>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • কমলেন্দু চক্রবর্তী.

    SongSoptok | 7/10/2014 |


     ছোটো আমি। 



    (পর্ব-২)


    এরপর বাবার বদলি হল বামনহাট station। অজ পাড়াগাঁয়ের কোনও লোককে যদি বড় শহরে আনা যায় বা খুব ছোট শহরের লোককে কলকাতায়, বক্সা রোড থেকে বামনহাটে এসে আমার ঠিক সেই দশা। এমনিতে হিসাব মতো বামন হাটকে গ্রামই বলতে হয়। তবে রেল station আছে, বাজার হাট আছে, দোকানপাট আছে, স্কুল আছে, ছোটছোট বাক্সের মত দেখতে বাসও আছে – কাজেই একেবারে গ্রামও বলা যায় না। এ সব জায়গাকে লোকে বলত গঞ্জ – ছোট শহরের ছোট্ট সংস্করণ। গ্রামের কাছে ছোট্ট শহর।

    এখানে সব দেখে আমার ঘোর আর কাটে না। কালো কালো রাস্তা দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম ও সব হল পিচ রাস্তা। যাতায়াত করতে সুবিধা। আমার অবশ্য খালি পায়ে ঐ শক্ত পিচ রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগত না। আমি পাশের ধুলোর পথেই হাঁটতাম।

    বামনহাটেই প্রথম শুনলাম চোঙা মাইকের গান। একেবারে অবাক করা ব্যাপার। একদিন তো সারাদিন ধরে গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করলাম যে খুঁটিতে বাঁধা অতো উঁচুতে লোকটা উঠে গান করে কি ভাবে? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না, বিকেলে দাদারা আমাকে খুঁজে এনেছিল বাজার থেকে।

    বামনহাটে সবাই নতুন। সবই প্রথম। আমার প্রথমবার স্কুলে যাওয়া। মনে আছে এখানে আসার দু-একদিন পরেই বাবার সঙ্গে চললাম স্কুলে ভর্তি হতে। দাদা-দিদিরাও সঙ্গে। হেড মাস্টারমশাই –এর সঙ্গে বাবার কি কথা হল জানিনা। আলাদা আলাদা করে হেডমাষ্টারমশাই আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমিও কিছু বলেছিলাম। উনি বাবাকে বললেন, আপনার এই ছেলেকে ওয়ানে ভর্তি না করিয়ে ক্লাস টু-তে ভর্তি করিয়ে দিন। বাবার ঘোরতর আপত্তি। বাবার যুক্তি আমার বর্ণপরিচয়ই ভালো মতো হয় নি, ওয়ানের পড়া শিখতেই ওর অসুবিধা হবে। তা ছাড়া গোড়াটা শক্ত না হলে পরে অসুবিধা হবে। কিন্তু বাবার যুক্তি টিকলো না। আমি ক্লাস টু- তে ভর্তি হয়ে গেলাম। হেড মাস্টারমশাই বললেন, আজই শুরু করে দাও। নিজেই আমাকে নিয়ে ক্লাসের দরজায় দাঁড় করিয়ে ক্লাসের মাষ্টারমশাই বললেন, যাও বসে পড়। আমার জংলি মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। কী করে বসব?

