বিজয়ের মাস - ফিরে দেখা। পর্ব - ৩
শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সারাদেশ জুড়ে ছয়দফা প্রচার শুরু করেন। ছয়দফা অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে । এতে আইয়ুব মোনেম আতংকিত হয়ে জেল জুলুম শুরু করলো। শেখ মুজিব যেখানেই জনসভা করতে যান সেখানেই তাকে গ্রেফতার করে। একটার পর একটা মামলা দায়ের করা হয়,আবার জামিনও দেয়া হয়। ৬ দফা প্রচারণার এক পর্যায়ে ৮ মে ১৯৬৬ শেখ মুজিব দেশ রক্ষা আইনে গ্রেফতার হন।এই গ্রেফতারের পূর্বে ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৫০ দিনে তিনি ৩২টি জনসভায় ভাষণ দেন। এই সময়সীমার মধ্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফার পক্ষে যে অভাবনীয় জনমত সৃষ্টি করেন তা সত্যি অকল্পনীয় ব্যাপার।
কেবল শেখ মুজিব নন,
১০ মে, ১৯৬৬ সালের মধ্যে দলের প্রায় ৩৫০০ নেতা কর্মী গ্রেফতার হন। কিন্ত শেখ মুজিব তার আগেই সব কিছু গুছিয়ে এনেছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে যাতে কর্মীবাহিনী কাজ চালিয়ে যেতে পারে সে ভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তার সংগঠনকে। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগও ছয়দফার প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ে। সে সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। ছাত্র ইউনিয়নের সহায়তায় রাজ্জাক ৬ দফার ৫০ হাজার লিফটলেট বিলি করেন। ন্যাপের যে অংশ ৬ দফার সমর্থক ছিল তারা সংবাদ থেকে ৬ দফার লিফটলেট ছাপিয়ে দিতেন।
শেখ মুজিবের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৭ জুন ১৯৬৬ দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। দেশের শ্রমিকশ্রেণী প্রথমবারের মত একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এতদিন শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে আওয়ামী লীগের কোন জনপ্রিয়তা ছিল না ।
শেখ মুজিব যখন ৬ দফা কর্মসুচি ঘোষণা করেন, এবং প্রচারণা শুরু করেন, তখন মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। ভাসানী নিজেও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন দাবী করেন, কিন্ত আওয়ামী লীগের ৬ দফার কঠোর সমালোচনা করে ১৯৬৬ সালে ১২ জুন ৬ দফার পাল্টা ১৪ দফা কর্মসুচি ঘোষোণা করেন। ভাসানী ছিলেন চীনাপন্থী। আইয়ুব যখন থেকে চীনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করেন তখন থেকেই তিনি আইয়ুবের প্রতি নরম হতে থাকেন। তা ছাড়া আইয়ুব খান ভাসানীর ইসলামী সমাজতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে শুরু করলে আইয়ুব-ভাসানীর সম্পর্কের আরো উন্নতি ঘটে। ১৯৬৩ সালে ভাসানী চীন সফরে গেলে চীনা নেতৃবৃন্দ তাকে বুঝতে সক্ষম হন যে, চীনের শত্রু সোভিয়েত রাশিয়া। ভারত-মার্কিন এর বিরুদ্ধে পাকিস্তান-চীন মৈত্রী দৃঢ় করতে হলে আইয়ুব সরকারকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। এতে তিনি আরো আইয়ুবের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।
চীনের সাথে আইয়ুবের এই সম্পর্ক উন্নয়নকে ন্যাপের কিছু বামপন্থী নেতা সমর্থন করলেও ন্যাপের সোভিয়েতপন্থী অংশ ভাসানী ও তার অনুসারীদের নীতির বিরোধিতা করেন। এতে ন্যাপের অভ্যন্তরে বিরোধ বৃদ্ধি পায়। এদিকে কম্যুনিস্ট পার্টির ১১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে দুটি ভিন্ন থিসিস উত্থাপনকে কেন্দ্র করে কম্যুনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এক অংশের নেতৃত্ব দেন মণি সিং ও আব্দুস সালাম অন্য অংশে দস্তিদার, তোয়াহা। মণি সিং এর অংশ ৬ দফাকে সমর্থন করে, তোয়াহার দল বিরোধিতা করে। মণি সিং এর অংশ সোভিয়েত নীতিকে আর তোয়াহার অংশ চীনা নীতিকে সমর্থন করেন। এর প্রভাব পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের উপরেও পড়ে।
