ধারাবাহিক আত্মকথা ' ছোট আমি '
"এক"
হঠাৎ প্রথমে গোঁ গোঁ করে শব্দ তারপর শো শো করে
আওয়াজ। আমি বারোয়ারী কলের জল নিয়ে একা একাই খেলছি। ভরা দুপুর। সবাই দরজা এঁটে ঘুমোচ্ছে। ফাঁকা মাঠ। শব্দ কানে আসতেই আমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু
হল, পাইপ ফেটেছে পাইপ ফেটেছে। কে কোথায় আছো দৌড়ে এসো। আমার বয়স এখন
কমপক্ষে তিন আর বেশি হলে পাঁচ বছর। আমার সরু গলায় তারস্বরে চিৎকার বোধহয় পঞ্চাশ মিটার দূরে থাকা লোকেরও কানে ঢোকার কথা নয়। কেউ শুনতে পেলও না। কেউ আসছে না
দেখে আমি নিজেই দৌড়ে বাড়ি এসে একটা বালতি তুলে নিলাম। তখন প্লাস্টিকের বালতির কথা কারোর মাথায় আসেনি। লোহার বালতি আমার শরীরের ওজনের কাছাকাছি। সেটাই
দু-হাতে তুলে কোনোরকমে কলতলায় এলাম। তখনও কলে সরু নলে জল পড়ছে। একটু একটু করে জল ভর্তি হচ্ছে – আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। হঠাৎ তামাং কাকাবাবু (আমাদের ওখানে তখনও ‘কাকু’ চালু হয়নি) এসে হাজির। হাতে বালতি। তামাং কাকাবাবু
এসেছে স্নান করতে - আমার ডাকে নয়। এসেই শুরু করে দিল, কী খোকা পাইপ তো ফেটে গেছে। জান না পাইপ
ফাটলে চীৎকার করতে হয়? বুদ্ধু কোথাকার এখন আমি স্নান করবো কী করে। পানি তো বিলকুল
খতম হয়ে যাচ্ছে। আমি মিনমিন করে বললাম, আমি তো চিৎকার করেছিলাম। কেউ না এলে আমি কী করবো? তামাং কাকাবাবু প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠল কৈ সা চিল্লায়া আ
-। দেখো কেইসা চিল্লায়া যাতা হ্যায়।
বলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল, পাইপ ফাট গিয়া। পাইপ ফাট গিয়া – জলদি সবাই।
সত্যিই তামাং কাকাবাবু চিৎকার তো নয় যেন ম্যাজিক। দেখি সবাই হাতে বালতি-কলসি নিয়ে
দৌড়ে কলসি নিয়ে দৌড়ে কলতলায় হাজির।
তামাং কাকাবাবু যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে আমাকে বলল,
-এই সে চিল্লায়া জাতা হ্যায়।
- কিন্তু তামাং তুমি এত দেরীতে চিৎকার করলে
কেন? কল থেকে জল পড়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।
ভীরের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল,
- তামাং –এর তো ও রকমই কাজ। এতো ঢিলে লোক আর কথাও পাবে না। অন্য এক কাকুর গলা।
তামাং কাকাবাবু কিছু বলতে গেল। কিন্তু ওকে থামিয়ে দিল চারিদিক থেকে আসা
চিৎকার।
তামাং কাকাবাবু পাহাড়ী মুখটা ফরসা থেকে লাল হয়ে গেল। আমার খুব খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারলাম না। আমার কথা শোনার যোগ্যও অবশ্য কোনও দিন
মনে হয় নি। পাইপ ফাটার গল্পটা এখন থাক। এটা বক্সা রোডের কথা। প্রথম থেকেই শুরু করি। আমি তখনও ছোট, এখনও ছোট। মানে আমি বড় হওয়ার জন্য জন্মায় নি। তাই ছোটবেলার বড় বেলা সব
