>

ডালিয়া ভট্টাচার্য




সংশপ্তক:  বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়েবলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষবেলাকার গল্প চোরাই ধনে। যে যুগে কবি এই ধারণার তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন, ভিক্টোরিয়ান রোম্যান্টিক যুগচেতনায় লালিত জীবনবোধের আলোতে, আমাদের এই একবিংশ শতকের সময়চেতনায় সেই যুগের বাণী কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় আপনার?
ডালিয়া: শুধু বিবাহ কেন জীবনের সব কিছুতেই তো সুর  আর এখন তখন বলে নয় সুর ছাড়া জীবনবোধ বোধহয় কোন দিনও সম্ভব নয় । সৎ স্বাভাবিক লক্ষ্যটাকে স্থির রেখে  নিজেদের ত রোজই পালটানো যায় ।  স্বামী স্ত্রী উভয়েই উভয় কে  রঙ্গিন সুরেলা ভাবনায় সাজিয়ে নিলেই বা ক্ষতি কি? আর উভয়েই  উভয়ের এই রঙ্গিন সুরেলা ভাবনাকে  স্বীকৃতি দিলেই বরং সংসার নিজেদের অজান্তেই প্রেমের জোয়ারে  সুখের তরণী বেয়ে  এগিয়ে যাবে ।। 

সংশপ্তক:নরনারীর পারস্পরিক অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্কের  মূল রসায়নটা ঠিক কি বলে মনে করেন আপনি? বিবাহ নামক সামাজিক  প্রতিষ্ঠান কি সেই রসায়নের উপরেই দাঁড়িয়েথাকে?                                                  ডালিয়া: বন্ধুত্ব শুধু মাত্র বন্ধুত্ব ,পরস্পরের মধ্যে এক নিবিড় আর দৃঢ় বন্ধুত্ব আর কিছু নয় যা ভললাগা দিয়ে শুরু আর ভালবাসা দিয়ে শেষ বিবাহ নিজে কোন প্রতিষ্ঠান বা বন্ধন বলে আমি অন্তত মনে করিনা।  বিবাহের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয় এই বন্ধন নামক সামাজিক সিলমোহর! 

সংশপ্তক:  দাম্পত্য সম্পর্ককে সুস্থসবল সজীব করে রাখার মূল শর্ত্তগুলি আপনার মতে কি কি?

ডালিয়া ১. পরস্পরের মধ্যে  সুদৃঢ় বন্ধুত্ব স্থাপন করা  ২. উভয়কেই পরস্পরের  ছোট খাটো ভুল গুলি  ignore করা  বা সংশোধনের চেষ্টা করা ৩. পারস্পারিক  ego না  রাখা ৪. লোকের কথায় কান না দেওয়া ৫. পারস্পারিক বিশ্বাস  এই বিশ্বাস ছাড়া কিন্তু সবই বৃথা ।। কবির মতে


সংশপ্তক: আমাদের সমাজ বাস্তবতায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখী গৃহকোণ গড়ে ওঠে, দাম্পত্য সম্পর্কের আঙিনায় দুইজনের মধ্যে কোনো একজনের ব্যক্তিত্বের কাছে আর একজনের আত্মসমর্পণের ভিত্তিতেই। এইটা কি আদৌ কোনো  আদর্শ পথ বলে মনে করেন আপনি? বিশেষ করে যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংসারের মুখ চেয়ে স্ত্রীকেই আত্মসমর্পণ করতে হয় স্বামীর কাছে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে পুরুষতন্ত্রের কাছে?