    ক্লাস ঘরে সব সার বসে আছে লম্বা কাঠের বেঞ্চে। ওরা সব ঐ উঁচু বেঞ্চের পেছনে গেল কি করে? মাষ্টারমশাই বললেন, যাও তাড়াতাড়ি বসে পড়। অগত্যা আমি বাধ্য হয়েই একটা উঁচু বেঞ্চের তলা দিয়ে মাথা গলিয়ে পিছনের বেঞ্চে বসতে গেলাম। মালুম হল, সবাই হাসছে আর পাশে বসা ছেলেদের হাতগুলো চাটি হয়ে আমার মাথায় এসে পড়ছে। আমি কোনোরকম ভাবে বেঞ্চে গিয়ে। বসলাম। শেষ হলে সবাই আমাকে ধরে যেটা শুরু করল সেটা হল র্যা গিং-এরই ছোট্ট সংস্করণ। আমার জীবনের প্রথম র্যারগড হওয়া। তবে লাভও হল ওরাই আমাকে সেখাল যে সামনের উঁচু বেঞ্চটাকে বলে হাইবেঞ্চে সেখানে বইপত্র রাখতে হয় আর খাতা রেখে লিখতে হয়। আর পিছনের নিচু বেঞ্চটাকে বলে লো – বেঞ্চ ওখানে বসতে হয়। হাইবেঞ্চের তলা দিয়ে কেঊ যাতায়াত করে না – দু-সারির বেঞ্চের মাঝে যে ফাঁকা সরু সরু পথের মতো আছে পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে পিছনের বেঞ্চে বসতে হয়।

    আমি রোজ স্কুলে যেতাম। কিন্তু সেখানে কি হতো সে নিয়ে আমার কোনও মাথা ব্যাথা ছিল না। আমাদের বাড়ির বিল্ডিং –এর মাঝ বরাবর একটা উঁচু দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা আর একটা কোয়াটার ছিল। সেখানে থাকত অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশনমাষ্টার। ওখানে একটা মেয়ে থাকত। নাম মীরা। আমাদের ক্লাসেই পড়ত। ঐ আমার প্রথম গার্ল ফ্রেন্ড। আমরা একসঙ্গেই স্কুলে যেতাম, একসঙ্গেই ফিরতাম বিকেলে একসঙ্গে পুতুল, রান্নাবাটি খেলতাম, মাঝে মাঝে ধুমধাম করে মীরার পুতুল আর আমার পুতুলের বিয়ে হতো। মীরা সেদিন শাড়ি পড়ত। আমিও মায়ের সাড়ি পরে কপালে টিপ লাগিয়ে পুতুলের মা সাজতাম। দু বাড়ির লোকজনদের নিমন্ত্রণ করা হতো। দুই বাড়ি বড়োরা সত্যি সত্যি এটা সেটা রান্না করত। বেশ মজা হতো। ভালই চলছিলো। হটাত শুনলাম পরীক্ষা। পরীক্ষা কী জিনিস কোনও ধারনাই নেই। সকালে স্কুলে গেলাম। দাদা-দিদিরও সেদিন পরীক্ষা। সকালে বাড়িতে কেমন যেন পরীক্ষা-পরীক্ষা ভাব। কিন্তু আমার এসব নিয়ে কোনও চিন্তা ছিল না। ক্লাসে বসলাম। অঙ্কের মাষ্টার এলেন। রাম বাবু স্যার। ক্লাসে উঁচু ক্লাসের ছেলে- মেয়েরাও ছিল। আমাদের বলা হল বড়দের দুঘণ্টার পরীক্ষা আর ছোটদের মানে আমাদের এক ঘণ্টা। আমরা যেন এক ঘণ্টা বাইরেই থাকি। সময় হলে স্যার আমাদের ডেকে নেবেন পরীক্ষার জন্য। বাইরে এসে আমরা যে যার মতো খালায় মেতে গেলাম। আমি আমার গার্লফ্রেন্ড মীরা একটা গাছের তলায় বসে বালি-মাটি নিয়ে ঘর বানানোর খালায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কতক্ষণ খেলেছি জানি না, হটাত শুনি একজনের গলা, কি রে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে? আমি বললাম, না, আমাদের পরে ডাকবে?

