ও আমার দরদী, আগে জানলে!
তিন দিন আগের ছোট্ট ঘটনা। ওয়ালমার্টে ইদানিং
হরেক রকমের মানুষ আসে, কেউ আসে জাপান থেকে, কেউ সাইবেরিয়া, কেউ মঙ্গোলিয়া, কেউ হাঙ্গেরী, বিরাম নেই অতিথি পাখী আসার, আসেনা শুধু বাংলাদেশের কেউ। আমি একা বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকি।
সেদিন লম্বা চওড়া এক সাদা সাহেব এসে উপস্থিত, উনার হাতে ধরা মোবাইল ফোনে কী জানি সমস্যা
হয়েছে। এই এক ঝামেলা, আরে, আমরা মোবাইল ফোন ফেরীওয়ালী, ফোন বেচা আমাদের ব্যবসা, ফোন একবার বিক্রী করে দিলে জিনিস তোমার, তুমি ফোন গলায় ঝুলিয়ে রাখো, মন চায় ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখো, ফোন টয়লেটে ফেলে দাও, মন চায় তো স্যুটকেসে রেখে দাও, যাই করো, সব তোমারই ইচ্ছা।
পান্নালাল ভট্টাচার্য্য যেমনি গেয়েছেন,
“ সকলি তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি, তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি” অবস্থা হয়েছে আমাদের। আরে, ফোন কিনে নিয়ে গিয়ে কী না কি করে, কয়দিন পর ফিরিয়ে এনে বলে,
“ তোমাদের কাছ থেকে কিনেছি, এখন তোমরা ঠিক করে দিবে”। মামার বাড়ীর আবদার আর কী, আগে তোতলাতাম কঠিন কথা বলতে, এখন তোতলাইনা, বলে দেই, আমরা এখানে ফোন সারাইয়ের কাজ করিনা।
আমার তেরছা কথা শুনে অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়, আবার কাউকে হেল্প করলে নিজের গায়ের চামড়া খুলে
একেবারে আমার গায়ের শাল বানিয়ে দিতে চায়। যার কথা বলছিলাম, সেই হোয়াইট বিশালদেহীর ফোন বন্ধ হয়ে গেছে, আমাকে বলে ফোন ঠিক করে দিতে। বললাম, আমাদের এখানে ফোন সারাইয়ের যন্ত্র নেই, তোমার ফোনের বয়স তো মনে হয় অনেক হয়েছে, এমনিতেই দম বেরনোর সময় হয়েছে, আরেকটি ফোন কিনে ফেলো।
বিশালদেহী বলল, তার নিজেরও মনে নেই ফোনের বয়স কত বছর হয়েছে। ফোন
চলছে ঠিকই, তবে ইদানিং কল ড্রপ করে। আর কোন সুবিধা নেই দেখে
শেষে সে সস্তা দামের ফোন কিনতে রাজী হলো, আমাকে বলল, সিম পাল্টাতে সাহায্য করতে। আমি সিম পালটে দিচ্ছি আর প্যাঁচাল পারছি, কল ড্রপ করা প্রসঙ্গেই বিশাল দেহী বলল, সে ফিশিং করতে ভালোবাসে, প্রতিদিন ফিশিং করে, কিন্তু ইদানিং লেকের পাড়ে গেলেই কল ড্রপ করে ।
কথা বলার জন্য যে কোন প্রসঙ্গ পেলে আমার কাছে ছাড়াছাড়ি নেই, জিজ্ঞেস করলাম,
-তুমি মাছ ধরো?
-হ্যাঁ, মাছ ধরি
-অনেক মাছ ধরা পড়ে?
-তা পড়ে, অনেক মাছই ধরা পড়ে
-আমেরিকানরা তো খুব বেশী মাছ খায় না, এত মাছ কি করো, আবার জলে ছেড়ে দাও?
-না, খাই।
-কীভাবে খাও, ভেজে নাকি গ্রিল করে?
-দুই ভাবেই খাই
-এত মাছ ধরো, কে পরিষ্কার করে দেয় মাছ
-আপনা হাত জগন্নাথ, আমার কাজ আমিই করি, আর তো কেউ নেই।
-কীভাবে খাও, ভেজে নাকি গ্রিল করে?
