>

রত্নদীপা




সংশপ্তক:  বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়েবলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষবেলাকার গল্প চোরাই ধনে। যে যুগে কবি এই ধারণার তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন, ভিক্টোরিয়ান রোম্যান্টিক যুগচেতনায় লালিত জীবনবোধের আলোতে, আমাদের এই একবিংশ শতকের সময়চেতনায় সেই যুগের বাণী কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আপনার?
রত্নদীপা: একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সমাজ প্রত্যক্ষ করছে তার সাথে পাশ্চাত্য সমাজের ব্যাবধান ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে । কবি গুরুর যুগে তার চারপাশে নারীদের বহির্জাগতিক বিচরণ ছিল সীমিত । আজ অধিকাংশ নারীর গতি অবাধ । তাই তার নারী জীবনে পুরুষের রূপ রস গন্ধ বর্ণ বিবিধ । সেখানে বিচিত্রের মাঝেই যে যোগসুত্র একটি বিবাহকে , একটি পরিবারকে , একটি সামাজিক বোধকে ধরে রাখতে পারে তা সামাজিক অপমান বা অবমাননার থেকে অনেকটা দূরে সরে এসে পারস্পরিক গভীর আস্থা সহমর্মিতা ও ভালবাসা ও বিশ্বাসে সুকঠিন কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল । তাতে যদি চিড় ধরে একুশ শতকের বিয়ে , অনেক ক্ষেত্রেই নারী অথবা পুরুষ সম্পর্কের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসে । সমাজের তোয়াক্কা না করে ... 

সংশপ্তক:নরনারীর পারস্পরিক অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্কের  মূল রসায়নটা ঠিক কি বলে মনে করেন আপনি? বিবাহ নামক সামাজিক  প্রতিষ্ঠান কি সেই রসায়নের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে?
রত্নদীপা: রসায়ন দৈহিক এবং মনস্তাত্বিক, সে বিবাহেই হোক অথবা সহবাসেই হোক । আজ মার্কিন দুনিয়ায় সমকামিত্ব আইনসিদ্ধ হয়েছে । অচিরে এদেশেও হবে । যে রসায়নের ওপর দুজন সমকামী মানুষ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে তা উভয়ত দৈহিক এবং মানসিক ।

সংশপ্তক:  দাম্পত্য সম্পর্ককে সুস্থসবল সজীব করে রাখার মূল শর্ত্তগুলি আপনার মতে কি কি?
রত্নদীপা: দেহজ প্রেম ও যৌনতা । যৌনতা সমন্ধে উদারতা  এবং অবশ্যই বিশ্বাস বা আস্থা , যা সন্দেহ প্রবণতার অনেক অনেক উর্ধে এবং সুগভীর । পৌরাণিক যুগের মত একটা যুগ আসতে চলেছে যেখানে প্রাচ্যেও বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা আবং সমকামিত্ব নিন্দার্হ গণ্য হবে না । অর্থাৎ সম্পর্ক টিকবে সম্পর্কের নিজের বলে , পাশ্চাত্যের মতই যৌনতা এবং নগ্নতার কোন ট্যাবু কিংবা সঙ্কীর্ণতা থাকবে না । পরিবারের সমস্ত সদস্যের মধ্যে বইবে খোলা হাওয়া ...

