বাপের বাড়ি
বাপের
বাড়ির তেল সিন্দুর ,মালিদের ফুল
এমন খোঁপা বেঁধে দেব হাজার টাকা মূল.....
এমন খোঁপা বেঁধে দেব হাজার টাকা মূল.....
হারিয়ে যেতে যেতে অনেক কিছুই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে
যাচ্ছে । অনেক অনেক পাওয়ার মাঝে কত কত কিছু যে উধাও হয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে । আমাদের
অজান্তে গুটিয়ে নিচ্ছে হাত। আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি না নিঃস্ব হচ্ছি তাই বা কে জানে
। অনেক দৃশ্যত ঝকমকে জীবনের দিকে পেছন
ফিরছে অনেক ভর ভরন্ত পাওয়া । সমবচ্ছর
পরিশ্রম , একঘেয়ে দিন কাটাতে কাটাতে দম বন্ধ । চল দীঘা পুরী ভাইজাগ আরও একটু সাহসী হলে হিমালয় অব্দি পাঁচ সাত দশদিনের ট্যুর করে বাঙ্গালী তাতে
মন চকাচক হয় বটে কিন্তু পূর্ণ মন ও শরীরের
বিশ্রাম নৈব নৈব চ । বিশেষত মেয়েদের । না
না মোটেই রে রে করে ছুটে আসা চলবে না। যতই
নারীবাদী নারীবাদী বল বাপু । নিজের বাড়ীটি ছেড়ে কাদের নড়তে হয় ? হ্যাঁ !! যতই অসহ্য লাগুক । জড় উপড়ে মেয়েরা চলে যায় একটি অচেনা উঠোনে ,
বাগান
বদলে যায় । শেকড় ওপড়ানো গাছের আক্ষেপ থাকবেই যতই নারীবাদী নারীবাদী বলে ছ্যা ছ্যা
কর !! পঁচিশ তিরিশ বছর বাপের বাড়িতে কাটান তারপর
দুম করে অন্য একটি জমিতে পুতে দেয়া !
এখন
আগের থেকে অনেক ভাল আছে ভাবলেও সত্যি কি আছে ! আগের থেকে দ্বিগুণ তিনগুন শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে কাজ কর্ম কি
দ্বিগুণ পরিমানে চেপে বসে নি ঘাড়ে । ব্যাংক রে পোস্ট অফিস রে বাজার
রে এ টি এম ইলেকট্রিক বিল
ফোনের বিল অনলাইন পেমেন্ট হোয়াট নট -- ছেলেমেয়ের পড়াশোনা স্কুলের সমস্ত রকম হ্যাপা সামলান ,
কোনটা
কমল । আমাদের মা জ্যাঠইমারা এগুলো থেকে রেহাই
পেয়েছিলেন । তবে বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের অন্দরমহল সামলাতে হত তাদের । এখন
মেয়েরা কিছুই করে না ভাবার কোন কারণ নেই । তারপর অফিস কাছারি থাকলে তো সোনায় সোহাগা
। যতই সমান সমান বলে চেঁচাও অফিস থেকে ফিরলে চা কে করবে ! তুমি না আমি ... কে প্রথম ......। ভালবাসা মায়া মমতা দরজায়
দাঁড়ায় । না এত কিছু বেড়ান ...