একাকার।
আমার আমিন গাঁও –এর কথা বিশেষ মনে নেই। শুধু জানি ওখানে আমার জন্ম হয়েছিলো। আর মনে
আছে ওখানে আমার হাতেখড়ি হয়েছিলো। আবছা মনে পড়ে বাবার হাত
ধরে ছোট্ট ছোট্ট পা দিয়ে আমি কামাখ্যা পাহাড়ে উঠেছিলাম। কামাখ্যা পাহাড়ে আর কারও হাতেখড়ি হয়েছিলো কিনা জানি না। সরস্বতীকে ছেড়ে কেনো কামাখ্যা? জানি না। আর মনে পড়ে কুকুরে কামড়ানোর কথা। কুকুরের কামড়ানো আমার খুব
মনে নেই। কিন্তু তারপরের প্রক্রিয়াগুলোর
কথা কিছু কিছু মনে আছে। ওঝা ডাকা, মন্ত্র পড়া, খালি গায়ে পিঠের উপর থালা লাগিয়ে দেখা সেটা আটকে থাকছে, না পড়ে যাচ্ছে।
ছোটবেলার কথা বলতে মনে পড়ে বক্সা রোডের কথা। আমি বক্সা রোডের কথা বলতে খুব পছন্দ করি। সে ভারি চমৎকার জায়গা একেবারে আদর্শ। স্কুল নেই-
কাজেই পড়াশোনাও নেই। দোকানপাট নেই – কাজেই ওসবের বালাই নেই। পয়সাও নেই – খরচা করার জায়গাও নেই। শুধু মজা আর মজা। খাও-দাও আর সারাদিন বগল বাজাও।
সত্যি সত্যি এক বগলের তলায় অন্য হাতের চেটো ঢুকিয়ে শব্দ বের করা শিখতে আমার বেশ সময় লাগছিল। আর এটা শেখানোর গুরু ছিল রাজা, তামাং কাকাবাবুর ছেলে রাজার অনেক গুন। স্কুলের বালাই বক্সা
রোডে ছিল না তাই পড়াশোনার বালাইও নেই। রাজা
তামাং রাজার মতো ঘুরে বেড়ায়। আর আমার ক্লাস নিত। ওর পিছনে অনেক ঘুরে ঘুরে বগল বাজানো শিখেছিলাম। তারপরের
ক্লাস ছিল সিটি বাজানোর। কিন্তু কিছুতেই শিখতে
পারছিলাম না। মুখের কোথায় আঙ্গুল রাখতে হবে, মুখ কতটা ফাঁক করতে হবে। জিভটা কি ভাবে
ওলটাতে হবে – অনেক চেষ্টা করেও ও আমাকে শেখাতে পারছিলাম না। শেষমেশ বলল – তোর দাঁড়া হবে না। ব্যাস লেগে গেল গায়ে – হবে না মানে হতেই হবে। খুব চেষ্টা চালাতে লাগলাম। সকাল থেকে বিকেল, বিকেল থেকে রাত্রি। পারলে ভাত খেতে বসেও
গ্রাসের বদলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে চেষ্টা করি। রাতে শুয়েও
চেষ্টা চলতে লাগল। একেবারের জন্যও সিটির আওযাজ বেরোয় না – কেবল ফুসফুস করে হাওয়া বের হয়। রাগে
দুঃখে চেস্তা চালাতে লাগলাম। আর অন্ধকার ঘরে সবাই যখন
ঘুমে ব্যাস্ত আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল প্রথম সিটি। আহা আমি পেরেছি ততক্ষণে দেখি বাবা-মা-দাদারা সবাই হাজির। হ্যারিকেনের আলো আমার মুখের কাছে তুলে
ধরে বলল – ভালো, গুন বাড়ছে। সিটি মারতেও শিখে গেছে। ব্যাস ওইকুই।
বাবা বা মা বাচ্চাদের গায়ে তোলা বা বকাবকি কোনওদিন করত না। সামান্য একটা দুটো কথা বলত। তাতেই কাজ হোতো। তবে সিটি মারা শেখার পরেই ইচ্ছা
ছিল রাজার কাছে বাঁশী বাজাবার ক্লাস করার সেটা করা হল না। তবে সিটি মারতে এখন বেশ ভালই পারি। এই তো বাষট্টি বছর বয়সে University College of London থেকে স্তন্যপান বিষয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরের শেষ দিন বিদেশী মহিলাদের বলিউডি
