[পর্ব –সাত ]
সোনাইয়ের মেয়ে হয়েছে। বড়মেসোর মুখ হাঁড়ি। খুব আশা ছিল, ছেলে হবে। সবাই অবশ্য ছেলেই ভেবেছিল। দুগ্গাপুজোর ঢাকের মতো ফুলে উঠেছিল পেট। মানে একটা গাব্দা-গোব্দা সাড়ে তিন কিলোর ছেলে। মেয়ে হলে কি ওরকম পেট হয়? মেয়ে মানেই তো একটা তুলতুলে ছোট্ট আড়াই কিলোর মাংসপিন্ড। আজ সকালে মেয়েটার একটা নাম ঠিক করেছি আমি। ঊর্জস্বী। সূর্যের আলোয় যে মেয়ের জন্ম। অথবা আনন্দী। ইস আমার যদি এরকম একটা নাম হতো! ঊর্জস্বী কিম্বা আনন্দী। এইসব নাম সেই নামধারী মানুষটির মনে অন্যরকম একটা আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। একটা শান্ত অথচ উজ্জ্বল প্রত্যয়। না, মিতুল। যার কোনও মানেই নেই। আমার খুব ধারণা, এই নামটাই কোনওদিন বড় হতে দিল না আমাকে। আজীবন কচি খুকি করে রেখে দিল। বাবা সাধ করে শৈলেন ঘোষের এক অপূর্ব রূপকথার চরিত্রের নামে নাম রেখেছিল আমার। পরে যখন বইটা পড়লাম, জানলাম সেটি আসলে একটি পুরুষচরিত্র, যা রাগ হয়েছিল বাবার ওপর! সুমন অবশ্য পরে কোনও একটা অভিধান ঘেঁটে বলেছিল, 'মিতুল' নামের মানে হল সুন্দর বন্ধু। সুমন তখন বন্ধুদের নামের মানে খুঁজে বেড়াত। আমার খুব সন্দেহ হয়, সুমন আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই কথা বলেছিল।
আমাদের দুই বোনেরই এই নাম নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি ছিল। তুতুলের তো রাগ আরও বেশি ছিল। কেউই নাকি ওর নাম একবারে উচ্চারণ করতে পারত না। তুতিল, তুতলি, পুতুল, তুলতুল- এই সব নানারকম উচ্চারণ ওর নামের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হত। আমার বেলাতেও হয়েছে। গড়িয়াহাট বাণীচক্রে গান শিখতে গেছি কুমুদবাবুর কাছে, কুমুদবাবু আমার নাম শুনে বললেন, "অ, মিঠুন? চক্কোত্তি নাকি?" আসল নাম ঠিকঠাক জানার পরেও সবার সামনে আমাকে মিঠুন বলেই ডেকে এসেছেন। আমৃত্যু। একা থাকলে অবশ্য মিতুল-ই বলতেন। ওঁর লায়েলকার বাড়িতে শিখতে যেতাম যখন, ফুর্তির আতিশয্য হলেই জানলা দিয়ে আকাশ দেখিয়ে বলতেন, "ওইখানে তুলে দেব।"
অর্থাৎ ওঁর কাছে গান শিখলে চন্দ্র-সূর্যের পাশে আমার ঠাঁই হবে। বলেই ফিরে প্রশ্ন করতেন, "কোনখানে?"
আমি মিনমিন করতে করতে জানলার দিকে আঙুল তুলতাম। একবার স্বগতোক্তি করেছিলাম,
"যদি পড়ে যাই?" ঠিক কানে গেছিল বুড়োর। শুনে সে কী তম্বি আমার ওপর!
ভালোও বাসতেন তেমনি। জেঠিমা, মানে কুমুদবাবুর স্ত্রীর কাছে শুনেছি, একদিন আমি যেতে না পারলে নাকি ঘর-বার করতেন। মাঝেমধ্যে চিঠিও লিখতে বসে যেতেন আমাকে, "মা মিতুল, তুমি আসিতে পারো নাই, আমি অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত।"
তারপর যেদিন যেতাম, ছেলেমানুষের মতো খুশিতে লাফালাফি করতেন। ওইরকম ফুর্তিবাজ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। পণ্ডিত ছিলেন। দর্শনে ডক্টরেট করেছিলেন। গানবাজনার থিওরির ওপর বই লিখছিলেন একটা। শেষ করে যেতে পারেননি।
কুমুদবাবুর ভালো নাম ছিল কুমুদরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। সরস্বতী পুজোর দিন জন্মেছিলেন বলে প্রতিবছর সেই বিশেষ দিনটিতেই ওঁর জন্মদিন পালন করা হত। সেদিন সন্ধেবেলা ওঁর বাড়িতে গানবাজনার আসর বসত। সেই আসরে অবিশ্যি ওঁর ছেলেমেয়ে আর ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর বিশেষ কেউই থাকত না। গানবাজনা, খাওয়াদাওয়ার পর সেদিন আমার আর বাড়ি ফেরা হত না। টালিগঞ্জে মেজোমামার বাড়ি থেকে যেতে হত।
কুমুদবাবুর পৈতৃক বাড়ি ছিল বসিরহাটে। আমার বড়মেসোর দাদা ওঁর বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে ফুটবল খেলতেন। বড়মেসোর দাদার ভালো নাম ছিল নির্মল। আর ডাকনাম ভেজাল। একই লোকের দুটো নামের এইরকম বৈপরীত্য আমি জীবনে আর দ্বিতীয়বার শুনিনি। এই ভেজালমামা টাকী-বসিরহাট অঞ্চলে রীতিমতো বিখ্যাত ছিলেন তার ডাকসাইটেপনার জন্য। শোনা যায়, একবার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ট্রেনে উঠেছেন, কারও পকেটে টিকিট নেই। ওইসব লাইনে সচরাচর টিকিট-কালেক্টর উঠত না, কিন্তু কী কপাল, সেদিনই উঠেছে। প্রখমে সাধারণ কথা-কাটাকাটি, তারপর ঝগড়া, সেখান থেকে হাতাহাতি। ট্রেন তখন নদীর ওপর ব্রিজ পার হচ্ছে। টিকিট-কালেক্টরকে টিকটিকির মতো তুলে নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন ভেজালমামা। ভাগ্যিস নদীতে তেমন জল ছিল না, হাজামজা ছিল সে নদী। তাই সে যাত্রায় প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন ভদ্রলোক।
[মিতুল দত্ত]