>

শ্রীশুভ্র




অন্তরঙ্গ সম্পর্কের অভিমুখ বলতে সাধারণভাবে বিবাহকেই ধরা হয়। যদিও যে সম্পর্কের সমাজ স্বীকৃত ও আইনসিদ্ধ যাত্রা শুরু হয় ঐ বিবাহের সূত্র ধরেই! অনেক ক্ষেত্রেই দূর্ভাগ্যজনক হলেও, যার পরিণতি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েই দেখা দেয়। বিশেষতঃ আমাদের বাংলাদেশের সমাজসংসারে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের শুরু বিবাহের সূত্রেই গড়ে ওঠে। কেননা আমাদের সমাজে এখনো প্রাকবিবাহ সম্পর্কে অন্তরঙ্গতার পরিসর গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও আমরা নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসার প্রাথমিক পর্বকেই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বলে ধরে নিই, এবং অবশ্যাম্ভাবী বলে বিবাহকেই যে সম্পর্কের মধুরেণ সমাপয়েৎ বলে বিশ্বাস করে থাকি।

কিন্তু সত্য‌িই কি এই যে সার্বিক চিত্র, এর মধ্যেই অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা? অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বলতে আমারা ঠিক কি বুঝি? আর সম্পর্ক বিন্যাসের কোন চিত্রটিই প্রকৃত অন্তরঙ্গতাকে ধারণ করতে সক্ষম? সমাজস্বীকৃত আইনসিদ্ধ বিবাহের যে ঘেরাটোপকে আমরা সুস্থ সুন্দর সমাজজীবনের ভিত বলে ধরে নিই সেই ঘেরাটোপ কতটা সুস্থ আর কতটা সুন্দর? যে বিবাহবিচ্ছেদকে আমরা সন্দেহাতীত ভাবেই দুঃখজনক বলে মনে করে থাকি, তা কি সকল ক্ষেত্রেই সমান দুঃখজনক? নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বিন্যাসের কোন কোন শর্ত্তে রূপ পায় প্রকৃত অন্তরঙ্গতা? এইসব প্রশ্নগুলির জট খুলতে থাকলে তবেই হয়তো আমরা পৌঁছাতে পারব অন্তরঙ্গ সম্পর্কের আশ্চর্য্য রঙমহলের নিশ্চিত ঠিকানায়।

একথা খুবই সত্যি যে আমাদের সমাজ সভ্যতার আধুনিক বিন্যাস গড়ে উঠেছে পুরুষতন্ত্রের হাত ধরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়। যে ব্যবস্থার ভিত মূলত অর্থনৈতিক! এবং সেই অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসের চাবিকাঠিটি পুরুষেরই হাতে ধরা থাকে। নারী সেখানে পুরুষের বংশরক্ষার কাজে ব্যবহৃত একক মাত্র! আর সেই বংশরক্ষার সংস্কৃতির হাত ধরেই সমাজ সংসারে বিবাহ প্রথার সূত্রপাত। ফলে প্রথমেই এই বিষয়টি আমাদের পরিস্কার বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন আছে যে, সামাজ সংসারের পরিসরে প্রচলিত বিবাহপ্রথার  প্রধানতম শর্ত্ত  নারী পুরুষের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নয় আদৌ। পুরুষের বংশরক্ষাই হল বিবাহপ্রথার উদ্ভবের মূল কারণ। এবং এও বলে রাখা ভালো, নারীর  গর্ভবতী হওয়ার ক্ষমতা না থাকলে কিংবা বংশরক্ষার এই তাগিদ পুরুষের চেতনায় না থাকলে, বিবাহ প্রথাও সমাজে প্রচলিত হত না! এরই সাথে আমাদের আরও একটি বিষয় পরিস্কার জেনে রাখা ভালো যে, এই যে আবিশ্ব প্রায় প্রতিটি প্রধানতম ধর্মেই নারী পুরুষের বিবাহকে ঈশ্বরের বিধান বলে প্রচার করে একে একটি স্বর্গীয় মর্য্যাদা দেওয়া হয়; এইটিই পুরুষতন্ত্রের মাস্টার স্ট্রোক! আবিশ্ব সকল ধর্মই পুরুষতন্ত্রের সৃষ্টি! আর সেটিকে কাজে লাগিয়েই পিতৃতান্ত্রিক সমাজসংসার বিবাহ নামক বংশরক্ষার যাঁতাকলে আবহমান কালব্যাপী নারীকে বন্দী করে ফেলেছে সুনিপূণ কৌশলে।

