সংশপ্তক: “বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু
সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়ে” বলেছিলেন
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষবেলাকার গল্প চোরাই ধনে। যে যুগে কবি এই ধারণার তত্ত্ব তুলে
ধরেছিলেন, ভিক্টোরিয়ান রোম্যান্টিক যুগচেতনায় লালিত জীবনবোধের আলোতে, আমাদের এই একবিংশ শতকের সময়চেতনায় সেই যুগের বাণী কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়
আপনার?
রঞ্জনা: জন্ম
মৃত্যুর মতো নিয়তি নির্ধারিত না হলেও বিবাহকে সভ্য সামাজিক মানুষের জীবনে এক
আবশ্যিক কর্তব্য বলে ধরা হয়েছে । সভ্যতার প্রথম পর্যায় থেকে বর্তমান সমাজ
ব্যবস্থায় বিবাহ নারীর জীবনে একমাত্রিক – কিন্তু পুরুষের জীবনে তা বহুমাত্রিকতার নামান্তরই ছিল এবং
আছেও । নারীকে সর্বদাই পুরুষের সম্পত্তি
রূপে গণ্য করা হয়েছে , তাই তার এক পতিত্বই স্বীকৃতি পেয়েছে । পুরুষের জীবনে একসাথে
বহু পত্নীর মত তার জীবনে বহু পতির উপস্থিতি প্রায় নগণ্য ,
শুধু মাত্র কিছু প্রাচীন জন জাতির মধ্যে এর
উপস্থিতি আছে । নারীর জীবনে একটি পুরুষের
পত্নীরূপে বিবাহ বন্ধনকে আজন্ম রক্ষা করা
একটি পবিত্র দায়িত্ব ছিল – কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তা আশ্চর্যজনক ভাবে
অনুপস্থিত - এবং এক্ষেত্রে ধর্ম ,
শাস্ত্র , সমাজ পুরুষকেই
সমর্থন করেছে । পরে মানুষ যখন
আধুনিকতার পথে এগিয়ে চলেছে তখন আইন করে পুরুষের বহুবিবাহ বন্ধ করা হয়েছে । তবে
সর্বক্ষেত্রে তা এখনো প্রচলিত নয় । বর্তমান
সমাজ জীবনের প্রক্ষিতে আমার মনে হয় স্ত্রী ও পুরুষ যদি দুজনে সত্য প্রেমের বন্ধনে
আবদ্ধ হয়ে বিবাহকে তাদের জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ রূপে গ্রহণ করে –
তবেই বিবাহ দুটি যৌথ জীবনের চলার পথে
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে – অন্যথায় তা কখন সম্ভব নয়।
সংশপ্তক:নরনারীর পারস্পরিক
অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্কের মূল রসায়নটা ঠিক
কি বলে মনে করেন আপনি? বিবাহ
নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান কি সেই রসায়নের
উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে?
রঞ্জনা: নর নারীর পারস্পারিক নিবিড় একাত্ম সম্পর্কের মূলে আছে প্রেম – আর এই
প্রেমের ভিত্তি হল ঐকান্তিক বিশ্বাস । বিশ্বাস নির্ভর প্রেমই নরনারীর পারস্পরিক
অন্তরঙ্গ সম্পর্কটিকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ
করে । বিবাহিত নারী পুরুষের মধ্যে অনেক সময়ই এই ঐকান্তিক প্রেমের অভাব লক্ষিত হয় । দেখা যায় বিবাহ অনেক
সময়ই একটা বাহ্যিক আচার হয়ে
দাঁড়াচ্ছে । সামাজিক বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবদ্ধ নরনারী বা পাত্রপাত্রী দুটির অন্তর আকাশে
বিশ্বাস নির্ভর প্রেমের কোন লক্ষনই দেখা যায় না । দৈনন্দিন আচার সর্বস্বতার বাঁধনে
বাঁধা পড়ে আছে দুটি প্রাণ ।
সংশপ্তক: দাম্পত্য সম্পর্ককে সুস্থসবল সজীব করে
রাখার মূল শর্ত্তগুলি আপনার মতে কি কি?