-দুই ভাবেই খাই
-এত মাছ ধরো, কে পরিষ্কার করে দেয় মাছ
-আপনা হাত জগন্নাথ, আমার কাজ আমিই করি, আর তো কেউ নেই।
বুঝলাম ঘরপোড়া গরু! ঘর সংসার বলে কিছু নেই, এই প্রসঙ্গে আমার কিছুই বলার নেই। হাতের কাজ
প্রায় শেষ, দেখি আরেক ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন। ইনি অবশ্য
বিশাল দেহী নন, গড়পড়তা বাঙ্গালীদের মত শরীর স্বাস্থ্য, দেখে তেমন কোন ড্যাশিং মনে হয় না। আমাদের মুখে
মাছ ধরা এবং মাছ খাওয়ার কথা শুনেই কম ড্যাশিং সাহেব বিশাল দেহী সাহেবের সাথে মাছ
ধরা নিয়ে আলাপ জুড়ে দিল। সেও নাকি মাছ ধরায় ওস্তাদ। দুই জেলে সাহেবের কথপোকথন কানে
আসছিল, কম ড্যাশিং সাহেব ক্যালিফোর্নিয়া থাকেন, মিসিসিপি এসেছেন মেয়ে জামাইয়ের কাছে বেড়াতে।
মেয়ে জামাই এয়ারফোর্সে পাইলটের চাকরী করে, মিসিসিপিতে এয়ারবেসে ট্রেনিং চলছে।
পাইলটের শ্বশুর, অর্থাৎ কম ড্যাশিং জেলে সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-তুমি কী ইন্ডিয়ান?
বললাম, “বাংলাদেশ চেনো?
-ইয়েস, আই নো, কাম করিছো।
ইংরেজী লোক এ আবার কোন ভাষা বলে! বুঝলাম এ লোক নির্ঘাৎ আমাকে মেক্সিকান ভেবেছে, ক্যালিফোর্ণিয়ার মানুষ স্প্যানিশ ভাষা জানে।
তাই হয়তো আমার সাথে স্প্যানিশ বলছে। বললাম, সরি! আমি মেক্সিকান নই, বাংলাদেশের মেয়ে, স্প্যানিশ বুঝিনা।
আমি তো অবাক, জেলে সাহেব বলছে ইংলিশ, অথচ দাবী করছে বাংলা বলছে। বললাম, কাম করিছো, মানে কী?
- আমার কিছু ইন্ডিয়ান বন্ধুর কাছ থেকে শিখেছি।
- এবার বুঝে গেছি, বলতে চাইছে, কাজ করছো, সাথে সাথে হেসে ফেললাম, সায় দিলাম, হ্যাঁ, কাম করিছি।
বিশালদেহী সাহেব উৎসাহের চোটে বলল, আমিও বিদেশী ভাষা বলতে জানি, একটা মাত্র চাইনীজ ওয়ার্ড, যার মানে খুব বাজে।
- আমার কিছু ইন্ডিয়ান বন্ধুর কাছ থেকে শিখেছি।
- এবার বুঝে গেছি, বলতে চাইছে, কাজ করছো, সাথে সাথে হেসে ফেললাম, সায় দিলাম, হ্যাঁ, কাম করিছি।
বিশালদেহী সাহেব উৎসাহের চোটে বলল, আমিও বিদেশী ভাষা বলতে জানি, একটা মাত্র চাইনীজ ওয়ার্ড, যার মানে খুব বাজে।
-মনে মনে বলি, এই সেরেছে, কি মানে কে জানে।
কিন্তু কম ড্যাশিং সাহেব খুব উৎসাহ দেখালো একটি মাত্র চায়নীজ শব্দ শোনার জন্য।
কিন্তু কম ড্যাশিং সাহেব খুব উৎসাহ দেখালো একটি মাত্র চায়নীজ শব্দ শোনার জন্য।
বিশালদেহী কী জানি ‘চুং বা চেং নাকি পিং পেং বলল বুঝলামনা, কিন্তু মানে বলল, হিসি করা। চায়নীজ ওয়ার্ডের মানে শুনে কম ড্যাশিং
সাহেব হেসে ফেললো, আমি না শোনার ভান করলাম। চট করে মনে পড়ে গেলো ১৯
বছর আগের এক ঘটনা।
সবে অস্ট্রেলিয়া গেছি, সেটাই ছিল আমার প্রথম প্রবাস জীবন। প্রবাস
জীবনের শুরুর দিকে আমার অবস্থা এমন ছিল, যাকে দেখি তার সাথেই ভাব করতে ইচ্ছে করে, দেশী চেহারার হলে তো কথা নেই, আধা বাংলা, আধা ইংলিশে কথা বলা শুরু করে দেই, বাসায় আসার জন্য নেমন্তন্ন করি। তো একদিন হয়েছে
কি, আমার বরের ( উত্তম কুমার) সাথে শপিং সেন্টারে গেছি। আমার চোখে তখন আশপাশে যা কিছু
দেখি, তার সবই বিশাল মনে হয়, এমনকি
পাড়ার শপিং মলটাও ছিল বিশাল। শপিং মলে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম, উত্তম একটা দোকানে ঢুকেছে, আমি বাইরে বেঞ্চে বসে আছি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি এক
ইয়া বিশাল দেহী সাহেব আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি বুঝিনি সাহেব আমাকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে। তখনও সাহেব
মেমদের সাথে ইংলিশ বলতে শিখিনি, অথচ সাহেব আমার সামনে এসে উপস্থিত, জিজ্ঞেস করলো, কোথায় আমার দেশ?
