>

রুমনী সেন




সংশপ্তক:  বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়েবলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষবেলাকার গল্প চোরাই ধনে। যে যুগে কবি এই ধারণার তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন, ভিক্টোরিয়ান রোম্যান্টিক যুগচেতনায় লালিত জীবনবোধের আলোতে, আমাদের এই একবিংশ শতকের সময়চেতনায় সেই যুগের বাণী কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আপনার?
রুমনী:  সাধারণত বিবাহ সম্পর্ক বা বিবাহিত জীবনের মধ্যে কোন কাব্যিকতা বা সঙ্গীতের মধুরতা থাকে না।  বরং বাস্তবে  এটা খুবই কেজো এবং দেনা পাওনার সম্পর্ক  বলেই আমার মনে হয়, যদিও এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।

সংশপ্তক:  নরনারীর পারস্পরিক অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্কের  মূল রসায়নটা ঠিক কি বলে মনে করেন আপনি? বিবাহ নামক সামাজিক  প্রতিষ্ঠান কি সেই রসায়নের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে?
রুমনী:  মূল রসায়নটা হল প্রেম, প্রেম এবং একমাত্র প্রেম। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রেমের উপর দাঁড়িয়ে নেই। বিবাহ সম্পর্কে অনেক দায় দায়িত্ব পালন করতে হয়, স্বামী স্ত্রী উভয়কেই। সন্তানদের প্রতিও দায়িত্ব কর্তব্য থাকে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপার থাকে। বিবাহ না থাকলে তো সমাজটা জঙ্গল হয়ে যেত। অবশ্য বিবাহ সম্পর্কের মধ্যেও দায়িত্ব কর্তব্যহীনতা ও নানা রকম অপরাধ দেখা যায়।  বিবাহিত  সম্পর্ক হত্যাকারীকে বধূহত্যা, পণের জন্য নিপীড়ন থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। তবে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি নরনারীকে একেবারে বয়ে যেতে দেয় না, কিছুটা হলেও অনুশাসনে বেঁধে রাখে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সংশপ্তক:  দাম্পত্য সম্পর্ককে সুস্থসবল সজীব করে রাখার মূল শর্ত্তগুলি আপনার মতে কি কি?
রুমনী: প্রেম, প্রীতি, পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ, বিশ্বস্ততা, পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার এ গুলোই মূল শর্ত। যদি তুমি স্বার্থপর হও তবে একা থাকো। যদি মনে করো তোমার স্বামী বা স্ত্রী স্বার্থপর, তবে একা থাকো। এখানে কোন আপোষ বা মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।  ও সব আপোষ টাপোস কর্মক্ষেত্রে বসের সঙ্গে চলে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে চলে না বা চলা উচিত না।

সংশপ্তক: আমাদের সমাজ বাস্তবতায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখী গৃহকোণ গড়ে ওঠে, দাম্পত্য সম্পর্কের আঙিনায় দুইজনের মধ্যে কোনো একজনের ব্যক্তিত্বের কাছে আর একজনের আত্মসমর্পণের ভিত্তিতেই। এইটা কি আদৌ কোনো  আদর্শ পথ বলে মনে করেন আপনি? বিশেষ করে যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংসারের মুখ চেয়ে স্ত্রীকেই আত্মসমর্পণ করতে হয় স্বামীর কাছে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে পুরুষতন্ত্রের কাছে?
রুমনী: ব্যক্তিত্ব জিনিসটা একটা সদ্‌গুণ। যার মধ্যে এই গুণ থাকে সে অন্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে না। একজন আর একজনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বা অপরের ব্যক্তিত্বকে পিষ্ট করতে চায় অর্থ বা ক্ষমতার জোরে। ব্যক্তিত্বের দ্বারা নয়। শুধু স্বামী স্ত্রী নয়, অন্যান্য বহু ক্ষেত্রেই  এটা দেখা যায়। মানুষ সব সময় তার পাওয়ারকে অনুচিতভাবে কাজে লাগাতে চায়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এটা বেশী দেখা যায়। কারণ আমাদের সমাজে সাধারণত স্বামীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান।  প্রায়শই দেখা যায় তারা নিজেদের স্ত্রীর সঙ্গে একটা প্রভু ভৃত্যের সম্পর্ক গড়ে তোলে। অথচ সম্পর্কটা প্রেমের। আমি বহু স্বামীদেরকে দেখেছি, যারা স্ত্রীদের সঙ্গে ভালভাবে কথা বলে না বা দরকার ছাড়া কথা বলে না। আমি নিজে বহু স্বামীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বার্তা শুনেছি।, তাদের কথাগুলো অনেকটা এই রকম।