ডালিয়া:আত্মসমর্পণ মানেই ত দাসত্ব আর দাসত্ব কোন আদর্শ পথ হতে পারে কি ?  আর রইলো পুরুষতন্ত্রের  কাছে নারীর  আত্মসমর্পণ করার কথা   এ  বিষয়ে রবি ঠাকুরের  মতে   
আমি এই মতের সঙ্গে এক মত  ।।


সংশপ্তক: বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক টলস্টয় তাঁর গল্প খ্রয়েৎসার সনাটায় (THE KREUTZER SONATA) বলেছেন “…a marriage without love is no marriage at all, that only love sanctifies marriage, and that the only true marriage is that sanctified by love” এখানেই প্রশ্ন জাগে এইটাই তো হওয়ার কথা, আর সেইক্ষেত্রে বিবাহের পরিণতি তো কখনোই বিয়োগান্ত হতে পারে না! তবে  সমাজে এত বিবাহ-বিচ্ছেদের বারবাড়ন্ত কেন?
ডালিয়া: এর আগেই  ত বলেছি  ৫  টি বিষয় যদি আঁকড়ে ধরে রাখা যায় ত  love,ভালবাসা  কখনই পালাতে পারবে না আর এইগুলির অভাবে ভালবাসার পালাবার পথ প্রসস্থ।।

সংশপ্তক: সাধারণভাবে বিবাহ বলতেই আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকেই বুঝিয়ে থাকি। এই যে একটি সম্পর্কের বন্ধন বা শৃঙ্খল এবং তাতে আজীবন আবদ্ধ থাকার প্রাথমিক অঙ্গীকার, সেই শৃঙ্খলই কি কোন এক সময় দাম্পত্যের পরিসরটিকে সঙ্কুচিত করে তুলে একটা দমবন্ধের পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে, যা অধিকাংশ বিবাহবিচ্ছেদের মূলে ক্রিয়াশীল থাকে বলে মনে হয় আপনার?
ডালিয়া:বিবাহের মধ্যে বারংবার এই কথা আসছে  কেন ? শৃঙ্খল , বন্ধন  এগুলো ভাল  বাসা ও ভালবাসা গড়বার  অন্তরায়   বিবাহের মধ্যে থাকে পারস্পারিক বিশ্বাস, প্রেম ভালবাসা ও  বন্ধুত্ব । শৃঙ্খল, বন্ধন এগুলো থাকলে তো ভাঙ্গন থাকবেই।  শৃঙ্খল = বেড়ি ,বন্ধন = বাঁধন  সুতরাং এ  ছিঁড়বেই , এরা ছেঁড়ার জন্যই তৈরি ।।    

সংশপ্তক:  সাধারণ ভাবে বিবাহ বলতে দুটি নরনারীর এক সাথে বসবাস ও বংশরক্ষা, সংসারধর্ম পালন বলেই বুঝে থাকি আমরা।  কিন্তু এই সামান্য জৈবিক পরিসরেই তো বিবাহের সার্থকতা পূরণ হতে পারে না! দুজন মানুষের মানসিক, শারীরীক, মনস্তাত্বিক ও আত্মিক সত্ত্বাগত মিলন ছাড়া তো বিবাহ সম্পূর্ণ হতে পারে না!  বর্তমান সমাজ সংসারের প্রেক্ষিতে দুইজন মানুষের এই সত্ত্বাগত মিলন কতটা বাস্তবিক সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?
ডালিয়া:বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব এর শক্ত  মোড়কের মধ্যে দু জন মানুষের মানসিক, শারিরিক, মনস্তাত্বিক, ও আত্বিক সত্ত্বার মিলন সম্ভব হয় ও মর্যাদা পায় । কিন্তু   অধিকাংশ সময় দেখা যায় শক্ত মোড়ক টি আলগা হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বন্ধুত্ব আর বিশ্বাস ভঙ্গ করে । আসলে বিবাহের আগে দু জন নরনারী উভয়েই স্বপ্নলোকে বিচরণ করে একে অপরকে ছায়া ছবির প্রধান চরিত্রে কল্পনা করে বসে কিন্তু বাস্তবটা  তাদের কল্পনার সঙ্গে মেলে না  ফলে বেঁধে যায়  গণ্ডগোল ভেঙ্গে যায় সব কিছু। বিবাহের আগে তাই মানসিক, মনস্তাত্বিক ও আত্বিক সত্ত্বার সঠিক ভাব বিনিময় প্রয়োজন দু জনের মধ্যে ।   আর রইল শারিরিক সেটা ওই তিনটির উপর নির্ভর করে আপনি গড়ে উঠবে ।।

