পরীক্ষার কথা বলি ৷ আমি ১৯৬৪ সালে পরীক্ষা দিয়েছি ৷ আমার
শরীর বরাবরই কমজোরি ৷ তার উপর রোদে অতক্ষণ যাওয়া ৷ দুটো করে পরীক্ষা এক একদিনে দিয়ে আবার রিক্সায় বাড়ি ফেরা –আমার কাছে বেশ ধকলের মনে হত৷ ইংরাজী পরীক্ষা brass কে boss লেখার কথা তো আগেই বলেছি ৷ অঙ্ক পরীক্ষার দিন অঙ্ক প্রশ্ন সোজাই ছিল ৷ আমি শুরু করলাম
৷ কিন্তু একটু পরেই আমার শরীর খারাপ হতে লাগল ৷ চোখে অন্ধকার দেখে অজ্ঞান হয়ে
গেলাম ৷ এখন জানি একে বলে vasosvagal attack . এটা সোজা কথায় বললে চিন্তা আর দুর্বলতা থেকে
হয় ৷ কিছুক্ষণের জন্য ব্রেনে রক্ত কমে যায় ৷ ব্রেন কাজ করে না ৷ শুয়ে বা মাথা নীচু
করে রাখলে এক আধ মিনিটের মধ্যে আবার সব ঠিক হয়ে যায় ৷ কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম,কখন
জ্ঞান ফিরল,তারপর কতগুলো অঙ্ক করলাম,কটা
ঠিক করলাম বা ভুল করলাম-কিছুই আর মনে নেই ৷ দিনে দুটো করে পরীক্ষা হত
৷ সেজদা থাকত ৷ বাড়ি থেকে হাত রুটি আর তরকারি থাকত সঙ্গে ৷ ওগুলোই খেতাম শরীর
খারাপের দিন সেজদা আমাকে নিয়ে কাছেই একটা মিষ্টির দোকানে গেল ৷ বেশ বড়বড় সাইজের
কয়েকটা মিষ্টি খাওয়ালো ৷ বলল,পেট ভরে খা ৷ তোর শরীরের জোর বলে কিছু নেই ৷
ওকে অবশ্য হল থেকে বেরিয়েই শরীর খারাপের কথা বলেছিলাম ৷ আর সেই জন্যই এই মিষ্টি
ভোগ ৷ যাইহোক,সেদিনের দ্বিতীয় পরীক্ষাও দিলাম ৷ আর ফিরে
শুরু হয়ে গেল গবেষণা ৷ সারা রাস্তায় সেজদা আমাকে রিক্সায় জড়িয়ে ধরে নিয়ে এসেছে ৷
কিন্তু বাড়ি এসে কথাটা সবাইকে বলেছে যে,ও কি পরীক্ষা দিয়েছে,ও
নিজেই জানে না ৷ আমি এতক্ষণে বুঝলাম শরীর খারাপের বাহানায় আমার পরীক্ষা খারাপ
দেওয়াটা একটা মারাত্মক ভুল কাজ হয়েছে ৷ আমি কাউকে কিছু না বলে,না
খেয়ে বাবার বিছানার এক কোণে শুয়ে থাকলাম ৷ আর চারিদিকে চলতে লাগল মতামত ৷ কাল
পরীক্ষা দিতে যাওয়া উচিত হবে কি,হবে না ৷ সেজদার মত হল,কালকের
পরীক্ষা দিতে যাওয়া ঠিক হবে না ৷ কমল ভালো রেজাল্ট করবেই ৷ কিন্তু এমন যদি পরীক্ষা
দিয়ে কম নম্বর নিয়ে পাশ করে তবে ভবিষ্যতে ক্ষতে হবে ৷ মায়ের ইচ্ছা আমি যাতে
পরীক্ষা দিই ৷ বাবা বলছে,ও নিজে ঠিক করুক ও যাবে কিনা ৷ আমি শুয়ে শুয়ে সব শুনে যাচ্ছি আর ভাবছি কী করব আমি ৷ কেন এমন হল ৷ বেশ রাত হয়ে
গেছে, আমি
উঠলাম ৷ ভাত খেলাম ৷ এবার নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম ৷
সকালে উঠে বললাম,আমি পরীক্ষা দিতে যাব ৷ গেলামও ৷ পরীক্ষাও
শেষ হয়ে গেল ৷ এরপর রেজাল্টের অপেক্ষা ৷ একটু চিন্তা, একটু
ভয় আর কিছুটা রেজাল্টের কথা ভুলে গিয়ে গল্পের বই পড়া ৷ এভাবেই একদিন রেজাল্ট
বেরানোর সময় হয়ে গেল ৷ রেজাল্ট বেরোনের দিন সকাল ৷ সত্যি কথা বলতে আমি খুব একটা