রঞ্জনা: দাম্পত্য সম্পর্ক
সুস্থ সবল রাখার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে – পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে
, উভয়ের মধ্যে বিশ্বাসের সেতু বন্ধন থাকবে । প্রেমই হবে এই বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার অটল
আশ্রয় । পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ , সহানুভূতি ও সহমর্মিতা গড়ে দেয় সুখী দাম্পত্যের
মজবুত ভিত । স্বামী স্ত্রী দুজনে
দুজনকে বোঝার চেষ্টা করবে , প্রত্যেকেই
প্রত্যেকের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এটাই সুখী দাম্পত্যের সঠিক উপায়
।
সংশপ্তক: আমাদের সমাজ
বাস্তবতায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখী গৃহকোণ গড়ে ওঠে, দাম্পত্য
সম্পর্কের আঙিনায় দুইজনের মধ্যে কোনো একজনের ব্যক্তিত্বের কাছে আর একজনের
আত্মসমর্পণের ভিত্তিতেই। এইটা কি আদৌ কোনো
আদর্শ পথ বলে মনে করেন আপনি? বিশেষ করে যেখানে বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই সংসারের মুখ চেয়ে স্ত্রীকেই আত্মসমর্পণ করতে হয় স্বামীর কাছে,
বা আরও স্পষ্ট করে বললে পুরুষতন্ত্রের কাছে?
রঞ্জনা:আমার মনে হয় সুখী দাম্পত্য গড়ে
ওঠার প্রথম ও প্রধান শর্ত হল – স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের ব্যক্তিত্বের সঠিক পথে
পূর্ণবিকাশ । সংসারের পথে চলতে চলতে স্বামী এবং স্ত্রী এই উভয়ের স্ব স্ব
ব্যক্তিত্ব যদি কোন ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয় তাহলে সেই সংসারের আকাশে অসন্তোষের কালো
মেঘ জমে । বাস্তবক্ষেত্রে সংসারে মেয়েদের বিশেষত ভারতীয় স্ত্রীদের ব্যক্তিত্ব
স্বামীর ব্যক্তিত্বের কাছে অনেক সময়ই খর্ব হয় , আঘাত প্রাপ্ত হয় – কিন্তু এটি কোন মতেই বাঞ্ছনীয় নয় । নারীকে দৃঢ়তার সঙ্গে
সংসারে তার ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে – কারণ চারিত্রিক ব্যক্তিত্ব, দৃঢ়তাই
দেবে তাকে সমাজে ও সংসারে সম্মানের আসন । পুরুষের পদানত জীবন নারীর কখনোই কাম্য
হতে পারে না । আত্মনির্ভরশীল , ব্যক্তিত্বময়ী নারীই গড়ে তুলতে পারে সুখ ও সমৃদ্ধ গৃহকোণ
।
সংশপ্তক: বিশ্ববিখ্যাত
সাহিত্যিক টলস্টয় তাঁর গল্প ‘খ্রয়েৎসার সনাটা’য় (THE KREUTZER
SONATA) বলেছেন “…a marriage without love is no marriage at
all, that only love sanctifies marriage, and that the only true marriage is
that sanctified by love” এখানেই প্রশ্ন জাগে এইটাই তো হওয়ার কথা,
আর সেইক্ষেত্রে বিবাহের পরিণতি তো কখনোই বিয়োগান্ত হতে পারে না!
তবে সমাজে এত বিবাহ-বিচ্ছেদের বারবাড়ন্ত
কেন?
রঞ্জনা: স্বামী ও স্ত্রীর
মধ্যে নির্মল ভালবাসা ও সঠিক বোঝাপড়ার অভাব থেকেই ক্রমশ বিবাহের স্থায়িত্ব হ্রাস
পাচ্ছে । বিবাহ যেন পারস্পারিক চাহিদা পূরণ ও ভোগ সর্বস্বতার নামান্তর হয়ে
দাঁড়াচ্ছে । বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দুটি মানুষের হৃদয়ে সৎ ভালবাসা ও আত্মনিবেদনের
মনোভাব অন্তর্হিত হচ্ছে ক্রমশ ..... সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে ।
সংশপ্তক: সাধারণভাবে বিবাহ বলতেই আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকেই বুঝিয়ে থাকি। এই যে
একটি সম্পর্কের বন্ধন বা শৃঙ্খল এবং তাতে আজীবন আবদ্ধ থাকার প্রাথমিক অঙ্গীকার, সেই শৃঙ্খলই কি
কোন এক সময় দাম্পত্যের পরিসরটিকে সঙ্কুচিত করে তুলে একটা দমবন্ধের পরিবেশ গড়ে
তুলতে পারে, যা অধিকাংশ বিবাহবিচ্ছেদের মূলে ক্রিয়াশীল থাকে
বলে মনে হয় আপনার?
