চাঁদের পরিক্রমণ
মুখবন্ধঃআজ অনেক বছর পর মনের তাড়নায় লিখতে বসেছি আমার এক দোসরকে নিয়ে.....আজ পর্যন্ত যখনই লিখতে শুরু করি আমার সব ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায় সে.....তাকে এড়িয়ে আমার লেখা অসম্পূর্ণ । তাই ভেবেছি এবার না হয় তাকে নিয়েই কিছু লিখি...... । ধরা যাক তার নাম চন্দ্রিমা.....যদিও তাকে আমরা চাঁদ বলেই জানব....। চন্দ্রিমার একটা কালো মলাটের আখাম্বা ডায়রী ছিল.....আমি তার প্রত্যেকটা অক্ষর পড়ে ফেলেছি। ডায়রীর পাতায় তার প্রত্যেকটা শব্দনির্মাণ আমাকে বুঝিয়েছে সে চিরকাল ই একটু অন্যরকম ....প্রবল জলোচছ্বাসের মধ্যে সে আজন্ম নির্জন দ্বীপ .....আবার দিগন্ত বিস্তৃত রুক্ষ মরুভূমির মাঝে সে অবধারিত শীর্ণ জলধারা......। চাঁদের জোছোনায় আমি সত্যিই চন্দ্রাহত.....। চাঁদের জীবন তিরিশ বছর বয়সে এসে শ্লথ হয়ে গেছে । চাঁদকে দেখলে সুস্থই মনে হয় কিন্তু চাঁদ মানসিক ভাবে বড় অস্থির.....সে অনেক মানুষের মন নিয়ে নাড়াচাড়া করে তবু নিজের মনটাই বুঝে উঠতে পারে না....সবাই যখন হাসে কথা বলে গল্প করে কখনও সে ঐ আনন্দের অনুভূতিতে প্রগলভ হয়ে ওঠে আবার কখনও আনমনা হয়ে যায়......সে হাসে , সাজে, নিত্যনতুন জিনিস কেনে কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন পূর্ণতা আসে না ।সম্পৃক্ততার আশায় কি যে খোঁজে তাও জানে না.....সবার মাঝে থেকেও সে একা .......আবার একা থেকেও সে একা নয়......তার দুটো সত্ত্বা....সে মনে মনে কথা বলে বুঝেছে.....তার একটা মন যতটা বাধ্য আরেকটা মন ততটাই বেপরোয়া ।এহেন চাঁদ ছোটোবেলা থেকেই বাবার ক্ষুদে হেল্পার ।বাবা গাছের পাতা ছাঁটছেন, চাঁদ বাবার পিছুপিছু ঘুরছে.....আর টালমাটাল পায়ে গাছের ফুল ছিঁড়ছে.....বলছে...''বাব্বা ফুঃ'' বাবাও তেমনি আপাত রাগে বলছেন....."ছিঃ চাঁদ , ছোটো ছোটো ফুল তুলছ কেন?....তাহলে বড়বড় ফুল গুলো কে তুলবে?" চাঁদ খুশি খুশি গাছের ফোটা ফুলের দিকে তাকিয়ে বলে, "আয়েত্তা তুব্ব"....? একটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা ফুল তুলে , ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ফেলে দেয় ....এইভাবে ফুল দেখলেই তাকে ছিঁড়তে চাওয়ার বাসনাটা তার মন থেকে অপসারিত হয় চির দিনের জন্যে । .........এটাইবোধহয় ছিল , তার সম্পৃক্ততার উপলব্ধি.....যা তাকে তার সজ্ঞানে, এরপর আর কোনও প্রাপ্তিই এনেদিতে পারে নি । চাঁদ বিশ্বাস করতে চায় পজিটিভিটিতে...যে কোনো 'না বাচক 'শব্দ ,যা মনের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করে তাকেই চাঁদ ভেঙে দেখতে চায়.....জানতে চায় কি এমন হিস্ট্রি-মিস্ট্রি-কেমিস্ট্রি আছে তার মধ্যে।
এক।
