>

কমলেন্দু চক্রবর্তী

SongSoptok | 12/10/2014 |





সপ্তম পর্ব!

সেজদা জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে ৷ তখন গোনাগুনতি কয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল ৷ সব সরকারি ৷ যাদবপুর, শিবপুর,জলপাইগুড়ি আর খরগপুরের আই আই টি ৷ কাজেই চান্স পাওয়া বেশ কঠিন ৷ কিন্তু সে জন্য মেজদার কোনো আনন্দ নেই ৷ ওর মাথায় একটাই চিন্তা ও চলে গেলে আমাদের কী হবে ? নানুর দলের হাত থেকে কে বাঁচাবে ? চিন্তা আমাদেরও কম হচ্ছিল না ৷ মেজদা থাকা মানেই নানুর দৌরত্ব কমে যাওয়া ৷ তার উপর সেদিন ওভাবে ভানুকে মারার পর নানু যে কতটা খেঁপে আছে,সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না ৷ 

অনেক ভেবে চিন্তে মেজদা একটা বুদ্ধি বার করল ৷ আজকের রুকস্যাক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলে-মেয়েরা হয়তো হোল্ড অন (Hold all) কথাটার সঙ্গে পরিচিত নয় ৷ তাই একটু হোল্ড অল নিকে দুটো কথা হয়ে যাক ৷ নামটার মধ্যেই ব্যাপারটা বোঝানো আছে ৷ হোল্ড অল মানে সব কিছু ভরা যায় এমন জিনিস ৷ একটা মোটামুটি সিঙ্গল বেড বা তার চাইতে লম্বা-চওড়ায় কম মাপের একটা রবার এবং কাপড় মেশানো বিশেষ শিটের (Sheet) দুই মাথায় দুটো ঐ ধরনের শিট দিয়ে দুটো বড়বড় পকেট থাকে ৷ এই পকেটে দুটো তিনটে বালিশ ছাড়াও জামা-কাপড় থেকে আরও দরকারি জিনিস থেকে আরম্ভ করে জুতোটুতো সব দুটো পকেটে ভরা যায়৷ লম্বা শীটে পাট করে তোষক ইত্যাদি রাখা যায় ৷ তারপর সমস্ত জিনিসটা রোল করে দুটো বেল্ট দিয়ে বাক্লসে শক্ত করে বেঁধে দিতে হয় ৷ এতে সব জিনিস নিয়ে যেতে সুবিধা হয় ৷ আবার ট্রেনের মেঝেতে বা প্লাটফর্মে কি  অন্য জায়গায় ওটা খুলে শুয়ে পড়ায়ও যায় ৷ কোথা থেকে কোথায় , ‘এতো ধান ভানতে শিবের গাজন হয়ে গেল৷ হচ্ছিল নানুর হাত থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্য মেজদার চিন্তার কথা, কোথা থেকে এসে পড়ল কোন মাজাতে আমলের কি এক হোল্ড অলের কথা ৷ ব্যাস, আর একটা মাএ বাক্য বলেই হোল্ড অল ছেড়ে দিচ্ছি ঐ যে বেল্ট দিয়ে হোল্ড অলটা বাঁধা হয়,সেটা বাবার শখের দামী হোল্ড অল থেকে খুলে নিল ৷ তারপর সেই চওড়া চামড়ার বেশ মোটা বেল্ট নিয়ে মুচির কাছে গেল ৷ মুচি বেল্টটা কেটে তার মধ্যে বাকল্স (আমরা বলতাম বকলেস) লাগিয়ে দিব্যি সুন্দর কোমোড়ের বেল্ট বানিয়ে দিল সব ভাইদের ৷ তারপর শত্রুপক্ষ সামনে এলে কী করে কোমড় থেকে সেই বেল্ট খুলে সেটা ঘুরিয়ে কী করে শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করতে হয় তার রীতি মত ট্রেনিং দিল কয়েক দিন ৷ আমরা এখন বাইরে বেরোলেই কোমড়ে বেল্ট লাগিয়ে নিত ৷ বলা তো যায় না কখন কোথায় শত্রু পক্ষ হানা দেয় ৷ 