আমাদের সমাজ সংসারের পরিসরে একটি মেযের জন্মের শুভক্ষণ থেকেই এই কৌশলটি নিপূণ দক্ষতায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেই সুদূর অতীতকাল থেকেইআর সেই কারণেই কন্যার জন্মের সময় থেকেই বলতে গেলে পিতামাতার চিন্তায় কন্যার বিবাহ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। যার সামাজিক প্রভাবে প্রায় প্রতিটি মেয়েরই চেতনায় ঋতুমতী হওয়ার পর থেকেই বিবাহই জীবনের প্রধানতম স্বপ্ন হয়ে উঠতে থাকে। স্বপ্নের রাজপুত্রের নেশা লাগতে থাকে চোখে। এইখানেই পুরুষতন্ত্রের মূল সাফল্য। আর একটু তলিয়ে দেখলেই পরিস্কার হয়, ঐ স্বপ্নের রাজপুত্রের ছবিটুকুর মধ্যেই ধরিয়ে দেওয়া হয় অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসের মূল চরিত্রটুকু। এইভাবেই সমাজ সংসার মেয়েদেরকে পুরুষের বংশরক্ষায় বলি প্রদত্ত করে গড়ে তোলে মূলত। তাই এই কথা বললে মোটেই অতিশয়োক্তি হয় না যে, বিবাহপ্রথা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আদৌ কিন্তু পরস্পরপরের পরিপূরক নয়। অর্থাৎ বিবাহই অন্তরঙ্গ সম্পর্কের শুরু বা পরিণতি এমনটা নয় মোটেই। পুরুষের বংশরক্ষাই যে প্রথার মূল উদ্দেশ্য ও চালিকা শক্তি তাকে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু বলে আমরা যতই বিশ্বাস করতে চাই না কেন, ঘটনা কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

স্বপ্নের ঐ রাজপুত্রের ছবিটির মধ্যেই কিন্তু মূল গল্পটি ধরা আছে। ঋতুমতী হওয়ার সময় থেকেই এই যে মেয়েদের স্বপ্নের আঙিনায় রাজপুত্রদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়, পিতৃতান্ত্রিক এই কৌশলের মূল অভিমুখ দুটি। একটি হল পুরুষের বাহুবল দৈহিক শক্তিসামর্থ্যের প্রতি নারীকে মোহগ্রস্ত করে রাখা। অর্থাৎ জীবনের সুরক্ষার জন্যে পুরুষই নারীর প্রধানতম ও শেষ ভরসাস্থল এই বিশ্বাসটি নারীর অস্থিমজ্জায় ধরিয়ে দিতে পারলেই নারীকে বশে রেখে ব্যবহার করা সহজসাধ্য হয়ে যায়। দুই, রাজপুত্রের চিত্রকল্পেই জাগতিক ঐশ্বর্য্যের অর্থনৈতিক স্বপ্নপুরণের মোহটিরও বিস্তার ঘটানো যায়, এবং সেইসাথে পুরুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের  বৈশিষ্টটিকে নারীর চেতনায় প্রথিত করে তাকে পুরুষ নির্ভর করে রাখার কাজটিকেও সাফল্যমণ্ডিত করে তোলা অনেক সহজ হয়। আর এই কাজগুলিই পিতৃতান্ত্রিক সমাজসংসার করে আসছে বিবাহপ্রথাকেই টিকিয়ে রাখার জন্যেই আবার পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বংশরক্ষার প্রয়োজনকেই এই বিবাহপ্রথার মাধ্যমে  চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আবহমান কালব্যাপি। বংশরক্ষাই পুরুষতন্ত্রের জীয়নকাঠি।

মজার কথা আধুনিক যুগের নর নারীর স্বাধীন প্রেম পরিণয় বিবাহের ঘটনাই হোক আর অভিভাবকদের  দ্বারা সংঘটিত পুত্র কন্যার বিবাহের সম্বন্ধ স্থাপনই হোক  বিবাহের মূল অভিমুখ কিন্তু সেই একই থেকে যায় এইটাই পিতৃতন্ত্রের সাফল্য। আর থাকে বলেই বিবাহিত জীবনের পরতে পরতে এত নানারকমের টানাপোড়েন দেখা যায়। বস্তুত বিবাহ নরনারীর পারস্পরিক চাওয়া পাওয়ার সরকারী দলিল হয়ে দাঁড়ায়।  আধুনিক যুগ প্রকরণের প্রেক্ষাপটে সেই চাওয়া পাওয়ার এবং স্বপ্ন ও বাস্তবতার ভারসাম্যে চুড়ান্ত অস্থিরতার সৃষ্টি হলেই  বিবাহবিচ্ছেদের সম্ভাবনা দেখা দেয়।  কিন্তু এই সংঘটিত বিবাহ তা সে প্রেম ঘটিতই হোক আর অভিভাবকদের দ্বারা নির্দ্দিষ্টই হোক সত্যই কি  কোনো অন্তরঙ্গতার জন্ম দেয় নারী পুরুষের পারস্পরিক চাওয়া পাওয়ার আঙিনায়?