“চুপ করো তো আর জ্ঞান ফলিও না, ঘরে বসে বসে সব জেনে গেছে।  হুঁহ!”
“কি হল? এখনও রান্না হল না? তাড়াতাড়ি করো”
“এই তো সেদিন তেল আনলাম, এর মধ্যে ফুরিয়ে গেল? আমি অফিস চলে যাওয়ার পর বন্ধুবান্ধব ঘরে এনে খাওয়াও না কি?”   

স্বামী নিজে জানে ভুল কথা বলছে। স্ত্রীও জানে। কিন্তু প্রতিবাদ করে না। এই কথাগুলো বলে তার প্রভুত্ব করার ইচ্ছা চরিতার্থ হয় তো হোক। না হয় একটু শুনলামই। চুপ করে থাকলে ক্ষতি তো কিছু নেই, বরং কথা বাড়ালে অশান্তি হবে। এর নামই আত্মসমর্পণ। যে স্ত্রী বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়, সে কিন্তু তার স্বামীর পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তিএটাও আমি  দেখেছি। মানুষ প্রতিবাদের দ্বারা অন্যায়কে প্রতিহত করে, মেনে নেয় না, ফলে তার ভিতরটা সুস্থ থাকে। কিন্তু  যখন মেনে নেয় বা নিতে বাধ্য হয় তখন সেই অন্যায়কে নিজের ভিতরে আত্মীকরণ করে নেয়। এইসব স্ত্রীরা স্বামীর সঙ্গে যে কোন অনুচিত কাজ বা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।

সংশপ্তক:  বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক টলস্টয় তাঁর গল্প খ্রয়েৎসার সনাটায় (THE KREUTZER SONATA) বলেছেন “…a marriage without love is no marriage at all, that only love sanctifies marriage, and that the only true marriage is that sanctified by love” এখানেই প্রশ্ন জাগে এইটাই তো হওয়ার কথা, আর সেইক্ষেত্রে বিবাহের পরিণতি তো কখনোই বিয়োগান্ত হতে পারে না! তবে  সমাজে এত বিবাহ-বিচ্ছেদের বারবাড়ন্ত কেন?
রুমনী:  ঠিকই বলেছেন টলস্টয়। রবীন্দ্রনাথও  লিখেছেন, ‘অপবিত্র ও করপরশ, সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে।’ প্রেমহীন সেক্স এর মধ্যে একটা কুশ্রীতা আছে, যা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে কুশ্রী করে তোলে। তবে প্রেম থাকলে কি বিচ্ছেদ হতে পারে? প্রেমই তো পরস্পরকে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখেবিবাহবিচ্ছেদের কারণ প্রেমের অভাব। শুধু প্রেমহীনতাই নয়। লোভ লালসা ডাউরি, পরকীয়া অনেক কিছুই কাজ করে  বিচ্ছেদের পিছনেঅনেক সময় ভালবেসে বিয়ে করলেও পরে আর ভালবাসা থাকে না। স্বয়ং টলস্টয় ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কিছুমাত্র ভালবাসা ছিল না। কারণ আর কিছুই নয়। বাসনা। যৌনতা আর প্রেমের মধ্যে একটা ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক আছে। তাই ১৩টা সন্তান হওয়ার পর টলস্টয়ের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ততায় ভরে গিয়েছিল। ৭০ বছরের বৃদ্ধ টলস্টয় স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি হওয়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং পরে একটি স্টেশনের ওয়েটিং রুমে মারা গিয়েছিলেন। ভাল হত যদি অনেক আগেই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যেত।  