চিন্তিত ছিলাম না ৷ কারণ আমার জীবনের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না ৷ শুনতে অবাক
লাগতে পারে আমাদের রেজাল্ট প্রথমে আসত পোস্ট অফিসে ৷ এটাই সব জায়গায়তে হত না কি
শুধু উওরবঙ্গের জন্য সেটা আমি জানি না ৷ রেজাল্ট পোস্ট অফিসে এলে পোস্টমাস্টার
একটা কপি পোস্ট অফিসের দেওয়ালে টাঙিয়ে দিত ৷ আর একটা পাঠাত স্কুলে ৷ যেহেতু আগে
পোস্ট অফিসে আসত,ওখানে গেলেই আগে রেজাল্ট পাওয়া যেত ৷ ছোড়দা
সকাল থেকে পোস্ট অফিসে গিয়ে বসে আছে ৷ কয়েক ঘন্টা পরে মুখ কালো করে গিয়ে নিজের
বিছানায় শুয়ে পড়ল ৷ এটাই ছিল আমাদের বাড়ির সবার স্বভাব ৷ কেউ যদি কাঁথা মুড়ি দিয়ে
শুয়ে পরে, মানে
খবর খারাপ ৷ বোঝা গেল সেজদা খারাপ খবর নিয়ে এসেছে ৷ তারপর ওর মুখ থেকেই জানা গেল
যে লিস্টে আমার নাম নেই ৷ মানে আমি ফেল ৷ সারা দুপুরটা বাড়িটা একটা চাপ দুঃখ নিয়ে
কাটাল ৷ খাওয়া-দাওয়াও প্রায় নাম মাএ হল না ৷ আর এসবের জন্য
দায়ী থাকলাম আমি ৷ একমাএ আমি ৷ আমাকে কেউ একটু বকল না অথচ আমি সবাইকে কষ্ট দিয়েছি
ভেবে,মন
খারাপ করে বসে থাকলাম ৷
সব খারাপ সময়েরই শেষ আছে ৷ দুপুর পেরিয়ে বিকেল হল ৷ হঠাৎ
বেশ সোরগোল করে হেডমাস্টার সঙ্গে আরও কয়েকজন মাস্টারমশাই হাতে একটা মিষ্টির হাড়ি
নিয়ে আমাদের ঘরে ঢুকলেন,হেডমাস্টারমশাই এই প্রথম আমাদের বাড়িতে ৷
ঢুকেই বললেন,একি এতো আনন্দের দিনে বাড়ি একদম চুপচাপ ? রূপকথার
রাজপ্রসাদের মতো হেডমাস্টার মশাই-এর একটা কথায় হাজার বছরের ঘুমন্ত পরিবার সব
যেন এককথায় জেগে উঠল ৷ মনে হল মাস্টারমশাই-এর কথাটার একটা সুইচে হাজার ওয়ার্ডের
বাতিগুলো সব জ্বলে উঠল ৷ আমি ভাবলাম আমার ফেল করার দিনে মাস্টারমশাই কী এমন ভালো
খবর নিয়ে এল৷ -তুমি কমল,আমাদের গর্ব ৷ আগে মিষ্টি খাও বলে স্যার
নিজেই আমার হাতে একটা মিষ্টি তুলে দিলেন ৷ তারপর খবরটা বললেন,আমি
ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করছি ৷
এখনকার ছেলেমেয়েদের মনে হতে পারে স্কুল ফাইনাল (যা
মাধ্যমিকে সমান বলে ক ধরা যায়) পরীক্ষার প্রথম ডিভিশনে পাকা করাতে এমন কি
আছে ? আছে
৷ তখন পরীক্ষায় ৬০% নম্বর পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয় ৷ সেই সময়
পরীক্ষার তিনটে করে পাশের ডিভিশন থাকত ৷ ফার্স্ট ডিভিশন,সেকেন্ড
ডিভিশন এবং থার্ড ডিভিশন ৷ বেশীরভাগ ছাএরাই থার্ড ডিভিশন পেত ৷ ভালো ছেলেরা পেত
সেকেন্ড ডিভিশন ৷ আর হাতে গুণতি ছেলে পেত ফার্স্ট ডিভিশন ৷
হেড মাস্টার বললেন,ওঠে পড় ৷ তোমাকে নিয়ে বেরোবো ৷
আমি কী বলব,আমার এখনও পুরোপুরি সন্দেহ যায়নি ৷
আমি বললাম,স্যার কিন্তু আমি তো শুনেছি আমি ফেল করেছি ৷
-কে বলল ?
