>

কথা কবিতা

SongSoptok | 12/10/2014 |





সপ্তম পর্ব!
খোন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালে টাঙ্গাইলের শামসুল হক ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। খোন্দকার মোশতাক আর শেখ মুজিব ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। খোন্দকার মোশতাক সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোশতাক নমিনেশন পেতে ব্যর্থ হন। মোশতাকের নির্বাচনী এলাকায় আব্দুল জব্বার খদ্দর কে নমিনেশন দেয়া হলে ক্ষুব্ধ মোশতাক স্বতন্ত্র পার্টি থেকে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। এরপর দশ বছর মোশতাক  আওয়ামী লীগে ছিলেন না। ষাটের দশকে্র মাঝামাঝি সময়ে  মোশতাক আবার আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

২৫ মার্চ রাতে  পাকবাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন মোশতাক হক নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। এরপর কুমিল্লা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় যান এবং পবিত্র হজ্বপালনের জন্য মক্কা যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। তাজউদ্দিন তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়ার আহবান জানালে মোশতাক মক্কা যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেন।

মেহেরপুর আম্রকাননে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের পর পরই মোশতাক ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেন। তার সমর্থক উপদলের সমর্থনে তিনি তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন।জহিরুল কাইউম, আব্দুল মোমেন,শাহ মোয়াজ্জেম,কে এম ওবায়েদ,তাহেরুদ্দিন ঠাকুর অধ্যাপক আব্দুল খালেকপ্রমুখ মোশতাকের সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হন। প্রধান সেনাপতি, জেনারেল ওসমানী বাংলাদেশ মিশন প্রধান হোসেন আলীও নাকি এই গ্রুপের সমর্থক ছিলেন।

এপ্রিল মে মাসের দিকে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সদস্যবৃন্দ আলাদা আলাদাভাবে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠে। ইন্দিরা গান্ধী সবাইকে দিল্লী আমন্ত্রন করেন। এই আমন্ত্রনে যোগ দেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনী প্রধান। তারা ভারতের নীতির অস্পষ্টতা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তোলেন এবং বাংলাদেশকে ভারত কর্তৃক স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পি এস পি এন হাকসার এক পর্যায়ে জানতে চান, ভারত সরকার স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য তাদের মুক্তিযুদ্ধ চালাতে কোন সমস্যা হচ্ছে কি না এক পর্যায়ে হাকসার বলেন,ভারত সরকারের স্বীকৃতিই যদি তাদের প্রধান আকাঙ্ক্ষা হয়, তাহলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে ঢাকার পথে রওনা হতে হবে।  কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা ফিরে আসেন।

 ভারত সরকারের এই ভূমিকার পিছনে হয়ত  এটাই কাজ করেছে যে,একদিকে পাকিস্তানী হামলার মুখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ সংগ্রামের অধোগতি অন্যদিকে প্রবাসী সরকারের অন্তর্ভুক্ত সদস্য আওয়ামী লীগের উপদলীয় নেতৃবৃন্দের কলহে ভারতের নীতিনির্ধারক মহল ক্রমশ সন্দিহান হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, প্রবাসী নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিতে সক্ষম হবে কি না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে তখনো বাংলাদেশের সংগ্রাম স্বীকৃত নয়, আবার ভারতের অভ্যন্তরেও সরকারের বাম ডানপন্থীদের বিপরীতমুখী অবস্থান ভারত সরকারকে দ্বিধান্বিত করে তুলে। তা ছাড়া পাকিস্তানের সমর্থনে চীন আমেরিকার সাহায্যের মুখে ভারতের নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার ফলে মার্কিন বলয় থেকে বের হয়ে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াটাও ভারত সরকারের কাম্য ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যে ভারতের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে নয় এটাও ছিল সুস্পষ্ট। তারচেয়ে পাকিস্তানকে পূর্বাঞ্চলে গৃহযুদ্ধে ব্যস্ত রেখে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের নিরাপত্তা ততদিনে সুদৃঢ় করাটাই এই মুহূর্তে ভারতের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। তাই অল্পস্বল্প গোপন সাহায্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিরোধ সংগ্রামকে চালিয়ে নিয়ে তা প্রলম্বিত করাই ছিল এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ভারত সরকারের স্ট্র্যাট্রেজি।