    - আর কখন ডাকবে? তোদের তো পরীক্ষা আর মিনিট পনেরোর মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এরপর দুপুরের ব্যাচের বড়দের পরীক্ষা। আমি তো সে জন্যই দুপুরের ব্যাচের বড়দের পরীক্ষা। আমি তো সে জন্যই দুপুরের পরীক্ষা দিতে এসেছি। তোরা পরীক্ষা দিবি না? আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আমি আর মীরা ছাড়া কেঊ নেই। লাগালাম দৌড় পরীক্ষার হলে। ঢুকতেই রামবাবু স্যার বলে উঠলেন, কোথায় ছিলে তোমরা? আর তো মিনিট দশেকের মধ্যে পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। এখন এসে আর কী করবে? তবুও আমার হাতে একটা পাতা ধরিয়ে দিয়ে বলবেন, দেখো, ব্লাক বোর্ডে প্রশ্ন লেখা আছে। একটা দুটো করার সময় যদি পাও। ততক্ষণে এক-দুজন করে পরীক্ষা শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। এতুকু বুঝলাম। সময় প্রায় শেষ। এর মধ্যেই অঙ্ক করতে হবে। আমি বোর্ডে লেখা অঙ্কটা কাগজে টুকে করতে শুরু করলাম। যোগ আছে। তাড়াতাড়ি দুই নম্বর অঙ্কটা করার জন্য বোর্ডে তাকাতে দেখলাম বোর্ডের ধারের বর্ডারে ইংরেজি হরফে কী যেন লেখা। ও দিকে মন না দিয়ে পরের অঙ্কটা করে ফেললাম। রামবাবু স্যার তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন সমানে। দ্বিতীয় অঙ্কটা করার সময় একটু ভালো করে ইংরেজি লেখাটার উপর নজর দিলাম। ব্যাস, আমার কাজ হয়ে গেল। আমি পর পর মন দিয়ে অঙ্কগুলো কয়েক মিনিটের মধ্যে করে ফেলে কাগজটা জমা দিয়ে দিলাম। বাড়ি এসে জানিয়ে দিলাম যে আমি দশ মিনিটে সব অঙ্ক করে এসেছি। বাবা বলল, বেশ, দেখা যাক কী করেছো।

    রেজাল্ট বেরোল। অন্যান্য পরীক্ষা মৌখিক ছিল। সেগুলোতে কোনও রকমে পাশ। কিন্তু অঙ্কে ফেল। বাবা বললো, দশ মিনিটে সব অঙ্ক করলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ভালো। অঙ্কে ফেল। বাবার বোধহয় একটু কৌতূহল হল। সাধারণ যোগ-বিয়োগ না করতে পাড়ার তো কথা নয়। বোধহয় আগ্রহ চেপে রাখতে না পেরে বাবা হেড মাস্টারের সঙ্গে দেখা করল। আমাকে সঙ্গে বগলদাবা করে নিয়ে চলল। ছোট জায়গায় সবাই সবাইকে চেনে। তা ছাড়া ছোট জায়গায় সবাই সবাইকে চেনে। তা ছাড়া ছোটবেলায় একটা কথা শুনেছিলাম- ‘Station Master is a master who minds the trains and school Master is a master who trains the minds.’ কাজেই দুই মাস্টারের কথা শুরু হল।

    - আপনি এসেছেন? ভালো হয়েছে। নইলে আমিই বিকালে যেতাম আপনার বাড়িতে। বলুন কেন এসেছেন?

    - তার আগে আপনি বলুন আপনি আমার বাড়িতে কেন যাবেন বললেন?

    - আপনার এই শ্রীমানের জন্যাই এসেছি।

    - আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়? আপনার ছেলে কি জিনিয়াস?

    - মানে?

    - মানে, ও কি মুখে মুখেই সব অঙ্ক করতে পারে?

    - জানি না। তবে অঙ্কের কথাই বলতে এসেছিলাম আমিও।

    - এই দেখুন, প্রতিটি অঙ্কের উত্তর একবারে নির্ভুল। যোগ আর বিয়োগ ঠিক আছে। কিন্তু গুন আর ভাগ?

    - মানে? ঠিক বুঝলাম না।

    - এই দেখুন। ওর উত্তরের কাগজটা। যোগ বিয়োগ একেবারেই করা যায়। কিন্তু গুন আর ভাগ করতে তোঁ কয়েকটা স্টেপ পর পর করতে হয়। আর ও শুধু ভাজ্য আর বিভাজক লিখে একবারে ভাগফল লিখে দিয়েছে। আর এক অঙ্কের বেশি গুন করছে একবারে কোনও স্টেপ ছাড়াই। তাই ভাবছি ও কি জিনিয়াস? সব অঙ্ক একবার দেখেই করতে পারে?