সংশপ্তক: বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় পারস্পরিক সম্পর্কের আঙিনায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই মনে হয়বিশেষ করে দাম্পত্যের পরিসরে তো বটেই। আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে তার লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারউপন্যাস প্রসঙ্গে লরেন্স এক জায়গায় বলেছিলে, “The modern cult of personality is excellent for friendship between sexes, and fatal for marriage” অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকেই তিনি সফল দাম্পত্যের অন্তরায় বলে মনে করছেন। নাকি দাম্পত্যের পরিসরে নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের স্ফূরণকে পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে অপারগ বলেই  দাম্পত্যে এই আধুনিক সংঘাতের সৃষ্টি বলে মনে হয় আপনার?
ডালিয়া: নারী পুরুষ উভয়েই যখন মানুষ তখন তার ব্যাক্তিত্ অস্বীকার করবার তো  উপায়  নেই আর ব্যাক্তিত্ব যখন আছে তখন তার  স্ফুরণও তো অবসম্ভাবি । আমার তো মনে হয় এই স্ফুরণের অভাবেই হয়ত পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি  যা সঠিক দাম্পত্যের অন্তরায় হয়ে উঠছে।  নারী বা পুরুষ  উভয়েই আসলে বোঝে না যে তারা কি চায় কতটুকু হলে তাদের আশ মেটে  বা পেলেও তা কোথায় কিভাবে ব্যাবহার করবে । আগে তারা নিজেদের ভাল করে চিনুক আর একে অপরের এই চেনাটাকে সন্মান করতে শিখুক । নিজেকে ছোট করে কক্ষনো অন্য কে বড় করা যায়  কি ? আসলে যারা নিজেকেই  অপমান করে চলেছে তারা তারা সন্মানের বুঝবে কি ?    

সংশপ্তক:   একজন বিবাহ বিচ্ছিন্না নারী ও বিবাহ বিচ্ছিন্ন পুরুষকে সমাজ কি একই চোখে দেখে বলে মনে করেন আপনি? বাস্তব অভিজ্ঞতায় কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর সম্বন্ধেই দোষারোপ করা হয় মানিয়ে নিয়ে চলতে না পারার জন্যেই! অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয় যে সফল দাম্পত্যের অন্যতম শর্ত হল নারীর এই মানিয়ে নিয়ে চলার ক্ষমতা, যা অন্যদিক দিয়ে পুরুষতন্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর। এই বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ডালিয়া: কবির মতে 
অধিকাংশ নারী নরম মনভাবাসম্পন্ন হয়ে থাকেন তাই  সহজেই তাদের মিথ্যা দোষারোপ, বদনাম এর ভাগিদার সেই  হয়ে থাকে, তাই নারী কে হয়ে উঠতে হবে  সাহসী , প্রতিবাদী চরিত্রের প্রতিরুপ ।  তবে সমাজই তার কাছে মাথা নোয়াবে । আর সংসার সকল কে নিয়ে সুতরাং  শান্তি চাইলে সকলকেই মানিয়ে চলতে হবে। এটাই নিয়ম এটাই বাস্তব সত্য ।।

সংশপ্তক: দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙন সন্তানদের চেতন অবচেতনে কি একটা অনিশ্চিয়তার জন্ম দেয় না? সেই অনিশ্চিয়তা যদি তাদের সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায় তবে তাদের পরবর্তী জীবনে তার প্রভাব কতটা সদর্থক বা নঙর্থক হয় বলে মনে হয় আপনার?
ডালিয়া: একদম ঠিক কথা  পরবর্তী প্রজন্মের উপর  প্রচণ্ড  খারাপ প্রভাব পড়ে । সন্তান মা বাবা দুজঙ্কেই সমান  ভালবাসে দুজনের সানিধ্য ই তার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ যে কারনেই  হোক আর যার জন্যই হোক তার কাছ থেকে মা বাবার এক জনও কেউ বিছিন্ন হয়ে যায় সেই সন্তানের অসহয়তা একমাত্র সে নিজেই উপলব্ধি  করে আর কেউ না । দোষ করে কেউ আর শাস্তি পায়  কেউ ।।