২৮ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এক চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান যে, পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে এক নীরব প্রক্রিয়া চলছে। পক্ষকালের মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী  শরণ সিং আমেরিকায় যান পাকিস্তানকে সামরিক অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের আবেদন নিয়ে। আমেরিকা ভারতের সংযমের প্রশংসা করে বলেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক পর্যায়ে সমঝোতা এবং শান্তি পূনঃপ্রতিষ্ঠা হলেই শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব। কিন্ত শরণ সিং দেশে না ফিরতেই জানা যায় যে আমেরিকা পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে এবং এই উদ্দেশ্যে সমরাস্ত্রের যন্ত্রাংশ নিয়ে দুটো জাহাজ পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেছে। অন্যদিকে ২৮ জুনে দেয়া ইয়াহিয়ার ভাষণে বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস থাকলেও আওয়ামী লীগের সাথে আলাপ আলোচনা করার সামান্যতম ইঙ্গিত নেই।

মার্কিন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ভারতে আসেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যদানের ক্ষেত্রে ভারতকে বিরত রাখার আবেদন নিয়ে। ইন্দিরাগান্ধীও শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়াসহ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌছাবার জন্য পাকিস্তানকে চাপ দেয়ার জন্য কিসিঞ্জারের কাছে দাবী জানান। কিন্ত ব্যাপারে কিসিঞ্জার অপারগতা প্রকাশ করলে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা ছাড়া আমারও গত্যান্তর নেই। তখন কিসিঞ্জার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ভারত পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়ালে চীনের ভারতকে আক্রমন করার সমুহ সম্ভবনা বিদ্যমান। রকম অবস্থার সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে জানতে চাইলে কিসিঞ্জার ১৯৬২ সালে ভারত- চীনের যুদ্ধের সময় চুক্তি উল্লেখ করে বলেন,পাক-ভারত যুদ্ধে আমেরিকা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলেও চীন কর্তৃক ভারত সীমান্ত আক্রান্ত হলে আমেরিকা তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।
এরপর কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করেন এবং দেশে ফিরে গিয়ে বলেন, চীন যদি ভারত সীমান্ত আক্রমন করে তা হলে ক্ষেত্রেও আমেরিকা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে অর্থাৎ ব্যাপারে আমেরিকা ভারতকে পুর্ব চুক্তি অনুযায়ী সাহায্য করবে না

এতে ভারতের সকল মহলের উপলদ্ধি ঘটে যে, চীন-পাকিস্তান-আমেরিকার আক্রমনের কাছে ভারত অসহায়। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে সমর সাহায্য বন্ধ করে দিলে হয়ত আসন্ন যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব ,কিন্ত পুর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহার না করলে বিপুল পরিমানের শরণার্থী ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়, যেহেতু শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দু শরণার্থীর সংখ্যাই বেশি। অতএব ভারত সরকার তার উত্তরপূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার জন্য সোভিয়েত সহযোগিতা লাভে তৎপর হয়ে উঠে।

বাংলাদেশ সরকার গঠনের ফলে পাকিস্তান সরকার তার সমর্থক বিদেশি শক্তিগুলো বেকায়দায় পড়ে। চীন মার্কিন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো প্রকাশ্যেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ অন্যান্য ইসলাম পন্থী দলগুলো পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর গণহত্যাকে শুধু সমর্থনই করলো না, পরবর্তীকালে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী শান্তি কমিটি গঠন করে পাকিস্তানী সহযোগী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো এবং সমান্তরালভাবে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের উপরে নির্যাতন চালালো। আন্তর্জাতিক বৈরিতা, পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতন, রাজাকারদের অত্যাচার আর মুজিব নগর প্রবাসী সরকারদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কলহে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠলো।

২০ জুন কলকাতায় ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্ম সচিব অশোক রায় যথাশীঘ্র বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য তাজউদ্দিনকে অনুরোধ করেন। তাজউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব গ্রহণ করে জুলাইয়ের তারিখে শিলিগুড়িতে বৈঠক অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করেন।  তাজউদ্দিন একা। তাকে সাহস বা ভরসা দেয়ার মত কেউ নেই। সবাই নিজ নিজ উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যস্ত। এই সময় জাতীয় পরিষদের সদস্য ময়েজউদ্দিন মেঘালয় থেকে কলকাতায় আসেন।আভ্যন্তরীন সমস্যা জ্ঞাত করে তাজউদ্দিন ময়েজউদ্দিনের হাত ধরে বলেন, কিছু একটা করেন ময়েজউদ্দিন সাহেব। যদি দেশ স্বাধীন করতে না পারি তাহলে কোনদিন বাংলার মাটিতে ফিরে যেতে পারবো না। সমগ্র বাঙালি জাতিকে পাঞ্জাবীদের দাসত্ব বরণ করতে হবে। ময়েজউদ্দিন ঢাকা জেলার কলকাতা প্রবাসী পরিষদ সদস্যদের একত্রিত করলেন শিয়াদহ স্টেশনের কাছাকাছি কোন এক হোটেলে। তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে তাদের সাথে বিশদ আলোচনা করেন। পরিষদের সদস্যরা আরও আগেই তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুনেছেন।ময়েজউদ্দিনের কাছ থেকে সবিস্তারে জেনে শামসুল হকসহ প্রতিটি সদস্য তাজউদ্দিন আহমদকে সহযোগিতা সমর্থনের আশ্বাস দেন এবং অন্যান্য জেলার পরিষদ সদস্যদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন।