নাচের সঙ্গে সিটি বাজিয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলাম। বক্সা রোড station- এ তখনকার ছোট চোখে বেশ বিশাল জায়গা মনে
হলেও প্রথম দেখলে হয়তো খেলনা station- ই মনে হবে। আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে একটা লাইন ঘন জঙ্গল ভেদ করে কোনও রকমে রাস্তা বের
করে নিয়ে পৌঁছায় ওই পথের শেষ station বক্সা রোডে।
মাঝখানে পড়ে রাজাভাত খওয়া। এখানে কোন রাজা কবে কোন ভাত খেয়েছিল জানি না। বক্সা রোড station ঘিরে ছোট্ট একটা রেল কলোনি। লোকজন বলতে কয়েকজন কর্মচারী। ওখান থেকে লোকে পায়ে হেঁটে যেত
জয়ন্তী পাহাড়ে। জয়ন্তী পাহাড়ে ছিল ভুটিয়াদের বাস। আমার
কাছে সব পাহাড়ি লোকেরাই নেপালি কিন্তু ভুটিয়ারা ভুটিয়াই- আর নেপালিরা নেপালিই। কিন্তু ওসব কথা থাক।
বড় হয়ে একটা কথা প্রায়ই শুনি যে ভারতীয় রেলওয়ে হচ্ছে ভারতের জীবন রেখা-life line। তখন ওসব কথা জানতামও না বুঝতামও না। তবে এখন কথাটার অর্থ মর্মে মর্মে বুঝি। বক্সা রোড station- এর সঙ্গে পৃথিবীর একমাত্র যোগাযোগ ছিল
সারা দিনে আসা একটা train। দু-তিন কামরার ট্রেন। মিটার গেজ, সেজদা – তখনও বেশির ভাগ
জায়গাতেই। ব্রড গেজের বড়দার আবির্ভাব হয় নি। সেই
সারাদিনে একবার আসা ট্রেনটাই ছিল ঐ গোটা অঞ্চলের life line ওতে আসত দৈনন্দিন জিনিসপত্র, সবজি থেকে মশলা সব কিছুই। আর আসত কাঁচা কয়লা। কী ভাবে আসত, কার নামে আসত, কার ভাগে কী পড়ত, টাকা পয়সার হিসাব কী করে হোতো – এসব নিয়ে আমার কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। কাজেই এসবের কোনও খবরও ছিলনা। আমরা কোনোদিন
অপু-দুর্গার মতো চলন্ত ট্রেন দেখতে ছুটি নি। ট্রেনের বগি, কয়লার ইঞ্জিন আমাদের কাছে ছিল জলভাত।
যতক্ষণ গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকত, আমরা বগিতে বগিতে ঘুরে বেড়াতাম, ইঞ্জিনে উঠতাম, লম্বা তার টেনে হর্ন বাজাতাম। কয়লার উপরে উঠে খেলতাম। এমন কি ড্রাইভার
কাকাবাবুদের মন জোগাতে পারলে ইঞ্জিনের এটা ওটা নাড়াচাড়া
করতাম। কি সব মিথ্যে কথা লিখছি। তখন ও সব করার বয়স হয় নি। তবে পরে আর একটু বড় হয়ে বামনহাটে এসব করেছি।
বক্সা রোডের প্রথম দিকটা অবশ্য আমার পরাধীন জীবন ছিল। আমাকে থাকতে হও গৃহবন্দী। কারণ প্রায় তিনতলা সমান গাছের কাণ্ডের সিঁড়ি। একবার পা
হড়কালে একেবারে গরগরিয়ে উঠোনের মেঝেতে। তাই থাকো একটা ঘরে বন্দী হয়ে। সঙ্গী দাদা-দিদিরা ছেঁড়া পাতার কয়েকটা বই, ভাঙা সিলেট আর কিছু খড়ি। মিছরির টুকরোর