সংশপ্তক: সাধারণ ভাবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতিদের মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব স্ত্রীই বহন করেন। সন্তানের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মার সাহচর্যই অধিকতর প্রয়োজনীয় হলেও শিশু মনে পিতার অভাব কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে? সেই ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
ডালিয়া: এ ব্যপারে একটা কথা বলি কি জন্মদাত্রী কিন্তু মা সন্তানের দায়িত্ব  ও তাই অন্যদের থেকে মায়ের খানিকটা বেশি হয়ে থাকে । মায়ের  সঙ্গে শিশুর পরিচয় মায়ের জঠর থেকেই । আর বহন কেন ?  এটা তো পিতা মাতা উভয়েরই কর্তব্য । সন্তানের কাছে পিতা মাতা উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ । মা শিশুকে প্রতিপালন করেন,  সন্তানের শিক্ষা , রুচি , চরিত্র ও চারিত্রিক দৃঢ়তা গড়ে ওঠে মায়ের শিক্ষায়অর্থাৎ মূল কাজটাই করেন মা । তেমনি সমাজ জীবনে সন্তান কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া  তাকে ভালো মন্দ এর সঙ্গে পরিচয় করানো, কোনটা গ্রহণীয় কোনটা বর্জনীয় ইত্যাদি  বোঝানোর দায়িত্ব বাবার ।  দুজনের দায়িত্ব দুজনে যদি ঠিকঠাক পালন করেন তা সন্তানের জন্যে একঘেয়ে হয়ে ওঠে না  ও  সন্তান একটি সুস্থ পরিবেশ পায়  বেড়ে ওঠার জন্য ।   যদিয়ও এদের একজনেরও অভাব  শিশু মন মেনে নিতে পারে না। এক জনের অভাবে আর এক জনকেই এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয় যা অতান্ত্য  কষ্ট দায়ক, আর সন্তানের পক্ষে একঘেয়ে  ও অমঙ্গল জনক ।।

সংশপ্তক:  আমাদের সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যার এই যে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাগরিক সমাজের পক্ষে তা কতখানি ক্ষতিকর বলে মনে করেন আপনি? নাকি এই পথেই নতুন সমাজ বিন্যাস গড়ে নেবে অনাগত ভবিষ্যৎ?
ডালিয়া:এক কথায়  খুব ই  দুর্ভাগ্যজনক  এই  পরিস্থিতি ।   আজকের এই দ্রুততর জীবনে  প্রধান সমস্যা মুলত একাকিত্ব  যা মানুষ শুধু তার মনের  মানুষটির কাছ থেকেই শুধু  নয়  সমাজ থেকে এমন কি নিজের কাছ থেকেও অনেক দূরে সরে  যায়  সমাজ থেকে একটি মানুষ হারিয়ে যাওয়া মানে  তার মধ্যে যে যোগ্যতা, প্রতিভা সুন্দর ইচ্ছা গুলো ছিল সে গুলি ও হারিয়ে  যাওয়া যা সমাজ কে আর ও সুন্দর করতে সাহায্য করত । ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি শিখবে তার উত্তরসূরির কাছে ? কোন আদর্শে তারা গড়ে তুলবে নিজেদের তা  তারা নিজেরাই বুঝবে  না । সুতরাং তাদের দুর্বল চিত্ত বা ভয়ঙ্কর মানসিকতার  শিকার হবে এই সমাজ ।যা নতুন সমাজ বিন্যাসের ক্ষেত্রে অন্তরায়।  মানুষের  চিন্তা ভাবনা , ইচ্ছে  যদি সুন্দর না হয় তবে  সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে কি করে ??আর এই  সুন্দর সৎ চিন্তা গুলি গড়ে উঠে সংসার ও তার সু চিন্তিত মানুষ গুলির থেকে অনেক গুলি ছোটো সুন্দর আদর্শ সমাজ ( সংসার ) নিয়েই তো গড়ে উঠবে এক বিরাট পরিপূর্ণ সমাজ  

[ডালিয়া: রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা ]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.