সংশপ্তক: আমাদের সমাজ বাস্তবতায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখী গৃহকোণ গড়ে ওঠে, দাম্পত্য সম্পর্কের আঙিনায় দুইজনের মধ্যে কোনো একজনের ব্যক্তিত্বের কাছে আর একজনের আত্মসমর্পণের ভিত্তিতেই। এইটা কি আদৌ কোনো  আদর্শ পথ বলে মনে করেন আপনি? বিশেষ করে যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংসারের মুখ চেয়ে স্ত্রীকেই আত্মসমর্পণ করতে হয় স্বামীর কাছে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে পুরুষতন্ত্রের কাছে?
রত্নদীপা: আজকের ভারতবর্ষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চরম আতিশয্য এখনো দেখা যায় পাঞ্জাব ,  রাজস্থান , উত্তর প্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশেও । যত দক্ষিণ এবং পূর্বে আসা যায় খোলা বাতাস বইতে শুরু করে । এই ভারতেও মেঘালয় জাতীয় রাজ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ , প্রতিবেশী নেপালের মত গোর্খা ল্যান্ড , সিকিম এবং বহু উপজাতি বা আদিবাসি এলাকায় মাতৃতন্ত্র এবং গন্ধর্ব বিবাহের ধ্বজা উড্ডীন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে । আর তার কারণ বোধ হয় শৈশব থেকে গেঁথে যাওয়া মূল্যবোধ ও শিক্ষা ব্যাবস্থা – যত পাণ্ডববর্জিত সমাজ ততই পণপ্রথার প্রতি অনীহা এবং নারী স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান । রেনেসাঁর বাংলায় ব্যাঙ্গালুরু কিম্বা মুম্বাই শহরের মত নারী অধিকাংশেই পুরুষের কাঁধে কাঁধ মেলায় । তা সত্ব্বেও কয়েকশো বছরের লালিত বিশ্বাসে এবং শিক্ষায় নারীকেই শিশু পালন করতে হয় , নারীকেই কর্মস্থল এবং ঘরের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হয় , নারীকেই সন্তানের শিক্ষা ও অন্যান্য যত্ন নিতে হয় । সমস্ত আলোকপ্রাপ্ত রাজ্য এবং রাষ্ট্রেও । কিন্তু দু হাজার বিশ এমন বার্তা  নিয়ে আসবে যেখানে পুরুষরা নারীদের থেকে বেশি বেবিসিটার হবে , ভালো কুক হবে , অথবা গৃহ কর্ম নিপুণ হবে এবং কর্মরতা  স্ত্রী বাড়ি ফিরলে তার সেবা করবে ।

সংশপ্তক: বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক টলস্টয় তাঁর গল্প খ্রয়েৎসার সনাটায় (THE KREUTZER SONATA) বলেছেন “…a marriage without love is no marriage at all, that only love sanctifies marriage, and that the only true marriage is that sanctified by love” এখানেই প্রশ্ন জাগে এইটাই তো হওয়ার কথা, আর সেইক্ষেত্রে বিবাহের পরিণতি তো কখনোই বিয়োগান্ত হতে পারে না! তবে  সমাজে এত বিবাহ-বিচ্ছেদের বারবাড়ন্ত কেন?
রত্নদীপা: প্রেম বিবাহেই হোক অথবা সামাজিক বিবাহেই হোক অস্থির সময়ের হাত ধরে মানুষ ও মানুষী বড় বেশি অশান্ত হয়ে  উঠছে নিজেদের দাবীসনদ পেশ করতে । সে দাবী যৌন বুভুক্ষার হতে পারে । যৌন সন্তুষ্টির অর্ধেক নির্বাণের হতে পারে , আর্থিক অনটনের হতে পারে , সামাজিক খ্যাতি এবং প্রতিপত্তির অভাবে হতে পারে , কিম্বা হতে পারে কোন একজনের অথবা উভয়ের যশ অপ্রাপ্তির কারণে হাহাকার ... আগেকার যৌথ পরিবারে অথবা সামাজিক ঘেরাটোপের আগলে এবং পরনিন্দা / পরচর্চা / এবং লোকলজ্জার ভয়ে ভীত পুরুষ অথবা নারী চেষ্টা করতো বা শিখে নিত অপ্রাপ্তি নিয়ে বাঁচতে কিম্বা অতৃপ্তিকে শিরোধার্য এবং আত্মস্থ  করতে । বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসার দুঃসাহস অথবা গতিজাড্য কোনটাই ছিল না । আজকের পুরুষ অথবা নারীর হাতে হাতে অপরয়ানা , তাদের মহাকাশযান কোনো বাঁধ মানে না । ছদ্ম সমাজ সংস্কার লোকলজ্জা অথবা নিন্দার । এমনকি সন্তানের মুখ চেয়ে আগেকার মত আর দুঃস্থ সম্পর্ককে আইসিইউএর  অক্সিজেন  সিলিন্ডারের আগায় বাঁচিয়ে রাখতে চায়না অধিকাংশ দম্পতি ।