সংশপ্তক: সাধারণভাবে বিবাহ বলতেই আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকেই বুঝিয়ে থাকি। এই যে একটি সম্পর্কের বন্ধন বা শৃঙ্খল এবং তাতে আজীবন আবদ্ধ থাকার প্রাথমিক অঙ্গীকার, সেই শৃঙ্খলই কি কোন এক সময় দাম্পত্যের পরিসরটিকে সঙ্কুচিত করে তুলে একটা দমবন্ধের পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে, যা অধিকাংশ বিবাহবিচ্ছেদের মূলে ক্রিয়াশীল থাকে বলে মনে হয় আপনার?
রুমনী: আমার তা মনে হয় না। যেখানে দায়দায়িত্বের শৃংখল থাকলেও মানুষ দায়িত্ব পালন করে না। যেখানে সারাজীবনের ভাত কাপড় দেওয়ার অঙ্গীকার করেও বিয়ের কয়েকবছর পর আরও দু তিনটে ভাত কাপড় দেওয়ার লোকের দায়িত্ব স্ত্রীর ঘাড়ে চাপিয়ে বিদায় করে দেয়,  পাঁকাল মাছের মত পিছলে দায়িত্বপালন করা থেকে বাঁচার  চেষ্টা করে, সেখানে শৃংখল না থাকলে যে কি হবে, ভাবতেও হৃদ্‌কম্প হয়। আর তা ছাড়া ওই দায়িত্বপালনের অঙ্গীকারটুকু আছে বলেই তো মেয়েরা বিয়ে করে।  সেটা না থাকলে মেয়েরা বিয়ে করবেই বা কেন? ও সব লিভ টুগেদার ফুগেদার সব বড়লোকদের ফ্যাশান। সাধারণ ঘরের মেয়েদের পাগলা কুকুরে কামড়ায় নি যে খামকা  একটা লোকের সঙ্গে একসাথে থাকতে যাবে।  তাই সমাজকে যদি বিবাহের বন্ধন ও শৃংখল থেকে মুক্ত করা হয় তা হলে পুরুষরাই অসুবিধায় পড়বে।  J

সংশপ্তক:  সাধারণ ভাবে বিবাহ বলতে দুটি নরনারীর এক সাথে বসবাস ও বংশরক্ষা, সংসারধর্ম পালন বলেই বুঝে থাকি আমরা।  কিন্তু এই সামান্য জৈবিক পরিসরেই তো বিবাহের সার্থকতা পূরণ হতে পারে না! দুজন মানুষের মানসিক, শারীরীক, মনস্তাত্বিক ও আত্মিক সত্ত্বাগত মিলন ছাড়া তো বিবাহ সম্পূর্ণ হতে পারে না!  বর্তমান সমাজ সংসারের প্রেক্ষিতে দুইজন মানুষের এই সত্ত্বাগত মিলন কতটা বাস্তবিক সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?
রুমনী: দেহ মন আত্মা সব দিক দিয়ে সার্থক মিলন হয়েছে এমন স্বামী স্ত্রী আমি দেখি নি। তবে সত্যিকারের ভালবাসা থাকলে অন্যসব খামতি পূরণ করে নেওয়া যায়।