জুলাই ১৯৭১ বাঙালি জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার দিন। জলপাইগুড়ি জেলার বাগড়োগরায় পরিষদ সদস্যদের সমাবেশ শুরু। খোন্দকার মোশতাক সভাপতির আসনে বসে আছেন। হাউজের সদস্যদের অনেকেই সভা একদিনের জন্য মুলতবি ঘোষণা করার জন্য সভাপতিকে অনুরোধ জানান। সভাপতি তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে শেখ আব্দুল আজিজকে বক্তব্য রাখার জন্য আহবান জানান। শেখ আব্দুল আজিজ সভামঞ্চে উঠেই তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেন। ময়েজউদ্দিন সভামঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলেন না তার মনে হচ্ছিল যা করার তা এখুনি করতে হবে। তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত করা হলে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা যাবে না। শেখ আজিজের বক্তব্যে পরিষদ সদস্যরা প্রভাবিত হলে তখন আর কোন উপায় থাকবে না। ময়েজদ্দিন নাটকীয়ভাবে মঞ্চে উঠে এলেন এবং এক হাতে শেখ আজিজের শার্টের কলার অন্য হাতে ঘাড় ধরে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মঞ্চের বাইরে ফেলে দিয়ে মাইক কেড়ে নিলেন। কেউ প্রতিবাদ করার আগেই তিনি আবেগে উদ্বেলিত কন্ঠে বক্তৃতা শুরু করলেন। খোন্দকার চেচিঁয়ে বললেন,Meeting is adjourned. তখন সদস্যরা উঠে বলতে লাগলেন, সভা চলবে। আজই সিদ্ধান্ত হবে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত,আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ সভা থেকে বের হয়ে গেলেন।

এরপর সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভা চলতে লাগল। সভায় জাতীয় পরিষদের ১৩৫ জন সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৯ জন সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপ তাজউদ্দিনের যোগ্যতা এবং তার ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা নিয়ে নানা ধরণের প্রচারণা চালাতে থাকে। মিজান চৌধুরী অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে দলীয় সম্পাদকের পদ থেকে তাজউদ্দিনের অপসারণ দাবি করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নৈরাশ্যজনক চিত্র তুলে ধরে বলেন, এর চাইতে দেশে ফিরে যেয়ে যুদ্ধ করা বা আপোস করা অনেক ভালো। কর্ণেল ওসমানী সম্পর্কে বলা হয়,মুক্তিযুদ্ধ ব্যবস্থাপনায় তার অক্ষমতার জন্যই মুক্তিসংগ্রাম দিনে দিনে ঝিমিয়ে পড়েছে।মোশতাক আহমদ তাজউদ্দিনের অযোগ্যতার প্রশ্ন তুলে ভারত সরকারের সমালোচনা করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ব্যাপারে তাদের মৌলিক অনীহার কারণেই খুব নগন্য পরিমান অস্ত্র তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কূটনৈতিক প্রশ্নে তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে চলছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত তাদের সমর্থন লা্ভ করবে কি না, তাও সন্দেহজনক। মূলত এসব কথা বলা হলেও এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে কোন দিকনির্দেশনার আভাস তাদের বক্তৃতায় ছিল না

