>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • সৌম্য সেনশর্মা

    SongSoptok | 12/10/2014 |



    বৃহৎ বঙ্গীয় শব্দকল্পদ্রুম

    (এক)

    কি নিলয়, প্রোজেক্টটা তাহলে এতদিনে শেষ হলো! খুব খাটিয়েছে যাহোক তোমাকে তো বটেই, আমাকেও আর হ্যাঁ, তোমার কাজ কিন্তু চমৎকার হয়েছে, বুঝলে! তুমি না থাকলে যে কি হতো, ভাবতেও ভয় লাগে

    একটানা এতগুলো কথা বলে ফেলার পর দম নেওয়ার জন্য থামেন প্রফুল্লবাবু একসঙ্গে বেশী কথা বলার বদ অভ্যাস তাঁর নেই বিশেষ করে নিলয়দের মত মানুষদের সঙ্গে তিনি যে সামাজিক স্তরের বাসিন্দা, এবং যে পদ অলঙ্কৃত করে তাঁর অবস্থান, সেখানে বেশী কথা বলার প্রয়োজনও যে খুব একটা পড়ে, এমন নয় আকার বা ইঙ্গিতকে অর্থবহ করে প্রাঞ্জলভাবে বুঝে নেবার জন্য সেখানে তার মোসাহেবরা সদাই মোতায়েন তাছাড়া অপচয় প্রফুল্লবাবুর দু-চক্ষের বিষতা সে অর্থেরই হোক, কিংবা কথারই হোক

    দম নেওয়া শেষ হওয়াতে এবার তাঁর নজর পড়লো নিলয়ের দিকে মাথা নীচু করে তাঁর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একমনে বুড়ো আঙুলের নখে দামী কার্পেটের রোঁয়া খুঁটে চলেছে নিলয় নিলয়, অর্থাৎ নিলয় সেনগুপ্ত, অর্থাৎ তালঢ্যাঙ্গা, উটের মতো বেখাপ্পা শরীরের উলোঝুলো অবিন্যস্ত একটা চেহারা বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিণ প্রযুক্তির ভারতবিখ্যাত সংস্থা দধীচি-র মেধাশ্রমিক নিলয় সেনগুপ্ত সেই নিলয়, স্বভাববিরুদ্ধ হলেও আজকের দিনটাতে যার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠার কথা যার হাতযশেই আজ ইন্দ্রপ্রস্থ প্রজেক্টের সাফল্য 

    - ‘কি হে, চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব একটা খুশি নও? কি ব্যাপার?
    - ‘তা কেন স্যার, খুশিই তো হয়েছিনিলয়ের মুখে তবু কালো পর্দা
    - ‘সকালের কাগজগুলো দেখেছো? আমাদের গুণে তো নুন দেওয়ার জায়গা নেই!’
    - ‘এখনো দেখা হয়ে ওঠেনি স্যার

    আসলি মেহগনি কাঠের বিশাল টেবিলের বাঁদিকের টানা থেকে এবার একগোছা দৈনিক পত্রিকা টেনে বার করেন প্রফুল্লবাবু প্রত্যেকটির শিরোনামেই দধীচিসংস্থার সাফল্যের খবর চশমাটা ঠিক করে নিয়ে পড়তে শুরু করার আগে হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল যে নিলয় তখনো দাঁড়িয়ে

    - ‘আরে দাঁড়িয়ে কেন, বসো শোনো কি লিখেছে দৈনিক বার্তাবহ

    প্রতিরক্ষা দপ্তরের, এবং প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ের তথ্য, খবর এবং হিসাব রাখা এবং এই সমস্ত বিষয়ের কার্যকারণে উদ্ভূত ঘটনাবলীর সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অসীম মেধাসম্পন্ন একটি যন্ত্রগণক তৈরীর যে কাজ ভারত সরকার বিখ্যাত সংস্থা দধীচি হাতে ন্যস্ত করেছিল, তা আজ সাফ্যলের সঙ্গে সম্পূর্ণ করা হয়েছে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনার প্রতিরক্ষাজনিত গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণের যে তীব্র প্রয়োজন আজ অনুভূত হচ্ছে, তার সম্পূর্ণ সময়োপযোগী সমাধান এই প্রকল্পটি, যা সরকারী পরিভাষায় প্রোজেক্ট ইন্দ্রপ্রস্থনামে পরিচিত, সেটি হাতে নেওয়া হয়েছিল দক্ষতা এবং কার্যকারিতার নিরিখেদধীচিনির্মিত যন্ত্রগণকের ক্ষমতা অসীম উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের যাবতীয় তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য কী কী ঘটনা আগামী দিনগুলিতে ঘটতে পারে, এবং সেগুলি মোকাবেলায় সরকারী দপ্তরগুলির কী কী করণীয়, তা ইন্দ্রপ্রস্থইতিমধ্যেই গণনা করে বলে দিয়েছে, এবং তার গণনা যে শতকরা ৮০ ভাগ সত্যি, এমন নগদ প্রমাণও পাওয়া গেছে উত্তরাখণ্ড, তেলেঙ্গানা, আজাদ কাশ্মীর, বৈরী মিজো, উলফা বা মণিপুরের উগ্রপন্থীদের কার্যকলাপে যে আস্থিতির পরিবেশ আজ ভারতবর্ষে সৃষ্ট হয়েছে তজ্জনিত ক্ষেত্রে ব্যবস্থাগ্রহণ আজ ইন্দ্রপ্রস্থর কল্যাণে অত্যন্ত সহজ হয়ে গিয়েছে কেবল তাইই নয়; এই ঘটনাগুলির পিছনে কোন কোন বৈদেশিক শক্তির কত আনা কত পাই মদত আছে তাও ইন্দ্রপ্রস্থর নখদর্পণে ভারতের প্রতিরক্ষার ইতিহাসে ইন্দ্রপ্রস্থতাই এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ কেবলমাত্র প্রতিরক্ষার ব্যাপারেই যেইন্দ্রপ্রস্থতার সিলিকনগঠিত মস্তিষ্ক ঘামাবে এমনটাও নয় প্রতিরক্ষার খাতিরে দেশের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কিংবা উৎপাদন কিভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ তার খুঁটিনাটিগুলিও এবার থেকে স্থির করবেইন্দ্রপ্রস্থ

    যে সংস্থার সুদক্ষ পরিচালনায় ইন্দ্রপ্রস্থগড়ে তোলার এই দুরূহ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, সেই দধীচির নির্দেশক ডঃ প্রফুল্লকুমার সরখেল দাবী করেছেন যে এই মূহুর্ত্তে ইন্দ্রপ্রস্থহল পৃথিবীর ক্ষিপ্রতম যন্ত্রগণক প্রমাণস্বরূপ তিনি জানান যে ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল নির্মাণের যে কাজ অন্য একটি সরকারী গবেষণাগারে আজ ছমাস ধরে চলছিলো, তা মাত্র ১৬ ঘণ্টা ৬ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডে সমাধান করে ফেলেছেইন্দ্রপ্রস্থ মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের নকশা প্রস্তুত করার যে কাজ ভারতীয় বিজ্ঞানীরা ইদানীং হাতে নিয়েছেন তার ক্ষেত্রেওইন্দ্রপ্রস্থর অবদান অসীম উচ্চমেধাসম্পন্ন শীর্ষস্থানীয় ৪০ জন গবেষকদলের এক মাসের হিসাবনিকাশের কাজইন্দ্রপ্রস্থসম্পন্ন করেছে মাত্র ২৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ড সময়ে উল্লেখ্য, এর ফলে মোট ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৩৪১ পাতা ফুলস্ক্যাপ কাগজ বেঁচে গিয়েছে, সাধারণ অবস্থায় যা এই সমস্ত হিসাবনিকাশের জন্য প্রয়োজন হতো ডঃ সরখেলের মতে, ‘ইন্দ্রপ্রস্থর কল্যাণে ভারতবর্ষ আজ আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে ……

    খবরের কাগজের পাতা থেকে চোখ তুলে তাকাতেই প্রফুল্লবাবুর চোখে পড়লো নীলুর করুণ বিষণ্ণ মুখখানা ছোকরার নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে পরিবেশটাকে আবারো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় তিনি বললেন, ‘কি হে, শুনে গর্ব হচ্ছে না?’
    - ‘অবশ্যই স্যারতাহলে কি ওকে উৎসাহব্যঞ্জক কিছু বলা দরকার?
    - ‘এই সাফ্যলের পিছনে তোমার নিজের অবদান ঠিক কতটা, তা তো তুমি ভালোভাবেই জানো নীলুএকটু ঘনিষ্ঠ, অথচ পিতৃসুলভ ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন প্রফুল্লবাবু ছেলেটার রকম সকম তাঁর মোটেই ভালো ঠেকছে না চাকরি ছাড়ার মতলব করছে না তো? তা হলেই তো চিত্তির! এত অল্প পয়সায় এই ক্যালিবারের ছেলে তিনি পাবেন কোথায় এই মন্দার বাজারে? ‘সত্যি কথা বলতে কি, তোমার নকশাগুলো না থাকলে ইন্দ্রপ্রস্থের স্ফটিকের ইঁটই তো গাঁথা হয়ে উঠতো না, হেঁ হেঁ হেঁ

