা দারুন ভাবে মেলে, হয়তো রবীন্দ্রনাথও কথাটা একেবারে ভাবেননি এমন নয়। কিন্তু তখনতো বাঙালি এতটা বেআক্কেলে হয়নি তাই মার্জিত আর অমার্জিতর ব্যবধানটা খুব বেশিই ছিল, সুতরাং শালা কথাটি ব্যবহার করাতে ওঁনার দ্বিধাবোধ থাকাই স্বাভাবিক। এখন আর সে ঝামেলা নেই সবাইকেই শালা বলা যায় শুধু নিজের শালাকে ছাড়া, নইলে বউ হয়তো রেগে গিয়ে বলবে তুমি জানো না - অন্ধকে অন্ধ বলতে নেই। আবার শুধু শালা বললেও পছন্দ নয় অসাম-শালা বলা চাই। আজকের দিনে ঐ গানটির কথা হয়তো এইরকম হোত - "ভেঙ্গে মোর ঘরের তালা নিয়ে যাবি কোন শালা - বল আমারে"। এই বলার মধ্যে একটা ধমকের সুর থাকবে আর সেটা ফাস্ট ফুডেরই মত তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমাকে তালা ভেঙ্গে কে নিয়ে যাবি চটপট বল, লাইনে আরো অনেকে দাঁড়িয়ে আছে - যা করবি তাড়াতাড়ি কর, তোর মুরদে না কুলোলে বলে দে - অন্য কেউ নিয়ে যাবে, অযথা সময় নষ্ট করবি না।
তখনকার দিনে লেখা বা বলার মধ্যে একটা মার্জিতভাব এবং অনুনয় বিনয়ের সুরই বেশি থাকত যা ঐ গানটির মধ্যে রয়েছে। এখানকার দিন অনুনয় বিনয়ের কোনো বালাই নেই, সব কিছুর মধ্যেই একটা দাবি বা অধিকার বোধ কাজ করে - প্রেম, ভালবাসা, দয়া-মায়া সব কিছুই এখন চাওয়া হয় দাবি হিসেবে। প্রেম করবি না মানে! করতেই হবে, ভাবখানা এমন - দেখি তুই কেমন করে প্রেম না করে পার পাস। এনিয়ে আবার কিছু বলতে গেলে চেঁচিয়ে গান ধরবে "প্রেম করেছি বেশ করেছি করবইতো" দেখি তুই কি করতে পারিস।
স্বামী-স্ত্রী ছেলে-মেয়ে সবারই একই মনোভাব - দেবে না মানে দিতেই হবে, সে আদর, ভালবাসা, স্নেহ-মমতা যাই হোক না কেনো, শাড়ি-গয়না টাকা-পায়সা গাড়ি-বাড়ির কথাতো ছেড়েই দিলাম। এমনকি এখনকার বুড়ো-বুড়ি যারা ওপরে যাবার টিকিট কেটে ওয়েটিং লিস্টে পড়ে রয়েছে তাদেরও দাবি, ছেলে-বউ করবে না মানে - করতেই হবে, মা-বাবাকে দেখবে না মানে - মগের মুলুক নাকি - এত কষ্ট করে মানুষ করেছি, কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে গেলেও করতে হবে, বুঝুন ঠ্যালা। তাই দেখে ছেলে-বউও মনে মনে ভাবে - কি যে মানুষ করেছো তোমরাই জানো। তোমাদের নিজেদের মা-বাবা, আত্মিয়-পরিজনদের প্রতি ব্যবহার দেখেইতো বড় হয়েছি, শুধু রোজগার করা আর নিজের আখের গোছানো ছাড়া কিছুইতো শেখাওনি। আমাদের মনের ঘরে তালাতো অনেক আগেই তোমরা মেরে রেখে দিয়েছো, মানুষ আর হোতে দিলে কোথায়, তাইতো আজ তোমাদেরকেও পরিবারের বোঝা বলেই মনে হয়।