সংশপ্তক: সাধারণভাবে বিবাহ বলতেই আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকেই বুঝিয়ে থাকি। এই যে একটি সম্পর্কের বন্ধন বা শৃঙ্খল এবং তাতে আজীবন আবদ্ধ থাকার প্রাথমিক অঙ্গীকার, সেই শৃঙ্খলই কি কোন এক সময় দাম্পত্যের পরিসরটিকে সঙ্কুচিত করে তুলে একটা দমবন্ধের পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে, যা অধিকাংশ বিবাহবিচ্ছেদের মূলে ক্রিয়াশীল থাকে বলে মনে হয় আপনার?
রত্নদীপা:পৌরাণিক  যুগে বিবাহের ধারণা ছিল খুবই ঝাপ্সা । অথবা পুরাণেরও আগে বৈদিক আবং বৈদান্তিক যুগে বিবাহের ধারণা তেমন জোরালো ছিল না । ঋষি মুনিদের বহুগমনের অভ্যাস এবং ক্ষেত্রজ সন্তানদের গর্ব এবং  উদ্ধত জীবনচর্যা আমাদের জানা । মনু বাদ প্রথম এই সুস্থ উদার উন্মুক্ত হাওয়ার জগতে বেড়ি পড়ায় যাতে দুঃশাসনদের থেকে সুশোভনরাই বেশি নাকাল হয় ।  এর পর ইসলামের প্রাদুর্ভাব মানুষকে করে তোলে আরও বেশি পর্দানশীন রক্ষণশীল ও সংস্কার আছন্ন । কনস্টান্টিনোপলের আগে ক্যাথোলিক দুনিয়াও আক্রান্ত হয়েছিল একই দমবন্ধ গণ্ডীতে । রেনেসাঁ যাকে মুক্ত করেছিল । প্রটেস্টাণ্ট ও রেনেসাঁর স্বাগতধ্বনি । একুশ শতকে অইসব নাকাব / হিজাব / ঘোমটা সমস্ত মুখোশগুলো খসে গেছে অনেকটাই  অন্তত আলোকবর্তিক দুনিয়ায় । আজ শুধু বিবাহের জন্যই বিবাহ আর টিকছে না । শরতচন্দ্র যেভাবে তার নায়িকাদের কল্পনা করেছিলেন তার শেষ প্রশ্ন , দত্তা অথবা পথের দাবী উপন্যাসে অথবা রবিঠাকুর যেভাবে নায়িকাদের রুপাঙ্কন করেছিলেন চার অধ্যায়ে , যোগাযোগে গোরায় কিম্বা চতুরঙ্গে ... সেভাবেই আজকের সব নারী বিনোদিনীর মত স্বাধীন সম্পরকের সুবাতাস সুমঙ্গলে বেঁচে থাকতে চায় ... সে বিবাহের নন্দনেই হোক অথবা বন্ধনেই হোক । অথবা বন্ধন কেটে বেরিয়ে আসা মুক্তডানার পালকবাসে ...

