নব জীবনের অনেক নৈতিকতা বোধই ধর্ম থেকে উৎসারিত এবং ধর্মশাস্ত্রে সংজ্ঞায়িত। এই নৈতিকতার মূল লক্ষ্য হলো সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা আনয়ন। উদাহরণস্বরূপ ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে অবাধ যৌন উশৃঙ্খলা থেকে সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা আনয়নে পরিবার প্রথা-র উদ্ভব । বিবাহ বর্হিভূত যৌনাচার অনৈতিক, এ চেতনার মূল প্রোথিত রয়েছে ধর্মশাস্ত্রে। শুধুমাত্র যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক জীবনের সার্বজনীন নৈতিকতা, যেমন-মিথ্যা না বলা, চুরী না করা, ঘুষ না খাওয়া, মানুষ হত্যা না করা ইত্যাদি পৃথিবীর তাবদ ধর্মগ্রন্থ আত্মস্থ করে পাপ-পুণ্যের আলোতে ধর্মীয় অনুশাসনে রূপান্তরিত করেছে পৃথিবীতে একটি আদর্শ, নৈতিক সমাজ বির্নিমাণের প্রচেষ্টায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ধর্মীয় অনুশাসন মানব মনে নৈতিকতাবোধ উজ্জীবনে কতোটুকু সমর্থ? পাশ্চাত্য সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন কার্য্যত অনুপস্থিত এবং গড়পড়তা ব্যক্তি মানসে ধর্মীয় চেতনাও ম্রিয়মান। সেখানকার সমাজ জীবন আবর্তিত হচ্ছে ইহজাগতিকতায়, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রাচ্যে, যেখানে ধর্ম দৃশ্যমানভাবে এখনো সমাজ নিয়ন্তা, সেখানে কি মানুষের মাঝে সার্বজনীন নৈতিকতাবোধ অত্যন্ত প্রবল? মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে আলোকপাত করলে এ বিষয়ে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে শুরু করে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ পর্য্যন্ত র্নৈব্যক্তিক দৃষ্টিতে সমাজ নীরিক্ষণে এই সব দেশ যে নৈতিক অবক্ষয়ে ক্যান্সারাগ্রস্ত তা নিঃসন্দেহে প্রতিভাস। অথচ এই সব দেশগুলোতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কমতি নেই। নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত তথা ইসলাম নির্দেশিত অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমাগত। এই যেমন বাংলাদেশে শুক্রবারে জুম্মার নামাজে মসজিদ উপচে রাস্তায় নামে নামাজীদের ঢল, রমজান মাসে রোজাদারদের উৎসাহ উদ্দীপনা, তারাবী নামাজে অংশগ্রহনের তাগিদ দেখে মনে হতে পারে দেশটি যেন নৈতিকতার ভিতেই প্রতিষ্ঠিত। কারণ নৈতিকতা বিরোধী কার্য্যক্রম, যেগুলো হাদীস-কোরানে নিষিদ্ধ তা তো মুসলমানের করতে পারে না। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ উল্টো। ঘুষ, র্দূনীতি, মিথ্যাচার, অনাচারে আজ আমাদের সমাজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে জর্জরিত। হাতে গোনা দুচারজন বাদে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের উপরিভাগের ক্ষমতাসীন এবং প্রাশাসনিক ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে সমাজের অপরাপর ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ নিজ নিজ বৈষয়িক অবস্থা উত্তরণে নৈতিকতা বিরোধী কাজ করছে অবলীলাক্রমে। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্য্যন্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনকারীদের সংখ্যা বাড়লেও ধর্ম তার মূল উদ্দেশ্য, মানব মনে নৈতিকতাবোধ স্থাপনে আজ ব্যর্থ।
ধর্মের এ ব্যর্থতার কার্য্যকারণ বিশ্লেষনে ফ্রয়েডের অবচেতন মনকে স্মরণ করতে হয়। বর্তমান সময়ে সংখ্যাগুরু মুসলমান সচেতন মনে বিশ্বাসী হলেও এদের অবচেতন মনে ধর্মবিশ্বাস ততোটা প্রবল নয়। বিশেষ করে, ধর্মবিশ্বাসের মূল চালিকা শক্তি পরলোকে শাস্তির ভীতি কিংবা পুরস্কারের প্রলোভন মানুষের অবচেতন মনে আগের মতোন ক্রিয়াশীল নয়। ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষ আগের চেয়ে অনেক যুক্তিবাদী। ধর্ম হচ্ছে পরিপূর্ণ বিশ্বাসে ইশ্বর তথা ঐশীবানীতে আত্মসমর্úন যা বর্তমান যুক্তিনির্ভর মানুষের অবচেতন মন গ্রহন করতে দ্বিধাগ্রস্থ। তাই সচেতন মনের প্রভাবে মানুষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে উৎসাহী হলেও ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মানব মনে নৈতিকতা বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থেই ধর্ম হয়ে পড়ছে আচার সর্বস্ব-আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস কিংবা সংস্কার, অনেকটা আজান পড়লে বাঙ্গালী মুসলমান মহিলাদের মাথায় ঘোমটা টানার মতোন।