    নিলয়ের মুখ তবুও কালো, নিলয়ের মুখ তবুও নীচু তার পায়ের নখ এখন ঘন নীল কার্পেটে ভারতের মানচিত্রে রক্তাক্ত কাশ্মীরের রূপরেখা এঁকে চলেছে নীলুর চোখ এখন প্রফুল্লবাবুর হাতের দিকে দু হাতে আটটা আংটি বেঁটে বেঁটে আঙ্গুলগুলো একটা চকচকে জেমক্লিপের বাঁকগুলো টেনে সোজা করছে লোকটার আঙ্গুলগুলো বিচ্ছিরি প্রফুল্লবাবুর মুখটাও তার পছন্দ নয় তার পছন্দ নয় কলাপের সাহায্যে ষাটেও সতেজ কালো চুল, পছন্দ নয় রীমলেস চশমার ফাঁকে মরা ইলিশের মতো ভাবলেশহীন অথচ সন্ধানী দৃষ্টি, পছন্দ নয় দুনিয়ার উপর শ্লেষে বেঁকে থাকা তার স্ফীত ক্রূর ঠোঁট কে যে লোকটার নাম দিয়েছিল প্রফুল্ল, কে জানে; তবে সে নিশ্চয়ই অন্ধ ছিল নাঃ, এক কথায় ঘোরতর অপছন্দের একটি খল চরিত্রপ্রফুল্লবাবুর সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তে এলো নিলয়

    - ‘খোলা হাওয়ায়, সমুদ্রের ধারে নিখাদ ওজোনের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটিয়ে এসো, বুঝলেপ্রফুল্লবাবু একাধারে পর্যটন বিভাগের সচিত্র ক্যাটালগ এবং ভ্রমণসঙ্গীকোভালম-ই ভালো, বুঝেছ! শুনেছি ……’ এবার গলা খাদে, ভঙ্গি প্রায় ষড়যন্ত্রকারীর………… ‘শুনেছি এখন ওখানে নাকি নগ্নবক্ষ সুইডিশ সুন্দরীদের ভিড় জমে যায়জিভ দিয়ে স্ফীত ঠোঁট চেটে দরাজ গলায় হাসলেন তিনি….. ‘আরে, এই তো চুটিয়ে বাঁচবার বয়স যাও ঘুরে এসো আর হ্যাঁ, তোমার যাবতীয় খরচ যে কোম্পানিই দেবে, সেটা বলাই বাহুল্য’     

    নিলয়ের নামানো মুখের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে প্রফুল্লবাবু উলোঝুলো, আলাভুলো নিলয় ছোকরা মহা নোংরা জামাকাপড়ে ইস্তিরি নেই, চুল কাকের বাসা, বোতাম ছেঁড়া ফুলসার্টের হাতায় হলুদের দাগ জঘন্য!!

    - ‘ছুটিটা তোমার দরকার, নিলয়প্রফুল্লবাবু এখন আর করুণাময় পিতা নন, ‘দধীচির নির্দেশক বলেইছি তো, সমস্ত খরচা আমাদেরগলায় ইস্পাতের ঝিলিক
    - ‘ঠিক আছে স্যার, আপনি যদি জোর করেন
    - ‘দিন পনেরো কেন, একমাসই ছুটি দিলাম তোমায়দাক্ষিণ্যের প্রতিমূর্তি প্রফুল্লবাবু ঘুরে এসো, খাও, দাও ফূর্তি করো

    এবার উঠে পড়লেন প্রফুল্লবাবু অপচয় তিনি পছন্দ করেন না অথচ এই ছোকরার জন্য বরবাদ হল নাহক আধঘন্টা
    উঠে পড়ল নিলয়ও উটের মতো বেখাপ্পা শরীরটা টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সেল সে বাঁ পা-টা ল্যাছড়াতে ল্যাছড়াতে

    (দুই)
    অফিস ছুটির পর নীড়প্রত্যাশী ভিড় ঠেলে ক্লান্ত পায়ে নিলয় যখন মধ্য কলকাতার দু-কামরার বাড়ীটাতে ফিরল, তখন সন্ধ্যা উৎরে গেছে অনেকক্ষণ জামাকাপড় ছাড়াছাড়ির বালাই তার কোনকালেই নেই কোনমতে রান্নাঘর থেকে এক পেয়ালা চা ছেঁকে সোজা নীলু গিয়ে হসে তার পড়ার টেবিলে সেটা তার মালিকের মতোই অগোছালো স্তূপীকৃত বইয়ের উপর জন্মের ধুলো একগাদা আলগা পাতা, গুচ্ছের সাপ্তাহিকী, হজমের ওষুধের খালি শিশি, ইত্যাদি নানা টুকিটাকি একদিকে লাদাই করে কোনরকমে একখানা খাতা রাখার জায়গা করা হয়েছে খোলা খাতায় দেখা যাচ্ছে কালো কালিতে লেখা একটা লাইনবোধহয় কোন গল্পের প্রারম্ভিক খসড়া

    চা খেতে খেতে লেখা লাইনটার দিকে তাকিয়ে থাকে নিলয় সস্তার সিটিসি চা পাতার তিক্ত কষায় স্বাদে মুখটার সঙ্গে সঙ্গে মনটাও তেতো হয়ে গেল তার অভ্যাসমতো বিড়বিড় করে পৃথিবীর যাবতীয় অপছন্দের বস্তুগুলিকে গাল পাড়তে থাকে নিলয় চুলোয় যাক ছুটি, গোল্লায় যাক কলকাতা শহরের বিজবিজে ভীড় বা কোভালমের যাবতীয় আকর্ষণ, ভোগে যাক ইলিশাক্ষ প্রফুল্লবাবু, চুলোয় যাক চাকরি, সে নিজে………

    এবং সেই মূহুর্তেই দপ করে জ্বলে ওঠে তার নিস্তেজ দুই চোখ খাবি খাওয়া মাছের মতো হাঁ হয়ে যায় মুখটা এক অসম্ভব বিস্ময়ে সমস্ত শরীর যায় স্থির হয়ে গালে এসে বসা মাছিটা এখন নির্ভয়ে খালিপায়ে নিলয়ের মুখের গিরিকন্দরগুলি জরীপ করা শুরু করে নিলয় নিবাত, নিষ্কম্প, দারুভূত ক্যালেন্ডারের লাস্যময়ী মেয়েটি অবশ করা চোখও নিলয়কে এখন আর আকর্ষিত করতে পারছে না এই, দুই, তিন, চার, পাঁচ……… সেকেন্ডগুলি পার হতেই থাকে প্রায় এক মিনিটের মাথায় প্রাথমিক বেভুল অবস্থাটা কেটে ক্রমশঃ স্বাভাবিক হতে শুরু করে নীলু, আস্তে আস্তে কুঁচকে উঠতে থাকে তার ঠোঁটের কোণ আরও ত্রিশ সেকেন্ড পরে সেই কুঞ্চন আকার ধারণ করে পরিতৃপ্তির অনাবিল হাসিতে গত ছমাসে এই প্রথম হাসল নিলয়

    বহুত আচ্ছা …… সাবাশ! ......... দূর, নির্ভেজাল পাগলামি ……… এ কি সম্ভব নাকি? …… অসম্ভবই বা কেন?’ এই বাক্যাংশগুলি দ্রুত পরম্পরায় বেরুতে থাকে নিলয়ের মুখ থেকে আর বহুদিন বাদে সেই রাত্রে তার ঘুম হল চমৎকার

    পরের দিন থেকেই নিলয়ের হুলিয়া গেল বদলে যে জাদু গত সন্ধ্যায় তাকে প্রায় দুই মিনিট স্থির বসিয়ে রেখেছিলো, সেই জাদুর পিছনে এবার ছুটতে থাকে সে কারণ এর উপর নির্ভর করে আছে তার জীবন মরণ তার প্রতি চরম শত্রুভাবাপন্ন মানবসমাজের একটা বিশেষ অংশের উপর আখেরি প্রতিশোধটা সে নিতে পারবে কি না, এটাও নির্ভরশীল এই জাদুর বাস্তব রূপায়নের উপর কাগজ কলম নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে নামে নিলয় প্রাথমিক কিছু নকশা, হিসাব নিকাশ ইত্যাদিতে ধীরে ধীরে বহরে উঠতে থাকে একটা বাঁধানো জাবেদা খাতা

    উদ্যমে কোন ঘাটতি না থাকলেও এক জায়গায় এসে থমকে গেল নিলয় কারণ এবার সামনে এসে দাঁড়ালো বৃহৎ এক বাধা একটা যন্ত্র, তা সে যতই গুণসম্পন্ন হোক না কেন, মৌলিক চিন্তা করতে তা অক্ষম যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন কাজকে গাণিতিক কিংবা নির্দিষ্ট যুক্তিবিন্যাসে বিন্যস্ত না করা যাচ্ছে, ততক্ষণ যন্ত্রকে দিয়ে কোন কাজ করানো সম্ভব নয়

    নিলয়ের উৎসাহের বেলুন এবার ধীরে ধীরে চুপসোতে শুরু করে বিজ্ঞানের বেঁধে দেওয়া এই সীমানা অতিক্রম করার সহজ বা জটিল কোন রাস্তাই খুঁজে পায় না সে অতএব গালে হাত দিয়ে বসে আকাশপাতাল ভাবা ছাড়া কোন গতি নেই যে অর্থে প্রকৃতিসৃষ্ট জীবের মগজ থাকে, সেই অর্থে যন্ত্রের মগজ থাকে না, এটা সত্যি কিন্তু যন্ত্রের স্মৃতিশক্তি তো থাকতেই পারে এইতো, প্রতিদিন ব্যবহৃত হয় যে ক্যালকুলেটর, সেই ছোট্ট যন্ত্রটিরও তো মনে রাখার ক্ষমতা দারুণ ব্যাটারি থেকে আসা বৈদ্যুতিক ঘাতগুলিকে সংখ্যা হিসাবে বুঝে নিয়ে মামুলি ঘরোয়া ক্যালকুলেটরও তো সেই সংখ্যাকে তার স্মৃতিকোষে ধরে রাখতে পারে, পারে প্রয়োজনমত তা ব্যবহার করতেও এই যুক্তি অনুসারে তো অসীম স্মৃতিসম্পন্ন একটা যন্ত্র গড়ে তোলা যায় যাতে…………………………………