সংশপ্তক:  সাধারণ ভাবে বিবাহ বলতে দুটি নরনারীর এক সাথে বসবাস ও বংশরক্ষা, সংসারধর্ম পালন বলেই বুঝে থাকি আমরা।  কিন্তু এই সামান্য জৈবিক পরিসরেই তো বিবাহের সার্থকতা পূরণ হতে পারে না! দুজন মানুষের মানসিক, শারীরীক, মনস্তাত্বিক ও আত্মিক সত্ত্বাগত মিলন ছাড়া তো বিবাহ সম্পূর্ণ হতে পারে না!  বর্তমান সমাজ সংসারের প্রেক্ষিতে দুইজন মানুষের এই সত্ত্বাগত মিলন কতটা বাস্তবিক সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?
রত্নদীপ: দুটি তরুণ – তরুণী কৈশোরের গণ্ডী পেরিয়ে যখন প্রেমের নৌকোয় দাঁর টানে তখন তাদের মধ্যে যে প্রাথমিক চাহিদা কাজ করে সেটি একান্তই জৈবিক । প্ল্যাটনিক প্রেম শরৎচন্দ্রের শেষ প্রশ্নের যুগ থেকে আজও বড়ই সঙ্খ্যালঘু । আজ নারী স্বাধীন । আর্থিক , সামাজিক শিক্ষা পাশ্চাত্যের মত প্রাচ্যের নারীকেও দিয়েছে মুক্তি । তাই নারী আজ বহির্মুখী এবং ভাগ্যের হাতে এবং খাপ জাতীয় অতীব পসছাদপদ অথবা রক্ষণশীল পরিবারের বাইরে ভাগ্যকে নির্বিচারে নীরবে , নির্বিকারে মেনে নেবার বিরোধী । তবু , বৃহত্তর সংসারের  স্বার্থে তারুণ্যের সহবাস অথবা বিবাহজাত প্রেম ক্রমশ অভ্যাস বনে । তারপর কম্প্রোমাইজ ও অন্যান্য প্রায়োরিটি তাদেরকে শেখায় বিবাহের বন্ধন অটুট রাখতে এবং একান্ত অপারগ না হলে বিবাহ ভেঙে বেরিয়ে না আস্তে । আজকের সমাজে পরকীয়া শুধু পুরুষেরই নয় , নারীর জন্য আর পাপবোধ ডেকে আনে না । মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের সংকোচ কাটিয়ে , অতীতের অবলা ও সহনশীলা নারী তার পুরুষের মত যৌনকর্মীর দারস্থ হয় নির্দ্বিধায় তাতে সংসার অপত্যস্নেহ বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য এবং দম্পতির পারস্পরিক দায়িত্ব কর্তব্য একটি আস্থা ভালবাসা ও বিশ্বাসের মোড়ক অথবা মুখোশ পায় ... এটি একমাত্র সত্য নয় , কিন্তু শেষ প্রশ্নের নারীরা আজ আদিবাসী বা উপজাতির থেকে  দ্রাবিড় সমাজের সমস্ত বর্ণে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ

সংশপ্তক: বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্পর্কের আঙিনায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই মনে হয়বিশেষ করে দাম্পত্যের পরিসরে তো বটেই। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে তার লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারউপন্যাস প্রসঙ্গে লরেন্স এক জায়গায় বলেছিলে, “The modern cult of personality is excellent for friendship between sexes, and fatal for marriage” অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকেই তিনি সফল দাম্পত্যের অন্তরায় বলে মনে করছেন। নাকি দাম্পত্যের পরিসরে নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকে পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে অপারগ বলেই  দাম্পত্যে এই আধুনিক সংঘাতের সৃষ্টি বলে মনে হয় আপনার?
রত্নদীপা: আজ থেকে পঞ্চাশ  বছর আগে অথবা এমনকি সত্তরের দশকেও হাজার চুরাশির মায়ের যে ভূমিকা ছিল আজকের একুশ শতকের এক দশকের নারীর ভুমিকা তার থেকে অনেক আলাদাযে নারী পর্দানশীন খাপ বোরখা হিজাব এবং মনুবাদের অন্দরমহল থাকে সেও আজ মুক্তি খোঁজে ... গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়তে তেত্রিশ পারসেন্ট আসন সংরক্ষন হয় নারীর জন্যে । সংসদে বিধান সভায় পৌরসভায় এবং বহুক্ষেত্রে আইনি বাধ্যতা ছাড়াও নারীকে স্বাভাবিক নেত্রী হিসেবে মেনে নেওা হয় । দুর্ভাগ্যের বিষয় হল ,এরমধ্যে অনেকেই তাদের পুরুষদের হাতেই এখনো ক্ষমতার দণ্ড এবং অহঙ্কার তুলে দ্যান । এও সত্যি , নারীই নারীর শত্রু বলে প্রতি হাজার পুরুষে ভারতে ন ‘ শো চৌত্রিশ নারীর বসবাস । আও সত্যি , কর্মরতা নারী ও মূলত আর্থিক অগ্রসর পাঞ্জাব হরিয়ানা রাজস্থান এবং গুজরাটে বাধ্য হন কন্যাভ্রুন হত্যায় । এবং সেখানে হাজার পুরুষে নারীর গড় নেমে দাঁড়ায় আট শো চুয়াত্তরে । পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে পণ দিয়েও প্রবাসী স্বামীর তালাকপ্রাপ্ত হন বহু হতভাগ্যা নারী ... কিন্তু অন্তত ষাট পারসেন্ট নারী  , হরিজন থেকে বর্ণহিন্দু এবং নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত , গৃহলক্ষ্মী  অথবা উপার্জনকারী আজ স্বাধীনচেতাআজ চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কিছুটা হলেও সরছে উত্তর পূর্বের মানচিত্রের দিকে এখানেই লাগছে দ্বন্দ্ব  , আসছে চ্যালেঞ্জ । এতকালের পুরুষপ্রধান শিক্ষা ও মনন প্রমাদ গুনছে বাইশ শতকের আগেই চরম শ্মশানযাত্রার ... আজকের মুক্ত সমাজ জোর করে দাবিয়ে বা দমিয়ে রাখার সমাজ নয় ... পদানত বা পদলেহন করার সমাজ নয় ... এই সমাজ অত্যাচার কেটে বেরিয়ে আসা সহজ বন্ধুতা এবং সহমরমিতার সমাজ ...