ছুটছাট
কাছে পিঠে ঘুরে আসায় মন ভরে না । না না
সেই রেফারেন্স টেনে লাভ নেই ,
মাম্মি
কা ফোন আয়া , মাম্মি কা ফোন । আজকাল কনের মায়েরা আকছার কন্যের বাড়িতে নাক গলান
এবং তার থেকে বিভিন্ন রকম বিপত্তি । সকাল বিকেল মেয়ের বাড়িতে ফোন না করলে পেতের
ভাত হজম হয় না তাদের । সেটা ক’
পারসেন্টের
কথা সেটা আমরা দিব্য ভুলে যাই । যে বিরাট শূন্যতা মনের কোনে উঁকি মারে তা হল নিপাট
বাপের বাড়ি হারান । মেয়েরা আকছার সকাল বিকেল বাপের বাড়ি যাচ্ছে । কিন্তু কতজন
মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা জ্যাঠিমা মা যেতেন বাপের বাড়ি ।
পিসিরা দিদিরা আসত বাপের বাড়ি । জ্যাঠাইমার বাপের বাড়ি বড়লোক তাই তিনি প্রায়
তিনমাস থাকতেন । চার পাঁচ টি ভাইবোনের মধ্যে ছোট দুটি যেত । অন্য গুলোকে সামলাত
বাড়ির লোক । মায়ের অত সাহস ছিল না তিনি নাহক এক মাসের জন্যে যেতেন । দিদিরা আসত উৎসব অনুষ্ঠানে, কখনও এমনি । পিসিরা তো বেশ দাপটের সঙ্গেই বাপের বাড়িতে
থাকতেন । পিসিদের শাসনে আমরা বেশ সিটকে থাকতাম । এই নয় যে ওরা এলে আমরা ধেই ধেই করে
নাচব । আমাদের যত দোষ ত্রুটি মায়েদের লাই দেয়ায় গড়ে উঠেছে সেটা শুধরে দেবার
সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের ছিল । আমরা ঠিক ঠাক সকড়ি মানছি কিনা , ঠাকুর দেবতায় ভক্তি আছে
কি না । নিয়ম করে পেন্নাম ঠুকছি কি না তিন বেলা । পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে
গৃহকর্মে নিপুন হয়ে উথছি কি না । তার নজরদারি চলত। এবং কথায় কথায় শুনতে হত এগুলো
ঠিকঠাক না শিখলে শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরত পাঠাবে । শ্বশুর বাড়ি জুজুবুড়ি দেখিয়ে কত
কিছু বলে ফেলা । আর ফেরত এলে তো উপায় নেই । সুতরাং একেবারে তটস্থ । এই যে তারা আসছেন সে জন্যে বাড়িতে কারো মুখ
হাঁড়ি করতে দেখিনি । বাচ্চাদের মজা ছিল বলাই বাহুল্য । সারা বছর অপেক্ষা কবে আরও
পাঁচ সাত টি এসে জুটবে । বাড়ির আট ন’ খানা বাচ্চার সঙ্গে
আরও চার পাঁচটি মিলে চরম হুজ্জতি চলবে। পড়াশোনা শিকেয় উঠবে । কোচিং ক্লাসের কচকচি
ছিল না । তাই লেজকাটা বাদর প্রথম থেকেই । এ এক মচ্ছব । বছরের অন্যান্য মোচ্ছবের মত
। শুধু একটি বাড়িতেই নয় । সব বাড়িতেই একরকম । বাড়িতে মেয়ে আসবে ,
সঙ্গে
জামাই । শীতের দেশে থাকতেন তাই পুরোটা শীতই শ্বশুর বাড়িতে কাটত । তিনি আবার
গরম জলের ভক্ত । খাওয়ার সময় , চানের সময় , হাত ধুতে , মুখ ধুতে গরমা গরম । তার জন্যে বাড়িতে হত
নানা রকমের জলখাবার এক দুদিন নয় এই এত দিন ধরে। এক এক বেলায় এক এক রকম ! যোগান দিয়ে গেছেন বাড়ির বউরা এবং সকলেই, শ্রদ্ধা সহকারে । বাড়িতে বিয়ে ভর পোয়াতি বাড়ির বড় বউ । এক