মতো সাদা এবড়োখেবড়ো দলা। তখনও সিগারেটের মতো স্মার্ট চক চোখে দেখেনি। এইসব জিনিসের সঙ্গে সারাদিন সহবস্থানের ফলে নিজেই শিক্ষক হয়ে
বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে পরিচয় করে নিয়েছিলাম।
এই বন্দীদশা কয়েক মাস ছিল না কয়েক বছর জানা নেই – তবে একদিন স্বাধীন হলাম। আর প্রথম অবাক
হয়ে দুনিয়াটাকে দেখতে শুরু করলাম। পাইপ ফাটার
রহস্যটা এবার একটু খোলসা করি। অবশ্য তখন যা বড়দের কাছে শুনেছি এরপরে চিন্তা করে যতটা বুঝেছি সেইটুকুই জানাতে পারব।
প্রকৃতি আর মানুষের বুদ্ধি মিলমিশ
দিয়ে জয়ন্তি পাহাড়ের কোনও জায়গায় জলের রিজারভার তৈরি করা হয়েছিল। যেখানে পাহার গড়িয়ে নেমে আসা জলস্রোতকে আটকে রাখা
হতো। আর পাহাড়ের গা ঘেঁসে মাইলের পর মাইল ধরে লম্বা
পাইপ দিয়ে সেই জল নেমে আসত সমতলে, আমাদের বক্সা
রোডে। আর সেটাই ছিল আমাদের সমস্ত ধরণের ব্যবহারের জন্য জলের সংস্থান। রান্না করবে? ঐ জল। খাবে? ঐ জল। স্নান করবে? ঐ জল। কাপড় কাঁচা? ঐ জল। বাসন মাজবে? তাও ঐ একই জল। আর একটা কল। বাড়ির সামনে
মাঠের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে অনর্গল জল দিয়ে যাচ্ছে সবাইকে।
বাবার কড়া হুকুম ছিল দরকার ছাড়া যেন কলের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়। সকাল-দুপুর-রাত্রি কলের মুখ খোলা আর জল নাও। কিন্তু মাঝে মাঝে একটা সমস্যা হতো।
সমস্যা হতো না – করা হতো। আর সেটাও করত ভুটিয়ারা। জলের পাইপ ধরেই ছিল ওদের
যাতায়াতের পথ। পাহাড়ি রাস্তায় চলতে চলতে যখনই জল তেষ্টা পেত, পাথর দিয়ে পাইপ ভেঙে জল খেত ওরা। এটা
মাঝে মাঝেই হতো। পাইপ ভাঙলেই কিন্তু তক্ষুনি জল আসা বন্ধ
হয়ে যেত না। লম্বা পাইপের জল বেশ কিছুক্ষণ ধরে আসত। কিন্তু সঙ্গে আসত পাইপ ভাঙার সংকেতও। ভাঙা পাইপ দিয়ে হওয়া ঢুকে যাওয়ার ফলে জল আর হওয়ার
ধাক্কাধাক্কিতে একটা অদ্ভুত শব্দ হতো। সে সময় যে কলের কাজে থাকত, তার প্রথম কাজ হতো ‘পাইপ ফেটেছে , পাইপ ফেটেছে’ বলে চিৎকার করা। আর সমস্ত বাড়ি থেকে লোকজন বালতি-টালটি নিয়ে
কলের জল ধরার জন্য ছুটে আসত। জলের সমস্যা ওখানে
মাঝেমাঝেই হতো।
উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে ডুয়ারসে এমনিতেই বৃষ্টি একটু বেশি হয়। কিন্তু বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও জলের একটা সমস্যা
থাকতই। জানি না এটা বাবা- মায়ের নিজস্ব বুদ্ধি কি অন্যদের কাছ থেকে ধার করা – জলের জন্য একটা একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা ছিল। একটা ধুতি বা শাড়ি টান টান করে উঠোনের
মাঝখানে ছাদের মতো টানিয়ে দিত। বৃস্টির জল সেই কাপড়ের পড়ে
গড়িয়ে চলে আসত মাঝখানে। আর সেখান থেকে জলের ধারা নেমে আসত নিচে রাখা বালতিতে বা গামলাতে। দাদা-দিদির কাজ ছিল সেই জল টেনে ঘরে তোলা। সারাদিনে যে সবে