    শুরু হয়ে গেল আমার উত্তরপ্ত্র সামনে রেখে দুই মাস্টারের গবেষণা। ততক্ষণে আমার ভয় কেটেছে কিছুটা। ওদের অতো চিন্তায় পড়তে দেখে আমি বলে উঠলাম, সময় ছিল না। তাই-

    হেড মাষ্টার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সময় ছিল না মানে? সময় ছিল না বলে আমি একবারে উত্তর লিখে দিয়েছি। তুমি একবারে অঙ্কের উত্তর দিতে পারো? দেখি করত এই দুটো অঙ্ক।

    হেডমাষ্টারমশাই একটা কাগজে একটা মাঝারি ধরণের গুন আর একটা ভাগ লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।

    আমি অনেকক্ষণ ধরে অঙ্ক দুটো করতে লাগলাম। বিস্তর কাটাকাটি করেছো। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় বেশ একেবারেই উত্তরগুলো লিখেছ। ট্রেঞ্চ। আমি তখন ধীরে ধীরে পরীক্ষার দিনের কথা বলতে লাগলাম। কেন আমাদের পরীক্ষার সময় কম ছিল। হাতে সময় ছিল না। ব্লাক বোর্ডের বর্ডারে ইংরেজিতে প্রশ্নের উত্তর লেখা ছিল। আমি শুধু অঙ্কগুলো টুকে উত্তর দেখে দেখে লিখে দিয়েছি। পরে শুনেছি রামবাবু স্যারকে হেড মাস্টারমশাই খুব বকেছিলেন। আর আমাকেও দয়া করে ক্লাসে প্রমোশন দিয়ে দিয়েছিলেন।

    ক্লাসের বাংলা মাষ্টার আমাকে ঘসা ছাত্র বলতেন। সেটা আমার বাড়ির লোকও জানত। প্রশ্ন দেখলেই আমি খাতায় উত্তর লিখতাম। তারপর প্রায় সময়ই মনে হতো লেখাটা ঠিক হল না। ব্যাস আঙুল দিয়ে ঘসে পেন্সিলের লেখাটা মুছতাম এবং সমস্ত পাতাতেই এ ভাবে চলত। ফলে পাতাটা লেখা আর ঘসার একটা অদ্ভুত আধুনিক শিল্পের আকার নিত। ওর মধ্যে থেকে মাষ্টারমশাইদের উত্তর খুঁজে নিতে হতো। আমার এই ঘসার স্বভাবটা পুরোপুরি যায় নি।

    বামনহাটে স্কুল চলতে লাগল যেমন চলে। পড়াশোনা কি চলছিলো জানি না। তবে স্কুল কামাই করতাম না। তেমন কোনও ঘটনাও বিশেষ নেই। শুধু আমার পয়সা চুরি করা ছাড়া।