একটু অবাক হয়েই বললাম, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ শুনেই সাহেব বলল,
-আমি ইস্ট পাকিস্তানে ছিলাম।
-তাই নাকি? খুশীতে আমার ঐখানেই লাফ দেয়ার অবস্থা, এতদিনে একজন সাহেব পাইলাম যে বাংলাদেশে ছিল।
-সে বলল, আমি লিবারেশান ওয়ার শুরু হওয়ার আগে তিন বছর ঢাকা, চিটাগাং ছিলাম। তখন বেশ কিছু বাংলা শিখেছিলাম।
-বলি, তুমি বাংলাও শিখেছো? তুমি ওখানে কী করছিলে? তুমি কী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম জানো?
-আমি ইস্ট পাকিস্তানে ছিলাম।
-তাই নাকি? খুশীতে আমার ঐখানেই লাফ দেয়ার অবস্থা, এতদিনে একজন সাহেব পাইলাম যে বাংলাদেশে ছিল।
-সে বলল, আমি লিবারেশান ওয়ার শুরু হওয়ার আগে তিন বছর ঢাকা, চিটাগাং ছিলাম। তখন বেশ কিছু বাংলা শিখেছিলাম।
-বলি, তুমি বাংলাও শিখেছো? তুমি ওখানে কী করছিলে? তুমি কী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম জানো?
-বলল মুজিবকে অবশ্যই মনে আছে, ব্যবসার কাজে গেছিলাম, তখন তো পাকিস্তানে শুধু মুজিব আর নৌকা।
-বাংলা কী এখনও মনে আছে? মাত্র তিন বছরে কী করে বাংলা শিখেছিলে?
-রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকে বাংলা শিখেছি।
-রিকশাওয়ালাদের কাছে বাংলা শিখেছো?
-হাঁ, রিকশাওয়ালাদের সাথে খুব খাতির ছিল আমার, ব্যবসার কাজে এখানে ওখানে দৌড়াতে হতো, ট্যাক্সি অথবা রিকশা, রিকশাতে চড়তে মজা লাগতো, রিকশা বেশী চড়তাম, তখন ওদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওরা তো ইংলিশ
পারতো না, আমিও বাংলা পারতাম না, কিন্তু ওদের কথাবার্তা খুব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা
করতাম, তখনই ওদের কাছ থেকে বাংলা শিখেছি। এখনও কিছু মনে
আছে।
-বাংলা মনে আছে? ওহ মাই গড! কী কী মনে আছে? একটু বলো প্লীজ!