মেজদা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে জলপাইগুড়ি শহরে চলে গেলেও আমার আর কোনো ভয় নেই ৷ কারণ আমার কাছে শিবের (মেজদা) দেওয়া গান্ডিব (বেল্ট) আছে ৷ ভানুকে মারার পর ওদিকে আর যাইনি ৷ কাজেই কোনো ঝামেলা হয়নি ৷ এখন আমি নিশ্চিন্তে নানুদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাই ৷ কেউ কিছু বলে না ৷ মনে হয় ভানুর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেছে ৷ একদিন বিকালের দিকে একা রাস্তা দিয়ে ফিরছি নানুর বাড়ির সামনে দিয়ে পেড়িয়ে আসছি শত্রু-এর এলাকা থেকে হঠাৎ হেনকালে হায় যমদূত প্রায় কোথা এল মালি (নানু) ৷ এসেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,তুই আমার গায়ে আবির লাগিয়েছিস ছোট ছেলে ভেবে আমি কিছু বলিনি ৷ কিন্তু তুই ভানুকে যে ভাবে মেরেছিস তাতে তো তোকে আর ছাড়া যায় না ৷ আজ তুই শেষ ৷ দেখি মেজদা তোকে কী ভাবে বাঁচায় ৷ দেখি মেজদা কী ভাবে বাঁচায় ৷ তুই আমাকে শেষ করবি না আমি তোকে এবার যে কি করব টের পাবি ৷ ভানুর কথা মনে নেই, আমি কথা বলতে বলতেই কোমড়ের বেল্টের বকলেস খুলে ফেললাম ৷ তারপর প্যান্টের আংটা থেকে বেল্টটা খুলতে একটু দেরী হয়ে গেল ৷ আর সেই ফাঁকে নানু আমার বেল্টের দুটো মাথা ধরে সোজা আমরা হালকা শরীরটাকে এক হাতে হাওয়ায় তুলে ধরল ৷ কোমড়ে হাওয়ায় ঝুললে শরীর বল হয়ে যায় শূন্য ৷ নানু বলে উঠল, বেল্ট বের করছে ৷ এই সাহস ? নে এবার মজা দেখ ৷ শরীরের জোর তো গেলোই, মনের জোরও শেষ ৷ এখন শুধু অসহায়দের মতো শূন্যে বল শূন্য হয়ে ঝুলে থাকা ৷ চড়কার লোকটার মতো ৷ কিন্তু  চড়কের লোকটা নিজের ইচ্ছায় দেখায় নিজের কেরামতি আর আমি ঝুলছি নানুর ইচ্ছায় আমার অসহায়তা প্রমাণ করতে ৷ আরশোলাকে চিৎ করে দিলে যেমন ওর কেরামতি সব শেষ হয়ে যায়,ছাগলের চোখে পাতা চাপা দিলে যেমন ওর সব জারিজুরি শেষ হয়ে যায় আমার অথবা বিড়ালের ঘেটি ধরে তুলে দিলে ওর ফোঁসফাস সব বন্ধ হয়ে যায়-আমার অবস্থা এদের থেকেও বোধহয় খারাপ ৷

ধপ করে নানু ওর হাতট ছেড়ে দিল ৷ আমি পাথর বাঁধানো রাস্তার উপর ধপ করে পড়লাম ৷ তারপর নানু আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সেই পাথরের রাস্তায় শরীরটাকে ঘষতে আর থেতলাতে থাকল ৷ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর নানু আমাকে ছেড়ে দিল ৷ ভাবলাম যাক মরে তো যাইনি ৷ এবার উঠে চলে যাই ৷ কোনোরকম ভাবে উঠে দাঁড়াতেই নানু আমার জামার কলারটা ধরে টানতে টানতে রাস্তার পাশে বিশাল চওড়া আর গভীরভাবে কাটা লম্বা শুকনো নালাটার মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ৷ তারপর নিজেও লাফিয়ে নেমে শুকনো আলগা মাটিতে আবার উপুর করে শুইয়ে মাথাটা ধরে আমার মুখটা গুজে দিল ৷ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ৷ মাটির গুঁড়ো আমার মুখ নাক দিয়ে ঢুকতে থাকল ৷ আমি মৃত্যুর কথা ভাবতে থাকলাম ৷ আসলে আমি তখন কিছু ভাববার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিলাম ৷ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পরে নানু আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল আর আমি এভাবেই পড়ে রইলাম ৷ তারপর কী করে ঐ ড্রেন থেকে উঠলাম,কী করে অতটা রাস্তা হেঁটে গেলাম,বাড়ি গিয়ে কী করলাম-কিছুই আমার মনে নেই ৷

মেজদা নেই কাজেই পরের দিন সকালে সেজদাকে ব্যাপারটা বললাম ৷ বললাম যে বেল্টের জন্য আরও বেশী মার খেয়েছি ৷ সেজদা বলল,কেন ? 
-বেল্টটা খুলতে পারছিলাম না ৷
-বেল্ট খুলতে পারিস নি ৷ এই দেখ,এই আমি বেল্ট কোমড়ে লাগালাম আর এই আমি খুলে হাতে নিলাম ৷ এক সেকেন্ড লাগল না ৷ এবার তুই কর ৷ 
-আমাকে আর করতে হবে না ৷ আমি বুঝে গেছি কোথায় আমি বোকামিটা করছি ৷ আমি তো প্যান্টের কোমড়ে আংটা আছে তার প্রত্যেকটার দিয়ে বেল্টটা গলিয়ে সুন্দর  করে পরেছিলাম ৷ অতগুলো প্যান্টের আংটা বা রিং থেকে বেল্ট বার করতেই পারছিলাম না ৷ 
-গাধা,বেল্টটা ওভাবে পরতে কে বলেছিল ঠিক আছে ৷ আর বেল্ট পরতে হবে না ৷
ব্যাস বেল্টা পরা তখনকার মতো শেষ হল ৷ পরে মনে হয়েছিল ৷ চোরডাকাত আসতে পারে অনেকে মাথার কাছে লোহার ডান্ডা নিয়ে ঘুমোয় ৷ যাতে চোর বা ডাকতরা ঐ ডান্ডা দিয়েই লোকটাকে ঘায়েল করতে পারে ৷ 