    হ্যাঁ, আমি একবার পাশে বসা এক বন্ধুর পকেট থেকে পয়সা চুরি করেছিলাম। তখন পরীক্ষার ফিজ ছিল দুই আনি। ক্লাসের কোনও একটি ছেলে পরীক্ষার ফিজ জমা দিতে পারে নি বলে ক্লাসে মাস্টারমশাই খুব বকেছিলেন। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গিয়েছিল। সে দিনি ছিল ফিজ জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। আমাদের ভাইদের পয়সাপাতি সেজদার দায়িত্বে থাকত। আমার হাতে কোনও সময় পয়সা থাকত না। ক্লাসে চলছে। হটাত তাকিয়ে দেখি আমার পাশে বসা বন্ধুর পকেট থেকে বেশ কিছু পয়সা দেখা যাচ্ছে। আর ঢিলে সাটের পকেটটা বসার বঞ্চে থেবড়ে থাকার ফলে পয়সাগুলো একেবারে পকেটের মুখের কাছে চলে এসেছে। আমি টুক করে পয়সা তুলে নিলাম। পেচ্ছাপ করার নাম করে হেডমাষ্টারমশাইকে ঐ ছেলেটার নামে ফিজ জমা দিয়ে দিলাম। বুকটা দুরু দুরু করলেও বেশ সাহস করেই ওটা করলাম। কিন্তু এতো বড় কাজটা করার পরেও একটা সমস্যা থেকে গেল। আমি ওর পকেট থেকে কেবল ছেলেটির ফিজের পয়সাই নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু হাতে উঠে এসেছিল বেশি পয়সা। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এখন যদি এই পয়সা নিয়ে ক্লাসে যাই, কেউ দেখে ফেলে? যদি ফেরত দিতে সবাই চোর বলবে। কি করি ভাবতে ভাবতেই বাকি পয়সা দিয়ে কয়েকটা নারকেলি লজেন্স কিনে খেয়ে ফেললাম। নারকলি লজেন্স এখনকার ছেলেমেয়েরা তো দেখে নি। শক্ত গোল নানা রঙের লজেন্স। নারকেল আর চিনি দিয়ে বানানো। একবার মুখে দিলে অনেকক্ষণ ক্ষয় হয় না। যতোটা স্বাদ তার চাইতেও বেশি জ্বালা শক্ত লজেন্সের ঘসায় জিভ আর টাগরার ছাল উঠে যাওয়ার।

    একটাও মুখে না দিয়ে পকেটে নিয়ে ঢুকলাম ক্লাসে। ক্লাসে ঢুকে দেখি আগের পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। পরের পিরিয়ডের মাষ্টারমশাই এসে গেছেন। আমি ঢুকতেই উনি বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, কোথায়, ছিলে এতক্ষণ। আমার পনেরো মিনিটেরও বেশি সময় হয়ে গেল। কী করছিলে এতক্ষণ?

    আমি কিছু না বলে বসতে গেলাম। মাস্টারমশাই বললেন, দাঁড়াও রমাপদর পয়সা চুরি হয়ে গেছে, সবার পকেট সার্চ করা হয়েছে। এবার তোমারটা সার্চ হবে। মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। এবার আমার বুকের মধ্যে দুর দুর করছে না, শুরু হয়ে গেছে ধরপরানি – একেবারে উথাল-পাথাল করছে হার্টটা যেন গলা দিয়ে উঠে মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। রামপদ এসে আমার পকেটে হাত ঢোকাল। বেরিয়ে এল লজেন্সের ঠোঙাটা।

    - কি পয়সা চুরি করে লজেন্সও কিনেছ? চলো হেড মাষ্টারমশাই-এর কাছে।

    - আমার কাছে যেতে হবে না। আমি এসে গেছি। হেড মাষ্টারমশাই ক্লাসে এসে ঢুকলেন। মনে হল আমার প্যান্টটা ভিজে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম বটে কিন্তু চোখমুখ সব অন্ধকার সব অন্ধকার হয় আসছে।

    হেডমাস্টারমশাই বললেন, তোমাদের কার বাড়ি কালিদাস মণ্ডলের বাড়ির কাছে? ওকে খবর দিও যে ওর পরীক্ষার ফিজ জমা দেওয়া হয়ে গেছে। ও যেন পরীক্ষা দিতে আসে।