রঞ্জনা: বিবাহ শব্দটির
ব্যুৎপত্তিগত অর্থের মধ্যেই এই বন্ধনের কথাটি নিহিত আছে । বিবাহ শব্দটি বি –
পূর্বক বহ্ ধাতু ও ঘঞ্ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন । বহ্ ধাতুর অর্থ বহন করা এবং বি
উপসর্গের অর্থ বিশেষ রূপে । ধর্মীয় প্রথা মেনে সামাজিক ভাবে একজন পুরুষ একজন
নারীকে সারাজীবন ধরে বহন করার অঙ্গীকার করছে । ফলে একটি বন্ধনের কথা অবশ্যম্ভাবী
রূপে এসে যায় এখানে । আর এই বন্ধনই বিবাহিত দুই নরনারীর মনকে অসাড় করে দেয় –
তাদের মধ্যে হারিয়ে যায় প্রেম , প্রীতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ,ও সম্মান জ্ঞাপন করার প্রবণতা । স্ত্রীকে বলা হয়
ভার্যা ---- অর্থাৎ তাকে ভরণ করতে হয় । সংসারে অধিকাংশ স্ত্রীরা চূড়ান্ত অপমান ও হীনমন্যতার অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে
। স্বামী স্ত্রীকে মানুষের সম্মান না দিয়ে
তার প্রতি কর্তৃত্ব প্রয়োগ করলে একটি
সুস্থ বিবাহিত সম্পর্ক কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ও বিবাহ বন্ধনের প্রকৃত মহিমা ক্ষুন্নিত হয় ।
বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থায় পুরুষ তথা স্বামীর এই কর্তৃত্ব বোধের চূড়ান্ত প্রকাশ ই অনেক ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ-
বিচ্ছেদের মুল কারন বলে আমার মনে হয় ।
সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে বিবাহ বলতে দুটি নরনারীর
এক সাথে বসবাস ও বংশরক্ষা, সংসারধর্ম
পালন বলেই বুঝে থাকি আমরা। কিন্তু এই
সামান্য জৈবিক পরিসরেই তো বিবাহের সার্থকতা পূরণ হতে পারে না! দুজন মানুষের মানসিক,
শারীরীক, মনস্তাত্বিক ও আত্মিক সত্ত্বাগত মিলন
ছাড়া তো বিবাহ সম্পূর্ণ হতে পারে না!
বর্তমান সমাজ সংসারের প্রেক্ষিতে দুইজন মানুষের এই সত্ত্বাগত মিলন কতটা
বাস্তবিক সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?