সংশপ্তক:   একজন বিবাহ বিচ্ছিন্না নারী ও বিবাহ বিচ্ছিন্ন পুরুষকে সমাজ কি একই চোখে দেখে বলে মনে করেন আপনি? বাস্তব অভিজ্ঞতায় কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর সম্বন্ধেই দোষারোপ করা হয় মানিয়ে নিয়ে চলতে না পারার জন্যেই! অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয় যে সফল দাম্পত্যের অন্যতম শর্ত হল নারীর এই মানিয়ে নিয়ে চলার ক্ষমতা, যা অন্যদিক দিয়ে পুরুষতন্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর। এই বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
রত্নদীপা: বিবাহ বিচ্ছেদের অনেক আগে একজন নবোঢ়া যদি সন্তান ধারনে অক্ষম হয় , শুধু পুরুষতন্ত্র নয় , মাতৃপ্রজন্ম তাকে বন্ধ্যাত্যের শিরোপা দ্যায় । তারা জানতে চায় না আর ... এর মধ্যে পুরুষটির ভুমিকা বা দোষ কতখানি । অথচ , ভাবতে অবাক লাগে এ দেশ শকুন্তলার মত  গন্ধর্ব বিবাহের দেশ , এ দেশ ক্ষেত্রজ রাজসন্তান কৌন্তেয়দের দেশ  ... অথচ , একটি সদ্য বিধবা মেয়েকে আজ ও শ্বশুর বাড়ী থেকে বিতাড়িত হতে হয় অথবা শ্বশুর ঘরে এবং পিত্রালয়ে মেনে নিতে হয় বহু গঞ্জনা এবং অত্যাচার । এ সমাজ আজ ও বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত বিধবা বিবাহের অনেকাংশে পরিপন্থী আজ ও সতীদাহ গৌরবউজ্জ্বল রাজস্থানের বহু গ্রামে । আফগান ইরানী সিরিয়ান লিবিয়ান মহিলাদের দুর্দশার কথা কার না অজানা ... আজ ও বিধবারা আমাদের বাঙালি সমাজেও নিরামিষ খেতে বাধ্য হন , কোনো বিপত্নীক বা মৃতদারের জন্যে এমন নিয়ম থাকে না । বিধবাদের মত সংযত বা নিরাভরণ বেসবাস বিপত্নীকদের করতে হয় না , তারা পুনর্বিবাহ অনায়াসে করতে পারে ... সুতরাং এই সমাজ যে নারীকেই বিচ্ছেদের জন্যে দুষবে তাতে প্রশ্ন কোথায় ... এর অবসান তখনি হবে যখন শিক্ষার উজ্জীবনে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের নারী  এবং পুরুষ ... সার্বিক সাম্যের ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হবেতখন আর দরকার পরবে না সেকশন ৪৯৮এ ।। নারীকেও আর ছলাকলার অই ধারার কদর্য অপব্যাবহারের সম্মুখীন হতে হবে না ।