চাঁদের রোজকার পাঁচালীটা যেন একটু বেশি রকম স্বশাসিত.....সে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে একটুও ভালোবাসে না.....তবুও আবর্তনে তো থাকতেই হয়.... চাঁদ এখন একটি বেসরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা করে.....সারাদিন ই তার নানান বয়সের মানুষের সাথে ওঠাবসা....শুধু তাই নয় এখনকার এই ছাত্রজীবনটাকে সে ভীষণ কাছ থেকে দেখে বলেই বোধহয় সবসময় একটা তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী তার অতীত আর বর্তমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরী করে দেয়....নচেৎ সে তার কলেজ-বাড়ি- পরিবার সবের মধ্যেই একটা তারতম্য বজায় রেখেই চলতে চায়.....শুধু তার মনের হদিস পাওয়া যায় না.....সে এগিয়ে চলতে চায়....কিন্তু অতীত তাকে কেন জানি না আজও বড়ো পিছু টানে......অতীতের কোন সে অসম্পৃক্ততা আজও তাকে কথার নেশায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়....তা সে বোধ করি নিজেও বোঝে না.....।
আজ চাঁদের সকালটা একটু অন্যরকম...কাকভোরে ঘুম ভেঙে যায় তার । শোবার ঘরের দখিনের জানলাটা তার কাছে মুক্তির স্বাদ ।ভোরবেলায় জানলার ভারী পর্দা সরিয়ে অন্ধকারের মাঝে যে আলো ফুটে উঠছিল ,তার আঘ্রাণ নিল চাঁদ । জানলার গ্রিলে মাথা হলিয়ে উদাস চোখে দূরের নারকেল গাছটার দিকে তাকালো ।চাঁদ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা তার মনে কখন ঝড় ওঠে,কখন মেঘ করে আর কখন বৃষ্টি আসে । চাঁদের জীবনে প্রথম বন্ধু তার বাবা ....তারপর বহু বন্ধু এসেছে....চাঁদ খোঁজে একটা অস্তিত্ব ,যার পাশে থাকায় এক নির্ণিমেষ স্বস্তি......সে সম্পর্কের জটিলতা এড়িয়ে ছোটো ছোটো অনুভুতির পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করতে চায় ।সে জানে সম্পর্কের সহজিয়া সুর তো একটাই.....'তুমি খুশী থাকলেই আমি খুশী...এর বাইরে আর কোনো চাওয়া হয় কি ????
.....সকালের রুটিন তার যাই থাকুক খবরের কাগজে একটু চোখ না বোলালে চাঁদের হয় না....আকাশটা আজ বড়ো মেঘলা....বৃষ্টি নামল বলে....আজ তার বেরোতে ভালো লাগছে না.....কিন্ত আজ তাকে ক্লাস নিতে হবে স্ট্রাকচারের.....থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্টসদের প্রোজেক্ট সাবমিশান আজ....ভাইভা নিতে হবে..সুতরাং যেতে তাকে হবেই....চাঁদ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল.....ইচ্ছে অনিচ্ছে মেঘলা আকাশ সব মিলিয়েই সে যেন অতীতের সেই দিনটাকে আরও একবার ফিরে দেখতে চাইল.................
বেশ কয়েক বছর আগের কথা । চাঁদ তখন উনিশে পা রেখেছে । যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্রী............
সেদিন কি হল কে জানে......সকাল থেকে তার একটুও ইচ্ছা নেই কলেজে বেরোনোর, অথচ ড্রয়িং শীট সাবমিশন আছে সেকেন্ড হাফে ।বেশ একটা আলসেমী জড়িয়ে ধরেছে তাকে। গোটা রাতই প্রায় জাগা ড্রয়িং শীটের জন্য। সাঁতরাগাছি থেকে যাদবপুর যেতে দুটো বাস তখন পাল্টাতে হত। দুপুরবেলা চাঁদ খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসে উঠল।বাসের জানলায় মুখ রেখে দেখল রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া আকাশটা কেমন যেন থমথম করছে। কোথা থেকে একফালি কালো মেঘ ঝড়ের আভাস দিচ্ছে......একটু পরে বাসটা ছাড়ল .....সঙ্গে দমকা হাওয়া, এলোমেলো বৃষ্টি....বৃষ্টির সাথে সাথে বাসের বন্ধ কাচের জানলায় ছোটো ছোটো শিলের টোকা পড়তে লাগল। চাঁদ ভাবল "ইস্ এখন কি হবে? ছাতাটাও নিই নি....বাস থেকে নেমে কোথায় দাঁড়াব? ভিজে যাব তো....." ধীরে ধীরে বাস বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর দিয়ে ,রবীন্দ্রসদন পেড়িয়ে ,বিড়লা প্ল্যানাটোরিয়ামের বিপরীতে এসে দাঁড়াল । চাঁদকে নামতেই হবে.....এখান থেকে সে যাদবপুরের বাস ধরবে.....ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে চাঁদও নেমে দাঁড়ালো একটা গাছের নীচে। দূরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকল কখন বাস পাবে.....এমন সময় তার খেয়াল হল 'কই , আমি ভিজছি নাতো?' ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল.....হ্যাঁ তা প্রায় ফুট ছয়েকের একটা ছেলে তার মাথার ওপর একটা ছাতা হেলিয়ে রেখে তাকে ভিজে যাওয়া থেকে অনেকটাই বাঁচিয়েছে....চোখে হাই পাওয়ারের চশমা , একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি,এলোমেলো চুল......এক গাল হেসে প্রশ্ন করল " ফার্ষ্ট ইয়ার তো ? কোন ব্রাঞ্চ তোর ? "
চাঁদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল " সিভিল "। মনে মনে ভাবল প্রথমেই তুইতোকারী করাটা একটু কেমন যেন লাগে ।পিছনে দাঁড়ানো ছেলেটা বলল " আমি থার্ড ইয়ার মেকানিক্যাল..."
এতক্ষণে চাঁদ বুঝে গেছে এই ছেলেটা তার আজকের সহযাত্রী....এতটুকুও কুন্ঠাবোধ না করে চাঁদ পাল্টা বলে উঠলো "আমি চন্দ্রিমা ব্যানার্জী.....তোর নাম কি? "আমি সোহম গাঙ্গুলী....তোর সিনিয়র....তুই বলাটা কি খুব জরুরি ?"চন্দ্রিমার মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি .....বলল "অপরিচিত একটা মেয়েকে তুই যদি তুই বলতে পারিস , আমি কেন নয়?" দুজনের কথার মাঝখানে হুড়মুড় করে যাদবপুর মিনিবাস করতে করতে এসে দাঁড়ালো । সোহম ছাতাটা বন্ধ করে বাসের গায়ে দুটো চাপড মেরে বলল...." আস্তে লেডিস"....চাঁদ ওঠার পর সোহম বাসে উঠেই তার দুজন বন্ধুকে দেখে তাদের মাঝে গিয়ে বসলো....আর যেন চাঁদকে ভুলেই গেল । চাঁদ একদম লাস্ট সিটে গিয়ে বসলো..... অপলক দৃষ্টিতে সোহমের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ.....তারপর গোটা রাস্তায় আর একটাও কথা হয়নি দুজনের । চাঁদ কেবল জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখেছে আর ভেবেছে....সে যেন ভুলেও আর সোহমের ছাতার মুখাপেক্ষী না হয় । ধীরে ধীরে বাস গড়িয়াহাটের কাছে আসতেই বৃষ্টিটা থেমে যায় বেশ.....চাঁদ দেখে সোহম উঠে পড়েছে আর ওর দুই বন্ধু সৈকত আর দীপান্বিতাকে উদ্দেশ্য করে গলাটা বেশ তুলেই বল....কাজ আছে কয়েকটা....কম্পিউটার ক্লাসে দেখা হবে.....একদম বাসের দরজার মুখে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে."দীপু আমায় রাতে পারলে ফোন করিস একটা....নাম্বারটা মনে আছে তো.....03326608645....করিস কিন্তু...."
দীপান্বিতা বলে,"নাম্বার বলার কি আছে? জানি তো ....করে নেব" চাঁদ একটু ফিরে চাইলেও সোহম পিছনে না দেখেই নেমে যায় বাস থেকে......চাঁদের চোখজোড়া কেমন যেন সোহমের চলার পথটা অনুসরণ করতে থাকে আর এমনই মুহুর্তে ফোন নাম্বারটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে...... !!!!
দুই।
মন খারাপ করা একটা দুপুরবেলা......জানলার বাইরের আকাশটা কালো মেঘে সেজে আছে.....চাঁদ হাতের সব কাজ সামলে ফোনটা নিয়ে খাটে এসে বসল ......একটা সময় ছিল, চাঁদের জীবনে ব্যস্ততা কিছু কম ছিল না....ইনফ্যাক্ট সারাটা দিনই প্রায় কেটে যেত অফিস ,সাইট আর বাড়ি করে ।খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে যারা ছিল আজকাল তাদের সাথেও আর যোগাযোগ হয়ে ওঠে না.....চাঁদ মোবাইলের কনট্যাক্টস দেখতে লাগল....কি আশ্চর্য , এমন কেউ নেই যাকে ফোন করে একটু নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যায়...অথচ সে ছিল একটা সময়...তখন সারাদিন কথাই কথা....চাঁদ মিউজিক সিস্টেমটা অন করল..... এফ.এম এ গান বেজে উঠল ......"এমনি বরষা ছিল সেদিন /শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন / তব হাতে ছিল অলস বীন /মনে কি পড়ে প্রিয়
".....এই গানটা শুনতে শুনতে চাঁদ হারিয়ে গেল অতীতে.....হোয়াট আ কো-ইনসিডেন্স ....সেদিনও এই গানটাই বাজছিল......কতদিন আগের কথা ।দিনটা ছিলো একটা শনিবার .....এরকমই দুপুর বেলা চাঁদ কলেজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে গান শুনছে .....ভীষণ চাপ যাচ্ছে কলেজে ....ড্রয়িং সাবমিশান চলছে....প্রায় এক সপ্তাহ হল.....চাঁদ নিজের শরীরটা বিছানায় এলিয়ে বালিশটা আঁকড়ে শুয়েছিল.....হঠাৎ কিছু একটা ভেবে উঠে বসল.....টেলিফোনটা সাইড টেবিল থেকে হাতের কাছে নিয়ে একটু ভাবল..... 'কি যেন নম্বরটা?'......তারপর ডায়াল করল....অপর প্রান্তে রিং শোনা যাচ্ছে ....চাঁদ শ্বাস বন্ধ করে দুটো রিং শুনে লাইনটা কেটে দিল ।....কিন্তু চুপ করে বসে থাকতেও পারল না...ইতস্তত করে আবার ডায়াল করল.....অপর প্রান্তে একটা ভারী কন্ঠস্বর...'হ্যালো'
চাঁদ তড়িঘড়ি ফোনটা কেটে দিল.....
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে একটু শাসন করে , বিছানায় শুতে যাবে, ...ফোনটা বেজে উঠল । চাঁদ ভাবল বুঝি বাবার ফোন....'মা তো নীচে থেকে ধরবেই'....কিন্তু ফোনটা দুটো রিং হয়ে কেটে গেল....চাঁদ ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল....তার মন বলছিল এখনি আবার রিং হবে.....ভাবামাত্রই ফোনটা সত্যিই বেজে উঠল.....
চাঁদ: হ্যালো
কপটরাগে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে উঠলো ...'ফোন করে কথা না বলে কেটে দেওয়ার মানে কি ?'
যদিও চাঁদ বিশ্বাস করতে পারছিল না....তবুও রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল 'কে বলছেন '?
ফোনের ওপার থেকে অবিশ্বাস্য ভাবে সেই অপরিচিত কন্ঠস্বর বলে উঠলো 'তুই চন্দ্রিমা তো ? ফোনটা তো আমাকেই করলি....তাও নামটা বলতে হবে?
চাঁদের মনে তখন কেউ যেন হাঁপর টানছে......স্থবির অবস্থাটা একটু কাটিয়ে বিষ্ময়ের সুরে বললো ' সোহম....?....নম্বর পেলি কোথা থেকে?....
সোহম: তুই দিলি তো ...(একটু হেসে বলল)
চাঁদ: আমি?????....হেঁয়ালি করিস না....বল কে দিল নম্বর ?আর আমি ফোন করেছি তাই বা বললি কেন?
সোহম: আরে বাবা ,দম নিতে দিবি তো .....সেটাই তো কথা....কলার আই ডি 'র কাজটাই তো এই ম্যাম ।
চাঁদ বেশ খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলে....'আসলে বাসে সেদিন তোর এক বন্ধুকে নম্বর টা দিলি না....এতজোরে চিৎকার করে বলছিলি যে আমার কানেও পৌঁছেছিল.....আর আমার মেমারী এমনিতেই বেশ শার্প......'
কথাটা শেষ করার আগেই সোহম চপল স্বরে বললো .....'হুমমম.....আমি জানি তো .....তাই তো নম্বর টা তোকেই শুনিয়ে আবৃত্তি করলাম.....আর সেইদিন থেকেই ভাবছি ফোনটা কবে করবি......কলেজে দেখাও হচ্ছিলো না.....তোরা মেয়েরা ভাঙবি ,তবু মচকাবি না..... ।
এবার চাঁদ বেশ সপ্রতিভ হয়ে বলল' এর মানেটা কি দাঁড়াল.....সেয়ানা গিরি!! ফোন নং চাইলে আমি কি দিতাম না?
সোহম: বলা যায় না....মুখের ওপর না বলে দিলে মানে লাগত....আফটার অল তোর সিনিয়র তো ।
চাঁদ : অত জুনিয়র সিনিয়র বুঝি না....চাইলে আমি ভাল বন্ধু হতে পারি....তবে ....?
সোহম: তবে কি?.....আচ্ছা ছাড়....তুই ক'টার বাসে এখান থেকে যাস....?
চাঁদ: কেন ? ন'টা কুড়ি....
সোহম: ঠিকই আছে ....সোমবার তাহলে সিটিসি বাসস্ট্যান্ডে ঐসময়ই দেখা হবে....ও.কে...বাই...রাখছি
চাঁদ : আচ্ছা .....বাই টাটা
চাঁদ যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল......দরজায় কলিংবেলের আওয়াজে তার সম্বিত ফিরে এল............ ।
তিন।
সকাল বেলাটা বেশ ঝকঝকেই হয়ে
আছে আজ... যদিও কিন্তু মাঝে
মধ্যেই একটু মেঘের আনাগোনা আকাশে
...আর সেই মেঘের মধ্যে দিয়ে
যেন সূর্যের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে এক
এক সময় ...গত কয়েকদিন ধরেই
চাঁদের মনটা বড়ো এলোমেলো হয়ে
আছে...।চাঁদ সম্পর্কের টানাপোড়েনে একটু
বেশি ই বেসামাল হয়ে
পড়ে আজকাল ,অথচ সে
কিন্তু এরকম ছিল না
আগে । তার সহনশীল দৃঢ়
স্বভাবটায় যে অস্থিরতার ছোঁয়া এসেছে.....তাতে চাঁদ নিজেকে কেমন একটু অসহায় মনে করছে.....আজ তাকে একটু বেরোতে হবে.....সে দক্ষিণাপনে যাবে....মৃগনয়নীতে তার পর্দার অর্ডার দেওয়া ছিল....ডেলিভারি নিতে হবে । বাসস্ট্যান্ডে এসে চাঁদ ট্যাক্সি ধরল....গাড়ি যখন বিদ্যাসাগর সেতুর ওপরে উঠল .....জানলার ভিতর দিয়ে তার চোখ চলে গেল একটু এগিয়ে থাকা একটা চলন্ত সিটিসি বাসের দিকে ।ক্রমে ক্রমে দূরত্ব কমে বাসটার পাশাপাশি এলে তার চোখে পড়ল বাসের জানলার ধারে বসা যাত্রীদের মুখের ওপর.....অনেক মুখের ভিড়ে সে যেন পনেরো বছর আগেকার চাঁদ কে দেখতে পেল.....
........অধীর আগ্রহে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এপাশ ওপাশ কি এত দেখছে চাঁদ ?.....কাকে খুঁজছে চাঁদ ? ৯:১৫এর সিটিসি বাসে রোজ চাঁদ কলেজের পথে পা বাড়ায়...।কখনও কোনো পিছুটান তাকে এমন করে উদ্বিগ্ন করে নি তো আগে...।সময়টা যেন ছুটছে .....চাঁদ জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় দেখে যাচ্ছে ....বাসটা স্টার্ট নিল....চাঁদের মনটা কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে গেল ......হঠাৎ....রাস্তার উল্টোদিকে চোখ গেল.... চাঁদ দেখল ভীষন দ্রুততায় রাস্তার ওপার থেকে ছুটে আসছে সোহম!!! বাসের গায়ে জোরে দুটো ধাক্কা মারতেই কন্ডাক্টর বেল মারল....বাসের গতি শ্লথ হয়ে আসল...আর বাসের দরজা খুলে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসল সোহম....যেন মূর্ত মুহুর্ত.....চাঁদকে দেখে একগাল হেসে বলল 'ব্যাগটা ধর'....চাঁদ ওর হাত থেকে ব্যাগ....ড্রাফটার সব নিয়ে নিল এমনভাবে....যেন পারলে সোহমকেও ধরে নিত....সোহম একটু দম নিয়ে চাঁদের সিটের সামনে উঠে এসে দাঁড়াল....সোহমের গোটা মুখটা লাল হয়ে আছে....কপালের পাশ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে....এমনকি দাড়ি গোঁফের খাঁজেও ঘামের বিন্দু চিকচিক করছে.....চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল....'তোর জন্যে পনেরো মিনিট আগের বাসটা ধরতে হল..'চাঁদ বুঝতে পারলো...তার মধ্যে যে প্রচন্ড উত্তেজনাটা ছিলো .....সেটা একটু কমেছে....তার রুদ্ধশ্বাসটাও যেন একটু হালকা হয়েছে....তার পাশে বসা ভদ্রলোকটি সোহমকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বার দুয়েক জরিপ করল....এতক্ষণ পর্যন্ত চাঁদ একটিও কথা বলে নি ....এবার চাঁদ সোহমের আরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল....'জল খাবি?'
সোহম: দে ....
ব্যাগের ভেতর থেকে জলের বোতল বার করে সোহমকে দিয়ে চাঁদ বলল 'বাপরে...এভাবে কেউ দৌড়োয় নাকি...'
সোহম জল খেতে খেতে বলল....'আগে আগে ক্লাসে পৌঁছেই বা লাভ কি? একি স্কুল নাকি....?
জলের বোতলের মাথাটা আটকে ব্যাগে ভরতে ভরতে ....
চাঁদ: আজও কি আবার গড়িয়া হাটে নেমে যাবি নাকি?
চশমার ওপর দিয়ে ঈষৎ ভুরু কুঁচকে একটা অদ্ভুত মন পড়ে ফেলা দৃষ্টি নিয়ে...আর একটা সবজান্তা একপেশে দাঁতে চাপা হাসি হেসে....চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল......
সোহম: নামলে কি তোর ভালো লাগবে ?
চাঁদ : (সরাসরি চোখে চোখ রেখে একটু হেসে ) না, ভালো লাগবে না .....তাহলে আর একসঙ্গে যাওয়ার মানে কি হল?
......বাসটা বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর উঠতেই হু হু করে গঙ্গার একরাশ ঠান্ডা জোলো হাওয়ায় চাঁদের খোলা চুলটা তার চোখে মুখে ছড়িয়ে গেল.....চাঁদ জানলার দিকে তাকিয়ে ছিল যদিও ....তবু তার মনে হচ্ছিল সোহমের দুজোড়া চোখ যেন নৈশব্দের আড়ালে তাকেই জরীপ করছে......হঠাৎ চাঁদের পাশের ভদ্রলোকটি উঠে পড়ল....আর সোহম বসে পড়ল সিটটায়....চাঁদ যেন এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিলো ....সোহম শার্টের কলারটা পিছনে একটু ঠেলে দিয়ে জানলার হাওয়ায় একবুক শ্বাস নিয়ে বলল....'দে...আমার সম্পত্তি !'...চাঁদের কাছ থেকে নিজের ব্যাগ, ড্রাফটার নিতে নিতে বলল...আমার কিন্ত রোজই এরকম একটু দেরী হবে...'তুই চাইলে অপেক্ষা নাও করতে পারিস...'
চাঁদ: চাইলে কি পনেরো মিনিট মেক আপ করা যায় না? নাহলে তো একসাথে আর যাওয়া হবে না....
সোহম: যায় হয়ত....কিন্তু আমি আমার আমার মতে চলি... দাসত্ব আমার রক্তে নেই বুঝলি ....আমি সোহম... মানে ....আমিই ব্রহ্ম ....চাইলে আমি জগত সৃষ্টি করতে পারি, সময় ছুঁতে পারি, সূর্যকে চালাতে পারি আমার হুকুমে....আর চাঁদ তো মুঠোয়......হা হা হা....কেমন বললাম বল?...তোর চন্দ্রিমা নামটাকে একটু সংক্ষিপ্ত করে দিলাম.....আপত্তি নেই তো ?
চাঁদ: না...তবে আমি কিন্তু তোর হুকুমের টেক্কা নই ,আর আমিও তোকে সোহম সোহম করতে পারব না....
সোহম: আচ্ছা? বেশ...কি বলবি শুনি....
চাঁদ: আমি তোকে ডাকব 'ওম্ 'বলে...
সোহম: ওম???
...... একমুহূর্তে সোহমের মনে হল তার চারপাশের পৃথিবীটা বদলে গিয়েছে বুঝি ....ধুসর থেকে লাল নীল রঙিন ....তার ভেতরে বসত করা বেয়াড়া আমিটা তার রক্তমাংসের শরীরের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করেছে ‘এ কোন সোহম গাঙ্গুলী?’....
সোহমকে চুপ থাকতে দেখে চাঁদ বলল, ' আজ থেকে তোর জীবনে রেনেসাঁস এল ।'
সোহম বলল: সেকি রে? আয়নার সামনে এত বছর ধরে আলগোছে যাকে দেখে আসছি ......তার জন্ম হল মোটে কয়েক সেকেন্ড আগে ?