ধন নীলমণি রেল ইঞ্জিনটা আসত সেখান থেকেও জল নেওয়া হতো। একদিনের কথা মনে আছে। কোনও কারণে কয়েকদিন জল নেই, ছোট্ট এলাকায় চা বানানোর মতো জল নেই।
শেষমেশ ইঞ্জিনের তলায় যে পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত বাষ্প বের হয় – সেখানকার মুখ খুলে
দিলে জলও পড়ে। একেবারে গরম জল। যে দিন রেল লাইনের পাশেই সবাই জড়ো হয়ে সেই গরম জল ধরে বারোয়ারী চা-এর পিকনিক করেছিল। তবে শুনেছিলাম ঐ জলের চা
খেয়ে কারও খুব একটা তৃপ্তি হয়নি। তবে পাড়াসুদ্ধু লোকের চা খাওয়াটা হয়ে গিয়েছিলো।
জলের মতোই দরকারি জিনিস হল জ্বালানি। যদিও চারিদিকে জঙ্গলে কাঠের টুকরোর অভাব নেই। তবে আমাদের থাকত কয়লা।
কাচা কয়লা। কয়লার কথা এখন থাক। পরে বড় হয়ে এই কয়লা নিয়ে আমাদের নিয়মিত কসরতের কথা লিখব।
ভুটিয়াদের সম্বন্ধে বেশি পড়াশোনা করা আর
পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে নি। এই বুড়ো বয়সে ছোটবেলার কথা লেখার সময়ও ইচ্ছে করে জ্ঞানের ভাণ্ডার জড়ো করিনি। সেই ছোটবেলার জ্ঞান, ছোটবেলার মন আর ছোট বেলার চোখ দিয়েই যা
বুঝেছি, যা মনে আছে তাই লিখছি। ভুটিয়ারা থাকত জয়ন্তী পাহাড়ে। শুনেছি ওখানে
সুভাসবসুকে জেলে বন্দী রাখার জন্য একটা বিশেষ জেল তৈরি
করা হয়েছিল। যাক গে, আমার কাছে তখন সুভাষ বসু কেবলমাত্র কানে শোনা নাম মাত্র। কাজেই ও বিষয়ে
বিশেষ উৎসাহ ছিল না। আমার উৎসাহ ছিল ভুটিয়াদের
ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। শিবরামের কোথায় যেমন একজন চিনাম্যানকে অন্য চিনাম্যানের থেকে ফারাক করা যায় না, তেমনি এক ভুটিয়াকে অন্য ভুটিয়াদের থেকে ফারাক এই বয়সেও ঠিক মতো করতে
পারি না। সেই বয়সে তো কোনও কোথাই নেই। সবই- সমান।
সব ভুটিয়াদের গায়ে একটা ভারি পোশাক থাকত। জব্বর মার্কা পোশাক। ওটা শুধু পোশাক ভাবলে মস্ত ভুল হতো। ঐ পোশাকটাই
ওদের সাময়িক ঘরবাড়ি। কি থাকত না ঐ পোশাকের মধ্যে? টাকা পয়সা, ছুরি, কুড়িয়ে পাওয়া ফল
ইত্যাদি থেকে থালাবাসন এমন কি রান্না
করার ভাতের হাড়ি পর্যন্ত। শুনেছি ঐ পোশাক বানাতে ওদের অনেক খরচা করতে হতো। ঐ পোশাক দেখলে নাকি বোঝা যায় কে কেমন
বিত্তশালী। এও শুনেছি বিয়েতে দামি পোশাক দেওয়ার জন্য কনে
পক্ষের দরকষাকষি মন কষাকষি সব চলত। যাই হোক আমাদের ছোট্ট বক্সা রোড সমতল, যেখানে প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না, সেটাই ছিল ভুটিয়াদের কাছে খুব বিরাট
জায়গা। কেন ওরা দিনের বেলাতে আসত, কেনই বা চলে যেত – আমি জানতাম না। - আমার জানার চেষ্টাও
ছিল না। আমি শুধু দূর থেকে ওদের দেখতাম।