    হঠাৎই বিদ্যুতের ঝলকের মতো একটা স্মৃতি নিলয়কে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার ছেলেবেলার মফস্বলের ছোট শহরটিতে চোখের সামনে ঝলসে ওঠে ব্রজগোপাল স্মারক উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক অনাদি সান্যালের মুখ ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে অনাদিবাবু হাতে চকখড়ি গুরুগম্ভীর গলায় ক্লাস কাঁপিয়ে বলছেন, ‘বাংলা ভাষাকে হেয় কোরো না বাবাসকল জেনে রেখো কোন ভাষা অঙ্কের চাইতেও জটিল, অঙ্কের চাইতেও চিত্তাকর্ষক যে নীতিনিয়ম বাংলা ভাষার বুনিয়াদ, তা চরিত্রের বিচারে কোন গাণিতিক সূত্রের মতোই অভ্রান্ততাইতো! কতকগুলি শব্দ দেওয়া থাকলে, এবং সেই শব্দ দিয়ে কোন ভাবধারা প্রকাশিত হবে তা দেওয়া থাকলে কেবল একটিই সঠিক বাক্য গঠন করা যেতে পারে অন্যথায় যা হয়ে দাঁড়াবে পাগলের প্রলাপ

    এটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক হলো নাআপন মনেই বলে ওঠে নিলয় এমন অনেক বাক্যই থাকতে পারে যেখানে শব্দের অবস্থান আলাদা আলাদা হলেও একাধিক ব্যাকরণসম্মত বাক্য তৈরী হতে পারে চুলোয় যাক তত্ত্বটা তো মোটামুটি সঠিক তবে কি যন্ত্রগণকের গঠনশৈলীর অনুকরণে এমন একটা কল বানানো যায় যা নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকরণগত নিয়ম অনুসারে অনেকগুলি শব্দকে সঠিক বিন্যাসে সাজিয়ে একটা বোধগম্য এবং অর্থযুক্ত বাক্য তৈরী করতে পারবে? যদি যায় তবে তো কেল্লা ফতে! এই যন্ত্রটাকে পড়িয়ে দেওয়া হবে ব্যাকরণের নানা নিয়ম, নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদ, বাচ্য, ইত্যাদি যন্ত্রের স্মৃতিকোষে মজুত করা থাকবে হাজার হাজার শব্দযা ভাণ্ডার থেকে বেছে নিয়ে যন্ত্রটি তৈরী করবে অর্থযুক্ত নানা বাক্য এইবার কি সাজাতে হবে আর কিভাবে সাজাতে হবে এসব যদি যন্ত্রকে শিখিয়ে দেওয়া যায়, তা হলেই তো নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ! ঝরঝর করে প্রবাহিত হবে বাক্যধারা, বাক্যলহরীতে ডুবে যাবে পৃথিবী

    এখন নিলয়কে আর পায় কে? সকাল হতেই সে ছুটল কলেজ স্ট্রীটে বইয়ের দোকান তোলপাড় করে ঘরে এনে তুলল বাংলা ব্যাকরণের মোটা মোটা বই, সুনীতি চাটুজ্যের ডি বি এল, গ্রন্থ অকাদেমীর এবং পুস্তক পর্ষদের শব্দকোষ, যাবতীয় অভিধান তার পড়ার টেবিল ভরে উঠল প্রাচীন, নবীন, ধ্রুপদী, আধুনিক, রক্ষণশীল কিংবা আঁভাগার্দ সমস্ত লেখকের প্রবন্ধ, উপন্যাস, রম্যরচনা এবং ছোটগল্পের বইতে দিস্তা দিস্তা সাদা পাতায় ফুটে উঠল অদ্ভুত সমস্ত নকশা, হাতির শুঁড়ের মতো কলনচিহ্ন গ্রীক অক্ষরে লেখা জটিল সমস্ত আঙ্কিক হিসাবনিকাশ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের যত্রতত্র; লাল-নীল-হলুদ রঙ্গে আঁকা ওয়ারিং ডায়াগ্রাম উড়ে বেড়াতে লাগল দমকা হাওয়ায়; উপন্যাস-ছোটগল্প থেকে সংগ্রহ করা কন্ধকাটা গদ্যাংশগুলিকে প্লট হিসাবে চিহ্নিত করে সযত্নে রাখা হল প্লাস্টিকের খামে কাগজ কেটে-জুড়ে তৈরী হল নতুন কিসিমের ইলেক্ট্রনিক টাইপরাইটারের বঙ্গীয় প্রতিকল্প কার্ডবোর্ড আর থার্মোকল দিয়ে প্রমাণ সাইজের এক কন্ট্রোল প্যানেলও বানানো হল যার প্রতিটি বোতামে লেখা হল দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক এবং অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত যাবতীয় বড়, মাঝারি এবং ছোট পত্রপত্রিকার নাম আর ঘরভর্তি এই কর্মকান্ডের নায়ক নিলয় সেনগুপ্তর অস্থির পদচারণায় অসহ্য হয়ে উঠল একতলায় বাস করা নবদম্পতিটির দৈনন্দিন জীবনযাত্রা পদচারণা, এবং তৎসহ বিড়বিড়ানির মধ্যে যে দুটি শব্দ বারংবার ঘুরেফিরে  আসতে শোনা গেল, তা হলসৃষ্টির গুষ্টির পিন্ডিশালা সম্পাদক

    (তিন)

    ছুটি শেষ হওয়ার একদিন আগে একইরকম কোঁচকানো, ইস্ত্রিবিহীন, নালঝোলমাখা জামাকাপড়ে নিলয় হাজির হল তার কাজের জায়গায়, এবং প্রথমেই গিয়ে প্রফুল্লবাবুর দপ্তরে হানা দিল বগলে তার প্রমাণ মাপের দুটি ফাইল

    নিলয়কে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন প্রফুল্লবাবু যাক, ছোকরা শেষ পর্যন্ত সটকায়নি!

    - ‘তোমার চেহারা তো দেখছি ফিরে গেছে নিলয়বক্তব্যটা প্রায় সত্যের অপলাপ হয়ে দাঁড়ায় কারণ প্রফুল্লবাবু দেখেন আর নোংরা হয়ে উঠেছে নিলয়, আর আলাভুলো গোছের বোধহয় ইঞ্চিদুয়েক কুঁজোও হয়ে পড়েছে নতুনত্বের মধ্যে কেবল কান এঁটো করা পাগলাটে একটা হাসি

    ফাইলদুটো তাঁর টেবিলের উপর সশব্দে আছড়ে পড়ায় প্রফুল্লবাবুর চিন্তার স্রোত যায় ঘুলিয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে, ভুরু কুঁচকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি আশ্চর্য, এগুলো কি?’

    - ‘ডিজাইনগুলো স্বচক্ষে একবার দেখুন স্যার………আমরা চেষ্টা করলে পুরো ইন্ডাস্ট্রির চেহারাটা পালটে দিতে পারবো স্যার…… ‘জন্মভূমিকাগজকে আর ছড়ি ঘোরাতে দেবো না, লাটে তুলে দেবোবার্তাবহ’, ‘কালকেতুকিংবাজনশৌর্য্য’-কে ………’
    - ‘কি হাবিজাবি বকে চলেছ তখন থেকে?’ ধমকে ওঠেন প্রফুল্লবাবুপরিষ্কার করে বলতো কি বলতে চাও?’

    ধাতস্থ হয় নিলয় ফাইল খুলে একটা একটা করে পাতা উলটে উলটে প্রফুল্লবাবুকে বোঝাতে শুরু করে সে যখন থামে তখন দুপুরের খাবারের ঘন্টা পড়ো পড়ো

    কিছুক্ষণ থুম হয়ে বসে থেকে চশমা খুলে রুমালে মুখ মোছেন প্রফুল্লবাবু তারপরই যেন ওল্ডোনিও লেঙ্গাই, চিম্বোরেজো আর কোটোপ্যাক্সি একসঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গর্জে ওঠে

    - ‘তুমি আসলে কি জানো তো? একটা আস্ত পাগল, বদ্ধ উন্মাদ আমার উচিৎ তোমাকে এক্ষুনি পাগলা গারদে পোরা আমাকে তোমার ইয়ার্কির পাত্তর পেয়েছ?’ উত্তেজনার প্রাথমিক দমকটা কাটিয়ে অবশ্য সামলে ওঠেন প্রফুল্লবাবু সারা শরীরে চিড়বিড়ানি ছড়িয়ে দেওয়া রাগ ছাপিয়ে চাড়া দিয়ে ওঠে বিষয়বুদ্ধি ছোকরাকে বেশী চটালে চলবে না
    - ‘কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি স্যার যে যন্ত্রটা চলবে প্রমাণ করে দেখানোর একটা সুযোগ অন্ততঃ দিন আমাকেনিলয়ের গলায় করুণ আর্তনাদ হে ভগবান, ইলিশলোচনকে সুবুদ্ধি দাও
    - ‘শান্ত হও নিলয় আইডিয়াটা তোমার চমৎকার, যাকে বলে, ইয়ে, প্রায় যুগান্তকারী কিন্তু এতে করে হবেটা কি? কে কিনবে গল্প লেখার যন্ত্র? আর একটা ফালতু মালের পিছনে, যার কোন দামই নেই, তার জন্য কোম্পানি টাকা ঢালবেই বা কি সুবাদে?