রঞ্জনা: আমাদের প্রচীন
ভারতীয় শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘ পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা” অর্থাৎ পুত্রের জন্য
ভার্যার প্রয়োজন । পুরুষের জীবনে নারীর স্বীকৃতি বংশরক্ষার জন্য । স্ত্রী হচ্ছেন
ধর্মপত্নী – ধর্ম রক্ষার সহায়ক । বংশ , ধর্ম , সংসার প্রতিপালন – এই সবের জন্যই
পুরুষের জীবনে নারীর প্রয়োজন এবং সেই
প্রয়োজনকে সামাজিক স্বীকৃতি দেবার জন্য বিবাহ নামক এই অনুষ্ঠানটি করা হয় । নারীকে
চিরকালই পুরুষের প্রয়োজনের মূল্যবান উপকরণ রূপে দেখা হয়েছে । তার সামাজিক ,মনস্তাত্বিক
ও আত্মিক উৎকর্ষতাকে সেভাবে কোনোদিনই পুরুষ প্রাধান্য দেয় নি – শুধু মাত্র নারীর
শারীরিক উৎকর্ষতাই তার কাছে বিচার্য বিষয় ছিল ও আছে । বিবাহের মাধ্যমে দুটি
নরনারীর যে শারীরিক মানসিক ও আত্মিক মিলন অবশ্যম্ভাবী হওয়া উচিত বাস্তবে তা খুব কম
ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় । দুটি মানুষের আত্মিক মিলনের ক্ষেত্রে কালের কোন ভুমিকা আছে
বলে আমার মনে হয় না । যদি দুটি মানুষ পরস্পরকে ভালবেসে যথার্থ প্রেমের বন্ধনে
আবদ্ধ হয় তাহলে তাদের বৈবাহিক জীবনে সত্ত্বা গত মিলনের কোন বাঁধা থাকতেই পারে না –
তা অতীত বর্তমান বা ভবিষ্যতে - যে কোন কালেই সম্ভব বলে আমার মনে হয় ।
সংশপ্তক: বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্পর্কের আঙিনায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত একটি
খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই মনে হয়। বিশেষ করে দাম্পত্যের পরিসরে তো বটেই। আজ থেকে প্রায় একশ
বছর আগে তার ‘লেডি
চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাস প্রসঙ্গে লরেন্স এক জায়গায়
বলেছিলে, “The modern cult of personality is excellent for friendship
between sexes, and fatal for marriage” অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের
স্ফূরণকেই তিনি সফল দাম্পত্যের অন্তরায় বলে মনে করছেন। নাকি দাম্পত্যের পরিসরে
নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকে পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে অপারগ বলেই দাম্পত্যে এই আধুনিক সংঘাতের সৃষ্টি বলে মনে হয়
আপনার?
রঞ্জনা: Samuel Richardson বলেছেন “ Marriage is the highest state
of friendship. If happy , it lessens our cares by dividing them , at the same
time it doubles our pleasures by mutual participation .”…বিবাহিত
দম্পতির মধ্যে যদি সুন্দর বোঝাপড়া থাকে , তারা যদি পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব কোন সংঘাত
সৃষ্টি করতে পারে না । কারন একজন যথার্থ আধুনিকমনস্ক মানুষ কখনই কারোর ব্যক্তি
স্বাতন্ত্র্যকে অবহেলা করতে পারেন না । কিন্তু যখনই এর ব্যাতিক্রম ঘটে তখনই
দেখা দেয় ব্যক্তিত্বের সংঘাত – বিশেষ করে মুখোশ ধারী আধুনিক
পুরুষ কখনই নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে
মেনে নিতে পারে না । আমার মনে হয় পুরুষের মানসিকতা চিরকাল একই রকম থেকে যাবে । কি প্রাচীন যুগ ---কি আধুনিক
বর্তমান সময় ...... খুব কম ক্ষেত্রেই একজন প্রকৃত আধুনিক মনস্ক পুরুষের দেখা মেলে
। নারী যতই অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে –
ততই বাড়ছে সমস্যা – ততই পুরুষ তাকে মনে প্রানে মর্যাদায় গ্রহণ করতে পারছে না ।
নারীর স্বাতন্ত্র্য , উৎকর্ষতাকে মেনে নিতে পারছে না বলেই বাড়ছে সামাজিক সংঘাত ,
বিবাহ – বিচ্ছেদের মত ঘটনা । তাই লরেন্সের উক্তি অনেকাংশে সত্যি বলে মনে হয় ।
সংশপ্তক: একজন বিবাহ বিচ্ছিন্না নারী ও বিবাহ
বিচ্ছিন্ন পুরুষকে সমাজ কি একই চোখে দেখে বলে মনে করেন আপনি? বাস্তব অভিজ্ঞতায়
কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর সম্বন্ধেই দোষারোপ করা হয় মানিয়ে নিয়ে
চলতে না পারার জন্যেই! অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয় যে সফল দাম্পত্যের অন্যতম শর্ত হল
নারীর এই মানিয়ে নিয়ে চলার ক্ষমতা, যা অন্যদিক দিয়ে
পুরুষতন্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর। এই বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
রঞ্জনা: একজন বিবাহ
বিচ্ছিন্ন নারী ও একজন বিবাহ-বিচ্ছিন্ন পুরুষকে সমাজ কখনই সমদৃষ্টিতে দেখে না ।
কারণ নারী চিরকালই পুরুষের ভোগের , মনোরঞ্জনের একটি প্রধান উপচার । বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ
দুটি নরনারী যদি কোন কারনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান – তখন সর্ব ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই দোষী বলে মনে করা হয় –
মেয়েটির সহনশীলতার প্রতি তর্জনী ওঠে । আমাদের সমাজ এখনও বিবাহ- বিচ্ছিন্না নারী সামাজিক ভাবে নানা অন্যায়ের শিকার হন । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে
মেয়েটির বাপের বাড়ির লোকেরাও তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে , তাকে নানা ভাবে প্ররোচিত
করে বিয়েটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য , কিন্তু যদি তা ভেঙে যায় তবে মেয়েটি চূড়ান্ত ভাবে
অসহায় হয়ে পড়ে । যদি সে অর্থনৈতিক ভাবে
স্বাধীনও হয় তবু তার নিরাপত্তার ক্ষেত্রটি ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকে – এক্ষেত্রে
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অনেক সময় তাকে
সহজলভ্য মনে করে । একজন বিবাহ বিচ্ছিন্না
মহিলা সামাজিক ও সাংসারিক জীবনে অনেক অপমান ও অসাম্যের সম্মুখীন হন – যা
পুরুষ তন্ত্রের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করে । কিন্তু একজন বিবাহবিচ্ছিন্ন পুরুষ
অতি সহজ ভাবে মর্যাদা নিয়েই সমাজ সংসারে বাস করেন ।
সংশপ্তক: দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙন সন্তানদের চেতন অবচেতনে কি একটা অনিশ্চিয়তার জন্ম দেয়
না? সেই
অনিশ্চিয়তা যদি তাদের সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায় তবে তাদের পরবর্তী জীবনে তার
প্রভাব কতটা সদর্থক বা নঙর্থক হয় বলে মনে হয় আপনার?
রঞ্জনা: দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙন শিশু মনে
যথেষ্ট প্রভাব ফেলে । শিশু ফুলের মত – মা বাবার যুগ্ম সহচর্যে তার মানসিক বিকাশ ঘটে । মা ও বাবা যদি
বিচ্ছেদের রাস্তায় হাঁটেন সেক্ষেত্রে শিশুটি নিরাপত্তার অভাব বোধ করে, আর এক
অনিশ্চয়তার আবর্ত তার মনে নঞর্থকতার জন্ম দেয় ।একটি শিশুর কাছে
মা এবং বাবা উভয়েই প্রিয় মানুষ কিন্তু তাকে সর্বদাই একজনকে ছেড়ে থাকতে হয় , ছোট
থেকেই তার মনে মা অথবা বাবা – কোন একজনের সম্বন্ধে ঘৃণার ভাব ঢুকিয়ে দেওয়া হয় – এর
ফলে শিশুমনের অবচেতনে একধরণের নিরাপত্তাহীনতা , বাস্তব বিমুখতার জন্ম হয় । এইজন্যই
এইধরনের শিশুরা তাদের পারিপার্শ্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে – খোলা মন নিয়ে সকলের
সাথে মিশতে পারে না ।এই প্রভাব তাদের মনে থেকে যায় তারা যখন বড় হয়ে ওঠে তখনও – এটি
আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ।
সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছিন্ন
দম্পতিদের মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব স্ত্রীই বহন করেন। সন্তানের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে
মা’র
সাহচর্যই অধিকতর প্রয়োজনীয় হলেও শিশু মনে পিতার অভাব কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে?
