কে
লেখে কবিতা?
কাকে কেন্দ্র করে লেখা হয় কবিতা? নারী কবিতার
পাঁচ ফোঁড়ন। নারীর সাথে কবিতার টান নাড়ীর। বাংলাসাহিত্য জগতে একটি সুপরিচিত নাম কবিতা
সিংহ। গল্প উপন্যাস কবিতা সব ক্ষেত্রেই তার সমান পারদর্শিতা ।‘পৌরুষ’ উপন্যাস
দিয়ে কবিতা সিংহের কলমের সাথে আমার মত তুচ্ছ পাঠিকার প্রথম পরিচয়, তারপর একে একে ‘চারজন রাগী যুবতী’, ‘পাপ পূণ্য পেরিয়ে’, ভালো লাগা ঘনীভূত হতে হতেই
হাতে পেলাম ’ কবিতা সিংহর শ্রেষ্ঠ কবিতা’. । তারপর আলোড়ন তোলা কাব্যগ্রণ্থ ‘সহজসুন্দরী’। আমার সামনে এক অজানা সাহিত্যজগতের দূয়ার খুলে
গেল। তারপর শুধুই মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা।
‘পিছনে
পিছনে এত বাঁধা আছে হৃদয়ের মানে আর
শিকড়ে
শিকড়ে জমে টান’
— শঙ্খ
ঘোষ কথিত এই টানের নিবিড়তা আর গভীরতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে কবিতা সিংহের কবিতার আনাচে
কানাচে। আজ কবি কবিতা সিংহের কথাই বরং বলি।
কেউ
বলে কবিতা হচ্ছে কাব্যলক্ষ্মীর আশীর্বাদ। কেউ বলে কবিতা কবি হৃদয়ের সুপ্ত বাসনার বহিঃপ্রকাশ।
কেউ বলে কবিতা জীবনের পরাবাস্তবতা আবার কেউ বলে গোটা জীবনটাই একটা কবিতা। একেকজনের
কাছে কবিতার ঘোর তত্ত্বকথা,
কবিতা প্রসবের প্রেক্ষাপট একেক রকম। কবিতার আমেজও পাত্র ভেদে ভিন্ন।
কবির কাছে কবিতা ধরা দেয় এক ঢঙে, আবার পাঠকের কাছে অন্য মেজাজে।
কবিতা
এবং আমি দুই যুযুধান পাঁয়তারা
ত্লীক্ষ্ন ফলা আগু পিছু,সাপের জিভের স্রিকস্রিক।
কাগজের
দলা জমছে বেতের বাস্কেটে ধিক ধিক?
***********************************
কি
আনন্দ লক্ষ্যভেদ,
কবিতা হে ভিতরে কোথাও
ওল্টালো
মধুর ভাঁড়, অমৃত
হে, খাও খাও-
এবার
সাবাস বলে হেসে উঠি দুজনে দুজন
মৃত্যু
নয়, বাঁচা
নয় লক্ষ্যভেদ, সর্ত ছিল রণ। (কবিতা এবং আমি)
কবিতার
মত নরের জীবনেও নারী এক উপাখ্যান। নারী শব্দটার মাঝে লুকিয়ে আছে এক পরম শীতলতা, আশ্বস্তটা। কখনো মাতা,
কখনো ভগ্নি, কখনো প্রেয়সী, ভিন্ন ভিন্ন রূপের আধার নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেউ কেউ নারীকে সাজিয়েছেন
নিজের মত করে। সাহিত্যে বঙ্কিম-শরতের পর নারীর সরব উপস্থিতি
দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথে ব্যাপকহারে। বঙ্কিম-শরতের রচনায় নারীর
যে বৈধব্য দশা, সমাজের অচ্যুত রূপটা প্রকট ছিল তা সম্পূর্ণ
প্রেমময় হয়ে উঠেছে রবীন্দ্র ছোঁয়ায়, আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তার কবিতায় নারীর যে রূপ চিত্রায়ন করেছেন, সেই নারীকেই নজরুল,
জীবনানন্দ কিংবা পরবর্তী অন্য সব কবিরা এনেছেন অন্যভাবে তাদের চিত্তে,
তাদের কবিতায়। এভাবেই যুগ থেকে যুগে কবিতায় নারীর আগমন ঘটেছে নানান
আঙ্গিকে।এদের মাঝখানেই নারীদের নিজস্ব জগত নিয়ে যখন কবিতা লেখা শুরু করলেন কবিতা সিংহ
তখন যেন বাংলা সাহিত্যের নতুন এক ধারার গোলাভরে গেল নতুন ফসলে।
আমিই
প্রথম।
জ্ঞানবৃক্ষ
ছুঁয়েছিলাম
আমিই প্রথম
আমিই
প্রথম
লাল
আপেলে পয়লা কামড় দিয়েছিলাম প্রথম আমিই
আমিই
প্রথম।
আমিই
প্রথম
ডুমুর
পাতায় লজ্জা এবং নিলাজতায়
আকাশ
পাতাল তফাৎ করে দেওয়াল তুলে দিয়েছিলাম
আমিই
প্রথম। (ঈশ্বরকে ঈভ / কবিতা সিংহ )
আমি
কবিতা বলতে বুঝি সাহিত্যের প্রাচীন এবং সর্বোচ্চ এক ধরন যা মানুষ ধারন করে নিজের চেতনায়।
সাহিত্য বুঝি আমি নান্দনিকতা আর বিষয়বস্তুর বিচারে। বিষয়বন্তুর মধ্যে থাকে বার্তা।
কথার গাঁথুনির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে কাহিনী আর দৃশ্যকল্প। কথা দিয়ে তৈরী মালা। আর
নান্দনিকতা দেয় কল্পনা,
ছবি। বিষয়বস্তু আর নান্দনিকতার গুনেই সাহিত্য হয়ে ওঠে সার্থক। কবিতাও
একই রীতি মেনে সার্থকতা পায়। কবিতা বলতে বুঝি এর এক একটা শব্দ এক একটা হিরক খন্ড আর
এই খন্ডগুলো তৈরী করে এক অনবদ্য চিত্রনাট্য। ঠিকএই সম্পদই আমি খুঁজে পাই আমার প্রিয় কবির লেখায়, কবিতায় ।
তবে
তাঁর এই প্রচেষ্টাকে তির্যক দৃষ্টিতে দেখতে ছাড়েননি অনেকেই। এদের মধ্যে কেঊ কেউ আছেন
বিদগ্ধ বা বরেণ্য লেখকও । তাদের ধারণা হল, উনি মেয়েদের জন্য লেখনী আদৌ ধরছেন
না, বরঞ্চ সস্তায় নাম কেনার মোহে নারীবাদের নামে নতুন করে
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন
। তবে ওনার কবিতারা মুলত: রূপক নির্ভর তির্যক বাক্যবিন্যাসে
সজ্জিত।
কাব্যের
ঈশ্বর নেই আছেন ঈশ্বরী।
তিনি
একা, তিনি
নিরীশ্বর।
ঈশ্বরী
কি ধ্বনি দেন?
চক্ষুহীন কর্নবিহীন?
না
তিনি দেখান তাঁর অঙ্গুলি হেলনে
চক্ষুষ্মান
সশরীর কবিতা চেহারা।
তিনি
তো ভূমন্ডলে শ্রেষ্ঠ নিষ্ঠুরা – তিনি
তীব্র
অপমানমুদ্রা
, নীলবর্ণ করতলে করেন ধারন,
দুহতে
বিলান নির্বাসন,
ঈশ্বরী
কাব্যের যিনি,
সাকার তমসা তিনি,
তিনি
ঘোর অমা। (আছেন
ঈশ্বরী)
দেবী
সরস্বতী এখানে মিশে গেছেন দুই স্ত্রী লিঙ্গ শব্দের সাথে, খ্যাতি ও গরিমা। পুরুষশাসিত
সমাজে নারীশক্তির নির্মম ও নির্লজ্জ প্রতিশোধবৃত্তি ফুটে উঠেছে কবিযশোলোভী পুরুষের
সামনে।
আমাদের
মহাভারতের দেশে নারী দেবী,
নারী সেবাদাসী। পুরুষের চাহিদার সাথে তাল রেখে খোলস বদলায় নারীর প্রজাপতি
জীবন। নারীর এই অবস্থানের সময়ের সাথে ক্রমশ আরো অবনতি হয়েছে। নারী সম্পূর্ণই পুরুষের
ইচ্ছার প্রতীক এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজসৃষ্ট, যাকে মনুসংহিতার
মতো কথিত শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে বৈধরূপে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেই আবহমানকাল
আমদের পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা মেয়েদের দেবী সাজানোর মিথ্যা আশ্বাসে তাদের সেবাদাসী,দেবদাসীর ভূমিকায় ঠেলে নিয়ে গেছে। গালভরা নামের আড়ালে দিয়েছে গালিভরা জীবনের ভ্র্রান্ত
সুখবিলাস। দেবী হয়েও সেই পুরুষ সভ্যতার অহেতুক গা জোয়ারী থেকে রেহাই নেই।
আমার
অপমানের প্রয়োজন আছে
!
ডাকেন
মুঠোয় মরীচিকা রেখে
মুখে
বলেন বন্ধুতার
___ বিভূতি ___
আমার
মরীচিকার প্রয়োজন আছে।
অপমানের
জন্য বার বার ডাকেন
ফিরে
আসি
উচ্চৈঃশ্রবা
বিদূষক-সভায়
শাড়ি
স্বভাবতই ফুরিয়ে আসে
আমার
যে
কার্পাসের
সাপ্লাই মেলে না।
(অপমানের জন্য ফিরে আসি // কবিতা সিংহ
)
সমাজের
ওপরতলার মানুষ যেমন এসেছে তাঁর কবিতায়, তেমনই এসেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষজন, সেইসঙ্গে একেবারে বস্তিবাসী
মানুষও ঠাঁই পেয়েছে বহু কবিতায়। এঁদের আমরা চিনি, আবার চিনিও না। চেনার আগ্রহও
নেই। অথচ এই সব অবমানিত মানুষের হৃদয়ের পরিচয় ও অনন্য জীবনদর্শনের পরিচয় পেলে বিস্মিত
হতে হয়।এদের মাঝে দাঁড়িয়েই কবি তীব্র শ্লেষে আক্রমন করেছেন সেই সব মেয়েদের
যারা নিজেদের কাঁচের পুতুলের মত সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানের আশায়,
পুরুষের নজরে পড়ার প্রতীক্ষায়, তাদের মনোরঞ্জনের
তাগিদে। মেয়েদের জন্য নির্ধারিত বিশেষ শ্রেণীর ম্যাগাজিনে খুঁজে পেতে পড়ে চটজলদি সুন্দরী
হবার উপায়, পুরুষের কছে নিজেকে আরো আকর্ষনীয় করে তোলার পদ্ধতি।
হঠাৎ
তোমাকে কেন রঙীন অফসেট মনে হলো?
হঠাৎই
ল্যাকার করা চুল সিল্কস্ক্রীন শাড়ী
বহু
বর্ণে সুশোভিত লেদার বাউন্ড
শরীরে
নিখুঁত লাইনো
মলাটে
মেডেন ফর্ম হলদে লাল বিবাহ মরশুম
বুদ্ধি
করে কে এঁকেছে তোমার কভার?
বিয়ের
বাজারে তুমি পড়তে পাবে না নারী,
পড়ার
আগেই বিকে যাবে।
***********************
মাসীর
মেয়েতে আজ ছেয়ে গেছে পেনেটি টেরেটি
এ
বয়সে আর কিবা পারি?
