কতৃ বা কর্মকারকে বাঙালি যাই হোক, ভাববাচ্যে সে পুরো আঁতেল চূড়ামণি। সে কাফকা দেরিদা এলিয়ট দিয়ে দুবেলা ভাত মেখে খায়। আরে, অমুকের নাম শুনিস নি? এমন করুনাঘন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিনাদিত হাসি উপহার দেবে যে আপনি আবার জন্ম নিতে চাইবেন। এ হেন বাঙালি কাব্যচর্চায় কতটা কাঙালি একটু অন্দরে ঢুকলেই মালুম হবে। কাব্যচর্চায় আসলে আমরা একটা মোটামুটি সিলেবাস অনুসরণ করি। বোল ধরলেই যোগীন্দ্রনাথের ছড়া দিয়ে শুরু করি
... পাড়ার
ফাংশানে স্টেজে উঠে বাঙালির বাচ্চা ছড়া বলছে, গদগদ বাবা মা স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে ভুলে যাওয়া লাইন সাপ্লাই দিচ্ছে এ দৃশ্য আপনি সারা জীবনে একবার অন্তত দেখেছেনই। স্কুলে ভর্তি হবার পর ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে’, ‘কাঠবেরালি কাঠবেরালি পেয়ারা তুমি খাও?’, ‘ভয় পেয়না ভয় পেয়না তোমায় আমি মারবো না’, লিচুচোর, পাল্কির গান থেকে হালে ভবানী প্রসাদ মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনির্মল বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কামিনী রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রহমানের ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে’। ক্লাস ওয়ান টু নাগাদ সংস্কৃতিবান বাপ মায়ের ছেলেপেলে স্কুলের এ টু জেড অনুষ্ঠানে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ঘটাবেই, কিম্বা ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারেবারে’,
‘দূত’ কে ভুত বানিয়ে রগড় করে নি এমন বাঙালি খুঁজে পাবার জন্য কোন ঘোষিত পুরষ্কার নেই।
বাঙ্গালির আবার আবৃত্তি শেখার বাই আছে। সুতরাং সিলেবাসের বাইরে তখন ‘অবনী বাড়ি আছ?’, ‘আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী, ‘কেউ কথা রাখে নি’,
‘মনে
কর যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’,
‘চে,তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দ্যায়’, (এটা অবশ্য প্রগতিশীল দের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় চলে একমাত্র), ‘আফ্রিকা’,
‘দেবতার
গ্রাস’, ‘বিদ্রোহী’,‘ফরিয়াদ’,‘ছাড়পত্র’,‘একটি মোরগের কাহিনী, ‘উলঙ্গ রাজা’,
‘কলকাতার
যীশু’, দু এক চামচ জয় গোস্বামী, (‘বেনিমাধব’ মাস্ট),
দীনেশ
দাশ, ‘বনলতা সেন’, ‘আবার আসিব ফিরে’,
‘হে
বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’ ‘রানার’,
‘অবাক
পৃথিবী’, ‘ঐ সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ’ ইত্যাদি কয়েকটি পেটেন্ট মাল নিয়ে বেশিরভাগের কারবার। ভাবসম্প্রসারনের জন্য
রবীন্দ্র কবিতার বাইরে নজরুলের দু চার পিস, বড়ু চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জয়দেব, চর্যাপদ থেকে অতি ব্যাবহারে আপন করে ফ্যালা কয়েক
পংক্তির বাইরে চর্চা নেই ই প্রায়। বিষ্ণু
দে, বুদ্ধদেব বসু, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু, সমর সেন, ভাস্কর চক্রবর্তী, অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত, নবনীতা দেব সেন, কৃষ্ণা বসু, মল্লিকা সেনগুপ্ত, রণজিৎ দাস, ফণীভূষণ আচার্য, মনীন্দ্র গুপ্ত, তারাপদ রায়, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ
এবং অগুন্তি কবি বঙ্গদেশে জন্মেছেন কিনা তা নিয়ে আম বাঙালির কোন মাথাব্যথা
নেই। তার বসারঘর আলো করে তিনটি ধর্মগ্রন্থ, ‘সঞ্চয়িতা’, ‘সঞ্চিতা’,
আর ‘সুকান্ত সমগ্র’। এই নিয়েই তার সংস্কৃতিবান ছাব্বিশ ইঞ্চি ছাতি ফেটে প্রায় গ্যাল গ্যাল।
ব্যাপারটা আবার খানিকটা কন্ট্রাডিক্টরি শোনায় কারণ এ বঙ্গে লোকে অন্ন
বস্ত্রনবাসস্থানের ন্যুনতম চাহিদা পূরণ
হোক না হোক ঊনকোটি চৌষট্টি লক্ষ কবি রাত দিন এক করে কবিতার জন্য প্রাণপাত করছে।
গণমাধ্যমে সবাই প্রায় লেখক। পাঠক হাতে গোণা। সেই মুষ্টিমেয় পাঠকের আবার কয়েক
প্রকার। ইনটেনসিভ রিডার নগণ্য। বেশীরভাগই পল্লবগ্রাহী। সবজান্তা। কিছুই পুরো জানে
না। সবখানে গলাতে অভ্যস্থ তার বদখত নাকটি । গড়পড়তা বাঙালির এপিক তথা ক্লাসিক মুখে মুখে শুনে অভ্যেস । রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড , ওডিসি সে কাব্যাকারে পড়েছে বা শুনেছে খুব রেয়ার , এসব গল্পের আকারে শ্রুতিপাঠ করে বা পড়ে। এদ্দুর লেখার পর
আমার আরেকখানা আমি মনের ভেতর মিনমিন করে বলল, এই জন্যই বাঙ্গালির কিস্যু হয় না, কাঁকড়ার জাত, ভালো কিছু চোখে দ্যাখ না কেন, শুনি ?