ধর্ম এবং রাজনীতির উদ্দেশ্যের মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। ধর্মের পারলৌকিকতা কিংবা আধ্যাতিœকতা বাদ দিলে ইহজাগতিক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করাই এর মূল উদ্দেশ্য। রাজনীতিরও মূল উদ্দেশ্য সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে শুধুমাত্র একজন প্রেরিত পুরুষ কিংবা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ভাবলে তাঁকে অবমূল্যায়ন করা হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি মধ্যযুগে মক্কাকেন্দ্রিক একটি প্রাগ্রসর রাষ্ট্র স্থাপনে কৃতিত্ব রেখেছেন। এ রাষ্ট্র স্থাপনে তাকে প্রয়োগ করতে হয়েছিল রাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি এবং কূটনীতির নানা ক্রিয়া কৌশল। তাই বলা চলে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হয়রত মুহাম্মদ (সঃ) একজন রাজনীতিকও ছিলেন বটে।
ধর্ম মানব মনে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে পারলৌকিক জীবনে শাস্তি কিংবা পুরস্কারের কথা বলে থাকে। এ ছাড়াও নৈতিকতা বিরোধী কার্য্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে ধর্মে রয়েছে ইহলৌকিক শাস্তির বিধান। সম্ভবতঃ ধর্মবেত্তাগন সচেতন ছিলেন, শুধুমাত্র পারলৌকিক শাস্তি কিংবা পুরস্কারের কথা বলে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অন্যদিক রাজনীতি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালায়। সুস্থ রাজনীতিতে এই আইনের শাসনের ভিত হচ্ছে সুনীতি, যা সার্বজনীন নৈতিকতাবোধ থেকেই উৎসারিত।
বর্তমান সময়ের রাজনীতি সুনীতিকে অবজ্ঞা করে দূর্নীতিকে আশ্রয় করেছে। শুধুমাত্র আমাদের দেশে নয়, মাত্রার তারতম্যে উন্নতবিশ্বেও। উন্নতবিশ্বের রাজনীতির নিয়ন্তা এখন বহুজাতিক কোম্পানী, যাদের মূল উদ্দেশ্য সমাজকে ভোগবাদী দর্শনে আপ্লুত করে নীতিহীনভাবে পূঁজির স্ফীতি ঘটানো। বহুজাতিক কোম্পানীর প্ররোচনায় উন্নতবিশ্বের রাজনীতি মানবতা বিরোধী কার্যক্রমে অংশগ্রহন করতে দ্বিধাবোধ করে না। উদাহরণস্বরূপ ইরাকে সাদ্দাম বিরোধী অন্যায্য, অমানবিক যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যায়, যার নেপথ্য নায়ক ছিলো বহুজাতিক কোম্পানীগুলোই। এই যুদ্ধে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সমরাস্ত্র বিক্রি করা ছাড়াও ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলো গ্রাস করার সুযোগও পেয়েছে।
হ্যা, উন্নত বিশ্বের রাজনীতি তবুও বহুলাংশে আইনের শাসনে প্রতিষ্ঠিত। অন্ততঃ তাদের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সহ তৃতীয়বিশ্বের অনেক দেশেই আজ আইনের শাসন অনুপস্থিত। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্ররোচনায় দূর্নীতি, রাষ্ট্রীয়সম্পদ লুটপাট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষন-নির্যাতন যেন আজ আমাদের ভাগ্যলিপি। দুঃখের বিষয় যারা আজ দেশের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যতিক্রমী দুচারজন বাদে কেউই দেশের এই অধঃপতনের জন্য ভাবিত নয়। বরং এদের বৈষয়িক স্বার্থের কারণেই রাজনীতি আজ রাহুগ্রস্থ। ক্ষমতালোভী, দূর্নীতিবাজ রাজনীতিকেরা সমাজের বিত্তবান লুম্পেন ধনিকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে করেছে নৈতিকতাবিহীন, র্দূবৃত্তায়নগ্রস্ত।
রাজনীতিকে র্দূনীতিমুক্ত করে সুনীতির ভিতে দাঁড় করানোর কোনই উপায় নেই? অবশ্যই আছে। এজন্য গণমানুষকে, যাদের নৈতিকতাবোধ প্রবল তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। নেতা কিংবা সংগঠনের জন্য অপেক্ষা করলে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে যাবে। র্দূনীতিবাজ ক্ষমতালোভীদের বিরূদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণমানুষকে ফুঁসে ওঠতে হবে। ঐক্যবদ্ধ গণজোয়ারেই স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে রাজনীতিতে সুনীতি এবং জন্ম নিবে গণমানুষের নেতা। এইভাবে দেশের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় রাজনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে অনির্বায্য ভাবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে এ কথা সুনিশ্চিত।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল – kabiranwar@yahoo.com