-ঐ পোস্ট অফিসের দেওয়ালে কাগজে আমার নাম নেই ৷
-নাম নেই ? সেই একই কাগজ তো আমার কাছেও আছে ৷ এই দেখ ৷
বলে পকেট থেকে রেজাল্টের কাগজটা বের করলেন ৷ একদম উপরে আমার
রোল নম্বর ৷ পরে সেজদার কাছে শুনেছি যে ও একদম নীচ থেকে মানে থার্ড ডিভিশনে পাশ
করা নামগুলো দেখতে দেখতে উপরের দিকে গেছে ৷ সেকেন্ড ডিভিশনের নামগুলো দেখেছে কিন্তু আমার একটা মাএ নম্বর একেবারে উপরের একলাইন
লেখার সঙ্গে প্রায় মিলে গেছে ৷ ওটাকে ও উপরের বাক্যটার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছে ৷ ফলে
আলাদা করে আর আমার নম্বরটা চোখে পড়েনি ৷ হেডমাস্টার আমাকে নিয়ে বেরোলেন ৷ আমি কিন্তু
না বুঝেই ওনার পিছন পিছন চললাম সঙ্গে আরো কয়েকজন ৷ স্যারের জন্য যারাই দেখা হোক,উনি
বাচ্চাদের মতো আনন্দে বলে ওঠেন,জানেন আমার এই ছাএটি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ
করেছে ৷ স্যার এবার চললেন বাজারের দিকে ৷ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই
একই কথা ৷ মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি,লজেন্সের দোকান থেকে লজেন্স আমার কাছে আসতে
লাগল ৷ এইভাবে আমরা প্রায় সারা চ্যাংড়া বান্ধা ঘুরে এলাম ৷ পরে শুনেছিলাম হেডস্যারের এত আনন্দ হওয়ার কারণ ৷ চ্যাংড়া বান্ধা হাইস্কুল অনেক
পুরানো ৷ স্যার নিজেও এই স্কুল থেকে পাশ করেছেন ৷ ঐ স্কুলে আজ পর্যন্ত কেউ ফার্স্ট
ডিভিশনে পাশ করেনি ৷ সেজদার উপর স্যারের খুব আশা ছিল,কিন্তু
সেটাও হয়নি ৷ কাজেই একদিনের মধ্যে আমি সবার গর্বের কারণ হয়ে গেলাম ৷পরে জানতে
পারলাম,আমি
কোচবিহার জেলার প্রথম,এন,এফ,রেলওয়ের জোনে প্রথম হয়েছি ৷ আমি ঐজন্য রেলের
স্কলারশিপ পেয়েছিলাম ৷ পেয়েছিলাম ন্যাশনাল
স্কলাশিপও ৷ ঐ নম্বরের ফলে পরবর্তীকালে আমার টিউশন-ফ্রী
ছাএ হয়ে গিয়েছিলাম ৷ আমি ডাক্তারীতে ফ্রী-স্টুডেন্টশি পেয়েছিলাম ৷ পরীক্ষায় পাশ তো হল ৷ এবার কি হবে ৷ সবাই ঠিক করল আসানসোলে মাসির বাড়ি থেকে
আমি ওখানকার কলেজে পড়ব ৷
(ক্রমশ)
[কমলেন্দু
চক্রবর্তী]