    থেমে যায় নিলয় শার্টের হাতায় মুখ মুছে শান্ত স্বরে বলে, ‘একটা কথা আপনাকে বলা উচিৎ স্যার প্রায় স্বীকারোক্তিও বলতে পারেন
    -‘বল কি বলবেহায় রাম, চাকরিটা তাহলে ছাড়বে বলেই স্থির করেছে এ তো মহা মুশকিল
    আমাকে অনেক সময় মন খারাপ করে ঘুরতে দেখে আপনি চিন্তিত হয়েছেন স্যার হয়তো ভেবেছেন যে ছোকরা সবসময় মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে ঘোরে কেন? আসলে………’

    দম নিতে থামে নিলয় মুখ থেকে মুছে ফেলে কাল্পনিক ঘাম সেই শার্টের হাতাতেই………… ‘আসলে সত্যি বলতে কি, এখানকার কাজকর্ম সম্বন্ধে আমার কোন আগ্রহই নেই এ সমস্ত কাজ আমাকে টানে না আমি কি করি, কতটা করি তার কেয়ারও করি না আমি এটা আমি জানি যে এইধরনের কাজে আমি যথেষ্টই দক্ষ কিন্তু মন থেকে কোনদিনই আমি এই কাজকে ভালবাসতে পারিনি আর এখন এমন একটা অবস্থা এসেছে যে আমার মনে হচ্ছে এ কাজ চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়

    প্রফুল্লবাবুর সারা শরীরে হাজার পিঁপড়ের চুলকানি

    -‘………আসলে ছোটবেলা থেকেই আমার ইচ্ছা লেখক হবার সেজন্যই…’
    -‘লেখক হবার?’ বোমার মত ফেটে পড়েন প্রফুল্লবাবু নিজের গর্জনে নিজেই খানিকটা চমকে ওঠেন কিন্তু নিলয় অবিচলিত
    - ‘আজ্ঞে হ্যাঁ আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু এক মুহূর্ত অবকাশ পেলেই আমি গল্পের প্লট ভাঁজা শুরু করি মাথার মধ্যে সেই প্লটগুলিকে সাজিয়ে তারপর রঙ রসান চড়াই গত দশ বছরে আমি কতগুলো গল্প লিখেছি জানেন? মোট পাঁচশো তেইশটা! অর্থাৎ গড়ে হপ্তায় একটা করে

    - ‘হায় ঈশ্বর!! কিন্তু এ দুর্বুদ্ধি তোমার হল কেন নিলয়?’
    - ‘জানিনা স্যার! কিন্তু মাথা খালি হলেই রাজ্যের গল্প আমাকে যেন ছেঁকে ধরে কানের চারপাশে নাছোড়বান্দা মশার মত বিনবিন করে গল্প পেটের ভিতর থেকে সোডার মত ভসভসিয়ে ওঠে চাপা অম্বলের চোঁয়া ঢেঁকুরের মত গলা বুক জ্বালিয়ে দেয় আর তখন শব্দগুলো উগরে নয়া দিয়ে পারি না সঠিক জানিনা স্যার, কিন্তু একেই বোধহয় বলে সৃষ্টির তাড়না!’
    - ‘আর তারপরে সেই গল্পগুলো দিয়ে কি করা হয়?’ ভাববাচ্যে যাওয়া মানেই, অন্ততঃ প্রফুল্লবাবুর ক্ষেত্রে, আবহমণ্ডলে গভীর নিম্নচাপ, ঘোরতর বিপদের সম্ভাবনা

    -‘এখানেই তো স্রষ্টা কাঁদে স্যার একটা করে গল্প শেষ করি, আর ছাপার জন্য পাঠাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় জন্মভূমি’, ‘বার্তাবহ’, ‘কালকেতুকিংবাজনশৌর্য্যেপাঠাই তারা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনা পাঠাইভূমা’, ‘প্রগতি’, ‘সারথিকিংবাঅরণিজাতীয় আঁতেল, নাকউঁচু পত্রিকায় তারা আমার লেখায় আমার অবচেতনে ফ্রয়েডের কিংবা জাং-এর প্রভাব বিশ্লেষণ করে বিশাল বিশাল সমালোচনা পাঠিয়ে দিয়ে পিঠ চাপড়ানি দেয়, কিন্তু লেখা ছাপে না এমনকি মফস্বলের অনামী অখাদ্য সব পত্রিকা, যেমনবাস্তবিক’, ‘অঙ্কুর’, ‘সৃজন’, ‘চার্বাক’, ‘মনন’, ‘সায়কবামধ্যবলয়েও পাঠাই ছাপে না তারাও শুধু তাই নয়, দস্তুরমত হ্যাটাও মারে মাসদুয়েক আগেসায়কপত্রিকায় ভারী মিষ্টি একটা প্রেমের গল্প পাঠিয়েছিলাম উত্তরে তারা লেখা ফেরত তো পাঠালই, এমনকি সবিনয়ে লিখে দিল এর পর গল্প পাঠালে তার সঙ্গে টিকিট মারা জবাবী একখানা খামও যেন পাঠাতে না ভুলি! কি ধৃষ্টতা দেখেছেন?’ চিড়বিড় করতে থাকে নিলয় গায়ের জ্বালায়

    -‘আমি বুঝতে পারছি নিলয় তোমার মনের অবস্থাটাপ্রফুল্লবাবুর দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটিকিন্তু তুমি একজন লোকও দেখাতে পারবে না যাকে এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়না এই আমাকেই দেখ না হবার কথা ছিল ওস্তাদ গাইয়ে, আর কি হয়েছি!’ নিলয় অবশ্য কল্পনার লাগাম পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েও প্রফুল্লবাবুকে কাফি কিংবা খাম্বাজ গায়নরত অবস্থায় দেখতে পেল নাকিন্তু এটা বোঝার বয়স তো তোমার হয়েছে যে যাঁরা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞঅর্থাৎ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতাঁদের মতে তোমার গল্পগুলি, যাকে বলে, ততটা উৎরোয়নি এবার তাহলে ওসব ছেড়েই দাও না কেন? ভুলে যাও অবাস্তব কল্পনাবিলাস যে বিষয়ে তোমার ক্ষমতা ভগবানপ্রদত্ত তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার কর এভাবেই তুমি সাফল্য পাবে ফালতু পাতা ভরিয়ে লাভ কি?’

    -‘কোন শালা বলে আমার গল্পগুলো উৎরোয়নি?’ – উত্তেজিত নিলয় কেবলমাত্র গলার পর্দাই চড়ায়নি, সে ভুলেই গেছে যে ভদ্রসমাজে শকারান্ত শব্দগুলি তেমনভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত নয়বুঝবে তবে তো ভালোমন্দ বলবে? ওরা গল্প বোঝেই না বুঝলে গল্পের নামে ঐসব রাবিশ ছাইভস্ম ছাপাত না সবকটা শালা ধান্দাবাজ, সবকটা শালা মর্কট, পাগল……’
    -‘শান্ত হও নিলয়, শান্ত হও ………’
    - ‘আপনি কোনদিন এসমস্ত পত্রিকা উল্টেপাল্টেও দেখেছেন কি?’
    - ‘মাপ করো নিলয়, কিন্তু এ সমস্তের সাথে তোমার যন্ত্রের সম্পর্ক কি তা তো বুঝছিও না, মাথাতেও ঢুকছে না
    - ‘হে ঈশ্বর, এ জানে না এ কি করছেআর্তনাদ করে ওঠে নিলয়এই সহজ সরল সম্পর্কটাও বুঝে উঠতে পারলেন না? শুনুন তাহলে আপনি কি জানেন যে এক একটা পত্রিকার এক একটা স্টিরিওটাইপ আছে? না জানারই কথা যেমন ধরুনজন্মভূমিপত্রিকা ওরা পছন্দ করে গম্ভীর গম্ভীর কথায় কিছু না বলা অন্তঃসারশূন্য গল্পকালকেতুর গল্পে যৌনতার মৃদু সুড়সুড়ি না থাকলে ছাপাই হয় না আরজনশৌর্য্যচায় চার আনা সমাজ সচেতনতা, দু-এক পোয়া বিপ্লবী ঝাঁজ, এক চিমটি মেঠো প্রেম আর উপসংহারে বাধ্যতামূলক লালঝাণ্ডা উত্তোলন বাকী পত্রিকাগুলো ঠিক একই ধরণের সাড়েবত্রিশভাজা ফরমুলায় চলেলেখকরাও এসব বোঝে তারা লেখেও সেইভাবেই
    -‘কিন্তু এতেও তো তোমারসহজ সরল সম্পর্কটা ঠিক বোধগম্য হল নয়া নিলয়?’
    -‘দয়া করে একটু থামুন স্যার বড়ো বেশী কথা বলেন আপনিচেয়ার থেকে প্রায় উলটে পড়ে যেতে যেতে কোনরকমে টাল সামলে নেন প্রফুল্লবাবুসামান্য ধৈর্য্য ধরুন যা বলছি, বিশ্বাস করুন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণনিলয় দম নিতে থামে তার চোখ উত্তেজনায় চকচকে, চাঁদি এবং চুল পরস্পর নব্বই ডিগ্রী কৌণিক অবস্থানে, কষে জমে উঠেছে থুতুদেখুন স্যার, আমার যন্ত্রের মূল স্মৃতিভাণ্ডারে দুটি ভাগ রাখা আছে প্রথম ভাগের নামসূত্রস্মৃতি’, দ্বিতীয়টিশব্দস্মৃতি এই দুই ভাগের মধ্যে যোগাযোগ রাখা হবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য তৃতীয় একটি ব্যবস্থা দিয়ে বোতাম টিপে কিংবা ডায়াল ঘুরিয়ে স্মৃতিভাণ্ডারের এই দুই অংশ থেকে সঠিক অনুপাতে সূত্র এবং শব্দ মিশিয়ে দেওয়া যাবে; তারপর এই মিশ্রণকে ঠিকঠাক বিন্যস্ত করে প্রিন্টার থেকে বেরোবে তরতাজা, জলজ্যান্ত গল্প রেডিমেড, হাতে গরমে