প্রশ্ন এখানেই। পুরষের চেতনায় নারী যেখানে  বংশরক্ষার একক, পুরুষের বীর্জ স্খালনের আধার, আর নারীর চেতনায় পুরুষ যেখানে সামাজিক শারীরীক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদানের একমাত্র হাতিয়ার তখন সেই সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা কতদূর প্রসারিত হতে পারে তা তো সহজেই অনুমেয়! পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতার এইটিই সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ! আর আমাদের প্রত্যেকেরই  অস্থিমজ্জার পরতে পরতে চেতন অবচেতনের অনন্ত গভীরে এই অভিশাপ এতটাই জড়িয়ে গিয়েছে যে আমরা এইটি উপলব্ধিও করতে পারি না।  উপলব্ধি করতে পারি না আমাদের এই উপলব্ধি করার অক্ষামতাই কিভাবে সামাজিক অবক্ষয়কে চির সজীব রাখে।

প্রশ্ন তাই এইটি নয় যে বিবাহই কি অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সার্থক পরিণতি? প্রশ্ন এইটিও নয় যে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের অভিমুখ আদৌ বিবাহ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ কিনা? প্রশ্ন মূলত এইটিই যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কোনটি? অন্তরঙ্গ সম্পর্কের রসায়নটাই বা কি? আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের  দৃষ্টি দিতে হবে নিজেদের দিকেইআমাদের এই যে জীবাত্মা, এটির মূলত তিনটি আধার। শরীর, যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত বাকি সব কিছু। মন, যা দিয়ে আমরা আমাদের অন্তরের অনুভবগুলিকে বুঝতে পারি, বা স্বীকার করি। আর ব্যক্তিসত্ত্বা, যা দিয়ে আমরা  আমাদের পরিপার্শ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি।  নিজেকে প্রকাশ করি। একথা সহজেই বোঝা সম্ভব যে এই তিনটি আধারেরই সম্মিলিত মিলনেই গড়ে উঠতে পারে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের যোগসূত্র। অনেকেই বলবেন সেই যোগসূত্র তো বৈবাহিক সম্পর্কেই গড়ে ওঠার কথা। কথা তো ঠিক, কিন্তু গড়ে ওঠার পরিসরটাই তো নষ্ট করে বসে আছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজসংসার। যে সমাজে নিজের শরীর নিয়ে কথা বলা তো দুরস্থান ভাবাটাও খারাপ, এমনই ধারণায় গড়ে তোলা হয় আমাদের শিশুদের। আমাদের শৈশব থেকেই এই যে শরীর নিয়ে একটা অস্বচ্ছতা গড়ে তোলা হয় মননের পরিসরে; বস্তুত সেটাই আমাদেরকে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের অতলান্ত গভীরে পৌঁছাতে বাধা দেয় সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে তীব্রভাবে। যৌবনের উন্মেষলগ্ন থেকেই যৌনতাবোধের পরতে লজ্জা ও পাপবোধ  আমাদের পঙ্গু করতে থাকে ক্রমাগত। আমরা আমদের প্রকৃত স্বরূপ ও এই বিশ্বজগতের সাথে আমাদের সম্পর্কসূত্রটিকে উপলব্ধি করার শক্তি ও সামর্থ্য কোনোটাই অর্জন করি না!