১৯৬৭ সালের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এক অংশে নেতৃত্ব দেন রাশেদ খান মেনন অন্য অংশে মতিয়া চৌধুরী। ন্যাপ ভাঙে ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর। ভাসানী ন্যাপের নেতা হন ভাসানী আর রিকুইজিশনিস্ট ন্যাপের নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। পশ্চিম পাকিস্তানেও ন্যাপ বিভক্ত হয়। এখানে এক অংশের নেতা ওয়ালী খান। ওয়ালীর দল মোজাফফরের দলকে সমর্থন দিয়ে একটি সর্বপাকিস্তানী রূপ দান করে। এর নাম হয় ন্যাপ ওয়ালী । মতিয়া গ্রুপ, ন্যাপ ওয়ালীর সাথে, আর রাশেদ খান গ্রুপ ভাসানী ন্যাপের ছাত্রসংগঠনরূপে সম্পৃক্ত হয় ।
আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলনে সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই এই আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এতে ছয় দফা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় আইয়ুব বিরোধী দলসমুহের নেতৃবৃন্দ ১৯৬৭ সালের ২ মে আতাউর রহমান খানের বাসায় মিলিত হয়ে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পি ডি এম)
নামের ঐক্যজোট গঠন করেন। এই জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হল, কাউন্সিল মুসলিম লীগ,
নেজামে এছলামী, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, এন ডি এফ, এবং জামায়েতে ইসলামী। জোটের উদ্দেশ্য হল,
আওয়ামী লীগের বহু নেতা বন্দী থাকায় যাতে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি না হয়। আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডন্ট ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম,ও আমেনা বেগম পি ডি এম এ যোগদানে বিরোধিতা করেন। সে সময় তাজুদ্দীনপ্রমুখ শেখ মুজিবের সাথে কারাগারে বন্দী থাকার সুযোগে আওয়ামী লীগের কিছু রক্ষণশীল নেতা যেমন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবুল মনসুর আহমদপ্রমুখ পিডিএম এ যোগদানে পক্ষপাতী ছিলেন। ফলে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এক অংশে ছয় দফা পন্থী অন্য অংশে পিডিএম পন্থী। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সামান্য কয়েকজন রক্ষণশীল নেতা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে পিডিএম এ যোগদান করেন। পিডিএম ৮ দফা কর্মসুচি ঘোষণা করে যা ছয় দফারই বর্ধিত সংস্করণ।
১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের ভাঙন এবং ভাসানী ন্যাপের আইয়ুবকে সমর্থন দান ছয় দফা আন্দোলনকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলে। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করেন এবং ভাসানী ন্যাপের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলেন।
উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার এক ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হয়। আওয়ামী লীগ এবং মুজিবকে ধ্বংস করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। এই ষড়যন্ত্রকে আগরতলা ষড়যন্ত্র বলা হয়। সরকার ৬ জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উক্ত ষড়যন্ত্রের কথা ঘোষণা করে । এই অভিযোগে দুইজন আওয়ামী লীগের নেতা দুইজন সিনিয়র বাঙালি সিভিল কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জনঅকে গ্রেফতার করা হয়। দুই সপ্তাহ পর ১৮ জানুয়ারি আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শেখ মুজিবকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি তখন জেলে ছিলেন।তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ।তারা ১৯ জানুয়ারি পুর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট আহবান করে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরী সভায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসহ শেখ মুজিবের প্রকাশ্য বিচার দাবী করা হয়। শেখ মুজিব জেল থেকেই ঘোষণা করেন, কেবল পূর্ব পাকিস্তানবাসীর স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে বানচাল করার উদ্দেশ্যেই এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
