আকুপাংচার এক
প্রাচীন চৈনিক চিকিৎসাপদ্ধতি। আকুপাংচার
শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল সূচ ফোটান। এই চিকিৎসাপদ্ধতির উৎসস্থল সম্বন্ধে নানা মুনির
নানা মত থাকলেও এর প্রকৃত উৎস হল চীন তাতে সন্দেহের কোন অবকাশই থাকতে পারে না। যদিও প্রাচীন
ভারতেও আকুপাংচারের মত চিকিৎসা চালু ছিল তাকে বলা হত মর্মভেদী চিকিৎসা।
এই চিকিৎসা পদ্ধতি
কত প্রাচীন সে সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। এটি যুগ যুগ ধরে চীন দেশে
চালু ছিল, এখনও আছে। যখন
মানুষ ধাতুর ব্যবহার শেখে নি তখন আকুপাংচার চিকিৎসায় পাথরের সূচ ব্যবহার করত।
সুতরাং বোঝা যায় প্রস্তর
যুগেও এই চিকিৎসা প্রচলিত ছিল। পরে ব্যবহৃত হত
বাঁশের সূচ, পরবর্তীকালে
বিভিন্ন ধাতুর সূচ ও বর্তমানে ব্যবহার হয় স্টেনলেস স্টিলের সূচ।
কমিউনিস্ট চীনের
শাসক মাও সে তুং ক্ষমতায় এসে যে সব সংস্কারমূলক কাজ করেছিলেন তার মধে একটা হল
আকুপাংচারকে নিষিদ্ধ করা। কারণ এটি না কি বুজরুকি ছাড়া আর কিছুই না। যদিও লুকিয়ে চুরিয়ে এই
চিকিৎসা করতেন চিকিৎসকরা কিন্তু প্রাচীন পুঁথিপত্র অনেকই পুড়িয়ে দিয়েছিল
বিপ্লবীরা। তারা অনেক ক্ষতি করেছে মানুষের যে ক্ষতি কোনদিন পূরণ হবার নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমাদের দেশেও আয়ুর্বেদ
চিকিৎসাপদ্ধতি ও যোগাকে অনেক “মুক্তমনারা” বুজরুকি
বলে আখ্যা দেন।
১৯৭১ সালে আমেরিকান
পর্যটকদের একটি দল চীনে যান এবং আকুপাংচার চিকিৎসাপদ্ধতি দেখে মুগ্ধ হন। তারা এর
পুনরুদ্ধার করেন। পরবর্তী কালে চীনে আকুপাংচারের উপর ব্যান উঠে যায়।
ভারতেও আকুপাংচারের
বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচার হয়েছে। কিন্তু তবুও আকুপাংচার চিকিৎসাকে এখানে উচ্ছেদ করা
যায় নি। কারণ অনেক ডিগ্রিওলা ডাক্তারও যখন হাজার হাজার টাকা খরচ করিয়েও সায়াটিকা
বা এই ধরণের অন্য কোন রোগীদেরকে নিরাময়
করতে পারেন না, কিন্তু সেই রোগীরাই আকুপাংচার চিকিৎসায় অল্প দিনেই রোগের কষ্ট
থেকে আরাম পান তখন তারা যে এই চিকিৎসাকেই প্রাথমিকতা দেবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এই চিকিৎসা বেশী প্রচার ও প্রসার লাভ করে নি। কারণ এ ক্ষেত্রে চিকিৎসককে অনেক বেশী
সময় দিতে হয় রোগীর জন্য। ডাক্তাররা চেম্বারে যখন রোগী দেখেন, ধরেন আর ছাড়েন। লম্বা ওষুধের ফর্দ লিখে দেন, তাতে
পাঁচ মিনিটের বেশী লাগে না। কম সময়
ব্যয় করে, কম পরিশ্রম করে বেশী অর্থ
তারা উপার্জন করতে চান, তাতে
রোগীর যাই ক্ষতি হোক না কেন। ওষুধ কোম্পানিগুলিরও ভুমিকা আছে আকুপাংচারকে জনপ্রিয়
হতে না দেওয়ার পিছনে। কারণ আকুপাংচারের
প্রয়োগ ওষুধের ব্যবহার অনেক কমিয়ে দেয়। এমন কি আকুপাংচারের দ্বারা রোগীকে অজ্ঞান
করে অথবা অংশত দেহকে অবশ করে অনেক অপারেশন করা যায়, যেটা
বিদেশে আজকাল হচ্ছে।আকুপাংচার চিকিৎসায় রোগীর ওষুধের প্রয়োজন কমে যায় বা একেবারেই
থাকে না। ফলে ওষুধের ব্যবহারজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ও থাকে না।
কিন্তু এখানে করে খাওয়া লোকেদের লোভের কাছে রোগীর স্বার্থ কিছুই না। এখানে
ডাক্তাররা এই চিকিৎসা সাধারণত করেন না। কিছু আকুপাংচার চিকিৎসক ব্যক্তিগতভাবে
চিকিৎসা করেন। যদিও আমি শুনেছি ডাক্তারি ছাত্রদের আকুপাংচারের শিক্ষাও দেওয়া হয়।
কিন্তু তারা ডাক্তার হওয়ার পর এই শিক্ষার প্রয়োগ করেন না। অথচ ভারতের মত দেশে যেখানে দরিদ্র মানুষের
সংখ্যা অত্যধিক সেখানে আকুপাংচার চিকিৎসাই রোগীর জন্য সর্বোত্তম ছিল।
আকুপাংচার চিকিৎসার
উদ্ভব কি ভাবে হল? অনুমান, অতীতে
মানুষ যখন যুদ্ধ বিগ্রহ বা অন্য
কারণে আহত হত, তীরবিদ্ধ হলে বা শরীরে কাঁটা ফুটলে যখন কিছু রোগ সারতে দেখা যেত, তার থেকেই এই চিকিৎসার উদ্ভব হয়েছে।