করি না কারণ সেই পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা যেদিন থেকে আমাদের জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে, সেদিন থেকেই, আমরা প্রকৃতির সাথে আমাদের আন্তরিক সম্পর্কসূত্রের প্রকৃত চিত্রটি দেখার দৃষ্টিটুকুই হারিয়ে ফেলেছি। যে বংশরক্ষার প্রয়োজনে বিবাহ প্রথা নিয়ে পিতৃতন্ত্রের এত আস্ফালন, সেই বংশরক্ষার তাগিদ তো জীবজগতের সর্বত্রই। শুধু তাতে পিতৃতন্ত্রের মতো অর্থনৈতিক যোগসূত্র নেই কোথাও। কিন্তু মানুষের জীবন শুধুই বংশরক্ষায় পরিপূর্ণতা পেতে পারে না। পেলে মানুষের আর কোনো বিশিষ্টতা থাকে না জগতে। তাই শুধুই বংশরক্ষার সাংসারিক তাগিদ নয়, নারী পুরুষের শরীরের অন্তর্লীন অতলান্ত গভীরে আরও এক বিপুল বিস্ময় খেলা করে। কিন্তু আমাদের সমাজসংসার আমাদেরকে স্বাধীন ভাবে বিকশিত হতে দেয় না। তাই সেই বিপুল বিস্ময়ের আশ্বর্য্য রঙমহলের চাবিটি আমরা অধিকাংশ মানুষই খুঁজে পাইনা আমাদের জীবনযাপনের পরতে, আয়ুর সীমানায়।

পাই না বলেই আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সূত্রগুলি ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণুমান। যা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সৃষ্টি করে নানাবিধ জটিলতা। নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের একান্ততার বলয়টি মূলত যৌনতা কেন্দ্রিক। সেই সম্পর্ক বৈবাহিক রূপে পরিণতি পাক আর নাই পাক, আমরা স্বীকার করি আর না করি।  আসলে এই পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের গোড়াতেই রয়েছে প্রবঞ্চনা। আর সেই সূত্রেই আমাদের উত্তরাধিকারে প্রাপ্তি আত্মপ্রবঞ্চনার অভিশাপ। সেই অভিশাপেই আমরা আমাদের শরীর সম্বন্ধেই আদৌ সচেতন নই। আমরা জানতেও পারি না এই শরীরটিই হল এই বিশ্বজগতের লীলাক্ষেত্র! আমার এই একান্ত আপন নিজের শরীরটুকর মধ্যেই সুপ্ত হয়ে আছে মহাজগতের মূল ইশারা। আর এই না জানার জন্যই আমরা শারীরীক যৌনতাবোধের অনাদী অনন্ত সৌন্দর্যকে উপলব্ধি না করে যৌন কামনার শিকার হই। ভুগী সামাজিক পাপবোধের লজ্জায়।  আবার পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী পুরুষের মেলামেশার মধ্যে  রয়েছে স্বঃতস্ফূর্ত স্বাভাবিকতার একান্ত অভাব।  আর এই দুই কারণেই নারী পুরুষ পরস্পরের সাথে স্বচ্ছ ও নির্মল অনুভবে মিলতে বাধা পায়, নিজেদেরই অবচতনের টানাপোড়েনে। আমরা ভুলে যাই নারী পুরুষের পারস্পরিক যৌন আকর্ষনের মূল ভরকেন্দ্র কখনোই শুধুমাত্র বংশরক্ষা নয়। যদি তাই হয়, তবে পশুজগতের সাথে আমাদের বিশেষ পার্থাক্য নাই। পশুজগতের মধ্যে বংশরক্ষার বাইরে পারস্পরিক শরীরের আর কোনো মূল্য নাই। কিন্তু মানুষের সমাজ যখন নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রটিকে পারিবারিক ও বৈবাহিক ঘেরাটোপের মধ্যেই বেঁধে ফেলে, তখনই দুজন সদ্য শুভদৃষ্টি হওয়া পাত্র পাত্রীকে ফুলশয্যায় শুইয়ে দেওয়ার মতো পাশবিক কাজকেও নান্দনিক সংস্কৃতির ছদ্মবেশে চালিয়ে দিতে পারে। এবং সেই কাজের মধ্যেও কোনো পাপবোধ অনুভব করে না।