    -‘কয়েকটা গল্পের জন্য এত ছাইপাঁশ করতে যাব কেন বলতো?’
    -‘তাহলে বলতে হবে আপনি ব্যবসা ভুলতে বসেছেননিলয় বেপরোয়াগল্পের বাজারটা ভাল করে বোঝার চেষ্টা করুন স্যর এই বাজারে চাহিদার তুলনায় যোগান খুবই কম ফলে স্ট্যান্ডার্ড মাল ছাড়তে পারে যারা, এমন লেখকরা ভাও চড়িয়ে রাখেন, নিয়ন্ত্রণ করেন বাজারটা আমার যন্ত্র থেকে ঘণ্টায় চারটে গল্প বেরোবে এবার এই গল্প চালিয়ে আমরা বাজার ভাসিয়ে দেবো গল্পে ক্ষমতা কেড়ে নেবো সমস্ত লেখকদের হাত থেকে সামান্য খরচে গল্প উৎপাদন করে বেশী দামে পত্রিকায় বেচে আমরা বড়লোক হয়ে যাবো এবার বুঝুন ব্যবসার কতবড় চাল এটা
    -‘কিন্তু নিলয়য়, যন্ত্রটা তো আর বিনা পয়সায় হবে না তা বানানো, চালানো সব নিয়ে খরচও চো আছে?’
    -‘ছ মাসে যন্ত্রের খরচ উঠে আসবে স্যর দাঁড়ান, বিশদ করে বলি শ্যামল দত্ত বা পরেশ গুঁইয়ের মতো বড় লেখকরা বড় বড় কাগজের কাছ থেকে এক একটা গল্প বাবদযা হামেশাই যাচ্ছেতাই হয়কত টাকা পায় জানেন? অন্ততঃ দশ হাজার টাকা
    -‘অসম্ভব’ – লাফ দিয়ে ওঠেন প্রফুল্লবাবু
    -‘গড়ে ধরলে অবশ্য দামটা খানিক পড়বে, তা, এই ধরুন সাড়ে সাত হাজার টাকা
    -‘বাজে কথা বোলো না নিলয়’ – গলা চড়ালেন প্রফুল্লবাবু – ‘সামান্য দু-এক কলম লেখার জন্য এত পয়সা কেউ দেয় নাকি?’
    -‘ব্যবসাবুদ্ধি তাহলে ফিরে এসেছে দেখছি আপনারকাষ্ঠ হাসি হেসে বলে নিলয়…‘দাঁড়ান, দাঁড়ান…… বিরক্ত করবেন না …… এখানেই আমার মেশিনের কৃতিত্ব নিন, কাগজ পেন্সিল ধরুন, হিসাব শুরু করুনহুকুম চালায় নিলয় আজ সে হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে

    মেশিনের মতই বাড়ানো প্যাডটা টেনে নেন প্রফুল্লবাবু

    -‘গল্পের জন্য চড়া দাম দেয়´- বলতে শুরু করে নিলয় – ‘বাংলাভাষায় এমন সাপ্তাহিক পত্রিকার সংখ্যা আনুমানিক দশ গড়ে তিনটে করে স্বল্প তাদের প্রতি সংখ্যায় ছাপা হয় অর্থাৎ মাসে ১২০টা গল্পও প্রতি গল্পে গড়ে সাড়ে সাত হাজার টাকা পাওয়া গেলে মাসে আয় হয় ন লক্ষ টাকা এক বছরে এই হারে আয় হয় প্রায় ৪৭ লক্ষ টাকা এ তো গেল শুধু সাপ্তাহিকের কথা অন্যান্য পত্রিকা ধরলে আয় চোখ বুজে এর দ্বিগুণ ধরা যায় ঘন্টায় চারটে করে গল্প বার করতে পারলে মাত্র ১৬ দিনে এইসংখ্যক গল্প উৎপাদন করা যাবে যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যদি ২ লক্ষ টাকাও লাগে, তাহলেও লাভ থাকবে ৪০ লক্ষ টাকার উপর এছাড়া শারদীয়া, বিশেষ সংখ্যা, ক্রোড়পত্র ইত্যাদি যদি ধরেন তাহলে বাজারের চেহারাটা কি দাঁড়ায় বুঝছেন?’

    -‘এসব পাগলামি ছাড়ো নিলয়এখনো বলছি বুনো হাঁসের পিছনে ছুটে লাভ নেই
    -‘ঐ বুনো হাঁসই আপনার ঘরে এসে ডিম দিয়ে যাবে স্যর আমার কথামতো চললে একবার ভেবে দেখুন যন্ত্র থেকে ৫০০০ শব্দের গল্প ঝরঝরে ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে আসবে মাত্র ১৫ মিনিটে দিনে তাহলে ……’

    এবং ঠিক সেই সময়েই নিলয়ের চোখ পড়ল প্রফুল্লবাবুর মুখের দিকে প্রফুল্ল সরখেলের মরা ইলিশের মতো চোখের দৃষ্টি আরো ভাবলেশহীন হয়ে পড়েছে টানটান হয়ে উঠেছে নাকের পাশের চামড়া; বাঁ দিকের গালে অবাধ্য একটা স্নায়ুর দপদপানি চেয়ারে এলানো শরীর উঠেছে শক্ত হয়ে পরিবর্তনটা সামান্যইঃ অভিজ্ঞ চোখ ছাড়া ধরা পড়ে না খুব লোভনীয় কোন জিনিষ দেখলে প্রফুল্লবাবুর এইরকম চেহারা হয়, এটা আগেও কয়েকবার লক্ষ্য করেছে নিলয় সেবারে যখন সেই সিন্ধ্রী ছুঁড়িটা রিসেপশনে জয়েন করলো তখন……… সতর্ক হয় নিলয় খেলানো মাছ প্রায় ডাঙ্গায় উঠতে চলেছে এবার অভিজ্ঞ মাছমারার মতো হুইল গোটাতে শুরু করে সে

    -‘আসলে কি জানেন স্যর, মাস প্রোডাকশনের যুগে হাতে যা কিছু তৈরী, তার সবই অচল সমস্ত কিছুই এখন মেশিনজাত, আর উৎপাদন হয়ও ঢালাও, কোয়ালিটিও এতে খুব একটা মার খায়না, আর খেলেও আই-এস-ও ২০০৯ নিয়ে সেটা সামলে নেওয়া যায় পহলে দর্শনধারী, পিছে গুণবিচারী! গল্প জিনিষটা কেন  আর দশটা জিনিষের মতো পণ্য হবে না, এটা আমায় বুঝিয়ে বলুন দেখি! আর পণ্য যদি হয়ই, তবে তার মূল কথা হল যোগান বজায় রাখা যতক্ষণ অবধি যোগান দেওয়া যাবে, ততক্ষণ কিভাবে কিংবা কোন পদ্ধতিতে তা তৈরী হয়েছে তা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাবেনা তাছাড়া মেশিনের সাহায্যে গল্প তৈরির অন্য অনেকগুলো সুবিধাও আছে বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে গল্প ছাড়তে পারবেন আপনিঐসব সমাজ সচেতনতা ফচেতনতা নিয়ে ফালতু মাথাও ঘমাতে হবেনা ব্যস, এক বছরে পুরো গল্পের বাজার আমাদের দখলেকেল্লা ফতে!!’

    -‘আমার এখনো বিশ্বাস পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তববঁড়শি গেলা মাছের অন্তিম প্রতিরোধ
    -‘ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়ে ক পয়সা লাভ করেছেন স্যর?’ নীচুগলায় বলে নিলয়-মাসে ওর দ্বিগুণ প্রফিট তুলে দেবো গ্যারান্টি দিয়ে
    -‘তোমার কি ধারণা লোকে লাইন দিয়ে এই যন্ত্র কিনবে?’
    -‘কেনার প্রশ্নই ওঠে না যন্ত্র তো আমরা বেচবো না
    -‘তবে?’
    -‘আমরা নিজেরা চালাবো আমরা নতুন নামে প্রকাশনালয় খুলবো, আর যন্ত্রের সাহায্যে গল্প বার করে বাজারে ছাড়বো পৃথিবীতে নামের অভাব আছে নাকি? আর এমনভাবে পুরো ব্যাপারটা চালাবো জাতে ঐ মেকী লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গেলে সবাইকে আমাদেরই দ্বারস্থ হতে হবে
    -‘লোক ঠকাতে বলছ নিলয়?’
    -‘পৃথিবীর বহু লেখকই কিন্তু ছদ্মনামে লেখেন স্যর এতে লোক ঠকানোর কিছু নেই তাছাড়া অন্য একটা লাভও আছে ধরুন এভাবে আপনি একজন মস্ত বাজারী লেখক হয়ে উঠলেন এবার টেলিভিশনে আপনি কোন কোম্পানির হয়ে বিজ্ঞাপন দিলেন – “আমার মস্তিষ্ককে সচল রাখে ধূমকেতু  সিগারেট”……কিংবা……“সৃষ্টির মুহুর্তগুলিতে আমাকে স্নেহস্পর্শে ঘিরে রাখে দেশপ্রেম মার্কা লুঙ্গি”…… ইত্যাদি পয়সাকে পয়সা, নামকা নাম
    -‘তুমি কি আমার নামেও গল্প ছাড়বে নাকি?’
    -‘অবশ্যই!! লেখকেরা মানুষের কাছে কতটা সম্মানিত জানেন? এই সত্যটাকে কাজে লাগবেন না? নিজের একটা ভাবমূর্তি, একটা ইমেজ গড়ে তুলবেন না? “প্রফুল্ল সরখেল অর্থগৃধ্নু শিল্পপতি ননএকজন সৃজনশীল আদর্শবাদী মানুষ” – এরকম শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন তো আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি পুঁজিবাদের করুণাঘন মানবিক প্রতিবিম্ব এমনটা হোক আপনি চান না?’
    -‘কিন্তু প্লট, প্লট আসবে কোথা থেকে? যন্ত্র তো আর প্লট পয়দা করতে পারবে না?’
    -‘বুনিয়াদী প্রশ্ন, স্যর! যন্ত্রটার মগজে হাজার হাজার মূল প্লট, অন্তর্বর্তী প্লট চালান করে দেবো আপনার সামনে ঐ দুই নম্বর ফাইলেই অন্ততঃ চারশো এরকম প্লট আছে ওগুলিকে সোজা চালান করে দেবো সূত্রস্মৃতিতে তারপর অবশ্য কিছু কায়দাকানুন করতে হবে প্রত্যেক লেখকের, জানবেন স্যর, পাঠকপাঠিকাকে আকৃষ্ট করার কিছু নিজস্ব কৌশল আছে যেমন ধরুন অরুণ রায় পৃথিবীর যাবতীয় আনখাই নাম খুঁজে বের করে গল্প-উপন্যাসের পাত্রপাত্রীদের নামকরণ করেন তিনি  কিংবা ধরুন দিলীপ গাঙ্গুলি বা শচীন ধরের কথা প্রথমজন শব্দকোষ ঘেঁটে অপ্রচলিত শব্দ গুঁজে দেন প্রতি অনুচ্ছেদে লোকে বোঝে না, আর না বুঝেই ভাবে, আহা কি উচ্চাঙ্গের চিন্তা, কি প্রখর পাণ্ডিত্যও দ্বিতীয়জন সুযোগ পেলেই খুচরো ফষ্টিনষ্টি কিবনবা টুকিটাকি শারীরিক লোভের ছোঁয়া দিয়ে যান মানুষ গোগ্রাসে গেলে এরকম নানা পারমুটেশন আমি বার করে ফেলেছি স্যর ঠিকঠাক বোতাম টেপও, মেশিন চালাও, গরমাগরম ইনস্ট্যান্ট তৈরী!’