পোশাক ছাড়া আর একটা অদ্ভুত জিনিস ভুটিয়াদের প্রত্যেকের কাছে থাকত। একটা ইংরেজি ‘T’ অক্ষরের মতো দেখতে জিনিস। ওটার একটা নাম
ছিল। এখন মনে পড়ছে না। তবে জিনিসটা বেশ কাজের। কোমরের নিচ
বরাবর একটা কাঠের ডান্ডির মাথায় আড়াআড়ি ভাবে একটা হাত খানেকের কাঠের টুকরো ‘T’ অক্ষরের মতো লাগানো। সেই আড় কাঠের মাঝখানটা আবার থাকত একটু গোল করে নামানো। সবাই জানে
হাতে একটা থাকলে পাহাড়ে উঠতে-নামতে সুবিধা হয়। ওটা একদিক
থেকে ওদের চলার পথের লাঠি। কিন্তু ওটা আরও একটা বড় কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। বলা যায় ঐ কাজটার জন্যই ঐ বিশেষ জিনিসটার আবিষ্কার আর ব্যবহার। পথ
চলতি ক্লান্তি যখন শরীরকে বিশ্রাম নিতে বলত, তখন ঐ লাঠিটা দাঁড় করিয়ে আড়াকাঠটার উপরে
বসে বিশ্রাম নিত। মানে পথ চলতি চেয়ার।
আজ থেকে প্রায় ষাট বছরের আগের চোখের দেখা, কানে শোনা ভুটিয়া –গবেষণা এখানেই শেষ করি। তবে একটা মজার ঘটনা না লিখলেই নয়।
ভুটিয়ারা বক্সা রোডে এসে সাধারণত আমাদের বাড়ির
বাগানটার কাছেই বসে পড়ত। আর কী করত জানিনা তবে প্রায় সময়েই খাওয়াদাওয়া করত। একদিন দুপুরে দিদি মুখ লাল করে এসে মেজদার কী যেন বলল। মেজদার কথা শোনামাত্র
মেজদা একেবারে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেল একদল ভুটিয়ার দিকে। দিদির বয়স তখন আন্দাজ দশ-টশ হবে। মেজদা বছর আস্টেক। সেই অর্থে একেবারেই ছোট। আমারে এমনিতে
দূর থেকে ভয়ে ভয়ে ভুটিয়াদের কাজকর্ম দেখতাম। কিন্তু সেদিন বীর বিক্রমে ভুটিয়াদের সামনে রনং দেহি বলে দাঁড়িয়ে কী সব বলে যেতে লাগল। ওরা উত্তর দিচ্ছে।
মনে হচ্ছিল কোনও পক্ষই কোনও পক্ষের কথা বুঝতে পারছিল না। কিন্তু কেউ কিছু না বুঝলেও কথা যুদ্ধু চলতেই থাকল। এ সময় একজন ভুটিয়া বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে
থাকা আমাদের কাছে এল। হাতে একটা ভাতের অ্যালুমনিয়ামের থালা। বলল, নুনু দে। দিদি ছুটে ঘরের ভিতরে চলে গেল। আমরাও রেগে গেলাম। কিন্তু ও বেশ ঠাণ্ডা
গলায় অনুরধের স্বরে বলতে থাকল, নুনু দে, নুনু দে। এক সময় আমরা কি ভাবে জানি বুঝতে পারলাম ও আসলে ভাত
খাওয়ার নুন চাইছে। আমরা অবশ্য তখন কলকাতার নুনকে
লবন বলতাম। বক্সা রোডের মুক্ত জীবনে আমাদের সব চাইতে মজার ব্যাপার হল জঙ্গল সাফারি। তিন-চার জন
ছেলেমেয়ে (ভাইবোন) বিনা কারনে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে
বেরাচ্ছে। কোনও কাজ ছাড়াই। বেত ফলের যতটা চামড়ার তলায় সে এক চিলতে মাংস থাকে তার স্বাদের চাইতে গায়ের কাঁটা ফোটার বিস্বাদ অনেক বেশি হতো।
জঙ্গলে একটা জিনিস প্রায়ই দেখতাম। গাছ কাটার ব্যবস্থা। মাঝে মাঝেই জঙ্গলে এখানে-ওখানে কাটা গাছের গুঁড়ি।