    হেডমাষ্টারমশাই বেরিয়ে যেতে যেতে আমাকে দেখে দাঁড়ালেন তারপর বললেন, ও আরও একটা ভালো খবর আছে। আমার খুব গর্ব হচ্ছে এই ভেবে যে তোমাদের মধ্যে এমন ছেলেও আছে যে অন্যের কথা ভাবে, অন্যের জন্য কিছু করতে চায় এবং করে। আমার খুব ভালো লাগছে যে এই ছেলেটি নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে কালিদাসের পরীক্ষার ফিহ জমা দিয়েছে। ওর জন্য হাততালি দাও সবাই মিলে। আমি আজই এই খবরটা বিকেলে গিয়ে ওর বাড়িতে বলে আসব। ওর বাড়ির লোকও খুশি হবে। আমি আর থাকতে পারলাম না। চোখে একবারে অন্ধকার লাগছে। কিছুক্ষণ পরে দেখি সবাই মিলে আমাকে ঘিরে রেখেছে। চোখেমুখে জল দিচ্ছে। জ্ঞান ফিরল। ঘটনাটা আর বেশি দূর গড়ায় নি। তবে রামপদ আর আমার কাছে বসত না। আর আমার পয়সায় অন্যের ফিজ দেওয়ার ব্যাপারটা অন্য ছেলেদেরও খুব হজম হয়নি।

    বিকেলে আমরা খেলতাম। ফুটবল খুব একটা খেলতাম না কারণ বড়োরা দিত না। আর ক্রিকেট? ওটার নাম কেন বোধহয় কেউই শোনেনি। আমাদের খেলা ছিল এক্কা- দোক্কা, গোল্লাছুট, দৌড়, বড়দের পিছন পিছন দুধুভাতু হয়ে খাপ খেলা, গুলি খেলা। আমি কোনও খেলাতেই জিততাম না। তার চাইতে আমার ভালো লাগত মিরার সঙ্গে খেলনাবাটি খেলা। মায়ের শাড়ি পরে মীরার সঙ্গে জ্ঞান গেলে নিজের মতো করিওগ্রাফ করে নাচ করা। অন্যদের হাসিটাসি গায়ে না মেখে মনের আনন্দে নেচে যাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।

    সন্ধের পর একটু বই-পুজা করে আবার বেরিয়ে পরতাম মাথে। সবাই প্রায় বেরত, বড়রাও থাকত। চলত নিজেদের মধ্যে গল্প। ওর মধ্যেই আবার চলত জনাকি পোকা ধরে জামায় ঘসে দিলে পোকাটা মরে যেত ঠিকই কিন্তু আলোটা রয়ে যেত অনেকক্ষণ। কার গায়ে কতটা আলো তাই নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। যেদিন চাঁদ উঠত সেদিন রাতের বেলাতেও দৌড়োদৌড়ি ইত্যাদি চলত। রাত ন-টার মধ্যে প্রতেকের খাওয়া এবং তারপর হ্যারিকেন নিভিয়ে ঘুম।

    সপ্তাহে একবার আমাদের বড় একটা কাজ থাকত। কয়লা পোড়ান। রেল কোয়াটারসে সবাই ঘরেই রান্না হতো কয়লায়। নিয়ম মাফিক একটা কয়লা বরাদ্দ ছিল প্রত্যেক বাড়ির জন্য। কাঁচা কয়লা – রেল ইঞ্জিন যে কয়লায় চলে সেই কয়লা। ঢাউস সাইজের কাঁচা কয়লা পুড়িয়ে, রান্নার উপযোগী করা। এটাকে সাপ্তাহিক উৎসবও বলা যায়। তবে খাটুনি যতই হোক। আমার খুব আনন্দের সঙ্গেই কাজটা করতাম। কয়লা পড়ানোর কথা পরে হবে।

    এক ধরণের জংলা গাছে ছোট ছোট ফল হতো। নাম জানি না। এক কড়ে সাইজের সবুজ এই ফলের গায়ে থাকত অসংখ্য নরম কাটা ( যেমন কাঁঠালের থাকে) লাগলে খুব বেশি ব্যথা লাগে না বরং জামা কাপড়ে আটকে যায়। চুলে আটকায় সবচাইতে বেশি। একজন আরেকজনের জামায়, চুলে ছুড়ে মারতাম। কার শরীরে কত ফল লাগানো যায় তার হালকা প্রতিযোগিতা। এই নিয়ে একটু আধটু মনোমালিন্যও যে হতো না, তা নয়। তবে বাড়াবাড়ি হতো না।

    আর একটা খেলা ছিল ধুতরো ফল নিয়ে। এটা অন্যের গায়ে মারতাম না, নিজের গায়েই মারতাম। কাঁটাওয়ালা ছোট বলের মতো গোল শক্ত ভারি ফুলটা এক হাতে হাওয়ায় একটু ছুড়ে দিয়ে অন্য হাতের পাতার পিছন দিকটা দিয়ে ওটাকে মারা। হাতের পিছন দিকটা দিয়ে ওটাকে মারা। হাতের পিছনটা অনেকটা ক্রিকেট ব্যাটের মত ব্যবহার করতাম। ব্যথা লাগত আর কাঁটা বিঁধে চামড়া ফুটো করে আলপিনের খোঁচা খাওয়ার মতো অসংখ্য রক্তের বিন্দু বেরত। হাতে ব্যথা লাগত। জ্বালা করত। কে কত বেশি রক্ত বের করতে পারে সেটাই হল খেলা। তারপর ব্যথা হাতে কয়েকদিন কাটতে না কাটতেই আবার সেই খেলা। আমার সার্কাস দেখতাম। আসলে তখন আমাদের ওখানে বছরে এক-আধবার সার্কাস আর কলকাতা থেকে আসা যাত্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সার্কাস দেখে এসে আমাদের কাজ ছিল সে সব নিজেদের করে দেখানো। দড়ির খেলা, ত্রিফলা, আরও নানা ধরণের খেলা সবই প্র্যাকটিস করতাম। ধীরে ধীরে আমাদের একটা ছোট্ট সার্কাসের দলও তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। গাছের ডালে দড়ি বেঁধে আমরা বেশ ভালই শিখেছিলাম। একদিনের কথা না লিখলেই নয়। আগের দিন একজন জোকারকে জল খেয়ে শরীরের নানা জায়গা থেকে সেই জল বের করতে দেখে ঠিক করলাম ওটা রপ্ত করতে হবে। দুপুরে সবাই ঘুমাচ্ছে। সেই মতো আমিও একটা সাইকেলে টিউব সারা গায়ে পেঁচিয়ে একটা দিক আমার মুখের কাছে লাগালাম। এবার মুখে জল খাওয়ার পাইপের মধ্যে জল ঢালার অনুশীলন জোর কদমে চালিয়ে যেতে লাগলাম। পাইপের মধ্যে যতোটা জল গেল তার চাইতে অনেক বেশি জল যাচ্ছিল আমার পেটে। বুঝতে পারছিলাম জলে পেট ভরে যাচ্ছে। কিন্তু আমার একটা গুন আছে – অধ্যাবসার। কাজেই পুরো না শিখে মাঝপথে তো কোনও ছাড়া যায় না। তাই সেই অধ্যাবসায় চালিয়ে যেতে থাকলাম। আস্তে আস্তে পেট জলে ভরে ঢাইস হয়ে গেল। কেমন যেন মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। শরীরের সব শক্তি ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। দম নিতে পারছি না। হটাত মনে হল মরে যাচ্ছি। হাওয়া চাই, বুক ভর্তি হওয়া চাই। তারপর অতিকষ্টে শরীরটা টেনে নিয়ে দরজা দিয়ে শহরে চলে এলাম, চোখ যখন খুলল, তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সবাই আমাকে ঘিরে রয়েছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আর আমি বিরাট রেলের সিমেন্ট বাধানো কুয়োর কাঠের ঢাকনা পাটাতনের উপর শুয়ে। গায়ে তখনো সেই সাইকেলে টিউব জড়ানো। দাদাদের হাত ধরে অনেক কষ্টে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। ডাক্তারি পড়ার সময় জানতে পেরেছিলাম আমার হয়েছিল ওয়াটার ইনউক্সিকেসন মানে অতিরিক্ত জলের বিষক্রিয়া। এতে উপকারী জল অতিরিক্ত হয়ে গেলে বিষ হয়ে যায়, কোনও জিনিসই বেশি ভালো না। ঐ জলের খেলাটা আর আমার শেখা হয়ে ওঠেনি।


    (চলবে)


    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.