এই সব অভি্যোগ,সমালোচনা,অনাস্থা,অপপ্রচার,নৈরাশ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াসের পরেও অধিকাংশ সদস্য স্বাধীনতার প্রশ্নে অবিচল থাকেন। বিভিন্ন অপপ্রচারের জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন,ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবংইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংএর জন্য যে সব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে তার ফল লাভের জন্য তিন চার মাস সময়ের প্রয়োজন।এত অধৈর্য্য হয়ে পড়লে কাংখিত ফল পাওয়া যাবে না তাজউদ্দিন বলেন, বিজয়ের জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম অশেষ ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন, তা সকল প্রতিনিধির পক্ষে নাও সম্ভব হতে পারে,ফলে যোগ্যতর নেতৃত্বের উদ্ভব সেখানে ঘটবেই। আমি নিজেও যদি সক্ষম না হই তবে যোগ্যতর ব্যক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্ত বিজয় বাংলাদেশের অনিবার্য। তুমুল করতালিতে তাজউদ্দিন অভিনন্দিত হন। এই অধিবেশন প্রবাসী সরকারের ভিতকে আরো শক্ত মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।উক্ত সমাবেশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ভারতের সীমিত সাহায্যের কারণে বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের মনে এক ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হয়। কারণ,ভেবেছিল আসার সাথে সাথেই হয়ত পর্যাপ্ত পরিমানে সামরিক সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্ত বাংলাদেশকে তাৎক্ষণিকভাবে সামরিক সাহায্য দেয়া ভারতের জন্য যে একটা জটিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তা সংখ্যাগরিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের মত অধিকাংশ সেক্টর কমান্ডারের উপলব্ধির বাইরে ছিল।তাই তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পর্যাপ্ত অস্ত্র-সশস্ত্র আর গোলা বারুদের অভাবে সেক্টর বাহিনী অনেকটা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে জুলাইয়ের ১১ তারিখে কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সভাপতিত্বে সেক্টর কমান্ডারদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের সার্বিক রণকৌশল নির্ধারণই ছিল এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য। এসময় মেজর জিয়াউর রহমান প্রস্তাব করেন যে, অবিলম্বে একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠন করা দরকার।এই প্রস্তাবে বলা হয়, যুদ্ধ কাউন্সিল পরিচালিত হবে সাতজন তরুণ অধিনায়ক দ্বারা। বর্তমান প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী সেনাপতি পদ থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। প্রস্তাবের মূলমর্ম ওসমানীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থাব্যঞ্জক হওয়ায় কর্নেল ওসমানী প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পদত্যাগ করলে প্রবাসী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে, এবং এতে মুক্তিযুদ্ধের উপর একটা কুপ্রভাব পড়তে পারে -- এই ভেবে তাজউদ্দিন ওসমানীকে পদত্যাগ থেকে বিরত করেন। আসলে এটা ছিল যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সামরিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি পদ থেকে অপসারণের চেষ্টা কারণ ওসমানী অপসারিত হলে চাকুরীরত অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র মেজর জিয়াই প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব লাভ করতেন। মেজর জিয়ার এই চক্রান্ত বুঝতে পেরে মেজর শফিউল্লাহ এবং মেজর খালেদ মোশাররফ যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের বিরোধিতা করেন। শফিউল্লাহ খালেদের বিরোধিতার ফলে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেজর জিয়ার সাথে ওসমানীর সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কর্নেল ওসমানী মেজর জিয়াকে গ্রেফতার করার জন্য তিনবার নির্দেশ দেন।

এদিকে মুজিব বাহিনী প্রবাসী সরকারের জন্য উদ্বিগ্নের কারণ হয়ে দাঁডায়। প্রথম দিকে ভারত সরকার তাদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে তাজউদ্দিন সরকারের কাছে গোপন রাখেন। ভারত সরকার কর্তৃক মুজিব বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ খতিয়ে দেখা যায়। এক, শেখ মণির দাবি অনুযায়ী একমাত্র তারাই সশস্ত্র বাহিনী গঠনের ব্যাপারে শেখ মুজিবের মনোনীত প্রতিনিধি। ব্যাপারে ভারতের উর্ধতনমহল শুধু ওয়াকিবহালই নন,অধিকন্তু এদেরও সহায়তা প্রদানের ব্যপারে ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ  দুই, যদি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা কোন কারণে নেতৃত্বপ্রদানে ব্যর্থ হন, তবে সে- অবস্থার বিকল্প হিসেবে এদেরকে সংগঠিত রাখা। তিন,বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কোন কারণে প্রলম্বিত হলে বামপন্থী প্রভাব যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে তার পাল্টা শক্তি হিসেবে এদেরকে সংগঠিত করা।

মুজিব বাহিনী গঠনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা আমিরুল ইসলাম বলেন,ভারতের দুটি স্থানে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।--- যতদূর জেনেছি,ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান রমানাথ কাও এর সাথে শেখ মনির লবিং ছিল। তাকে বুঝানো হয়, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সে সময় অসমর্থ হবে।অথবা এই নেতৃত্ব যে কোন সময় আপোস করতে পারে।তাকে আর বুঝানো হয় যে যুবশক্তি স্বাধীনতার উম্মেষ ঘটিয়েছে,তারাই কেবলমাত্র সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। প্রয়োজনে এই নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারবে। তা ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নবশক্তি চীন বা নক্সালপন্থীদের বিরুদ্ধে স্বাধীন সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে। পরে আরো জেনেছি যে, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের পিছনে কারণ হল এক বাক্সে সব ডিম না রাখা। বি এস এফ এর প্রধান রোস্তমজী মুজিব বাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্ত তার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য হয়নি।