এই যে পাপবোধের অভাব, এইযে শরীরকে বাদ দিয়েই অর্থাৎ যৌনতাবোধের অনাদী অনন্ত  সৌন্দর্যের উপলব্ধির  উন্মেষ না ঘটিয়েই  বংশক্ষার প্রবল তাগিদে  দুটি নরনারীর যৌনসংসর্গ স্থাপনকে বিবাহ বলে চালানো এই রকম অন্ধকার চর্চার কারণেই ঘরে ঘরে দাম্পত্য সম্পর্কের রসায়নে এত ভেজাল। আমরা আগেই বলেছি অভিভাবক নির্ধারিত বিবাহই হোক আর স্বাধীন নির্বাচিত প্রেমের বিবাহই হোক ঘটনা পরম্পরা কিন্তু মূলত একই গোত্রের। কিছুমাত্র আলাদা নয়। তাই দেখা যায় আমাদের সমাজ বাস্তবতায় বিবাহের ঘেরাটোপে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিন্যাসের মূল সূত্র সেই পিতৃতন্ত্রের বংশরক্ষা ও নর নারীর অবদমিত যৌন কামনার পরিতৃপ্তির ক্ষেত্রই। আর সেই সম্পর্কের ভরকেন্দ্র হল নারীর সুরক্ষা ও পুরুষের বংশরক্ষা। অর্থাৎ সেই পারস্পরিক চাওয়া পাওয়া ও দেওয়া নেওয়া। তারই ভিত্তিতে নারীর ভরণপোষণ ও পুরুষের সেবা! আর এই  হিসেব নিকেশের মধ্যে সবদিক না মিললেই গণ্ডগোল! সম্পর্ক বিন্যাসের ভারসাম্যে টানাপোড়েন। যার চুড়ান্ত পরিণতি বিবাহ বিচ্ছেদ।

আমরা সবাই জানি পুরুষের আর্থিক সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল নারীকে জীবন ধারণের জন্যেই; অন্তরঙ্গ সম্পর্কে ফাটল ধরলেও, তা জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। তাই সেই প্রসঙ্গে না গিয়েও আমরা দেখে নিতে চাইছি বিবাহবিচ্ছেদ হোক বা না হোক; দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে যে হাজারো কারণে ফাটল ধরে থাকে, তার মূল ভরকেন্দ্রের অবস্থানটির সঠিক সরূপটি  কেমন! আর সেই সঠিক সরূপটি জানতে গেলেই আমাদের আরও একবার ফিরে যেতে হবে সেই জীবাত্মার তত্ত্বেই। অর্থাৎ যে তিনটি আধারের মধ্যে দিয়েই আমাদের জীবাত্মার প্রকাশসেই তিনটি অর্থাৎ শরীর মন ও ব্যক্তিসত্ত্বার পরিপূর্ণ উদ্বোধনের জন্যেই  আমাদের চেতনায় যৌনতাবোধের সঠিক উন্মেষ ঘটানো একান্তই জরুরী। এই যৌনতাবোধের সঠিক বিকাশ ছাড়া আমরা নারী পুরুষ কেউই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে পারি না। বস্তুত আমাদের এই সেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজবাস্তবতায় আমরা অধিকাংশই প্রাপ্তবয়স্ক না হয়েই আমাদের জীবনচক্র শেষ করে ফেলি। আমাদের নিজের শরীর মন ও ব্যাক্তিসত্ত্বার সরূপটি সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা থাকে না বলেই আমরা পিতৃতন্ত্রের শর্ত্তগুলিকেই জীবনবাস্তবতা বলে মেনে নিই আম্লানবদনে। আর সেই কারণেই কেবলমাত্র অবদমিত যৌন আকাঙ্খা ও বংশরক্ষার তাগিদেই আমরা দাম্পত্যের সম্পর্কসূত্রে যৌনসংসর্গের মধ্যেই আমাদের পরিতৃপ্তি খুঁজে নিতে চাই। তাই সেই পরিতৃপ্তির পরিসরেই আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের আয়ু। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় আমাদের শারীরীক অনুভবের পরিসরেই। আমাদের শরীর সম্বন্ধে আমাদের চেতনার বলয়টি এতই অসম্পূর্ণ ও অসচ্ছ যে সেই শরীরেও যে একটা আলাদা মন মনন মানসিকতা আছে, সে কথা জানতে পারি না আমরা কোনদিনই। আর ঠিক সেই কারণেই আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার হই সবার আগে। যার প্রভাব পরে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম বয়নে। এই কারণেই দেখা যায় অধিকাংশ দাম্পত্য সম্পর্কেই যৌন আকর্ষণের উষ্ণতা ক্রমশ শীতল হতে থাকে সন্তানের জন্মের পরপরই। তখন পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রের বন্ধনটি সন্তানকে কেন্দ্র করে স্থান বদল করতে থাকে। অমরা টেরও পাইনা প্রথম দিকে। এইখানেই চোরাবালি জমতে থাকে দাম্পত্য সম্পর্কের বয়নে। আমাদের নিজেদের শরীর আর আমাদের যৌনতাবোধের মধ্যে সম্পর্ক সূত্রটি এতটাই অপুষ্ট হয়ে গড়ে ওঠে যে আমাদের চেতনা অসাড় হয়ে পড়ে থাকে। আমরা না পারি নিজেকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে, না পারি জীবনসঙ্গীকে পুরোপুরি অনুভব করতে।  সেইখানেই হয়তো তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে আমাদের স্বপ্নের রঙমহল যার জন্যে প্রস্তুত থাকব না আমরা দুজনের কেউই।