    -‘আমাকে ভাবতে হবে নিলয়, কোন কথা এখন দিচ্ছি না

    বড় মাছ ডাঙ্গায় তোলার খাটনি কম নয় ঘাম মুছে নিলয় ঘর ছেড়ে বেরোয়

    (চার)

    পরের দিন আর একপ্রস্থ আলোচনা হল নিলয় আর প্রফুল্লবাবুর যন্ত্রের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে           এক সপ্তাহ বাদে দেখা গেল প্রফুল্লবাবু পুরো প্রকল্পটিকে নিজের বলেই ভাবতে শুরু করেছেনদেড়মাসের মাথায় কাজ শেষ করতে দেরী হচ্ছে কেন এ বাবদে নিলয় প্রচণ্ড গালাগাল খেলো প্রফুল্লবাবুর কাছে

    যন্ত্রটা তৈরী শেষ হল ছমাসের মাথায় তার নাম রাখা হল বৃহৎ বঙ্গীয় শব্দকল্পদ্রুম 

    (পাঁচ)

    দধীচিকারখানার হাতার শেষপ্রান্তে একটা পরিত্যক্ত শেড সারিয়ে সুরিয়ে শব্দকল্পদ্রুমের বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে কারখানার সমস্ত কর্মীর সেখানে প্রবেশ নিষেধ -মাসের মাথায় সেই শেডে ঢুকলেন প্রফুল্লবাবু, শব্দকল্পদ্রুম চালু করার জন্য

    প্রায়ান্ধকার ঝুপসি শেডের মধ্যে ভুতুড়ে চোখের মত জ্বলছে কন্ট্রোল প্যানেলের সারি সারি লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা আলো সেই আলোয় নিলয় আর প্রফুল্লবাবু দুজনকেই দেখাচ্ছে বহুরূপীর মতো কোন কারণ না থাকা সত্ত্বেও কথা হচ্ছে ফিসফিস করে

    -‘নিন স্যর, যন্ত্রটা চালু করুন
    -‘কি করে যে চালাবো তাই তো কলা বুঝছি না’ – টেনশনে বিড়বিড় করেন প্রফুল্ল সরখেল – ‘ছাইপাঁশ একরাশ আলো জ্বালিয়েছ কেন?’

    কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে টাইপ মেশিনের চাবির মত একসার সাদা বোতামের দিকে নির্দেশ করে নিল্য় – ‘কোন পত্রিকার জন্য গল্প বার করবেন বলুন – ‘জন্মভূমি’, ‘বার্তাবহ’, ‘কালকেতু’, ‘সহর্ষা’ – যা চান, যেমন চান তেমনটিই হবেজন্মভূমিদিয়েই শুরু করা যাক নাপত্রিকার নামাঙ্কিত বোতামটা টিপলেন প্রফুল্লবাবু খুট করে একটা শব্দ আগের আলোগুলি নিভে গিয়ে জ্বলে উঠল অন্য একরাশ আলোসিলেকশন হলও এবার ডানদিকের কোণের এই বোতামটা দিয়ে প্লট বাছুনরোমহর্ষক’? বেশ তো এবার বাঁয়ের এই হাতলটা ডানদিকে এক প্যাঁচ ঘোরান ব্যসএবার গল্প বেরোবার পালা

    হাতলটা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শেড জুড়ে হাজার মৌমাছির গুঞ্জনের মত গুনগুন একটা আওয়াজ উঠল ছোট বড় হাজারো গিয়ার ঘোরার মৃদু কিরকির শব্দ, খাঁজে পড়া কন্ট্যাকটর ও লিভারের খুটখাট চলতে থাকল এগারো মিনিটের মাথায় সমস্ত শব্দ থেমে গিয়ে জ্বলে উঠল বিশালবপু প্রিন্টারের আলো প্রিন্টারের সঙ্গে যুক্ত মনিটরে ভেসে উঠল – ‘প্রসবমূহুর্তপ্রস্তুত হোনপ্রায় সাথেসাথেই গলা খাঁকারি দিয়ে নড়ে উঠল প্রিন্টার, ঘুরতে শুরু করল তার ট্রাক্টর-ফীডে পরানো ছাপার কাগজ, ইংকজেটের চিটপিট শব্দে তার সাদা বুক জুড়ে ফুটে উঠল ছাপার অক্ষর, আর একপাক ঘুরে সেই ছাপা কাগজ জমা হতে থাকল ট্রে-র উপর প্রথম পাতাটা বেরোতে না বেরোতে ট্রে-র উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন প্রফুল্লবাবু, তার ঘাড়ের উপর নিলয় ছাপা কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাটিতে চোখ বুলিয়েই মাথা চেপে ধরে আর্তনাদ করে ওঠেন তিনি – ‘হে ভগবান, কি সমস্ত ছাইপাঁশ মাথামুণ্ডু ছেপেছ?’

    কাগজটায় সত্যিসত্যিই ছাপার অক্ষরে দেখা যাচ্ছে কিছু অর্থহীন কথা, যার প্রথম পংক্তিটি এইরকমঃ
    ডঅ্যানোজিবিজিহিলকু গোন্ধগাং টাপৎ চিলকেট পাটইঁর টাওর রাত্তজ বুসদেলহ ……”

    কপালের রগ ফুলিয়ে পা দাপাচ্ছেন প্রফুল্লবাবু আর তাঁকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে নিলয়
    -‘চিন্তার কোন কারণ নেই স্যররেট্রোফিটে ওটা ঠিক হয়ে যাবে যুক্তিবিন্যাসে হয়ত কোথাও কিছু ভুল হয়ে গেছে প্রায় সাতশো কিলোমিটার তার আছে স্যর যন্ত্রটার মধ্যে - কোথাও কোন জোড়ে ঢিলে থাকার কারণেও এ ধরণের ভুলভ্রান্তি হতে পারে তাছাড়া এটা তো আলফা টেস্টিং পর্যায় স্যর, এতো চিন্তা করছেন কেন? আমি দেখছি স্যর
    -‘দেখবে তোমার মাথা আর আমার মুণ্ডু! উঃ, কি আহাম্মক আমি! তা না হলে একটা আধপাগলের কথায় এতগুলো টাকা খরচ করে বসি? ছিঃ ছিঃ, কি গুখেগোর কাজটাই না করেছি!’

    ততক্ষণে যন্ত্রের কাছে পৌঁছে নিলয়ের কলকব্জা নাড়া শুরু হয়ে গিয়েছে প্রায় দশ মিনিট বাদে, যা সময়ে প্রফুল্লবাবুর মেজাজের পারা চড়তে চড়তে প্রায় বিস্ফোরণের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, নতুন করে আবার যন্ত্রটা চালু করে সে আবারও আলো জ্বলা নেভা, আবারও শেড জুড়ে হাজার মৌমাছির গুঞ্জন…. পনেরো মিনিটের মাথায় এবার যা ছাপে বাড়ল তা এইরকমঃ

    হলদে সবুজ ওরাংওটাং
    ইঁটপাটকেল চিৎপটাং
    গন্ধগোকুল হিজিবিজি
    নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি
    নন্দীভৃঙ্গী সারেগামা
    নেই মামা তাই কানা মামা
    মুশকিল আসান উড়ে মালি
    ধর্মতলা কর্মখালি

    -‘হয়েছে, হয়েছে, হয়েছে’ – বাচ্চা ছেলের মত লাফিয়ে ওঠে নিলয়
    -‘ছাই হয়েছে! কি মানে এই কথাগুলির?’ খিঁচিয়ে ওঠেন প্রফুল্লবাবু
    -‘হয়েছে স্যর কথাগুলো বোধগম্য তো হয়েছে তাহলে বাকীটাও হবে দাঁড়ান, আর একটু চেষ্টা করে দেখি

    এবার নিলয়ের চেষ্টার ফলে বেরোল চমৎকার ছন্দে রচিত সুললিত এই গদ্যাংশঃ

    এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি যাহার শিখরদেশে সতত সঞ্চারমাণ জলধর পটল সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নিলীমায় অলংকৃত অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে সমাচ্ছন্ন থাকাতে স্নিগ্ধ শীতল ও রমনীয় ……”

    প্রোজেক্ট শতকরা ১০০ ভাগ সফল!!!!

    (ছয়)

    তিনমাস পরের কথা.....