মুলত আওয়ামী লীগের বিভক্তি মন্ত্রিসভার অনৈক্য,তাজউদ্দিনের বামঘেষা রাজনীতি ভারত সরকারের মনস্তাত্ত্বিক চাপের কারণ। যেহেতু দেশটা হল পাকিস্তান। তাদের গৃহযুদ্ধকে প্রলম্বিত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনসহ দেশটাকে চাপের মুখে রাখা্র সুযোগের সদব্যবহারও হয়ত ভারত সরকার করতে চেয়েছে। তা ছাড়া ইতোমধ্যে বিপুল পরিমানে হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এদের নিরাপত্তা নিয়েও ভারত সরকার চিন্তিত ছিল। এমন ভাবাও অস্বাভাবিক নয় যে,স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েও বাঙালি যে ভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মকলহে জড়িয়ে পড়েছে, দেশ কতটুকু স্বাধীন হবে তা নিশ্চিত না হতেই ক্ষমতা দখলে তারা যে ভাবে মরীয়া হয়ে উঠেছে, তাতে এদের একদল পাকিস্তানের সাথে আপোস করে যে দেশে ফিরে যাবে না তারও নিশ্চয়তা নেই। ফলে এই বিপুল সংখ্যক হিন্দু শরণার্থী কতটুকু নিরাপত্তা নিয়ে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন গৃহযুদ্ধ পরবর্তী পূর্ববাংলায় পুনর্বাসিত হতে পারবে,আর কতটুকুই বা তাদের বোঝা হয়ে থাকবে, তাও নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।তাই পাকিস্তানপুষ্ট ভারতীয় নাগা মিজো বিদ্রোহীদের মত একটা বিদ্রোহী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকেও সমান্তরাল সশস্ত্র বাহিনী  হিসেবে মুজিব বাহিনীর সৃষ্টির কারণ হতে পারে।

মুজিব বাহিনীর আত্মপ্রকাশ করার সাথে সাথে স্পষ্ট হয় যে,এই বাহিনী পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে কর্নেল ওসমানী তথা বাংলাদেশ সরকারের কোন এখতিয়ার নেই। ফলে তাজউ্রদ্দিন ওসমানী উভয়েই সন্দিহান হয়ে পড়ে। কিন্ত বিষয়ে মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যের ভূমিকা দোদুল্যমান। অনেক সময় মুজিব বাহিনীর ক্ষমতা সম্পর্কে উৎকন্ঠা প্রকাশ করলেও প্রত্যেকেই পৃথক পৃথকভাবে মুজিব বাহিনীর নেতাদের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ছিলেন আগ্রহী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের আত্মজ মুজিব বাহিনীর একজন উৎসাহী হওয়ায় মুজিব বাহিনীর প্রতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দুর্বলতাও কম ছিল না ফলে মন্ত্রিসভা এই বাহিনীকে নিয়ন্ত্রনে আনার ক্ষেত্রে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। এমনিভাবে মাত্র দুইমাস আগে যাদেরকে কেবলমাত্র ছাত্র যুবকর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল,বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতা এখতিয়ারের বাইরে তারাই হয়ে উঠে এক সশস্ত্র বাহিনীর স্বয়ং নিয়ন্ত্রিত অধিনায়কবৃন্দ। অথচ, যে সময় মুক্তি বাহিনীর তরুণ সেনারা অনাহারে অর্ধাহারে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করেছে,তখন মুজিব বাহিনীর তরুণরা দেরাদুনে সামরিক একাডেমির অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমস্ত সুখ-সুবিধা গ্রহণ করে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এরপর সব তরুণরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে অত্যন্ত অশালীন ভাষায় বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। এমনকি তারা কথাও বলে যে, শেখ মুজিবের গ্রেফতারের কারণ হল তাজউদ্দিন। সে যতদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবে ততদিন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না। তাজউদ্দিন তার মন্ত্রিসভা যতদিন ক্ষমতা আসীন ততদিন মুক্তি অর্জন সম্ভব নয় ... ইত্যাদি বিদ্বেষমূলক প্রচারণার পাশাপাশি তারা মুক্তিবাহিনীর সাথেও বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়, এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে মুজিব বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে।

[ক্রমশ]

[কথা কবিতা]








Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.