এই যে বাঙালি সংস্কৃত সাহিত্যের বিপুল
উত্তরাধিকার পেয়েছে, মহাকবি কালিদাসের ‘কুমার সম্ভব’, ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, ‘মেঘদূত’ ইত্যাদি, তারপর ধর গে চর্যাপদ, মৈথিলী ভাষায় রচিত সাহিত্যসম্ভার, তারপর পল্লী প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা লোকমুখে প্রচলিত অগুন্তি ছড়া, চারণ কবির দল গেয়ে গেয়ে বেড়িয়েছে যে সমস্ত প্রবহমান গীতিকবিতা, পালাগান, কবির লড়াই, পাঁচালি, ব্রতকথা, শের শায়েরি, রুমি, মির্জা গালিব এর উর্দু থেকে বঙ্গিভুত অপূর্ব সে
আলো এই অন্ধকার দূর করেছে বাঙালির সে ঋণ স্বীকার না করলে রৌরব নরকে পুড়ে মরবে হে! অগত্যা বিরস বদনে তর্ক জুড়ি, শোনো হে ভালো দেখনেওয়ালা, কব্বে তুমি ঘি খেয়েছ, তা শুঁকে শুঁকে কদ্দিন চালাবে হে! কি ছিল , না ভেবে, কি আছে তার ডেবিট ক্রেডিট মেলাও দেখি, তবে না বুঝবো, ধারে ভারে তুমি আদৌ কাটার যোগ্য কিনা! পড়ার মধ্যে তো পড় খালি নিউজ পেপার, রবিবাসরীয় সাহিত্য, দু চারটে ম্যাগাজিন আর পুজোসংখ্যা। আর
হ্যাঁ, ইদানীং বিজ্ঞাপনও সাহিত্য বটেক! যেমন ধর, বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের হোরডিঙ এ ব্যাবহৃত ছড়া, প্রচারাভিযান চালানো গাড়ি থেকে লাউডস্পীকারে ভেসে আসা ছড়া বেশ খায় পাবলিকে।
পাড়ায় পাড়ায় আজও কিছু ফেরিওয়ালার দ্যাখা মেলে যারা মজার মজার ছড়া বানিয়ে লোক আকৃষ্ট করে মাল ব্যাচে।
অনুবাদ সাহিত্যের কল্যাণ্যে বাঙালি নোবেল বিজয়ী কবিদের অনুদিত পুরষ্কার
প্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ কিনে ঘর সাজায়। পড়েও কেউ কেউ। শেক্সপিয়ার, পাবলো নেরুদা, মায়াকোভস্কি, হাইনরিখ হাইনে, জন ডান, শার্ল বোদলেয়ার, পল এলুয়ার, জ্যাঁ আরতুর, লুই আরাগঁ, স্তেফান মালার্মে, গুন্টার গ্রাসের মত কবিদের বঙ্গানুবাদ বাজারে
কাটে ভালোই, বহু খ্যাতনামা বাঙালি কবিই এদের কবিতার অনুবাদ
করেছেন। শঙ্খ ঘোষ, অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত অসিত সরকার ইত্যাদিদের
সম্পাদনায় এপার বাংলা থেকে যেমন এজাতীয় ভালো অনুবাদ কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে
তেমনি ওপার বাংলায় এ জাতীয় কাজ করছেন রহমান হেনরি, জুয়েল মাজহার, অবন্তী সান্যাল, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রতনতনু ঘোষ, শিহাব সরকার, শামসুজ্জামান খান, করুণাময় গোস্বামী, সুরেশ রঞ্জন বসাক এরা বেশ কাজ করছেন। ডানেরন‘ক্যাননাইজেসন’ এর প্রথম দুটি লাইন প্রেমিক বাঙালির প্রেমপত্রের
লব্জে অমর করে গিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। ফরাসী কবিতার বঙ্গানুবাদ কিম্বা তৃতীয়বিশ্ব, আফ্রিকার কবিতার অনুবাদের কাজ খুব ভালো হচ্ছে দুই বাংলাতেই। লাতিন আমেরিকার
সমকালীন এবং যারা নোবেল পান নি তেমন কবিদের নিয়ে কাজ সেই তুলনায় বাজারে অনেক কম।