সত্যি এই তালা বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেকাল থেকে একাল অবধি। বাঙালি চিরদিনই একটু ভীতু প্রকৃতির, চিকেনহার্টেড্ যাকে বলে, সব কিছুতেই ভয় আর সংশয়। সব কিছুই আগলে রাখতে চায়, ধনসম্পদ থেকে শুরু করে পুত্র-কন্যা এমনকি আম-জনতা পর্যন্ত। আর সেটা করতে গেলে তালা খুব জরুরী, সব কিছু তালা মেরেই রাখতে হয় নইলে চুরি হওয়ার ভয় থাকে। সিন্দুকের ভিতরে মাল কি আছে সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু তাতে তালা দেওয়া খুবই জরুরী, তাইতো আমদের অনেক খাজানাই তালা-বন্দী হয়ে পড়ে থাকে, এমনকি জ্ঞানের আধার বইও। আমরা বইমেলাতে যাই, বই দেখি, বই কিনি কিন্তু পড়ি না - বসার ঘরে কাচের শোকেসে তালা-বন্দী করে রেখে দি লোকেদেরকে দেখানোর জন্য, কারণ আমাদের বিশ্বাস "বই আর বউ একবার ঘর থেকে বেরোলে আর ফেরত আসে না" তাই তালা মেরে রাখাই শ্রেয় ।
তাই বলতে বাধা নেই তালা বাঙালির বড় প্রিয়, তালা লাগানোতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। চলছে না - চলবে না, মানছি না, মানব না বলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কানে তালা ধরিয়ে কত কল-কারখানা ষে আমরা তালা মেরে বন্ধ করে দিয়েছি তার হিসেব নেই। এতদিনে টনক নড়েছে “বিড়াল বলে মাছ খাবো না, আঁশ ছোঁবনা কাশী যাবো”। এখন বলে কিনা ‘না’-গুলো সব মুছে দেবো, একি চকের লেখা যে একটানে মুছে যাবে, এত বছরের অভ্যেস যা রন্ধ্রে রন্ধ্রে খোদাই হয়ে গেছে তা মুছে ফেলা অত সহজ নয়, কারণ ঝোলা তালার নিশ্চিন্ত সুরক্ষা উপভোগ করতে বাঙালি এখনো ভালোবাসে। তাইতো আমদের দু-খানা ঘরের ১৪ খান তালা, আর ঘর থেকে বেরোবার আগে তালা ধরে ঝুলে পড়া আমাদের এক নিত্য-নৈমিতিক ব্যাপার। এখনতো অনেকে বাড়িতে থাকাকালীনও নিজেদেরকে তালাবন্দী করে রাখেন, মানুষের চেয়ে তলাতেই বেশি আস্থা। সেদিন একজনের বাড়িতে নিজেকে পুরোপুরি প্রবেশ করানোর আগেই দেখি কোল্পাসেবল গেটে তালা পড়ে গেল, আমার পাঞ্জাবিটা তখনও বাইরে।
এক সময় বাড়িতে পাতকুয়োর চল ছিল এখন আর তেমন নেই, তবে দড়ি বালতি এখনো কাজে লাগে, জল তুলতে নয়, শাক-সব্জির বাজার করতে। এর কারণও সেই তালা, ১৪ খানা তালা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরোনোর ঝামেলা অনেক, তাই বহুতল বাড়ির ব্যলকনি থেকে দড়ি বালতি নামিয়ে বাজার করা অনেক সহজ। স্কুল ফেরত ছেলে-মেয়েদেরকেও এইভাবে তুলে নিতে পারলে হয়তো আরো ভালো হোত, মায়েদের অনেকটা সময় বেঁচে যেতো।
শুধু ধনসম্পত্তি নয়, আরো অনেক কিছুই আমরা তালা মেরে রাখতে চাই, লজ্জাবোধ, বিবেকবোধ, মূল্যবোধ কোন কিছুকেই বাদ দিই না। মুখে আমরা যতই বড় বড় কথা বলিনা কেনো আজকের দিনেও নারীদের মুখ আমরা তালা মেরেই রাখতে চাই। পরিপূর্ণ নারীকে তালা মেরে রাখার কিছু অসুবিধা থাকে তাই তাদেরকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিতে চাই ভ্রূণ হত্যার মাধ্যমে।
তাই আজও তাদেরকে বলতে হয় - "ভেঙ্গে মোর ঘরের তালা নিয়ে যাবি কে আমারে"……