    কলকাতার সবচেয়ে উচ্চবিত্ত অফিসপাড়ায় বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছেপ্রতিধ্বনিপ্রকাশনীর দপ্তর যার মালিক প্রফুল্লবাবু আর নিলয় শব্দকল্পদ্রুম-এর কল্যাণে গত তিন মাসে গল্প বিক্রি হয়েছে ২৮০ খানা এবং প্রকাশনীর দপ্তরে এসে পৌঁছোচ্ছে আরো বেশী বেশী গল্পের চাহিদাসম্বলিত পত্রাবলী ব্যবসা জমে উঠেছে

    শব্দকল্পদ্রুম-এর আদি সংস্করণের বহু পরিবর্তনও ঘটানো হয়েছে ইদানীং প্রফুল্লবাবুর এর ছোটগল্পলিখতেভাল লাগছে না তাঁর স্নেহধন্য ও বশংবদ মহলের দাবী অনুযায়ী তাঁর এখন ইচ্ছা আরো গম্ভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ভাবাবেগ নিয়ে কারবার করার তিনি চানওয়ার এন্ড পীসকিংবাপথের পাঁচালীজাতীয় একখানা ধ্রুপদী উপন্যাস লিখতে সুতরাং প্রফুল্লবাবুর ফরমাস অনুসারে যন্ত্রটাকে উপন্যাস লেখার মত করে পরিবর্তন করতে হয়েছে নিলয়কে শব্দকল্পদ্রুম-এর বিশাল স্মৃতিভাণ্ডারকে আরও কয়েকগুণ বিশদ এবং বিস্তৃত করা হয়েছে এছাড়াও যন্ত্রটিকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হয়েছে যাতে দুটো বিশেষমোডবা সাধন প্রণালীতে সেটা কাজ করতে পারেউপন্যাসমোড’-এ বা ছোটগল্পমোড’- ক্ষিপ্রতম ঘনীভূত বর্তনী বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট দিয়ে পুরোন বৈদ্যুতিণ বর্তনীগুলিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে ধাতুনির্মিত কলকব্জা, গিয়ার বা লিভার পালটে বসানো হয়েছে নতুন প্রযুক্তিজাত হাল্কা অথচ টেঁকসই যন্ত্রাংশ ফলে যন্ত্রের জড়তা কমেছে, বেড়েছে কাজ করবার ক্ষমতাবেশ কয়েকগুণ ঘন্টায় চারটির বদলে এখন পাওয়া যাচ্ছে ছ-টি করে গল্পও একখানা মাঝারি বপুর উপন্যাস লিখতে সময় লাগছে কমবেশী দুই ঘন্টা

    উপন্যাসলেখার কাজেলেখককে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে নেবার জন্য, লেখককে সৃষ্টির আনন্দের ভাগীদার করে তোলার জন্য চমৎকার এক ব্যবস্থা করেছে নিলয় এরোপ্লেনের ককপিটের অনুকরণে প্রস্তুত করা হয়েছে একসৃজনকক্ষ এই সৃজনকক্ষে গদিমোড়া কুর্শিতে বসে লেখক তাঁর কাজ শুরু করবেন লেখার কাজ করা হবে একটাআনন্দদণ্ডকে উপর, নীচে, ডাইনে ও বাঁয়ে সঞ্চালিত করে লেখকের পায়ের কাছে থাকবে কিছু নিয়ন্ত্রক পাদানি, যেমনটি ব্যবহৃত হয় গাড়ী চালানোর সময়ে এই নিয়ন্ত্রাগুলির এক একটিতে মৃদু বা তীব্র চাপ দিয়ে উপন্যাসের প্লটের সঙ্গে প্রেম, সমাজসচেতনতা, যৌনতা, আবেগ, দুঃখ, গাম্ভীর্য ইত্যাদি ভাবাবেগ অল্প বা বেশীমাত্রায় মেশানো হবে তবে গাড়ী চালানোর মতই এতে দক্ষতা চাই এবং চালানোর প্রক্রিয়া রপ্ত না হলে যে মুস্কিল আছে, সেটার প্রমাণ হাতেনাতেই একদিন পাওয়া গেল

    সেদিন লেখকের আসন আলোকিত করে বসেছিলেন প্রফুল্লবাবু শব্দকল্পদ্রুম-এর বিশাল মনিটরের সামনে বসে যন্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী উপন্যাসের প্রাথমিক উপাদানগুলি স্থির করছিলেন তাঁর পছন্দ নিম্নরূপঃ


                ধরণ                                          উপন্যাস
                শৈলী                                         আঁভাগার্দ
                ভাবধারা                                                প্রেম, দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা, বেদনা
                বিষয়                                         নরনারী সম্পর্ক
                মূল চরিত্র                                    তিনটি পুরুষ, সমসংখ্যক নারী, দুটি শিশু
                চরিত্রের পারস্পরিক বিন্যাস                       জটিল
                নরনারীর সম্পর্কসূচক ধ্রুবক                       চিরায়ত ত্রিকোণ 
                পার্শ্বচরিত্র সংখ্যা                          বারো
                চরিত্রের নামধাম                          স্বয়ংক্রিয় ভাবে স্থিরীকৃত
                দৈর্ঘ্য                                         আনুমানিক ১৫ পরিচ্ছেদ

    প্রফুল্লবাবুর পছন্দ অনুযায়ী যন্ত্র চালু করেছিল নিলয় প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে মনিটরের কথামতো আনন্দদন্ড চালিয়ে এবং পায়ের চাপে নিয়ন্ত্রাগুলিকে ব্যবহার   করে প্রাথমিক প্লটে পরিমাণমতো বুনিয়াদী আবেগগুলিকে মিশিয়ে উপন্যাস শেষ করেছিলেন তিনি প্রিন্টারের ট্রে থেকে ঝকঝকে ছাপা উপন্যাসটি হাতে নিয়ে বেশ শ্লাঘাও অনুভব করেছিলেন চক্ষু স্থির হয়ে গেছিল দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের মাঝামাঝি এসে প্রতিটি ছত্রে উদ্দাম যৌনতা, প্রতিটি অনুচ্ছেদে কল্পনাতীত ব্যভিচারের জ্বলন্ত বর্ণনা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন তিনি বোঝেন, মনের অবচেতনে ক্রিয়াশীল  অবদমিত তাড়নার প্রভাবে যৌনতার নিয়ন্ত্রায় বাড়তি চাপ পড়তে শুরু করেছিল দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের মধ্যখান থেকেই

    তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসে এমন কোন অসঙ্গতি বা মাত্রাছাড়া উদ্দামতা চোখে পড়েনি, কারণ প্রফুল্লবাবু অতিরিক্ত সতর্ক ছিলেন নগদ সাত হাজার টাকায় এই উপন্যাসটি চিনি বিক্রি করেছিলেন নারীবাদী পত্রিকাসহর্ষার বিনোদন সংখ্যার জন্য

    উপন্যাসটি যাবতীয় সমালোচক, এমনকি উন্নাসিকপ্রবর অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়েরও বাহবা কুড়িয়েছিল

    (সাত)

    নিলয় এখন স্যর বলা ছেড়ে দিয়ে আধুলিক কায়দায় প্রফুল্লবাবুকেপিকেবলে ডাকে সেই অবিন্যস্ত নিলয়কে এখন এর খুঁজে পাওয়া যাবে না এখন তার গায়ে হালফ্যাশানের জংলা জামা, দামী কাপড়ের কেতাদুরস্ত প্যান্ট, জেন্টস বিউটি পার্লারের সৌজন্যে তার মাথার চুল এখন ফুরফুরে, সযত্নে অযত্নলালিত ব্যবসার টেনশন কাটাতে নিলয় বছরে দুবার নতুন নতুন বান্ধবীর সাহচর্য্যে উড়ে যায় দেশদেশান্তরে প্রফুল্লবাবু ফরাসী কেতায় তাঁর দুর্বল চিবুক ঢেকেছেন সাদাকালো ছাগলদাড়িতে, তাঁর গায়ে উঠেছে ডিজাইনার পোষাক স্বচ্ছন্দ এমন একটি সকালে দীনেশ দলুইয়ের দেওয়ালজোড়া ছবিতে সাজানো অফিসে নিলয় মুখোমুখি হল প্রফুল্লবাবুর