সেই ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
রঞ্জনা: একজন শিশু জন্ম থেকে মা ও বাবার স্নেহের উপর নির্ভরশীল । মা এবং বাবা দুজনের
উপস্থিতিই তার জীবনে অপরিহার্য । এটি একটি শিশুর সুস্থ , সুন্দর বিকাশের পক্ষে
সর্বাপেক্ষা আবশ্যিক শর্ত । কিন্তু দৈব ক্রমে যদি মা ও বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে
যায় এবং শিশুটি যদি দুগ্ধপোষ্য হয় তবে সেক্ষেত্রে অনেকসময় মহামান্য আদালতের
নির্দেশে শিশুটিকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখা হয় । শিশুটি কিছুটা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তার
কাছে মহামান্য আদালত জানতে চায় সে মা না বাবা কার কাছে থাকতে পছন্দ করে এবং শিশুর
ইচ্ছানুসারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাকে মায়ের কাছেই রাখা হয় । এছাড়া অধিকাংশ মা-ই
শিশুর অধিকার বাবাকে দিতে রাজী থাকেন না । এর প্রভাব শিশুর অন্তরে গভীর ছাপ ফেলে... শিশুটির মনে অনেক
সময় নিজের বাবার সম্বন্ধে এক বিরূপ মনোভাব তৈ্রী হয় ,মা যদি অর্থনৈতিক ভাবে সবল না
হন অনেক সময় দারিদ্র্য হীনমন্যতার স্বীকার
হতে হয় ... এছাড়াও মনের মধ্যে একটা অভাব বোধ থাকার জন্য সে অন্যান্য
স্বাভাবিক পরিবারের বাচ্চাদের সাথে সহজ
ভাবে মিশতে পারে না । এই সময় শিশুটিকে সুন্দর ভাবে মানুষ করার ক্ষেত্রে মায়ের
দায়িত্ব দ্বিগুন হয়ে যায় । মাকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
তার শিশুকে বড় করে তুলতে হয় । তবে আজকাল অনেক মা-ই অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন তাই
শিশুর দায়িত্ব তাদের ভারাক্রান্ত করে না । আর আমার মনে হয় এক্ষেত্রে পিতার অভাব
শিশুর মনে সুপ্ত থাকলেও তার মায়ের স্নেহছায়ায় সুন্দর ভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে ।
মা –ই হচ্ছেন সন্তানের জীবনের প্রধান আশ্রয় ।
সংশপ্তক: আমাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের
সংখ্যার এই যে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাগরিক সমাজের পক্ষে তা
কতখানি ক্ষতিকর বলে মনে করেন আপনি? নাকি এই পথেই নতুন সমাজ
বিন্যাস গড়ে নেবে অনাগত ভবিষ্যৎ?
রঞ্জনা: বর্তমান আর্থ – সামাজিক পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা , ধৈর্য , অপরকে বোঝার মতো মানসিক পরিসর ক্রমশ হ্রাস
পাচ্ছে । নগরজীবনের আধুনিকতায় জীবনে বাড়ছে জটিলতা ।বিবাহ –এই সামাজিক
প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিমুলেও ঘা লেগেছে ,
বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে । তাছাড়া বিবাহিত দম্পতিরাও অর্থনৈতিক
উচ্চাশায় নিজের নিজের জগতে এমন ভাবে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে যে তাদের মধ্যে প্রেম তথা
মানসিক , সামাজিক নৈকট্য কমে আসছে , মানুষ হচ্ছে একাকীত্বের শিকার । ভোগবাদী সমাজ
ব্যবস্থায় স্বামী- স্ত্রী , ছেলে মেয়ে
আত্মীয় পরিজন সকলের মধ্যে সংযোগ সূত্রটি শিথিল হচ্ছে । মানুষ হচ্ছে
স্বার্থ মুখীন ...সামাজিক বন্ধন তুচ্ছ
করতে চাইছে । কিন্তু এই ধরনের মানসিকতা মানুষের জীবনে মঙ্গল আনবে না... তাই সাবধান
হবার সময় এসেছে । আমার মনে হয় বর্তমান সমাজের প্রতিটি দম্পতির কর্তব্য পারিবারিক
বন্ধনের বৃত্তে তাদের ছেলে মেয়েদের মানুষ করা- তাদের নিজের নিজের মা বাবা ছাড়াও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও ভালবাসা প্রবণ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া । সামাজিক বিধি নিষেধ মেনে
চলার শিক্ষা ও মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হবার শিক্ষা দেওয়া উচিত । এই ভাবে না চলতে শেখালে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একাকীত্বের
অন্ধকূপ থেকে রক্ষা করতে পারবো না ।
রঞ্জনা রায়: বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক