গত একমাস যাবৎ গজায় ইজরায়েলের সন্ত্রাসী হানায় প্রায় দুই হাজার প্যালেস্টাইন নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে ও দশসহস্রাধিক নাগরিক বাকি জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে হয়ে গিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এইরকম ইজরায়েলি হামলায় প্যালেস্টাইন ও সন্নিহিত লেবাননের বিস্তীর্ণ জনজীবন বারংবার বিদ্ধস্ত হয়ে চলেছে বিগত তিন দশক ধরেই। ফলে এই বর্বরোচিত আক্রমণ নতুন কোনো ঘটনা নয়! নতুন ঘটনা নয, আরব ভুখন্ডে ইজরায়েল ও মার্কীণ বাহিনীর বিধ্বংসী তান্ডবেও বিশ্বজনমতের মূক ও বধির হয়ে থাকা! নতুন ঘটনা নয়, ইহুদীদের উপর যে নারকীয় হত্যালীলা সংঘটিত করার অপরাধে হিটলার ও তাঁর নাৎসী বাহিনী ইতিহাসে চরম কলঙ্কিত অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত: সেই একই রূপ হত্যালীলা বিগত সাত দশক ধরে চালিয়েও ইজরায়েল ও তার রাষ্ট্রযন্ত্র আজও যুদ্ধাপরাধী বলে বিশ্ববাসীর কাছে নিন্দিত নয়! নতুন ঘটনা নয়, আজও প্যালেস্টাইনের জনগণ সম্পূর্ণ সার্বভৌম স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত! নতুন ঘটনা নয়, গাজায় জনজীবন তিনশত পঁয়ষট্টি দিন ধরেই ইজরায়েলি মিলিটারীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। তবে কেন এই নারকীয় হত্যালীলা?
ইজরায়েলের অভিযোগ অনুসারে গাজায় হামাস মাটির নীচে সুরঙ্গ খুঁড়ে ইজিপ্টের মধ্যে দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র আমদানী করছিল, এবং ইজরায়েলের অভ্যন্তরে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে কজন মিলিটারীকে অপহরণ ও খুন করে। আর তারই পাল্টা প্রতিশোধ নিতে ইজরায়েলের ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় ও বোমা বর্ষণে প্রথম তিন সপ্তাহেই ১৮৬৫ জন গাজাবাসী, যার অধিকাংশই নিরীহ নিরস্ত্র এবং মহিলা ও শিশু; নিহত! আহত দশসহস্রাধিক! এই হামলার প্রতিবাদে হামাসের ছোঁড়া রকেটে ইজরালের হানাদার বাহিনীর এ পর্য্যন্ত পাওয়া খবরে ৬৪ জন হত হয়েছে! অনুপাতটিই পুরো ঘটনা অনুধাবনের পক্ষে যথেষ্ট! এবারের হানায় যত শিশু নিহত হয়েছে, তা বিগত সব হিসেবকেই ছাপিয়ে গিয়েছে বলে ওয়াকিবহাল সূত্র্রের দাবি!
মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খোঁরার উপযুক্ত শাস্তিই বটে! অথচ ইজরায়েলের মিলিটারীর হাতে জল-স্থল-অন্তরীক্ষ সর্বত্র অবরুদ্ধ গাজাবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনের চিত্র কতটুকু বহির্বিশ্বে প্রচারিত হয়? মজার কথা পৃথিবীর সকল দেশের মতো ইজরায়েলেরও যেমন স্বাধীন সার্বোভৌম অস্তিত্ব স্বীকৃত, শুধু প্যালেস্টাইন তথা গাজাবাসীদেরই সেই অধিকার স্বীকৃত নয়। একটি হাস্যষ্কর অসলো চুক্তির দৌলতে গাজাবাসী চারিদিক থেকে ইজরায়েল দ্বারা অবরুদ্ধ থেকে নামমাত্র সায়ত্বাশাসনের অধিকারী। আবার সেই অধিকারের সনদেই গাজাবাসীর ভোটে নির্বাচিত হামাসকে ইজরায়েল আজও স্বীকৃতি দিতে নারাজ! কি চমৎকার বন্দোবস্ত বর্তমান বিশ্বের নাকের ডগায়! রাষ্ট্রপুঞ্জ নামক শিখণ্ডীকে সামনে খাড়া রেখে, মার্কীণ শক্তির তত্তাবধানে!
এবং একথাও স্মরনে রাখা প্রয়োজন, এই প্যালোস্টাইন ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে বিভিন্ন ছুতোনাতায় ইজরায়েল চার পাঁচ বছর পরপরই এইরকম বিদ্ধংসী আক্রমণে সাধারণ ফিলিস্তিনীদের সন্ত্রস্ত করে রাখে শুধু তাই নয়, খুব হিসেব কষেই তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা যুদ্ধকে দুই এক প্রজন্ম করে পিছিয়েও দেয়। এখানেই বর্তমান পরিস্থিতির মূল তাৎপর্য! কারণ ইজরায়েল ও তাদের সব অপকর্মের বরাভয় দানকারী মার্কীণশক্তি কোনোদিনও ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা দিতে রাজি নয়। আর ঠিক এই কারণেই, প্রতিবারই ইজরায়েলের অক্রমণের শুরুতে রাষ্ট্রপুঞ্জকে শিখন্ডী করে নিরাপত্তা পরিষদের কালক্ষেপনের পেছনে কলকাঠি নেড়ে থাকে প্রবল প্রতাপশালী মার্কীণশক্তি। ইজরায়েলি হামলার নীল নকশা অনুযায়ী উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে আসার পরেই, নড়েচড়ে বসে হোয়াইটহাউস। আর বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করে ইজরায়েলকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে থাকে। উভয়েরই পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে বিশ্ববাসীকে সাক্ষী রেখে ইজরায়েল তা মেনেও থাকে। গেম সেট এন্ড ম্যাচ! কিন্তু ততক্ষণে কত ফিলিস্তিনী পরিবার যে উজার হয়ে যায় তার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছায় না।
গত এক মাসব্যাপি ইজরায়েলের লাগাতার হামলায় বর্তমানে গাজায় এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই হামলার তীব্রতা এতই ভয়াবহ যে মৃতদেহগুলি সবক্ষেত্রে শানাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছেও না। আবার অনেক ক্ষেত্রেই শানাক্তকরণের জন্যে পরিবারের কাউকেই জীবিত পাওয়া যচ্ছে না। অন্যদিকে অবরুদ্ধ গাজায় সিমেন্টের অভাবে মৃতদেহগুলি নিয়মমত কবরস্থ করাও সম্ভব হচ্ছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। যদি বা কবর দেওয়ার বন্দোবস্ত করা সম্ভব হচ্ছে, সম্ভব হচ্ছে না পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন করে কবরস্থ করা। কারণ ইজরায়েলের বর্বরচিত হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না গোরস্থানগুলিও। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মৃতদেহগুলি রাখা হচ্ছে হিমঘরে!
বহুক্ষেত্রেই পথেঘাটে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহগুলিতে পচন ধরে সৃ্ষ্টি হচ্ছে এক নারকীয় পরিবেশের। এর সাথে যুক্ত হয়েছে, বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে শুরু করে, ধ্বংসপ্রাপ্ত জলের পাইপলাইন, ভেঙে পড়া যোগাযোগ ব্যাবস্থা, প্রভৃতি জরুরী ভিত্তিতে মেরামত করার জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তিবিদের বাইরে থেকে ঢুকতে না দেওয়া! হাসপাতালগুলির অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে পড়ছে। বেশকিছু হাসপাতাল তো ইতিমধ্যেই ইজরায়েলি হামলায় অল্প বিস্তর ধ্বংসপ্রাপ্ত!
প্রশ্ন হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী বর্বরতার বিরুদ্ধে যে বিশ্ববিবেক জেগে উঠেছিল, তা এখন কোথায়? নাকি আবিশ্ব একমেরুর বিশ্বায়নে সব বিবেকই দাসখত দিয়ে বসে আছে? চোখের সামনে এই বীভৎসতা দেখেও নড়েচড়ে বসার স্বাধীনতা নেই তাবৎ বিশ্বনেতানেত্রীদের! আর আবিশ্ব সাধারণ জনগণ দিব্যি যে যার চড়কায় তেল দিতেই ব্যাস্ত! ফিলিস্তিনী মায়ের শূন্য কোল, অনাথ শিশুর হাহাকার, ঘরে ঘরে সদ্য বিকলাঙ্গ যুবা পুরষ নিযে গাজাবাসী যাপন করুক অবরুদ্ধ জীবন। আর, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইজরায়েল ও তার দোসররা মিলিত হোক বিজয়াল্লাসে!!
এবং আরও অসংখ্য! লঙ্ঘিত মানবাধিকারের নিদারুণ সব চিত্র! ফিলিস্থিনী হাহাকারের মর্মান্তিক দলিল!