    -‘পিকে, ব্যবসার হালচাল আমার ভালো ঠেকছে না
    -‘কেন নীলু, গতমাসের ব্যালান্সশীটে তো বিশাল লাভ দেখিয়েছে?’
    -‘আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু এখনো কমেনি পিকে প্রতিদিনই নতুন নতুন লেখক গজাচ্ছে বাজারের ৬০ ভাগ আমাদের দখলে থাকলেও নামীদামী লেখকেরা এখনো বাজারেই থেকে গেছে এবং করে খাচ্ছেও এটা কিন্তু লক্ষণ হিসাবে খুব একটা ভালো নয়
    -‘সে আর আমরা কি করবো বলো আমরা বেনামী লেখক তৈরী করতে পারি, কিন্তু জ্যান্ত লেখকদের মেরে তো ফেলতে পারি না
    -‘মারতে না পারলেও গিলে তো ফেলতে পারি? এইসব লেখকদের চাপের মুখে ফেলতে পারিরকফেলারের স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি যেমন করে তেলের ব্যবসা থেকে সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের হটিয়ে দিয়েছিল, সেরকম একটা ব্যবস্থার কথা তো ভাবা যায়
    -‘চাঁদে হাত বাড়িওনা নীলু, পস্তাবে
    -‘এই তালিকাটা দেখুন পিকে এখানে অন্ততঃ ৫০ জনের নাম আপনি পাবেন যাদের কোন না কোনভাবে সরিয়ে দিতে পারলে বাজারের ৯০% আমাদের দখলে এসে যাবে
    -‘কি মুস্কিল, আবারো বলছি, এদের মেরে তো ফেলা যাবে না?’
    -‘মারামারির প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু বাজার থেকে এদের তাড়াতে হবে সে জন্য একটা পরিকল্পনাও আমি করেছি আমরাপ্রতিশব্দপ্রকাশনী থেকে এই পঞ্চাশজন লেখককে আলাদা আলাদাভাবে চিঠি দেবো নিমন্ত্রণ জানাবো আমাদের দপ্তরে তারপর এঁদের প্রত্যেককে এক একটি লোভনীয় আর্থিক প্রস্তাব দেবো এই প্রস্তাবে আমরা এঁদেরকে নিশ্চিতি দেবো যাতে আমৃত্যু খাওয়া-পরা-আমোদ-আহ্লাদের জন্য এঁদের কোন চিন্তা না থাকে বিনিময়ে এঁদের লিখে দিতে হবে যে গল্প/উপন্যাস লেখবার জন্য তাঁরা আর কখনো কলম তুলবেন না তবে গল্প/উপন্যাস এঁদের নামে বেরোতেই থাকবে, এবং তা বার করবে শব্দকল্পদ্রুম!! সোজা ভাষায় বললে এক অভিনব ধরণের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক আরকি! কি, আইডিয়াটা কেমন?’
    -‘লেখকদের তুমি চেন না নিলয় এঁরা কেউই রাজী হবেন না লিখে রাখো
    -‘প্রত্যাখ্যান করাটা কিন্তু খুব সহজ হবে না পিকে লেখকদের বাঁধা রোজগার নেই লেখাও বেরোয় অনিয়মিতভাবে তারপর আছে মুড, যা না এলে লেখায় ছিপিএর উপর আছে আমজনতার চাহিদা, যা প্রতিমুহূর্তে বহুরূপীর মতো বদলাচ্ছে আজকে যার চূড়ান্ত কাটতি, কাল সেই লেখকই আস্তাকুঁড়ে তারপর বয়স হওয়া আছে আছে নানারকম সাংসারিক ঝামেলা আর এতেও কাজ নয়া হলে আছে মোক্ষম দাওয়াই অবাধ্য মাথাকে যা দু-দিনে হেঁট করিয়ে ছাড়বে
    -‘কি সে মোক্ষম দাওয়াই?’ জানতে আগ্রহী প্রফুল্লবাবু
    -‘আন্ডারকাটিং পিকে; ব্যবসার ব্রহ্মাস্ত্র এঁরা রাজী না হলে এঁদের স্টাইল নকল করে ভেজাল গল্পে বাজার ছেয়ে দেবো জলের দরে বিক্রি করব সেইসব গল্প অতএব ভাও কমানো ছাড়া এঁদের গতি থাকবে না আবার এঁরা দাম কমালে  ভেজাল গল্পের দাম আরো কমিয়ে দেবো দেউলিয়া করে ছেড়ে দেবো সব শালাকে

    প্রফুল্লবাবু স্তম্ভিত

    -‘কিন্তু এঁদের সৃষ্টির তাড়না? সৃষ্টির নেশায় তারা তো তোমার পরিকল্পনা বানচাল করে দিতে পারে
    -‘সুরের খাদ্যে, পিকে, মানুষের ক্ষিধে মেটে না টাকার মুখে লাথি মেরে এরা যাবে কোথায়?’
    -‘দেখো্ চেষ্টা করে কি দাঁড়ায়হাল ছেড়ে দেন প্রফুল্লবাবু

    (আট)

    নিলয়ের নামের তালিকার প্রথম নামটি শ্যামল রায়ের উঁচু মাপের এই সাহিত্যিকের সঙ্গে কথা বলতে নিলয়ের একটু ভয়ই করছিল কিন্তু নয়া দমে ধীরে ধীরে তার বক্তব্য পেশ করে সে শ্যামলবাবু অত্যন্ত মার্জিত মানুষ গলাধাক্কা নয়া দিয়ে চা খাইয়ে মিষ্টই কথায় নিলয়কে বিদায় জানান তিনি

    তালিকার দ্বিতীয় লেখক শচীন ধর টেবিলে রাখা ভারী পিতলের ছাইদান তুলে নিলয়ের মাথা ভাংতে উদ্যত হয়েছিলেন, কিন্তু সময়ে সামলে নেন

    এই দুটি ঘটনার হপ্তা দুয়েকের মধ্যেই জাল শ্যামল এবং জাল শচীনের গল্প হু হু করে বেরোতে লাগলো আজেবাজে সমস্ত পত্রিকায় যতক্ষণে তাঁরা এটা টের পেলেন, ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে দুজনের টেবিলেই কমপক্ষে আধ ডজন প্রত্যাখ্যাত গল্প সম্পাদকেরা বেশী দাম দিয়ে আর আসল মাল কিনতে চাইছেন না

    শ্যামলবাবু বিচক্ষণ ব্যক্তি ফোনে নিলয়ের সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে এলেন স্বর্ণবিশ্রান্তিপত্র সই করাতে নিজে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হল নিলয়

    শচীনবাবুকে টানা তিনদিন ঘোরালো নিলয় এবং তাঁর অবসরপ্রকল্প স্থিরীকৃত হল নামমাত্র মূল্যে নিলয়ের টেবিলের কাটা কাঁচের ভারী ছাইদানের দিকে এবারও হাত বাড়িয়েছিলেন শচীনবাবু ……… কিন্তু করে উঠতে পারেননি কিছুই

    নিলয়কে এর পর এর তেমন কোথাও ছোটাছুটি করতে হয়নি নামী, অনামী, খ্যাত, অখ্যাত, উঠতি, পড়তি লেখকেরা তাঁদের সাহিত্যকীর্তি বগলে নিয়ে ধর্ণা দিতে লাগলেনপ্রতিধ্বনিপ্রকাশনীর দরজায় নাম, কাটতি, সম্ভাবনা ইত্যাদি পাল্লায় চড়িয়ে বিচার করে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা মূল্য ধার্য করল নিলয়

    এবং সেই বছরের শেষেই সাহিত্যের বাজারের শতকরা ৮০% দখল করে নিলপ্রতিধ্বনিপ্রকাশনী শব্দকল্পদ্রুম-এর কল্যাণে

    (নয়)

    একটানা এতক্ষণ লিখে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি বিড়ির প্যাকেটটাও শেষ এক কাপ কড়া চা পেলে মন্দ হত না

    চা? মাসের আঠাশ তারিখে? সে সমস্ত দিন কি আর আছে?

    আমার কেরোসিন কাঠের নড়বড়ে টেবিলটার মালিন্যের সঙ্গে বড় খাপছাড়া লাগছে ওটা, আজ সকালের ডাকেই যেটা এসে পৌঁছেছে দামী আর্ট পেপারে ছাপা এমবস করা স্বর্ণবিশ্রান্তিপত্র, প্রেরকপ্রতিধ্বনিপ্রকাশনী এরই সঙ্গে এসেছে তিন পাতার নিয়মাবলী আর আবেদনপত্রও

    নামী লেখক আমি নই, এমনকি মাঝারিও না অবরেসবরে দু-একটা ছোট পত্রিকায় দুচার লাইন ছাপা হয় কিন্তু কোন প্রতিযোগিতাই আজ আর সহ্য করতে পারছে নাপ্রতিধ্বনিপ্রকাশনী এমনকি আমাদের মতো অখ্যাত লেখকদের কাছ থেকেও সেই কারণেই ঐ ঝকঝকে তকতকে ছাপার কাগজগুলি পাঠানো হয়েছে আমার কাছে, যাতে আমার মধ্যে ক্ষীণতম যে প্রতিযোগিতার ইঙ্গিত পাচ্ছে ওরা তা পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়

    ব্যস, একটামাত্র সই, আর তাতেই সব সুরাহা

    বিনিময়ে? প্রতি মাসে একটা ধরাবাঁধা রোজগার, সংসারের মলিন দারিদ্র্যের উপর হয়ত একটা পলেস্তারা, হয়ত কি ভাবে আরও একটা দিন চলবে সেই যন্ত্রণাদায়ক চিন্তা থেকে মুক্তি, হয়ত একদিন একটু ভাল খাবার, একটু দম নেওয়া এ সমস্তই তো প্রায় আলাদীনের প্রদীপ আমার কাছে

    কিন্তু………………………… লিখতে পারবো না যে? শীতের শেষে বসন্ত যখন সমস্ত পৃথিবীকে ভরিয়ে তুলবে রঙের ছোঁয়ায়, তখন নিজের খেয়ালে শব্দ গেঁথে গেঁথে ছবি গড়ে তুলতে পারা যাবে না কাঁদা যাবে না মানুষের দুঃখে প্রত্যয়ে ভরিয়ে দেওয়া যাবে না হতাশায় মুহ্যমান মানুষের বুক আপ্লুত হওয়া যাবে না শিশু শরীরের গন্ধে বাঁচতে হবে পাথরের মতো, দিন কাটাতে হবে প্রস্তরের অপরিবর্তনের নিয়মে

    পাশের ঘুপচি ঘরটা থেকে ভেসে আসছে আমার তিন মাসের মেয়ের কান্না জন্মাবধি বড় রুগ্ন, বাঁচবে কি না জানিনা ভাল পথ্য দেওয়া যায় নি ওর মাকে- দেওয়া যায় নি শিশুকেও এখনকার কান্নাটা ক্ষিধেরমাসের আঠাশ তারিখে যে ক্ষিধে মেটানোর সাধ্য আমার নেই

    একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী ঈশ্বরে বিশ্বাস কেড়ে নিয়েছে বহুদিনই কিন্তু এই মূহুর্তে, প্রচণ্ড মানসিক দ্বন্দ্বের মুখে দাঁড়িয়ে আপনাআপনিই আমার হাঁটু মুড়ে আসছে, হাত উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে আমার প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হচ্ছে, বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, হে ঈশ্বর, ঐ রুগ্ন শিশুকে অনাহারে মরতে দেওয়ার মতো সহ্যশক্তি আমাকে দাও

    আমাদের সবাইকে দাও


    রোওল্ড ডাল-এর
    ‘দ্য গ্রেট ইংলিশ গ্রামাটাইজেটর’
    কাহিনী অবলম্বনে

    [সৌম্য সেনশর্মা]





    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.