একেবারে মাটি একটু উপর থেকে বিরাট বড় গাছটা ভ্যানিস। লোকজনও কেউ নেই। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে কিছু কাঁচা পাতা আর ছোট ছোট ডালপালা। আরও একটা জিনিস চোখে
পড়ত। বয়স্ক মানুষের মাথার সমান উঁচুতে কাঠের তৈরি অনেক লম্বা বেঞ্চের মতো বানানো একটা জিনিস। দাদাদের কাছে জেনেছিলাম ওটার উপর কাঠ চেরাই হয়। সকালের
দিকে কদাচিৎ লোকজনদের কাঠ-চিড়তেও দেখেছি। ঐ কাঠর বেঞ্চের পাটাতনের উপরে একজন লোক থাকত। আর নিচে থাকত অন্য একজন। যে কাঠকে কাটতে হবে সেটা থাকত মাটি
থেকে বেঞ্চের উপরে হেলানো। উপরের আর নিচের লোক আট- দশহাত একটা করাত চালিয়ে ঐ কাঠটা কাটত। আমরা কাছে গেলে ধমক লাগাত। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সর্দারমার্কা
লোক। ওদের কাজ দেখার আমাদের কোনও আগ্রহ ছিল না। বরং ওরা না থাকলেই আমাদের আনন্দ হতো। আর দিনের বেলায় ওদের খুবই দেখা যেত। আমরা ঐ কাটা গাছটার আশেপাশে খুঁজতাম, যদি কিছু ফেলে যায়। বেশিরভাগ সময়েই কিছুই পড়ে থাকত না। কিন্তু পাঁচ খানা ভাঙা
করাতের টুকরো পেলে আমাদের চোখ চকচক করে উঠত। এক আধটা
গাছকাটার কুড়লও চোখে পড়ত। বাড়িতে বেশ কয়েকটা কুড়ল জোগাড় হয়েছিলো। তবে সব চাইতে বেশি পাওয়া যেত কাঠের হাতুড়ি। অনেকটা ক্রিকেটের ব্যাটের মতো দেখতে। তবে
সবই আকারে বড়সড়। আর ক্রিকেট ব্যাটের মতো অত লম্বা নয় বরং গতরে বেশ নাদুসনুদুস আর ভারি। যদিও ক্রিকেটের ব্যাটের সঙ্গে তুলনা করলাম – আমরা তখন ক্রিকেটের ব্যাট চোখে দেখা তো
দুরের কথা ক্রিকেট কথাটাও কানে শুনিনি। ওগুলোকে
আমরা বলতাম গদা। কার বাড়িতে কে কটা গদা জোগাড় করতে পেয়েছিলাম। জিনিসটা এতটা বড় আর ভারি যে তিন-চার জন মিলেও ওটা তুলে বাড়ি আনা সম্ভব ছিল না।
শেষমেশ গাছের লতা পেঁচিয়ে ওটার হ্যান্ডেলে বেঁধে সবাই মিলে জঙ্গলের এবড়োখেবড়ো পথ ধরে ওটা টানতে টানতে এনেছিলাম। মাঝে আবার ছিল রেল লাইন। ওটা
পেরোতে দম বেরিয়ে যাবার জোগাড়। অনেক মেহনত করে যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে ওটা উঠোনে এনে ফেলেছিলাম। আর ওটা ওখানেই পরেছিল। মেজদা ওটার নাম দিয়েছিল মহাকাল।
ঐ নামটা কেন দিয়েছিল কে জানে তবে ওখানে হাতিকে মহাকাল বলা হত।
নিঃশব্দ শান্ত বক্সা রোডে মাঝে মাঝে আওয়াজ হতো। দুম করে একটা বা দুটো। চমকে উঠতাম। কিন্তু জানতাম বিকেলে বা
পরদিন বাড়িতে আসবে হরিনের মাংস। ফরেস্টের হরিন মেরেছে। আমার হরিণের মাংস খেতে ভালো লাগত না। আর মাঝে মাঝে আওয়াজ হও মানুসের গলায়। এক সঙ্গে অনেক
লোক হাতে মশাল নিয়ে বুনো হাতিদের তাড়া করে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিত। সঙ্গে তেলের খালি টিন আর বাসনপত্রের কাঠি দিয়ে শব্দ। দাদাদের মাথা একবার হরিন ধরার