সংশপ্তক: বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্পর্কের আঙিনায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই মনে হয়বিশেষ করে দাম্পত্যের পরিসরে তো বটেই। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে তার লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারউপন্যাস প্রসঙ্গে লরেন্স এক জায়গায় বলেছিলে, “The modern cult of personality is excellent for friendship between sexes, and fatal for marriage” অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকেই তিনি সফল দাম্পত্যের অন্তরায় বলে মনে করছেন। নাকি দাম্পত্যের পরিসরে নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকে পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে অপারগ বলেই  দাম্পত্যে এই আধুনিক সংঘাতের সৃষ্টি বলে মনে হয় আপনার?
রুমনী: বিদেশী লেখকদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভেতো বাঙালীর দাম্পত্য সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। J তবে পুরুষরা অধিকাংশই স্ত্রীকে নিজের থেকে নীচু দেখতে পছন্দ করে। স্ত্রী তাকে ছাপিয়ে উঠলে তার গায়ে জ্বালা ধরে যায়। পুলিস ফাইলসে এমনই একটি ঘটনা দেখেছিলাম। স্বামী মাধ্যমিক আর স্ত্রী বি এ পাস বলে স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে উঠতে বসতে বাক্যযন্ত্রণা দিত। বলত, “এহ, বি এ পাস বলে নিজেকে কি না কি ভাবে।” স্বামী তার উপর অত্যাচার করত, সবসময় বলত, “বি এ পাস বলে তোমার খুব অহংকার তাই না?” অবশেষে তাকে একদিন মেরেই ফেলল। এই সব অসুস্থ লোকরা বিয়ে করার যোগ্যই নয়।  

সংশপ্তক:   একজন বিবাহ বিচ্ছিন্না নারী ও বিবাহ বিচ্ছিন্ন পুরুষকে সমাজ কি একই চোখে দেখে বলে মনে করেন আপনি? বাস্তব অভিজ্ঞতায় কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর সম্বন্ধেই দোষারোপ করা হয় মানিয়ে নিয়ে চলতে না পারার জন্যেই! অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয় যে সফল দাম্পত্যের অন্যতম শর্ত হল নারীর এই মানিয়ে নিয়ে চলার ক্ষমতা, যা অন্যদিক দিয়ে পুরুষতন্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর। এই বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
রুমনী:  কখনওই এক চোখে  দেখে না। মহিলারাই দেখে না।  আমি নিজে ভুক্তভোগী। আসলে সমাজ টমাজ, ও সব কিছু না। সমাজ তো মানুষকে নিয়েই।  বড়দের কুশিক্ষা এতটাই শক্তিশালী ছিল, যে  আমি নিজেও এক সময় ভেবেছিলাম বশ্যতা স্বীকার করাটাই ভবিতব্যকিন্তু পারি নি। আমার অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করেছিল।  শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার পর আমাকে বহুদিন ধরে  হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রশ্নকর্ত্রীরা কিন্তু সবাই মহিলা। প্রশ্নগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিল।

কি গো কি হয়েছিল গো?
এই বলো না। কি করত তোমায়? অ্যাই মারত?
আচ্ছা এখন কি করবে ঠিক করেছ?
কি করে চলবে তোমার? বাচ্চাকে কি করে মানুষ করবে? তোমার তো আবার মেয়ে। ছেলে হলে যেখানে হোক চরেবরে খেতে পারত। মেয়েকে নিয়ে তো হাজার ঝামেলা।  

এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না চাইলে বা দরজা দেখিয়ে দিলে তারা খেপে যেত। বলত,

না বাচ্চাটাকে দেখে কষ্ট লাগে।  বেচারা বাবা কি জিনিস জানল না। কি হবে ওর, বড় হয়ে কি খাবে, কি করে বেঁচে থাকবে ভেবে চিন্তা হয় বলেই আসি। না হলে আসতাম না।  ওরাই বা কেমন লোক। বাচ্চাকে একবার দেখতেও আসে না। বউ যতই বদমাস হোক, বাচ্চা তো কোন দোষ করে নি। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

বরং সত্যের খাতিরে বলতে হয়, পুরুষদের কাছ থেকে কিছুটা বন্ধুত্বমূলক ব্যবহার পেয়েছিলাম।
তবে সফল দাম্পত্যের অন্যতম শর্ত হল নারীর মানিয়ে চলার ক্ষমতা, এ কথা মানতে পারলাম না। নারী বশ্যতা স্বীকার করলেই কি দাম্পত্য সফল হয়? স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তো প্রভু ভৃত্যের নয়।