ভদ্র
বেশ্যা বানানোর টিপস বলে দিই হপ্তায় হপ্তায়
যে
ভাবে ঘোড়ার টিপস বলে দেয় দেউলে ঘোড়েল
সেইভাবে
কচি কচি খুকিদের ব্যাবসা শেখাই। (বৃদ্ধ বেশ্যা তপস্বিনী)
বেদনার
বহুধা অনুভূতি,বহুমাত্রিক বিস্তার ,এর প্রতি শব্দ ও অনেক।দুঃখের
অনেক রূপ ,কষ্টের অনেক শেকড় ,বেদনার
অনেক বিমূর্ত ও ভাষাহীন আকুতি ।
কিন্তু
দুঃখ কষ্ট ,বেদনা
যাই বলিনা কেন সব কিছুর রঙই বোধকরি কালো আর এ সবের পরিনতি বিরহবোধে নিমজ্জন । পৃথিবীর সব কবিরাই মনে হয় “হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে
ভালবাসেন” ।কিন্তু কবিতা সিংহের কাব্যিক বেদনা
পুরোপুরি বাস্তবনির্ভর। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মেয়েদের দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, লাঞ্ছনা,
উপেক্ষা,সামাজিক শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে বারবার
সরব হয়েছে তাঁর লেখনী।বর্শাফলকের মতো তাঁর কাব্যভাষা ছিন্ন করেছে সাংকেতিক কুয়াশা,
আলো ফেলেছে এমন কিছু কিছু সামাজিক ব্যাভিচার শোষণ ও অবনমনের উপর, যে বিষয়গুলি নিয়ে এত স্পষ্টভাবে উচ্চারন করতে অনেক পূর্বসূরী মহিলা কবিই
দ্বিধাগ্রস্থ হয়েছেন।
ব্রাহ্মন
বাটপার
ধরণীর
মত কর্ষণে তাকে করেছে রজস্বলা
শাড়ীর
সঙ্গে তার উড়েছে ভীরুতা
এখন
ভিতরে তার শুধু ক্রোধ,শুদ্ধ ঘোর ক্রোধ,
মন্দিরে
যায় নি নারী দেখেনি সে অবিকল
তারই
নগ্ন
কালো রক্তজিহ্ব প্রতিমার
অদ্ভুত
বিশাল
এলো
চুলে কালো স্তর,খড়্গ জ্বলে লাল
স্পৃশ্যতার
কূটকচাল আজ জেনে গেছে ভাঙ্গী রমনী। (ভাঙ্গী রমনীর ক্রোধে)
পুরুষ
মাত্রই দুর্বার উশৃঙ্খল এলোমেলো আর এই পুরুষই দিন শেষে ফিরে আসবে নারীর কাছে, এই যে পুরুষকে নিজের আঁচলতলে
টেনে নেয়ার ক্ষমতা, এ নারীর স্বভাবজাত।কেননা নারীরা স্বভাবে
সর্বংসহা। কিন্তু তা বলে মেয়েরা এতটা অবলা নয় যে বারেবারে পুরুষ তাকে ঠকিয়ে যাবে,
অবদমিত, পদানত করে রাখবে। নারী জীবনের দুঃখ-বঞ্চনা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকারহীনতা,
পদে পদে বন্দিত্বের শৃঙ্খল আর নিত্যদিনের মনু্ষত্বের অবমাননার পথ
ধরে নারীর যে জীবন কবিতা সিংহ তা তুলে ধরেছেন তার কবিতায় । মেয়েরা যে সমাজে একটা স্বতন্ত্র অংশ, পুরুষের ওপর নির্ভরশীলা
নয় বরঞ্চ স্বয়ংসম্পূর্ণ তার প্রতিষ্ঠা, এটা কবির লেখায় বারে
বারে ঘুরে ফিরে এসেছে।জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু বাক্যগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ
রাখেননি, শাণিত ও শক্তিশালী কবিতা নির্মাণে অস্ত্রের আকারেও
উপস্থাপন করেছেন।
মা, আমি কি তেমন হব?