ফন্দি এল। মাঝে মাঝে এক-আধটা হরিণ দলছুট হয়ে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি চলে আসত। সেদিন আমরা প্রস্তুত। আমাদের একটা বাগান ছিল। শাকসব্জির শখ ছিল বাবার
। বয়স্ক মানুষের বুক সমান উঁচু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আমরা বাগানের গেটটা খুলে দু-দলে ভাগ হয়ে ধীরে ধীরে হরিণের দিকে এগোতে থাকলাম। হরিণটা ঠিক
আমাদের পরিকল্পনা মাফিক খোলা গেট দিয়ে বাগানে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গেট বন্ধ করে দেওয়া হল। সেজদা বলল – ওকে পোষ মানাব। হরিণটা বাগানের বেড়ার ধার দিয়ে দৌড়তে লাগল আর মুহূর্তের
মধ্যে ঐ উঁচু বেরা লাফিয়ে বাইরে এসে চোখের নিমেষে
হারিয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল হরিণ ধরা।
বক্সা রোডে মাঝে মাঝে বাঘ আসত। কিন্তু আমরা কোনও সময় দেখিনি। তার চাইতে হাতির দৌরাত্ম ছিল বেশি। প্রায়
শুনতাম হাতির দল রেল রেল লাইনে বসে পড়েছে তাই ট্রেন আটকে রয়েছে। মাঝে মাঝে শুনতাম খ্যাপা হাতিরা কোনও লোককে শুঁড় দিয়ে ধরে ভলি খেলছে। আমার যাবার আগে
যে stationমাষ্টার ছিল সে নাকি লাইনের উপরে বসে থাকা হাতিকে কিছু বলেছিল
বা করেছিলো। রাতে সেই হাতি এসে ওর বাড়িটার যা আমার বাসস্থান, গাছের বিশাল বিশাল কাণ্ডগুলো শুঁড় দিয়ে
এমন ঝাঁকিয়েছিল যে বাড়িটা কাৎ হয়ে গিয়েছিল।
বক্সা রোড আমার কাছে ছিল স্বর্গ। নেই কোনও দোকানপাট, নেই কোনও খেলার মাঠ, নেই কোনও দোকানপাট, নেই কোনও রেডিওর গান। তবু সারাদিন আনন্দে
কেটে যেত। আমার তখনও হয়তো স্কুলে যাওয়ার বয়স
হয়নি, কিন্তু দাদা-দিদিদেরও পড়াশোনার কোনও বালাই ছিল না। একবার
মেজদার মাথায় ঢুকল লুডো খেলতে হবে। কিন্তু লুডো কোথায় পাব? চললাম আমরা মেজদার নেতৃত্বে লুডো কিনতে।
কিন্তু ট্রেন চেপে আলিপুরদুয়ার জংশন, লুডো কিনে ফেরার সময়ের ঘটনাটা আমার
সারাজীবন মনে থাকবে। মিটার গেজ ট্রেন। ট্রেনের
দরজা সব সময় ভিতর দিকে খোলা। কিন্তু তখন কিছু কিছু কামরা ছিল যা বাইরের দিকে খোলা। আমরা ফাঁকা ট্রেনে বসে আছি। হটাত আমার কী মনে হল দরজায় হাত রেখে মুখ
বাড়িয়ে কিছু দেখতে গেলাম আর আমার ছোট্ট শরীরের চাপেই দরজাটা খুলে গেল। আমার শরীরের ভারটা যেহেতু দরজার উপরেই ছিল, দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার গোটা শরীরটাই দরজার সঙ্গে
বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি কোনওরকমে দরজায় ঝুলছিলাম। ট্রেন
চলছে। কয়েক সেকেন্ডে অনুভব করলাম মৃত্যু কি? মেজদার চোখে পড়তে কোনও ভাবে আমাকে
প্যান্টের পিছনটা হাত দিয়ে দরজাসুদ্ধু আমাকে ভিতরে নিয়ে এল। এই কথাগুলো লেখার সময় আমাকে এই বয়সেও বুক ধড়ফড় করছে।
(ক্রমশ)
Harano din gulo
ReplyDelete