সংশপ্তক: দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙন সন্তানদের চেতন অবচেতনে কি একটা অনিশ্চিয়তার জন্ম দেয় না? সেই অনিশ্চিয়তা যদি তাদের সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায় তবে তাদের পরবর্তী জীবনে তার প্রভাব কতটা সদর্থক বা নঙর্থক হয় বলে মনে হয় আপনার?
রত্নদীপা: হুম , অনিশ্চয়তার  জন্ম দায় বইকি । সুস্থ এবং সুসম্পরকের বাতায়ন না পেলে কোন গাছই বৃক্ষ হতে পারে না । মাতৃস্নেহ , এবং পিতৃআদর প্রতিটি চারাগাছকে সঠিক এবং সুমঙ্গল বৃক্ষ কোরে তোলে । এর অন্যথা হলে , সন্তানদের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং ভীতির জন্ম হয় । এই ভীতি থেকে তৈরি হয় অসহায়তা , অবিশ্বাস ... চারাগাছ আর সম্পূর্ণ হতে পারে না ... সাংসারিক অক্সিজেনের অভাবে ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ে ...

সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতিদের মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব স্ত্রীই বহন করেন। সন্তানের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মার সাহচর্যই অধিকতর প্রয়োজনীয় হলেও শিশু মনে পিতার অভাব কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে? সেই ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
রত্নদীপা: বিবাহ বিচ্ছেদ যদি কোনোভাবেই ঠেকানো না যায় ... সেই ক্ষেত্রে মা এবং বাবার উচিত সন্তানদের সাথে আলোচনায় বসা । তার ও আগে উচিত , একটি সুন্দর পারস্পরিক আবহাওয়া তৈরি করা সেই আলচনা শুরুর আগে ... সন্তানকে এটাই বোঝাতে হবে , যে কিছু সমস্যার কারণে তারা স্বামী স্ত্রী হিসেবেই কেবল আলাদা হচ্ছেন , কিন্তু বাবা – মা হিসেবে তারা এক এবং অভিন্ন । সন্তান যখনি চাইবে , মা এবং বাবারর সাথে দেখা করতে পারবে ... সময় কাটাতে পারে ... অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় , মা কখনই চান না তার সন্তান , বিবাহবিচ্ছেদের পরে বাবার সাথে দেখা করুক ... এটা কিন্তু ঠিক নয় ... সন্তান মায়ের কাছে থাক্লেও তাকে রেগুলার বাবার সাথে দেখা করতে । সময় কাটাতে দেওয়া উচিত ...

সংশপ্তক:  আমাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যার এই যে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাগরিক সমাজের পক্ষে তা কতখানি ক্ষতিকর বলে মনে করেন আপনি? নাকি এই পথেই নতুন সমাজ বিন্যাস গড়ে নেবে অনাগত ভবিষ্যৎ?
রত্নদীপা: বিবাহের ধারণা ফিনিস দেশগুলিতে খুবি ক্ষীণ । সুতরাং সহবাসী অথবা সমকামী অভিভাবকদের সন্তানও আজ মান্যতা পাচ্ছে । ক্রমশ ভারতও পা রাখছে এই পথে । গত এক দশকে একাকী- মায়েদের বিপুল সঙ্খ্যাবৃদ্ধি তারি পরিচায়ক । আমনকি একাকি পিতাদের সন্তানেরাও আজ গৌরবের জীবনে অধিষ্ঠিত হচ্ছে  , যেমন ধরা যাক মাসাবা গুপ্তা । হয়ত অচিরে বেজন্মা শব্দটি  অভিধান থেকেই লোপ পাবে । তবু আগামি এক থেকে দুই দশক ... যতক্ষন এই ভাঙ্গাচোরার মধ্যে এই  ক্ষয়িষ্ণু সমাজ পরিবর্তনের নির্ঝর সংগ্রামে  মত্ত আমাদের সন্তানেরা যে বিচ্ছেদ জনিত অবমাননা , অবিচার বঞ্চনা অবহেলা ও  বিড়ম্বনায় এমনকি আত্মহত্যাকেও বেছে নেবে না এমন ধারণা করা অস্বাভাবিক নয়  ... তবে এই পর্যায়টি সাময়িক ... হয়ত দু হাজার পঞ্চাশের আগেই আমরা নতুন সমাজের নব কলেবর দেখতে পাবো , পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণার আয়নায় আদলে  ...


রত্নদীপা: বিশিষ্ট কবি 

Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.