দেড়মাস পরেই সময় । অক্লান্ত পরিশ্রম করে তুলে দিলেন অনুষ্ঠান। যে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাক – মূল অনুষ্ঠান কিন্তু বসত বাটিতে হত । এমনকি
বাড়ির ছেলেরা বিয়ের পর বউদের বাড়িতে
রেখে যাওয়াই রীতি ছিল । আস্তে আস্তে বদলাল
নিয়ম । ছয় মাস এক বছর পর স্বামীর বাসা বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যেত ।
রেখে যেতেন বাড়ির সকলের সঙ্গে পরিচিত
হওয়ার জন্যে । নতুন বউ নিয়ে টক করে বাসা বাড়িতে চলে
যাবে নেচে নেচে সে হবার যো ছিল না । সেই বাড়িতে নতুন বিয়ে হওয়া বউ রেখে ছোট দুটিকে
নিয়ে বাপের বাড়ি বিশ্রাম করতে গেলেন বড় বউ । সন্তান নিয়ে ফিরে এলেন তিন মাস পর । বাপের বাড়িতে থেকে
যথেষ্ট চেহারা ছবি উজ্জ্বল হয়েছে । নাইওরের
গুণ।
মা যেতেন বাপের বাড়ি । গেলেই প্রথম নজর দেয়া হতো শরীর
স্বাস্থ্যে । মামা ডাক্তার । সব রকম
পরীক্ষা নিরীক্ষা হত । কারণ চেহারা বেশ খারাপ হয়ে গেছে । যৌথ পরিবারে খেটে খেটে ।
ভিটামিন এল , ফল এল , নিয়ম করে দুধ খাওয়ান হত। জামা কাপড় ঠিকঠাক আছে কি না তা ও লক্ষ্য করা হত । তার সঙ্গে যেটি এসেছে তার তো আর আদরের
সিমানা নেই । উদ্দাম আনন্দে আর দশটা বাচ্চার সঙ্গে দিন যাপন । বাড়ির মেয়েটি কি খেতে ভাল বাসে । সেই অনুযায়ী মেনু হত তখন । কচুর লতি চিংড়ি মাছ বোয়াল মাছের লেজ চিতলের পেটি ,
মুইঠ্যা পিঠে পুলি সবই তার কথা ভেবে । তারপর তো ছিল আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নেতন্ন খেয়ে বেড়ান । বাড়ির
মেয়ে এলে বাচ্চাদের দায়িত্ব থেকে সে মুক্তি পেত , একে নাওয়ান খাওয়ান । সব কিছুর দায়িত্ব
অন্যে নিত বিশেষত ছোট বোনেরা। হা করে বসে
থাকা কখন বোনঝি বোনপো ঘুম থেকে জাগবে। আর তারপর শুরু হবে সব আতন যতন । আর বাপের আসা মেয়েটি তখন পাড়া বেরিয়ে আদর খাবে । শুধু বাড়ির নয়
সারা পারার ই মেয়ে এসেছে। সেই বাপের বাড়ি আজ আর সেরকম হয় না । হারিয়ে যাওয়ার
শূন্যতা । বাপের বাড়ি গিয়ে যে হাপ ছেড়ে বাঁচা , সে ছিল আসলে এক
মুক্তির আনন্দ । ‘আপন হারা প্রান ,বাঁধন ছেড়া প্রান’ । সে যাত্রা ছিল দায়িত্ব মুক্তির। সকালে উঠে কি
জলখাবার হবে দুপুরে কি রান্না হবে । মাথা ঘামিয়ে মেনু করা ,কোন কিছু নেই , কোন ভাবনা নেই । সারা দিন মানিয়ে চলা নেই । রোজকার থোড় বড়ি খাড়া নেই । নেই গর্জন তর্জন চোখ রাঙ্গানি। এই দায়িত্ব মুক্তি স্বাধীন স্বাধীন । বুকের ভেতর চাপ নেই । ঘড়ি ধরে সকালে লাফ দিয়ে ওঠা নেই । এই নেই নেই থেকে দু হাত
তুলে মুক্তি আর এর ই নাম বাপের বাড়ি । তার তেল সিঁদুর মালীর ফুলের সুগন্ধ সবই সব
কিছু থেকে আলাদা । সেই ফুল দিয়ে খোঁপা বাঁধলে ঝকমক করে ওঠে মন । সে খোঁপা আর কোথাও
বাঁধলে এমন প্রাণ মেতে ওঠে না। সেই খোঁপায় আটকে থাকে হাজার হীরের ফুল । সেই স্বাধীনতার মূল্য হাজার টাকা , লক্ষ টাকা !
~~~~~~~~~~~
নন্দিতা ভট্টাচার্য