রক্ষিতামন্যস্ফীত স্তনিত শঙ্খিনী,
মেডেলে
পদকে স্বর্ণে ব্যর্থ বিজয়িনী
শয্যায়
পুরুষহত্যা,
পিতৃহত্যা শুদ্ধ নয় মাতা,
রণক্ষেত্রে
দেখা হবে সম্মুখসমরে তীব্র ইস্পাতের অচিত্র অঙ্গদে।
আমি
তো শিখিনি মাতা রমনীয় পশ্চাদপসারন।
****************************
হে
আমার আদিপিতা,
হে আমার আদিম প্রেমিক,
তোমার
বিচ্ছেদ দষ্ট যেন কালসর্পদষ্ট দয়িতার ওই মুখ
কোনদিন
তুমি দেখলে না,
এসো
মা, তোমায়
দেখি, আমি তোর ব্রাত্যকন্যা,
আজীবন
পাথরপ্রতিমা।
(আজীবন পাথর প্রতিমা)
নারী
কি মানুষ? প্রশ্ন
উঠলেই তাত্বিক বোদ্ধার দল কাগজে কলমে অনেক হিসাব নিকাশ করে দেখিয়ে দেবেন, না নারী শুধু নারীই, মানুষ নয়, সেতো চিরকালীন ভোগ্যপণ্য । শারীরি যৌনতার মূর্ত প্রতিভূ নারী। সমাজের
সর্বত্র আজও নারী যৌন লাঞ্ছনা, যৌন নির্য্যাতন, যৌন লালসার শিকার।
শিশুকন্যা থেকে শিশুর মা, কেউ এর আওতার বাইরে নেই। অসূর্যস্পশ্যা মহাভারতীর যুগ থেকে আজ সূর্যস্পশ্যা
একবিংশ শতকের নারী, সময় বদলালেও অবস্থান বদলেছে কি?
রিস্কার উত্তর, ‘না’। আর এই খানেই মুখর আমার প্রিয় কবির কলম। আজকের
অবক্ষয়ী সমাজের নারী নির্য্যাতন, নারী লাঞ্ছনা তাই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর বোধে,
তাঁর কলমে।
উরুর
কুলুপ ভাঁজ
খুলে
যায়।সূর্যশেঁকা বায়ূ ছোঁয় প্রতি পরমাণু।
সূর্য
কিভাবে তার ভ্রণগুলি শুক্রকণাগুলি
রক্তের
বিম্বগুলি অবিকল সূর্যবিম্ব করে
ঘোরায়
বিরলে।
কি
ভাবে জগায় তাকে
কি
ভাবে ভাসায় তাকে
কি
ভাবেত্বকের নীচে গলেযায়,
ছেয়ে যায় সোনালী রাঙতা,
সূর্যাস্তেরও
পরে হিমরাত্রে নারী জ্বলে সে গূঢ় উৎসারে। (সূর্যস্পশ্যা )
যে
নারীর গর্ভে জন্ম নারী ও পুরুষের, যে নারীর অমৃতপানে পুষ্ট নবজাত বা নবজাতিকা, সে নারী নরকের দ্বার। নারীর জন্ম মৃত্যুতেও তাই খোদার ওপর খোদকারী। ভ্রূণহত্যা
থেকে সতীদাহ কি বধুদহন সমাজের এই অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার কবির কলম।
আমরা
ভ্রূণ না ভ্রূণা
আমাদের
জন্ম দিও না মা
মা
আমার জেনেশুনে কখনো উদরে
ধরোনা
এ বৃথা মাংস
অযোচিত
কখনো ধরোনা
**********************
হলুদ
বসন্তপাখী ডাকুক নির্ভীক স্বরে হোক
গেরস্তের
ঘরে ঘরে
খোকা
হোক।খোকা হোক।শুধু খোকা হোক। (ভ্রূণা )
লেখার
সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক হচ্ছে তার জাদুকরী ভাষা। তার লেখার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাবলীল।লেখার ক্ষেত্রে
তিনি ভাষা কখনো স্বচ্ছ, কখনো রহস্যাবৃত আবার কখনো গতিময়।
জীবনকে যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই তিনি কথামালা সাজিয়েছেন তার সাহিত্যে।জীবনক্ষেত্রে অত্যন্ত
সফল নারী কিভাবে গড়ে তোলে তার জীবন? কি ভাবে তার ব্যক্তিগত
জীবনে ফুটে ওঠে চাওয়া - পাওয়া, পাওয়া
- না পাওয়ার টানাপোড়েন? কিভাবে তার চারদেওয়ালের
ইতিবৃত্ত লেখা হয় পুরুষের চোখে?