সাধরণভাবে দাম্পত্যের এই অন্তরঙ্গতায় ফাটল দেখা দেওয়ার যে কারণগুলিকে আমারা চিহ্নিত করতে পারি একটু ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যেতে পারে আসলে সেইগুলি অধিকাংশই সিমটম মাত্র। আসল কারণ দুজনের যৌনসম্পর্কের চোরাবালিতেই প্রথিত। আর সেই সম্পর্ক পরিপূর্ণতা পেলে বাকি বৈষম্যগুলিকে সামলানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। নারী পুরুষের ব্যক্তিত্বের যে সংঘাতকে আমরা সম্পর্ক ভাঙ্গনের কারণ বলে উল্লেখ করে থাকি অনেক সময়ে; ব্যক্তিত্বের সেই সংঘাতও গড়ে ওঠে দুজনের যৌনসম্পর্কের সামঞ্জস্যের অভাবজনিত কারণেই। আর এইটি হয়, আমাদের জীবাত্মার সেই তিনটি আধারের মধ্যে  দিয়ে আমাদের পরিপূর্ণ বিকাশের পথটি অবরুদ্ধ থাকে বলেই। কিন্তু আমরা যদি আমাদের এই শরীর মন ও ব্যক্তিসত্ত্বার পূর্ণ  ও স্পষ্ট অনুভবের পথরেখা ধরে এগিয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যে আমাদের অর্দ্ধেক ব্যক্তিসত্ত্বার পরিপূর্ণ উদ্বোধনের শিক্ষা অর্জন করতে পারতাম, তবেই আমরা পরস্পরের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবাত্মারই পূর্ণ উদ্বোধন ঘটাতে সমর্থ হতাম। আর সেইটিই প্রকৃত বিবাহ। পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত নকল বিবাহ নয়।

এই যে আমাদের শরীর মন ও ব্যক্তিসত্ত্বার পূর্ণ অনুভবের শিক্ষা, সেইটিই দেওয়ার ক্ষমতা নেই এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার। সমস্ত গণ্ডগোলের মূলে এইটি আসল কারণ। আমাদের শরীর ও তার নিজস্ব মনন যাকে আমরা যৌনতাবোধ বলে চিহ্নিত করতে পারি, সেই সম্বন্ধে আমাদের চেতনার প্রসারতা ঘটানোর আশু প্রয়োজন! এই যৌনতাবোধই বিশ্বজগতের সাথে মানুষের একমাত্র যোগসূত্র। সেই যোগসূত্রটিকে আমাদের মন অর্থাৎ চেতন অবচেতন অনুভবের শক্তি যে মূহুর্ত্তে স্বীকার করতে সক্ষম হবে সেই মূহূর্ত্তেই আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বা হয়ে উঠবে প্রাপ্তবয়স্ক! আর তখনই আমরা আমাদের প্রকৃত জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পেতে জপ করবো “কোথায় পাবো তারে” কেননা তখনই আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বা তার যৌনতাবোধের শক্তিতে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে আমাদের জীবনের পূর্ণ উদ্বোধন তখনই সম্ভব হবে, যখন আমাদের শরীর মন ও ব্যক্তিসত্ত্বা আর একজনের শরীর মন ও ব্যক্তিসত্ত্বার সাথে পরিপূর্ণ মিলনে একাত্ম হয়ে উঠবে। সম্পূ্র্ণ ভিন্ন দুটি ব্যক্তিসত্ত্বা তাদের শরীর মন ও ব্যক্তিত্বের পরতে পরস্পরের সাথে একাত্ম হয়েই সেই সম্পর্কে পৌঁছাতে পারে যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কের একটিই অভিমুখ ‘ভালোবাসা: ভালোবেসে ভালোবাসা ভালোবাসাকেই’

কবির ভাষায়, “এ বাণী প্রেয়সী, হোক মহীয়সী- তুমি আছো আমি আছি”

শ্রীশুভ্র।

Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.