-খাঁটি বাংলা উচ্চারণে সে বলল, বানচোত, শালা মনে আছে, আরও মনে আছে, ভালো কথা না, সবই গালি।
-খাঁটি বাংলা উচ্চারণে সে বলল, বানচোত, শালা মনে আছে, আরও মনে আছে, ভালো কথা না, সবই গালি।
এমন বাজে ওয়ার্ড শুনে আমার খুব খারাপ লাগা উচিৎ
ছিল, কিন্তু সত্যি বলতে কি, খারাপ লাগছিলো না, বিদেশ বিভুঁইয়ে, চারদিকে কঠিন ইংলিশের রাজত্বে, একজন অস্ট্রেলিয়ান সাহেবের মুখে বাংলা উচ্চারণে
গালিগুলোকেও খুব মধুময় মনে হচ্ছিল, সাহেবকে মনে হচ্ছিল কত আপনার জন।
এরপর সে ‘চ’ বর্গীয় আরও কঠিন গালি শোনাতে লাগলো, এসকল ভয়াবহ গালি শুনে আমার খারাপ লাগছিল, কিন্তু মুখের চেহারায় কিশোরী সুলভ হাসি ধরে
রেখেছিলাম। সে জানালো, রিকশাওয়ালাদেরকে সে অতিরিক্ত পয়সা দিত গালি
শেখানোর জন্য। আমি ধারণাও করতে পারিনি, একজন বিদেশী এমন খাস বাংলায় একেবারে আদি ও অকৃত্রিম গালি
শোনাবে। আমার মনে হলো, কেউ যদি শুনে ফেলে একজন সাহেব আমাকে হাসতে হাসতে
অসহ্য রুকমের গালিগালাজ করছে, আর আমি সেই গালি খুব এনজয় করছি, লজ্জা এবং ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো।
আমি বলি, ভাল বাংলা না শিখে তুমি গালি শিখতে চেয়েছিলে কেন?
-বলে, সে পথের জীবন খুব এনজয় করতো, রিকশাওয়ালাদের ঝগড়া এনজয় করতো, বাংলা শেখার জন্য তো সে বাংলা শিখেনি, রিকশাওয়ালাদের ভাষা আয়ত্ব করার জন্য সে বাংলা
শিখেছে। ঝগড়ার সময় তারা যেভাবে একে অপরকে ‘চ’, ‘খ’ আদ্যক্ষর যুক্ত শব্দ ব্যবহার করে গালি দিত, বাপের নাম তুলে, মা, বোনের সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে গালি দিত, সেসব গালি তার কাছে নাকি খুব ভালো লাগতো।
আমি বললাম, থাক, আর বলতে হবেনা। এইসব গালি শুনতে ভালো লাগেনা।
এরমধ্যেই উত্তম কুমার দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে উত্তমের সাথে বিশালদেহী
গালিবাজ সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিলাম। উত্তম তো ‘হেলো’ বলেই সারা, আমি এবার সাহেবকে নেমন্তন্ন করে বসলাম। বললাম, বিদেশে এই প্রথম একজন সাহেবকে পেলাম, যে বাংলা বলতে পারে,
সাহেব বলে, কিন্তু সব বাংলা পারিনা, শুধু গালি বলতে পারি।
আমার কোন হুঁশ নেই, বলি, তুমি আমাদের বাসায় বেড়াতে এসো, তোমার নেমন্তন্ন রইলো। বাংলা খাবার খাওয়াবো, পোলাও, মাংস। আমাদের ফোন নাম্বার লিখে নাও, তোমার ফোন নাম্বার দাও, আমি তোমাকে কল দেবো।
ফোন নাম্বার দেয়া নেয়া সেরে সাহেব চলে গেলো।
আমি উত্তমের সাথে ঝুলোঝুলি লাগিয়ে দিলাম এই সাহেবকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমন্তন্ন খাওয়াবো বলে।
উত্তম তো এক ধমক দিয়ে উঠেছে,
‘আরে, এই রকম সাহেব আরও অনেক দেখবে, সবাইকেই তুমি বাসায় নেমন্তন্ন করবে নাকি? চেনো না , জানো না, নেমন্তন্ন করে বসে থাকো।
-কী বলো, চিনিনা বলে কী চিনবো না? বাংলা জানে সাহেব।
-দেখলাম তো, বাংলা জানার ছিরি, তোমাকে নিয়ে তো পারা গেলো না, কোথাকার কোন লোক, বাংলা বলার নাম করে কতগুলো নোংরা গালি শুনিয়ে
গেলো, সেই লোককে এখন বাড়ীতে ডেকে নিয়ে যাবো, পাগল নাকি?
আমরা সেই শপিং মল থেকে বেরিয়ে এলাম, সেই সাহেব আমাদের বাসায় কোনদিন ফোন করেনি, আমরাও ফোন করিনি সাহেবকে। কিন্তু মনে মনে সেই সাহেবকে অনেক খুঁজেছি। আমার সব সময় মনে হয়েছে, বিদেশের মাটিতে বিদেশীর মুখে আমার মাতৃভাষা শুনাটাই বড় কথা, সে ভাষা বুলিই হোক আর গালিই হোক, মিষ্টতার দিক থেকে কোন কম বেশী তো নেই।
[রীতা রায় মিঠু]