অনেক হল মারমারি এবার বাড়ির আমাদের কাজকর্ম নিয়ে একটু হয়ে যাক ৷ মানে আমাদের নিত্য কর্ম পদ্ধতি ৷ আমরা সকাল সকালই উঠতাম প্রায় একই সঙ্গে ৷ তারপর কয়লার উনুনের ছাই দিয়ে ঘুরে ঘুরে দাঁত মাজা, আমাদের বাড়ির পিছনের বড় বাগানে ঘুরে ঘুরে শাক সবজির অবস্থা দেখা ৷ তারপর বালতি করে দরকার মতো জল দেওয়া ৷ আবার গরুর গোয়ালে গিয়ে গোয়াল সাফ করা,গরুদের খড় এবং খোল দেওয়া (খরগোশের দানার খোসা) ইত্যাদি করে গরুর গলায় দড়ি বেঁধে মাঠে বেঁধে দেওয়া ৷ যে গরুর দুধ হয়, তার দুধ দোয়ানো ৷ এই সব কাজ শেষ হলে হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে বা উঠোনে পরপর সবাই কাপে কাপে চা খাওয়া ৷ বড়দের ভর্তি কাপ আর ছোটদের আধকাপ ৷ সঙ্গে আগের রাতের বাসি একটা বা আধটা হাতে বানানো রুটি ৷ মাঝে মাঝে রুটির সঙ্গে গুড়ও জুটত ৷ আমাদের কারোই খাওয়া নিয়ে কোনো নালিশ ছিল না ৷ কেবল সেজদা ছাড়া ওর একটু ভালো খাবারের বা একটু বেশী খাবারের প্রতি দূর্বলতা ছিল ৷ তবে কোনো বাড়াবাড়ি করত না ৷ চা খাওয়ার পর্ব শেষ হলে পড়তে বসা ৷ কাউকে পড়ার জন্য কিছু বলতে হত না ৷ মোটামুটি নয়টার মধ্যে সবার পড়া শেষ ৷ এরপর গায়ে সরষের তেল মেখে স্নান ৷ কিন্তু তার আগে অতি আবশ্যিক একটা কাজ ছিল আমাদের ৷ সেটা হল কুয়ো থেকে জল তুলে বাড়ির বাথরুমের চৌবাচ্চাতে জল ভরা ৷ আমাদের সদর দরজা থেকে প্রায় দুটো লম্বা বিল্ডিং-এর পরে বিশাল পাকা কুয়ো ৷ ইদাঁরা যাকে বলে ৷ রেল কোম্পানীর তৈরী এবং আমাদের একমাএ জলের উৎস ৷ কুয়োটার পারটা এতটাই চওড়া যে আমরা ওর উপরে বসে গল্পও করতাম ৷ জলের স্তর সবসময় একরকম থাকত না ৷ শীতকালে বা গ্রীষ্মকালে জলের স্তর অনেক নীচুতে নেমে যেত ৷ আমাদের কাছে কাজটা এতটা নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল যে ওসব নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না ৷ আমরা কয়েক ভাই মনের আনন্দে লোহার বালতিতে  দঁড়ি বেঁধে জল তুলে দুটো বড় বালতিতে ভরে বাড়ি পৌঁছে চৌবাচ্চাতে ঢালতাম ৷ প্রতিদিন চৌবাচ্চা ভর্তি করাটা যেমন কাজ তেমন মজা ৷ বিশেষ করে বর্ষাকালে  তো কথাই নেই ৷ জল একেবারে কুয়োর মুখে চলে আসে ৷ সোজা বালতি ধরে জল তুলে নিলেই হল ৷ আমরা কুয়োর জল নিয়ে অনেক খেলাও খেলতাম ৷ যেমন জলে দড়ি বাঁধা বালতি ফেলে জল ভরে একটা মাএ হাত দিয়ে বালতি তুলতে হবে ৷ না জানলে মনে হবে অসম্ভব ৷ প্রাকটিস করে করে এমন হয়ে গিয়েছিল আমরা প্রায় সবাই এক চেষ্টাতে সেটা করতে পারতাম ৷ কী করে করতাম, বালতিতে জল ভরার পর একদম রেডি হয়ে সেই বালতিকে হেঁচকা টান দিয়ে একেবারে হাতের কাছে নিয়ে আনতাম আর অনেকটা ক্যাচ ধরার মতো বালতির হাতলটা ধরে ফেলতাম ৷ আমরা পা দিয়েও জল তুলতে পারতাম ৷ আরও অনেক কেরামতি দেখাতাম, কিন্তু সে সব এখন আর মনে নেই ৷ সবার বাড়িতেই প্রায় কুয়োয় পড়ে যাওয়া বালতি তোলার জন্য একটা কাঁটা থাকত ৷ একটা লোহার রিং-এ অনেকগুলো বড়শি ধরনের লোহার কাঁটা থাকত ৷ লোহার বেশ বড় মাঝারি নানা ধরনের কাঁটা চারিদিকে মুখ করে ছড়িয়ে থাকত ৷ দড়িতে সেই কাঁটার রিংটা বেঁধে জলে ফেলে দড়িটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কাঁটাকে এদিক-ওদিক করা হত ৷ আর যেই বালতিতে লাগত তখন আস্তে আস্তে তুলে দেখতে হত বালতিটা কাঁটার সঙ্গে উঠছে কিনা ৷ অনেক সময় কাঁটায় পড়ে থাকা অন্য জিনিসও পাওয়া যেত ৷ একবার একটা বড় পিতলের ঘটও উঠেছিল আমাদের কাঁটায় ৷ কোনো কোনো সময় হাত পিছলে কাঁটা পড়ে যেত ৷ তখন অন্য কোনো বাড়ি থেকে কাঁটা এনে সেই কাঁটা তোলা হত ৷ এসব আমরাই করতাম ৷ বড়দের দরকার হত না ৷