সংশপ্তক: দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙন সন্তানদের চেতন অবচেতনে কি একটা অনিশ্চিয়তার জন্ম দেয় না? সেই অনিশ্চিয়তা যদি তাদের সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায় তবে তাদের পরবর্তী জীবনে তার প্রভাব কতটা সদর্থক বা নঙর্থক হয় বলে মনে হয় আপনার?
রুমনী:  সন্তানরা নানা কারণে ইনসিকিউরিটি ফিল করতে পারে। যে সব দম্পতির ঝগড়ায় বাড়িতে কাক চিল বসতে পারে না, তাদের সন্তানরা কি সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে? তারা সব চেয়ে বেশী অনিশ্চয়য়তায় ভোগে।  যে সব পেরেন্ট সন্তানের প্রতি স্নেহহীন আচরণ করে, শাসন, পীড়ন, তর্জন চালায়, করে, তারাও অনিশ্চয়তায় ভোগে। সিঙ্গল মাদার যদি সন্তানকে স্নেহ ভালবাসা দিয়ে দায়িত্বের সঙ্গে মানুষ করে তা হলে দারিদ্র্য থাকলেও সে অনিশ্চয়তায় ভুগবে না। সাধারণত সিঙ্গল মাদাররা সন্তানের প্রতি বেশী কেয়ারিং ও দায়িত্ববান হয়।

সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতিদের মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব স্ত্রীই বহন করেন। সন্তানের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মার সাহচর্যই অধিকতর প্রয়োজনীয় হলেও শিশু মনে পিতার অভাব কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে? সেই ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
রুমনী: শিশুর জীবনে পিতামাতা উভয়েরই প্রয়োজন আছে। কিন্তু দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। পিতা যদি দুষ্ট হয়, বদমাস হয় তা হলে সে শিশুর পক্ষে ক্ষতিকরই হবে। যেমন বেহালার অভীক ঘোষ। সে নিজের স্ত্রীকে খুন করে দুই সন্তানকে মাতৃহীন করে দিয়েছিল। তাই এমন পিতার কবল থেকে মুক্ত হলে শিশুরা মানসিক দিক দিয়ে চাপমুক্ত থাকবে বলেই মনে হয়।
সিঙ্গল মায়ের দায়িত্ব অনেক বেশী। তার কর্তব্য শিশুকে দ্বিগুণ স্নেহ ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখা এবং একাধারে বাবা ও মা হয়ে কর্তব্য পালন করা। নিজের জীবনের দুঃখ কষ্টের দায়ভার শিশুর উপর চাপানো ঠিক নয়।  অন্যদের প্রতি রাগ নির্দোষ শিশুর উপর ঝাড়া ঠিক নয়। বোঝা উচিত, তাকে তুমিই পৃথিবীতে টেনে এনেছ। সে আসার জন্য হাত জোড় করে নি।

সংশপ্তক:  আমাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যার এই যে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাগরিক সমাজের পক্ষে তা কতখানি ক্ষতিকর বলে মনে করেন আপনি? নাকি এই পথেই নতুন সমাজ বিন্যাস গড়ে নেবে অনাগত ভবিষ্যৎ?
রুমনী: যে সম্পর্ক ভাঙার তাকে জোর করে জোড়া লাগিয়ে, জুড়ে থাকার চেষ্টা করলেই তা শিশুদের পক্ষে ক্ষতিকর হয়। আমার মনে হয় আমরা যে দিনগুলো পেরিয়ে এসেছি, তার থেকে বর্তমান সময়ের অল্পবয়সীরা অনেক ভাল আছে।  হ্যাঁ, ডিভোর্সিদের সন্তানরাও। 



রুমনী সেন: চিন্তাবিদ ও সুলেখিকা




Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.