চাঁদ : হুম ... জানিস কি , কে যেন বলেছিলেন ‘মানুষের জন্ম কেবল একবারমাত্র হয়ই না....একটা জীবনে মানুষ কয়েক লক্ষ বার জন্মায় .....জন্ম শুধুমাত্র শরীরের পিতৃদত্ত সম্পত্তি নয় , মানুষ মনে মনে অসংখ্য বার জন্মা নেয় .....শারীরিক জন্মগুলোর মৃত্যু আছে...কিন্তু এই জন্মগুলোর কোনও শেষ নেই....শুধু বিস্তার আছে আজন্ম ....আকাশের মত.....বিজ্ঞানের মত....সূর্যের মত...।
সোহম: সাবাস.....তুই কি লেখালিখি করিস নাকি?
চাঁদ: সেরকম নয়....মাঝেসাঝে, ইচ্ছে-টিচ্ছে হলে....কেন বলতো?
সোহম: না চাঁদ.....তুই লেখ....তোর শব্দচয়ণ বেশ ভালো .....তার সাথে এটুকু বলতে পারি....তুই একটা মুহুর্ত তৈরি করতে পারিস....তুই কবিতা পড়িস?
চাঁদ: ভীষণ ভাবে.....আমি এখনকার কবিদের মধ্যে সুবোধ সরকার....পুর্ণেন্দু পত্রী পড়তে ভীষণ ভালোবাসি .....তুই পড়েছিস ???
সোহম: হুমমম......তবে রবীন্দ্রনাথ আমার প্রাণ....আমাদের বাঙালিদের রক্ত মাংস হাড় মজ্জায় মিশে আছেন রবি ঠাকুর ......
এমনি করেই কবি বিষ্ণু দে , শঙ্খ ঘোষ ,দীনেশ দাস .......চাঁদ আর ওমের গতিময় জীবনের প্রাত্যহিকি হয়ে উঠলেন.......আর সঙ্গে তো রইলেনই শক্তি-সুনীল-সুবোধের মত বড়ো মাপের কবিরা....
রবীন্দ্রসদন স্টপেজ আসতেই ওমকে অবাক করে 'উঠি' বলে চাঁদ হঠাৎ সিট ছেড়ে উঠে পড়ল....
ওম: কিরে এত তাড়াতাড়ি উঠছিস....একটা স্টপেজ আগেই নামবি নাকি...?
চাঁদ: ...(একটু হেসে) আজ আমার ক্লাস সেকেন্ড হাফে....তুই একসাথে যাবি বলেছিলি বলে এই সময়টায় এলাম(একটু থেমে).....পিজি হসপিটালে আমার এক দিদি আর .এম.ও....ওর সাথে দেখা করব....দরকার আছে ।
সোহম কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না......একটু এগিয়ে বাসের দরজার মুখে এসে চাঁদ ওমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে 'আর হ্যাঁ...আমি কিন্তু চেষ্টা করব ৯:১৫ এর বাসটাই ধরার.....তাই'......বাসটা থেমে গেল ,বাসের দরজা খুলে চাঁদ নেমে পড়ল....ও চাইলে ফিরে তাকাতেই পারত...কিন্তু ও জানে আজ হয়ত সোহম ওর চলার পথটা অনুসরণ করবে.....এটা না হলে আজ আরও একবার যে চাঁদ নিজেকে অবহেলিত মনে করবে...থাক না এই ভাবনাটা....ক্ষতি কি আছে....???
......সত্যিই কিন্তু সোহম আজ চাঁদের একটু ফিরে চাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে রইল...মুখে কিছু না বললেও চাঁদের পুতুল পুতুল স্নিগ্ধ মুখটার মধ্যে কোথা থেকে এতটা আত্মপ্রত্যয় এল....তাই ভাবতে ভাবতে নিজেকে একটু অন্যরকম মনে হল সোহমের....কয়েক মুহুর্ত আগে জন্মানো ওমের জন্যে কেমন যেন একটু বদলে যেতে ইচ্ছে করল সোহমের!!!!
(ক্রমশ)