থাক কুয়োর গল্প ৷ এরপর কুয়োর জলেই স্নান করে বাড়ি ফিরে স্কুলের পোশাক পরে ভাত আর আলু সেদ্ধ খেয়ে আমরা একসঙ্গে স্কুলে বেরিয়ে পড়তাম ৷ আমাদের সময় স্কুল ব্যাগট্যাগ বলে কিছু ছিল না ৷ বই নেওয়ার একটা নিজস্ব স্টাইল ছিল ৷ সমস্ত বই খাতা ডান কাঁধে রেখে ডান হাত দিয়ে ধরে আমরা দিব্যি হাটতাম ৷ প্রায় মাইল খানেক হাঁটলে স্কুল ৷ স্কুলের মজা ছিল টিফিনে খাওয়ার পাওয়া ৷ তারপর বাড়ি ফিরে আবার ভাত খাওয়া এবং খেলতে বেরিয়ে যাওয়া ৷ সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে একটু চা, তারপর পড়াশোনা ৷ বারান্দায় একটা বড় টেবিল ছিল ৷ সেই টেবিল ঘিরে আমরা পড়তে বসতাম ৷ যে যার পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকত ৷ কেউ কাউকে ডিস্টার্ব করত না ৷ তবে মাঝে মাঝে কিছু বুঝতে না পারলে জিজ্ঞেস করা ৷ পড়ার একটা সমস্যা প্রায় রোজ হত ৷ হ্যারিকেন ৷ হ্যারিকেনের ফিতে অসমান হলে, সেটা নিভিয়ে আবার কাঁচি দিয়ে কেটে সমান করে আবার জ্বালাতে হত ৷ তখন পড়া বন্ধ ৷ আবার হ্যারিকেনের চিমনি ঠিক মতো না লাগনো হলে বা জোরে হাওয়া হলে হ্যারিকেনের চিমনিতে কালি পড়ে যেত ৷ একটু আধটু কালি পড়লেও আমরা পড়া চালিয়ে যেতাম ৷ তারপর ধারে কালি প্রায় গোটা চিমনি ভরে গেলে সব আবছা অন্ধকার তখন কেউ একজন গিয়ে সেটা আবার ছাই দিয়ে পরিস্কার করে পড়া শুরু হত ৷ সেজদার পড়ার স্টাইলটা একটু আলাদা ৷ পরে হবে সেটা , কিন্তু হ্যারিকেন নিয়ে রোজকার সমস্যা হল দুপাশের দুটো মোটা স্ট্যান্ড যা হ্যারিকেনের গোড়ার দিক আর মাথার দিকটাকে ধরে রাখে ৷ এই স্ট্যান্ডে আলো বাধা পেয়ে দুপাশের দুটো দিকে ছায়া ফেলে ৷ যেখানে বই পড়তে অসুবিধা ৷ আমাদের যার যার বসার জায়গা নির্দিষ্ট  ছিল ৷ তাই যে আগে এসে বসত, সে স্ট্যান্ডের দিকটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিত ৷ কিন্তু  পরের জন এসে তার  সুবিধা মতো হ্যারিকেনকে ঘুরিয়ে আলোটা নিজের দিকে করে নিত ৷ মাঝে মাঝে পড়া বন্ধ থাকত ৷ শুধু হ্যারিকেন ঘোরা ঘুরিই চলত ৷ আর প্রতিবারই আমার দিকে শেষ পর্যন্ত ছায়া থেকে যেত ৷ আমি বোকা ছিলাম তো তাই কিছু বলতাম না ৷ যতোদিন মেজদা দোমহনীতে ছিল,মানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায় নি,ততদিন ওর বসার চেয়ারটা থাকত মাঝখানে ৷ কেউ তাতে বসত না ৷ আর হ্যারিকেনের আলো থাকত সবচাইতে বেশী ৷ এটা ছিল সতসিদ্ধ তাই ওটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না ৷ 

মনে আছে সে বছর মানে ক্লাশ এইটে একটা অ্যালজেবরার অংক অংকের মাস্টারমশাই একটা বোর্ডে একটা অংক করতে গিয়ে আটকে গেলেন ৷ মাস্টারমশাই খুব ভালো অংক করান ৷ আমার ওনাকে খুব ভালো লাগত ৷ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও তিনি অংকটা মেলাতে পারছিলেন না দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল  ওনার জন্য ৷ ক্লাশ ভর্তি ছাএের সামনে নিশ্চয়ই উনিও খুব বিব্রত বোধ করছিলেন ৷ শেষে পুরো পিরিয়ডটা উনি বোর্ডে নানাভাবে চেষ্টা করে গেলেন ৷ কিন্তু অংকটা মেলাতে পারছিলেন না ৷ ঘরে গিয়ে আবার চেষ্টা করব ৷ মাস্টারমশাই এভাবে বেরিয়ে যাওয়াটা আমার ভালো লাগল না ৷  বাড়ি গেলাম ৷ সেজদাকে দেখালাম অংকটা ৷ সেজদা সঙ্গে সঙ্গে অংকটা নিয়ে বসল ৷ তারপর সেজদার অংক কষা চলতেই থাকল ৷ সেজদা স্কুলে যায়, বাড়ি আসে ৷ খায় দায় আবার সেই অংক নিয়ে বসে ৷ সকাল থেকে রাএি একটা মাএ অংক ৷ পাতার পর পাতা শেষ ৷ তিন দিনের মাথায় স্কুলে যাওয়ার আগে মেজদা আমার হাতে একগাদা কাগজ দিয়ে বলল, নে এটা ফ্রেশ করে কপি করে নিয়ে যা ৷ দেখলাম অংকটা করতে ওর প্রায় তিন পাতা ভর্তি করতে হয়েছে ৷ আমি কিছু চিন্তা না করে সেটা কপি করে স্কুলে চলে গেলাম ৷ অংক মাস্টারমশাই আসতে আমি কাগজগুলো হাতে দিয়ে বললাম, এই যে স্যার, অংকটা হয়ে গেছে ৷
-সেকি তুমি করে ফেলেছো ? আমার তো এখনও মেলেনি ৷ 
স্যার আমার কাগজটা নিয়ে ভালো করে দেখলেন ৷ আমি তখন উওেজিত হয়ে পড়েছি ৷ মেজদার জন্য গর্ব হচ্ছে ৷ কিন্তু এও ভাবছি যদি মাস্টারমশাই বলে ভুল হয়েছে ৷
-এটা তুমি করেছো ?
-না স্যার, আমার মেজদা করেছে ৷ 
-তোমার মেজদা যে এবার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছে ৷ ভারি দুষ্টু ছেলে ৷ আমি চুপ করে থাকলাম ৷