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি এই মতে বিশ্বাসী নই। কারণ কোন একটা বিন্দুতে বা একাধিক
কম্বিনেশন বিন্দুতে প্রিকিং করে যখন চিকিৎসক নিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট রোগ সারিয়ে দেন, তখন এই তত্ত্ব ধোপে টেকে না। প্রাচীন আকুপাংচার চিকিৎসকরা আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
আকুপাংচার চিকিৎসার
মূল তত্ত্ব হল – সমস্ত
জীবিত প্রাণীর শরীরে যে শক্তি ক্রিয়াশীল তা হল জীবনীশক্তি। এই জীবনীশক্তিকে চীনা
ভাষায় বলে ছি। জীবনীশক্তি পরস্পর বিপরীতধর্মী দুই শক্তির সমন্বয়ে গঠিত। ‘ইন’ আর ‘ইয়াং’। এই দুই শক্তির সামঞ্জস্যই জীবকে (বা
মানুষকে) সুস্থ
রাখে, ইন
ইয়াংএর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই মানুষকে রোগগ্রস্ত করে।
আমাদের দেহের
স্কিনের কয়েকটি নির্দিষ্ট রেখা দিয়ে এই
জীবনীশক্তি প্রবাহিত হয়। এই রেখাগুলিকে বলে চ্যানেল বা মেরিডিয়ান।প্রতিটি রেখা বা
চ্যানেলগুলি দেহের নির্দিষ্ট অন্তর্যন্ত্রের সঙ্গে ছি এর মাধ্যমে সংযুক্ত
থাকে।যে এই সব চ্যানেলগুলি যে নির্দিষ্ট দেহযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে তার নামকরণও
ওই দেহযন্ত্রের নামেই করা হয়। যেমন হার্ট
চ্যানেল লাং চ্যানেল, স্প্লীন
চ্যানেল, স্টমাক চ্যানেল, স্মল
ইন্টেনস্টাইন চ্যানেল, লার্জ ইনটেনস্টাইন চ্যানেল, কিডনি
চ্যানেল, ইত্যাদি।
প্রতিটি
চ্যানেলে থাকে বিভিন্ন বিন্দু। এই বিন্দুগুলিই হল আকুপয়েন্ট, যেখানে
সূচ বিদ্ধ করে চিকিৎসা করা হয়। শরীরে নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসায় সংশ্লিষ্ট
চ্যানেলের নির্দিষ্ট বিন্দুতে
সূচ ফুটিয়ে (অথবা
অন্য কোনভাবে – যেমন প্রেশার, ইলেকট্রিক
স্টিমুলেশন) উদ্দীপনা
দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট অঙ্গের
রোগ সারানোর জন্য।
উপরের ছবিতে কিছু
চ্যানেল ও তার মধ্যস্থিত বিন্দুগুলি অংকিত হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন ইংরেজিতে
সংক্ষেপে চ্যানেলগুলোর নাম লেখা আছে। LU মানে লাং চ্যানেল, ST
মানে স্টমাক, HT
মানে হার্ট, LV
মানে লিভার, PE মানে পেরিকার্ডিয়াম, GB
মানে গলব্লাডার, KD
মানে কিডনি চ্যানেল। এই চ্যানেল ও বিন্দু
কিন্তু খালি চোখে দেখা যায় না, মাইক্রস্কোপে
দেখা যায় না। কোন ভাবেই এই চ্যানেল ও বিন্দুকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। শুধু এই
চিকিৎসাপদ্ধতির জনকরাই এটার অস্তিত্ব সম্বন্ধে জেনেছেন। তাই বলা যায় এই চ্যানেল ও
বিন্দুগুলি নিরাকার কিন্তু অস্তিত্ববান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থা আকুপাংচার দ্বারা সফলভাবে নিরাময় হয় এমন রোগের তালিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে
আছে শ্বাসতন্ত্রের রোগ - অ্যাকিউট
সাইনুসাইটিস, সর্দি, টনসিলাইটিস, ব্রংকাইটিস, অ্যাস্থমা, ইত্যাদি।
চোখের রোগ – কনজাংটিভাইটিস, মায়োপিয়া, ক্যাটারাক্ট
ইত্যাদি।
পরিপাকতন্ত্রের রোগ – গ্যাসট্রাইটিস, অ্যাসিডিটি, ডিসেন্ট্রি, ডায়রিয়া, কনস্টিপেশন, ইত্যাদি।
নার্ভ মাসল ও হাড়ের রোগ – মাথার যন্ত্রণা, মাইগ্রেন, প্যারালাইসিস, সায়াটিকা, অস্ট্রিওয়ার্থ্রাইটিস
ও আরো অনেক ব্যাধি।
আকুপাংচার একটি
সম্পুর্ণ চিকিৎসাপদ্ধতি এ কথা বলা যায় না। কিন্তু বহু জটিল ও কঠিন রোগে, যেখানে পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও
সফলতালাভ করে নি সেখানে আকুপাংচার আশ্চর্য সুফলদায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। যদি উভয়
পদ্ধতিকে এবং আয়ুর্বেদ যোগ ন্যাচারোপ্যাথিকে সম্মিলিতভাবে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো যায় তবে সেটাই সঠিক হবে।
[রুমনী সেন]