ইদানিং জয়া চৌধুরীর মতো দু একজন এই সব কবিদের দারুণ দারুণ কবিতার অনুবাদ আমাদের
পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। গণমাধ্যমগুলিতে যেসব বাঙালির যাতায়াত অবাধ তাদের কাছেই
খুলে গ্যাছে এই কবিতা বিশ্বের বাতায়ন।
কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, তা বাঙালির চাইতে বেশি কেউ বোঝে না। কোন কবিতা
শালীন কোনটা অশালীন, কোনটা গঙ্গাজল আর কোনটা খেউর, কোনটা সফি কবিতা আর কোনটা বটতলা, কোনটা পোষ্ট মডার্ন আর কোনটা মান্ধাতা আমলের আউট
অফ ফ্যাশান এই নিয়ে চায়ের কাপে, বাংলা বোতলে তুফান তোলা বাঙালি দিব্যি আইকন পুজো
করতে পারে, তাদের কাব্যি প্রতিভার ছিটেফোঁটা থাক না থাক, হাভভাব কপি করতে পারে, কোঁচা দুলিয়ে আতর বুলিয়ে কবিতা মাড়িয়ে পরকীয়ার
লাইসেন্স প্রাপ্ত হতে পারে
... অতএব
সাধু সাবধান! প্লেটো কি আর সাধে কবিদের নির্বাসন দিতে
চেয়েছিলেন! এমনিতেই রাজ্যির অনৈতিক ব্যাপার স্যাপার আর
মিথ্যের চাষ করে কবিকুল এই ভদ্রসমাজে ল্যাজ নেড়ে বেড়াচ্ছে, (মাপ করবেন , আমার কথা থোরি এসব, আমি তো মহামান্য প্লেটোর ভারবাহী খচ্চর মাত্র!), তাদের থেকে নিরাপদ এবং সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখুন সেয়ানা
জনগণ। বিয়ের বাজারে বিজ্ঞাপন দিতে, পাত্র পাত্রী কবিতা লেখে এটা কোন ক্রাইটেরিয়া নয়!
বাঙালির ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বাচ্চা নাক সিটকাতে সিটকাতে বড় হয়, ম্যাগো! বঙ্গসাহিত্য কারে কয়! যতোসব বোকা বোকা সাবজেক্ট। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার হলেও না হয় কথা ছিল। বাবা মা চোখ নাচিয়ে বলে, আমার বেবি বাংলা বলে ঠিকই, পড়তে পারে না।
আমরাও বলি, কি হবে ওসব পড়ে ? অঙ্ক, কম্পিউটার আর সাইন্স ... ব্যাস, আর কিছু চাই না বাবা তোমার কাছে, পড়ে লিখে বিদেশ পালাও, আমরা এখানে বসে ডলার গুনবো (এসব অবশ্য মনে মনে)। যাদের গতি হোল জেনারেল লাইনে, ওগুলো ঢ্যাঁড়স! গুঁতিয়ে গাতিয়ে নেট ছিঁড়ে স্লেট ভেঙ্গে কামাল
করলো তো বেশ, না হলে আর কি, কানে বিড়ি গুঁজে, হলুদ পাঞ্জাবী পরে, কাঁধে খাদি না হলে শান্তিনিকেতনের ঝোলা নিয়ে ঘাস পুল পাতা নদী পাখির রচনা লিখে ধরণীর বোঝা বাড়াবে!
আদতে দোষটা বোধহয় বাঙলার জল হাওয়ার। এখানে নিয়মিত সঙ্গমের মত কবিতার তৃষ্ণা পায় কিছু মানুষ মানুষীর। এখানে আজও পাড়ার দাদার সাথে ‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ’ আবৃত্তি করতে গিয়ে প্রেম হয়ে যায় রক কাঁপানো সুন্দরীর। এখানে কিছু পাগল আজও কবিতা যাপন করে। এখানে কিছু আঁতেল কফিহাউস আর কাব্যচর্চা সমার্থক ভাবে। এখানে আজও কিছু নেশারু ভীষণ সফল জীবিকা অর্জনের পরও কবিতা ছাড়া অর্গাজমের কথা ভাবতে পারে না। এখানে আজও ক্লাস সেভেন এইট নাগাদ দু কলম লেখার চেষ্টায় কলম এর পেছন খেয়ে ফেলে বয়ঃসন্ধি...ভাগ্যিস!
[শর্মিষ্ঠা
ঘোষ]