তারপর আমাকে বললেন, শোন ও তোমার মেজদা একটা জায়গায় ঠিক ধরেছে,যেটা  আমি মিস করে গেছি ৷ এই অংকটা যেভাবে ও করেছে সেটা ভালো বলব না মন্দ বুঝতে পারছি না ৷ ও নিজের বুদ্ধি দিয়ে পরপর স্টেপ করে গেছে ৷ ঠিকই আছে ৷ কিন্তু ও একটু বেশি অংকের রাস্তায় হেঁটে ফেলেছে ৷ ফলে অংকটা এতো বড় হয়ে গেছে ৷ আমি তোমার মেজদার করা অংকটাকে এবার ছোট করে বোর্ডে লিখছি ৷ মানে ছয় লাইনের মতো করেই স্যার অংকটা মিলিয়ে দিল ৷ আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,মেজদাকে বলো আমি খুব খুশি হয়েছি ৷ আর ওকে আমার করা ছোট সাইজের অংকটা দেখিয়ো ৷ একেই বলে জেদ আর বুদ্ধির সঠিক মিশ্রন ৷ 
বাড়িতে এসে মেজদাকে বললাম, ও কিছু বলল না ৷ পরে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলেছিল, পৃথিবীতে এমন কোনো অংক নেই যা করা যায় না ৷ 

সেই মেজদা কিন্তু বাংলা, ইংরাজী, ইতিহাস বই দেখলেই রেগে যেত ৷ কী এত সব মুখস্থ করতে হবে ৷ আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ ভালো কবিতা লিখেছে ভালো কথা ৷ ছাপিয়ে ঢাউস ঢাউস বই করেছে ৷ সেটাও ভালো কথা ৷ নোবেল পুরস্কার পেয়েছে খুব ভালো কথা ৷ কিন্তু তাই বলে সেটা আমাদের বইতে দিয়ে কী লাভ হচ্ছে ৷ কেন আমাকে ওগুলো মুখস্থ করতে হবে ৷ কবিতা মুখস্থ আমার দ্বারা হবে না ৷ ইতিহাস নিয়ে তো তার যুক্তি আরও সরেস কথা বলেছিল রাজা রাজায় যুদ্ধ হয়েছে ৷ হয়েছে ৷আমরা যেসব কাজ করি সেটা কি ইতিহাস লেখকরা জানে ৷ আমি কোন সালে, কোন তারিখে কী কী করেছি সেটা কি কেউ জানতে চায় ? তবে শিবাজী হোক বা শাহাজাহান আমার তাতে কী এসে গেল ৷ যুদ্ধ করছিস কর, রাজ দখল করছিস কর ,এরমধ্যে আমাদের টানা কেন বাবা ৷ যারা ইতিহাস বই লেখে তারা খুব খারাপ লোক ৷ মেজদা অবশ্য আমার মতো ব্যাকব্যাক করে এত কথা বলেনি ৷আমি লেখার সময় ওর সংক্ষেপে বলা কথা গুলো একটু বেশী করে লিখলাম ৷ কারণ এই কথায় আমারও একটু সায় আছে ৷ মেজদা অংক আর বিজ্ঞানে খুব ভালো নম্বর পেত কিন্তু ইতিহাস, বাংলা এসবে মোটামুটি পাশ করতো ৷ ফলে সব মিলিয়ে রেজাল্ট খুব ভালো হত না ৷ মেজদার পড়াশোনায় একটা বিলাসিতা ছিল, কেউ ওকে ডিস্টার্ব করবে না ৷ আমি আর সেজদা খুব জোরে পড়তাম ৷ তাতে ও বিরক্ত হত ৷ কারণ সারাদিন টোটো কোম্পানি করে এসে শরীরে আর ক্ষমতা থাকত না ৷ সামনে বই রেখে ঘুমে ঢুলত ৷ কিন্তু কিছু বলা যাবে না ৷ মাঝে মাঝে মা টেবিলের পাশ দিয়ে নিজের কাজে এদিক-ওদিক যেত ৷ মা ঢুকছে বুঝলেই আমরা টেবিলে টোকা মারতাম, আসছে মেজদার ঘুমের লাল চোখ খুলে যেত ৷ আর ভীষণ রেগে যেত ৷ পাঁচ মিনিটে আবার ঢুলুনি চালু হয়ে যেত ৷ রাত নটার মধ্যে আমাদের পড়া শেষ হয়ে যেত ৷ বেশী রাত করে পড়া বাবার বারণ ৷ পড়া হয়ে গেলে আমরা সবাই একসঙ্গে মা-এর বিশাল খাটে যে যার মতো ঢুকে পড়তাম ৷ কে কত মায়ের গায়ের কাছে থাকতে পারে ৷ তখন মা রামায়ণ বা মহাভারতের বিশাল বই বুকের উপর রেখে শুয়ে শুয়ে আমাদের পড়ে শোনাত ৷ শুধু শোনানো রীতিমত ব্যাখা করত ৷ মায়েরে বোধ হয় কাশীরাম দাসের মহাভারতটাই বেশী পছন্দের ছিল ৷ বই না দেখেই সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় গড়গড় বলত ৷ এখন ভাবলে অবাক লাগে ৷ মার বিদ্যা বরিশালের একটা গ্রামের স্কুলের ক্লাশ ফোর ৷ তখন এসব মনে হত না ৷ আমরা গোগ্রাসে ওসব গিলতাম ৷

আধঘন্টা মতো এই পাঠ চলত ৷ তারপর রাতে একটা তরকারি আর ভাত এবং ঘুম৷ বক্সা রোডে আমাদের একটা বোন হয়েছিল ৷ কেন জানি না বাবার এতে এতো আনন্দ হয়েছিল যে বাবা ওর নাম দিয়েছিল বিশ্বসুন্দরী ৷ যদিও আমার সেই বোন অত্যান্ত সাধারণ দেখতে ৷ কিন্তু বাবাকে সেটা কে বোঝাতে যাবে ৷ আমাদের কোনো ভাইবোনকে বাবা এতো গায়ে গায়ে রাখত ৷ বিশ্বসুন্দরী থেকে ওর নামটা ছোট হয়ে গেলো শুনু ৷ শুনু একজন নিপাট ভালো মেয়ে ৷ শুধু ভালো মেয়ে বললে হয় না ৷ খুব সরল এবং শান্ত ৷ বেশী কথা বলে না আর কথায় কাঁদত ৷ বাবা তখনকার দিনের হিসাবে একটা বড়সর সাইজের পুতুল কিনে দিয়েছিল ৷ এই পুতুলটা ছিল শুনুর প্রাণ ৷ সারাদিন সকাল থেকে রাএি পুতুল কখনও হাত ছাড়া করত না ৷ পুতুলটার নাম দিয়েছিল ভগিরথ ৷ কেন ভগিরথ আমরা তো জানতামই না, ও নিজেও জানত না ৷ শুনু যে কারো সঙ্গে বেশী কথা বলত না, কিন্তু ভগিরথের সঙ্গে সবসময় বিরবির করে কথা বলত ৷ আবার বকুনি লাগাত, বোকতও ৷ স্নান করানো খাওয়ানোও যেন ভগিরথের মা ৷ আমার মাঝে মাঝে শুনু আর ভগিরথের সম্পর্ক নিয়ে ওকে খেপানো ৷ তারপর আমরা বামনহাটে তিন বছরের মতো ছিলাম ৷ সেখান থেকে দোমহনী ৷ এই বদলির ঝামেলায় ভগিরথ কোথায় চলে গেল কেউ জানে না ৷ শুনু্ও এখন একটু বড় হয়েছে এবং স্কুল শুরু করেছে ৷ আমরা ভগিরথের কথা একদম ভুলে গেলাম ৷ বোধ হয় শুনুও ভুলে গিয়েছিল ৷ 

হঠাৎ একদিন পুরানো জিনিস ঘাটতে ঘাটতে কোথা থেকে ভগিরথের পুনরোদ্ধার হল ৷ নোংরা, কালিঝুলি লাগানো ভগিরথ ৷ শুনু প্রথমে ভগিরথকে দেখে বেশ চমকে গেল ৷ কেন জানি না ওর ভগিরথকে নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাল না ৷ মেজদা,সেজদা আর পিছন পিছন লেজুর আমি ভগিরথকে নিয়ে ছাদে উঠে গেলাম ৷ তারপর শুরু হল ফুটবল খেলা ৷ এর পা থেকে ওর পায়ে ৷ ভগিরথ আমাদের পায়ে পায়ে ছাদের এপাশ থেকে ওপাশ থেকে আছাড় খেয়ে মরছে ৷ শুনু ছাদে উঠতে পারে না বলে নীচু  থেকে ছোট গলায় চিৎকার করছে খেলা থামিয়ে ভগিরথকে ওর কাছে দিতে বলল ৷ কিন্তু কে কার কথা শোনে ৷ তারপর মেজদা জোরে এক লাথিতে ভগিরথকে এমন জায়গায় ফেলল যে ভগিরথ আশেপাশের মাঠের কোনো একটা জায়গায় আবার হারিয়ে গেল ৷ শুনু কেমন হয়ে গেছে ৷ একে তো শান্ত চুপচাপ থাকে ৷ এখন যেন আরও ঠান্ডা হয়ে গেছে ৷ আমি দু-একবার কথা বলতে গেলাম ৷ বলল, তুমিও ফুটবল খেললে ৷ পারলে একটা জ্যান্তমানুষকে নিয়ে- ভগবতীকে নিয়ে ফুটবল খেলতে ৷ আমি আর কথা বাড়ালাম না ৷ 

আস্তে আস্তে দিন থমকে থাকা থেকে ফুল স্প্রীড নিল ভগবতীর পাট শেষ হল ৷ আমাদের বাড়ির চারধারেই মাঠ আর গাছপালা শুধু পিছন দিয়ে গোয়াল ঘর আর বাগান ৷ আমাদের বাড়ির কাছেই একটা সজনে গাছ ছিল ৷ সজনে ফুল মাঝে মাঝে কুড়িয়ে আনতাম ৷ ভাজা হত ৷ আর সজনের ডাটা সে তো রান্না যতো হত তার চাইতে বেশী হত আমাদের তলোয়ার ৷ আর ছুঁড়ে মারার জিনিস ৷ প্রথম কোলকাতায় এসে সজনে ডাটা ওজন করতে দেখে আমি বিশ্বাস করিনি এভাবেও এই ডাটা বিক্রি হয় ৷ আর তার এত দাম ৷ যাক গে, ঐ সজনে গাছতলায় ছিল আমাদের বন্ধুদের আড্ডাখানা ৷ ওখানে বসে আমরা টুকিটাকি খেলতাম ৷ খেলতে খেলতে দেখি এক জায়গায় মাটিটা কেমন যেন উঁচু হয়ে আছে ৷ ব্যাস শুরু হল খোড়াখুড়ি ৷ একটু খুড়তেই বেরিয়ে পড়ল ভগিরথ ৷ কবল থেকে দৌঁড়ালাম সোজা শুনুর কাছে ৷ মাটিটাতি লেগে ওকে আর চেনা যাচ্ছে না ৷শুনু হাতে নিয়ে বলল কী এটা ? 
-ভগিরথ ৷ আমি বললাম ৷ 
সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে ফেলে শুনু সোজা ঘরে ঢুকে গেল ৷ 

এখন ভাবলে গা শিউরে ওঠে ৷ আমরা কতটা নৃশংস ছিলাম ৷ হোক না একটা রবারের পুতুল কিন্তু কারো একটা ভালোবাসার জিনিস ৷ আমরা বোধ হয়  হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলাম সে সময় ৷ ভুলে গিয়েছিলাম যে শুনু আমাদের নিজের বোন আর ও ভগিরথকে জ্যান্ত বলে মানে ৷ কিন্তু এতো করেও আমাদের নেশা মিটল না ৷ মেজদার নেতৃত্বে আমরা আবারগ গেলাম সজনে গাছটার কাছে ৷ এবার হল ভগিরথকে বেঁধে গাছের ডালে গলায় দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁসি ৷ শুনু দূরে দাড়িয়ে সব দেখল ৷ ওর চোখ দিয়ে অনর্গল জল ঝরে পরছে ৷ কিন্তু কারো ভ্রুক্ষেপ নেই ৷ অনেকক্ষণ এই ফাঁসি খেলা চলল ৷ তারপর ওখানে মাটি খুঁড়ে ভগিরথে দেহটা মাটিতে পুঁতে কবর দিয়ে দেওয়া হল ৷ সব কাজ শেষ করে আমরা ঘরে ফিরে এলাম, এবং সব ভুলে গেলাম ৷ ভগিরথের পাট চুকল কিন্তু চুকল না ৷ শুনু এখন অনেকটা স্বাভাবিক ৷ কিন্তু একটা জিনিস ক্রমশ প্রকাশ পেতে লাগল যে শুনু এখন যে কোনো পুতুলই হোক কি বড়ো প্লাস্টিকের হোক বা রবারের কোনো পুতুল দেখলে ও ওখান থেকে সরে যেত ৷ এটা দেখে আমরা আবার নতুন খেলায় মাতলাম ৷ আমরা পুতুল ওর কাছে এনে রাখতাম ৷ আর কীভাবে চিৎকার করে পালায় সেটা দেখে আনন্দ উপভোগ করতাম ৷ শুনু ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় আমরা ওর বুকের উপর পুতুল রেখে আসতাম ৷ শুনু যখন টের পেত লাফ দিয়ে উঁচু খাট দিয়ে নেমে চিৎকার করতে করতে পাগলের মতো দৌড়াত ৷ মা শুনুকে বোঝাত যে ওটা শুধুই পুতুল , ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই ৷ কৈ আর তো কেউ ভয় পাচ্ছে না৷ তুমি এখন বড় হচ্ছো ৷ ঘরে বাইরে পুতুল তো থাকতেই, ওভাবে ভয় পেলে হয় ? শুনু  চুপ করে শুনত ৷ 

-সে জন্যই তো মা আমরা ওর গায়ে পুতুল দিয়ে দিয়ে ভয়টা ভাঙাতে চেষ্টা করছি ৷ খুব ভালো ছেলেদের মতো মেজদা তার যুক্তি দেখাল ৷ মা মেজদার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, তুমি চুপ কর ৷ তুমিই সব নষ্টের গোড়া ৷ 

শুনুর ভয় পাওয়াটা কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকল ৷ ওর ভয় আর শুধু পুতুলে সীমাবদ্ধ রইল না ৷ ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ল অন্য যেকোনো ধরনের খেলনার উপর ৷ প্লাস্টিক গাড়ি ইত্যাদি ছোটখাট যে কোনো খেলনা দেখলে ও ভয় পেত ৷ কাঁদত, উঠে যেত ৷

অনেকদিন পরে আমাদের মাথায় বোধ হয় শুভ বুদ্ধির উদয় হল ৷ শুনুকে আমরা বোঝতে শুরু করলাম যে ওসব নিস্প্রাণ জিনিস দেখে ভয় পাওয়ার কোনো মানে হয় না ৷ ওসব শুধুই খেলনা ৷ শুনু কী বুঝত জানি না ৷ কিন্তু চুপ করে শুনত ৷ উওর দিত না ৷ মানুষের একটা সুবিধা হল, মানুষ সব কিছু ভুলে যায় ৷ আমরাও ভুলে গেলাম ৷ জীবন চলতে থাকল ৷ আমাদের তখন যানবাহন বলতে সারাদিনে একটা দুটো ট্রেন ৷ কোথায় যাচ্ছিল মনে নেই তবে আমাদের পুরো পরিবার ট্রেনে যাচ্ছিল ৷ আমরা অনেকগুলো ল্যান্ডাপ্যান্ডা ৷ একেক করে গাড়িতে উঠলাম ৷শুনুও উঠল ৷ ভালো করে উঠতে না উঠতেই চিৎকার করে দৌড়ে নেমে পড়ল ট্রেন থেকে ৷ তাকিয়ে দেখলাম একটা সীটে ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা একটা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে আর তাদের পাশে রয়েছে একটা বিশাল সাইজের পুতুল ৷ ব্যাস,শুনুকে আর ট্রেনে ওঠানো যায় না ৷ আমরা পাশের কামরার দিকে দৌঁড়ালাম বাক্স প্যারটা নিয়ে ৷ কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ৷ সকালের ট্রেন ধরতে এসে শেষে বিকালে ট্রেন ধরতে হল ৷

এরপর তেমন কিছু নেই ৷ আমাদের বাড়িতে সব ধরনের পুতুল খেলনা ইত্যাদি আসা বন্ধ হয়ে গেল ৷ শুনু এখন রীতিমত সংসারী, ছেলে কলেজ পাশ করে ভালো চাকরি করছে ৷ কিন্তু ওর দুঃখ ছেলেমেয়েদের কোনোদিন খেলনা কিনে দিতে পারেনি ৷ এখন আর খেলনা দেখে চিৎকার করে পালায় না ঠিকই, কিন্তু শক্ত হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে ৷ এখন ডাক্তার হিসাবে মনে হয় আমরা যা করেছি সেটা শুধু অপরাধ নয় ঘৃণ্য মনুষ্যত্ব্যের প্রকাশ ৷ 

আমাদের বড়দা কোলকাতায় জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে থাকত ৷ কোলকাতা বলতে দমদমে ৷ ছোট বেলাতেই জ্যাঠামশাই নিয়ে গিয়েছিল ৷ সেজন্য বড়দাকে আমরা  অন্য বাড়ির ছেলে ভাবতাম ৷ কেন ওই ছেলেটা (বড়দা) আমাদের মাকে মা বলে ডাকে তাই আমার রাগ হত ৷ থাকগে সে সব কথা ৷ বড়দার প্রসঙ্গ এই জন্য তুললাম যাতে নতুন কিছু বলতে পারি ৷ আমি যখন ক্লাশ এইট, মানে সালটা ষাট হবে ৷ বড়দা একটা বড় পিচবর্ডের বাক্স পার্সেল করে পাঠাল ৷ ব্যস্ত হয়ে আমরা খুললাম ৷ একি ? এগুলো কি ? চপ্পল ৷ কিন্তু চামড়ার নয় ৷ নরম নরম কেমন জানি ৷ একটা কাগজে বড়দা লিখেছে সবার জন্য হাওয়াই চপ্পল পাঠালাম ৷ এই প্রথম হাওয়াই চপ্পল দেখলাম ৷ নিজের নিজের পছন্দ আর মাপ অনুযায়ী পায়ে পরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ৷ সবার মনে হতেই পারে আজকের দিনে একটা হাওয়াই চপ্পলের পড়তে হবে ? আমি জানি হাওয়াই চপ্পল আজকাল কোনো বস্তুই নয় ৷ কিন্তু আমাদের আনন্দটা ছিল, প্রথম পাওয়ার ৷ সে আনন্দের কথা অন্য লোক বুঝবে কি করে ৷

যখন ডটপেন বেরোলো তখনও বড়দা সবার নামে ডটপেন পাঠিয়ে ছিল ৷ সেটা খুব আনন্দের খবর ছিল ৷ পেনের কথা যখন উঠল, তখন পেন নিয়ে কিছু বলি ৷ প্রাইমারি ক্লাশে আমরা পেনসিলে লিখতাম ৷ ক্লাশ ফাইভ থেকে সবাই পেন মানে ঝর্ণাপেন (fountain pen) দিয়ে লিখত ৷ কিন্তু আমি পেনসিলেই চালাতাম ৷ কিন্তু পরীক্ষার সময় পেনসিল চলবে না ৷ তখন আমি কালি আর কলম দিয়ে লিখতাম ৷ দোয়াতে কালি পাওয়া যেত আর পাওয়া যেত হাত-কলম ৷ আমরা বলতাম হ্যান্ডেল পেন ৷ ছয় ইঞ্চির চাইতেও লম্বা একটা কাঠ গোল করে কলমের মতো দেখতে হত  এই হ্যান্ডেল পেন ৷ পেনের মাঝখানটা একটু বেশী মোটা আর একধারটা একেবারে সম ৷ অন্য দিকে ফাউন্টেন পেনের মতো নিভ আর জিভ লাগানো ৷ ভেতরটা ফাঁপা থাকত না, কালি ভরা যেত না ৷ দোয়াতের কালিতে চুবিয়ে নিয়ে লিখতে হত ৷ কিছুটা লেখ আবার কালিতে চোবাও ৷ লিখতে কোনো অসুবিধা হত না ৷ সমস্যা একটাই খাতার মাঝে মাঝে বেশী কালি পড়ে যেত ৷ আমাদের কাছে ব্লটিং পেপার থাকত ৷ লিখতাম আর ব্লট করতাম ৷ মাঝে মাঝে খাতার লেখার চাইতে কালির ছাপ বেশী হয়ে যেত ৷ আর বাড়ি ফিরতাম যখন মুখ-হাত জামা প্যান্টে কালির ছাপ নিয়ে৷   একদিন ক্লাশ ফাইভে পরীক্ষা দিচ্ছি হেডমাস্টার এসে দাড়ালেন আমার পাশে, তারপর বললেন , বাঃ তুমি এখনও কালির দোয়াত আর কলম দিয়ে লেখ, ভালো লাগল আমার দেখে ৷ লেখ বলে হেডমাস্টার চলে গেলেন ৷ রাতে শুয়ে ভাবলাম স্যার হয়তো ভালো মনে খুশি হয়েই বলেছেন, কিন্তু সবাই তো ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখে তবে কি স্যার আমাকেও ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখতে বলে গেলেন ৷ ব্যাস, সকালে উঠে মাকে বললাম, আমার ফাউন্টেন পেন চাই ৷ পেলামও ৷ ক্লাশ এইটে বড়দা তো ডট পেনই পাঠিয়ে দিল ৷

(ক্রমশ)

[কমলেন্দু চক্রবর্তী]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.