যে
নারী পেরিয়ে যায় অসংখ্য শিখর
বাচেন্দ্রিপালের
গাঢ় হৃদয় নিবেশে
সে
কি পায়?
পায়
না কিছুই
পাবার
জন্য নয় কোন অতিক্রম
অতিক্রম
কেবলই হারার পথে পথে লুট হয়ে যায়,
বন্ধু
সখা প্রিয় নর পড়ে থাকে নিজস্ব একেলা। (আলাত পুরুষ)
তা
বলে কবি যে পুরুষবিদ্বেষী এমনটা ভাবারও কোন কারন নেই। কবিতায় নারীর প্রতিবাদ আছে, কিন্তু তথাকথিত পুরুষবিদ্বেষ
নেই। নারীপুরুষ একে পরের পরিপূরক। কেউ কারো অধীন নয়। কেউ কারো মালিকানায় বা প্রভুত্বে
নেই। পৃথিবী আর আকাশের মত, চাঁদ আর সূর্যের মত তারা একজন আরেকজনের
সাথে অঙ্গাঙ্গী বাঁধনে বদ্ধ। সে বাঁধনই প্রেম। সে বাঁধনই পারস্পরিক বিশ্বাস,
সহমর্মিতা, সে বাঁধনই ভালোবাসা। । বাংলা গীতি কবিতা সম্পর্কে একদা আপ্তবাক্য
ছিল যে,কানু
বিনা গীত নেই,ঠিক তেমনি বাংলা কবিতা সম্পর্কে আরো পরম সত্য
হলো. প্রেমের নিটোল প্রকাশ ছাড়া কবিতা নেই । তবে প্রেম সর্বদা সুখের আধার নয় ; প্রেম বেদনাবিধুরতার গভীর
মহাসমূদ্র ও বটে। তাতে বিষের ছোঁয়াও অমৃতের স্বাদ পায়। কবির ভাষায়ঃ–
চোখে
যদি মন ফোটালে
/ মনে কেন চোখ দিলে না,
বদলে
তার বদলে/ লজ্জায়
ভুঁয়ে নোয়ালে,
লজ্জায়
ভুঁয়ে নোয়ালে/
তবু কেন ছেড়ে দিলে না,
বদলে
তার বদলে/ দুনিয়ায়
বেঁধে ঘোরালে।
দুনিয়ায়
বেঁধে ঘোরালে/
কালামুখ ঢেকে দিলে না,
বদলে
তার বদলে/ রক্তে
প্রেমের বিষ মেশালে। (সহজসুন্দরী )
কবিতার
মৌলচেতনা প্রেমের বিচিত্রবিধ রূপের প্রকাশ ।
বাংলা
কবিতায় প্রাচীন লীলাভূমি বলে প্রেম চেতনা রূপায়নের প্রধান অনুষঙ্গ নিসর্গ । প্রেম এবং প্রকৃতির মূলাধার সুন্দরের প্রতি
মানব মনের চিরকালীন আকর্ষন। কখনো বা মানবীয় প্রেম ও প্রকৃতি কবির কবিতায় একাকার এবং
একাত্ম -অম্বিষ্ট
হয়ে যায় । কখনো কখনো প্রকৃতিতে নরত্বারোপ
করেছেন তিনি । আকাশ,সমূদ্র,ফুল, মেঘ,বৃষ্টি-এসবের মধ্যে মানব রূপের, প্রেমিক রূপের চিত্রকল্প
বিনির্মান করেছেন ।
যেন
তাঁর প্রেম জীবন্ত থাকলে প্রকৃতি সুষমামন্ডিত হয় আর অনুরাগ আহত হলে প্রকৃতিতে ও পড়ে
এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া-হারিয়ে যায় রূপের জৌলূস,কলঙ্কিত হয় সুনির্মল সৌন্দর্য,অমানিশায় আক্রান্ত হয় প্রেমের শিল্পিত ভূবন ।
নীলতারা
মনে করতেই আকাশ
আকাশ
মনে করতেই আবার নীলশার্ট,
নীলশার্ট
মনে করতেই কেবল বারবার
ঘুরে
ফিরে, ফিরে
ঘুরে আবার-
আকাশ
আঙ্গুল চোখ ছুট হাসি চরণ আবার নীলশার্ট,
মরণ! (মরণ)
বহমান
নগর জীবনের অনুষঙ্গের পাশাপাশি সমান দক্ষতায় কবি তুলে আনেন গ্রামবাংলার প্রকৃতি জীবনের
চেনা ছবি।তিনি সমাজ জীবনের নানা সমস্যা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য,
হতাশা-বঞ্চনা, রাজনীতি
সচেতনতা নিয়ে লিখেছেন ,লিখেছেন যাপিত দিনলিপির পরতে পরতে সাজানো
অভিজ্ঞতার নির্য্যাসে জারিত প্রবাদ নিয়ে, তার লেখনী অনায়াসে
ছুঁয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে প্রায় হারাতে বসা চরিত্রদেরও।পুরান উপকথা থেকে মহাভারত লোকগাঁথা,
বিনি সুতোয় গাথা মালার কাহিনীরা ফুটে উঠেছে শব্দের অলঙ্কারে,
ছাপা অক্ষরে, কবির ভাষায়। লোক-পুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রগুলোকে নতুনভাবে এনেছেন।
এই
দেখো, দেহ
নেয় যে আমার বিমূর্ত প্রণয়,
যে
আমার নিমকাঠে প্রতিকোষে আয়নায় আয়নায়
যে
আমার সমগ্র আমিকে করে তক্ষনে সৃজন
নিমের
শরীর খুঁড়ে গড়ে দেয় কৃষ্ণ চেতনাকে
হস্তবিহীন
তার খুলে যাওয়া বাড়ানো দু’হাত
এই
দেহ অধিবাসী আদিবাসী নিম জগন্নাথ। (নিমকাঠ )
ডবলিউ
এইচ অডেন (১৯০৭-১৯৭৩) কবিতাকে বলেছেন ‘স্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা’ - সে হিসেবে অমন অনেক পঙ্ক্তি
রচনা করে কবি-অঙ্গীকার পূরণ করেছেন কবি কবিতা সিংহ। তিনি ছিলেন ভাব সম্পন্ন কবি। ভাল
কবিতা রচনার আদি-অন্ত তাঁর আয়ত্তে – ছিল। কবিতা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম শিল্প মাধ্যম । হাজার বছরের ও বেশী সময় ধরে বাংলা ভাষার কাব্য
মালঞ্চ বহু বর্ণিলতায় বিকশিত হয়ে চলেছে ।
এই
কাব্য মালঞ্চে কবি হিসাবে কবিতা সিংহের নাম অমরত্ব লাভ করুক, এই কামনাই রইলো।