এ সময় পিডিএম ভুক্ত পাঁচটি দল ও অন্য তিনটি দল মিলে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি (DAC) নামে এক বিরোধী জোট গঠন করেন। এই জোটে ছিলেন এন ডি এফ, ছয়দফাপন্থী আওয়ামী লীগ,
ন্যাপ ওয়ালী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ,
জামায়েতে ইসলামী এবং নেজামে এছলামী। ভাসানী ন্যাপ এবং পিপলস পার্টি এই জোটে যোগদান করেনি। DAC এর অন্যতম নেতা ছিলেন এন ডি এফ এর হামিদুল হক চৌধুরী, নুরুল আমীন, মাহমুদ আলী,
নেজামে এছলামীর ফরিদ আহমেদ, দুদু মিয়া, পিডিএম এর আব্দুস সালাম খান,
ছয়দফাপন্থী আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জামায়েতে নেতা গোলাম আজম, ওয়ালী ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, স্বতন্ত্র পার্টির বিচারপতি এস এম মোরশেদ। DAC বর্তমান আন্দোলনকে ব্যাপকতর ও সমন্বিত করে একটি অহিংস সংঘবদ্ধ ও শৃংখলা বদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তোলার সংকল্প ঘোষণা করে।
এ সময় ছয়দফাপন্থী আওয়ামী লীগ বার্ষিক কাউন্সিলে সমাজতন্ত্রকে পার্টির আদর্শরূপে গ্রহণ করলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলে। এই দুই সংগঠন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গঠন করে এবং আন্দোলন কর্মসুচি হিসেবে ১১ দফা দাবী ঘোষণা করা হয়।
আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে শুরু হলেও তা ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে তুঙ্গে উঠে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। এ সময় আন্দোলন শহর ছেড়ে গ্রামেও ছড়িয়ে যায়। বিডি মেম্বারদের পদত্যাগের আহবান করলে ৭৫% সে আহবানে সাড়া দেন। অনেক বিডি মেম্বারকে বিদ্রোহী জনতা হত্যা করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহাকে পুলিশ বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করলে সারাদেশে ছাত্র-শিক্ষক-জনগণ নির্বিশেষে এমন গণবিক্ষোভ শুরু হয় যে, সরকার ১৯৬৯ সনের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন । সে সাথে অনেক কম্যুনিস্ট বন্দী -- যারা দীর্ঘদিন যাবৎ জেলে ছিলেন তারাও মুক্তি পান । রেসকোর্স ময়দানে পাঁচ লক্ষ লোকের সমাবেশে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেই সমাবেশে ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদের প্রস্তাবনায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। উক্ত সভাতেই জয় বাংলা স্লোগানের উদ্ভব ঘটে।
শেখ মুজিবের মুক্তির পর আন্দোলন আরো বেগবান হলে আইয়ুব শাহী ডাক এর নেতৃবৃন্দকে এক গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। ভাসানী ন্যাপ এবং পিপলস পার্টি এ বৈঠক বয়কট করে এবং ভাসানী মুজিবকেও বৈঠকে যোগদান না করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্ত শেখ মুজিব সে বৈঠকে যোগদান করে আওয়ামা লীগের ছয় দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবী উত্থাপন করেন। জামায়েতে ইসলামের মওদুদী ও নেজামে এছলামের চৌধুরী মোহম্মদ আলী শেখ মুজিবকে উক্ত দাবী উপস্থাপনে বিরোধিতা করেন। মোজাফফর আহমেদ ও বিচারপতি মোরশেদ শেখ মুজিবকে সমর্থন করেন, ওয়ালী খান শুধু স্বায়ত্তশাসনকে সমর্থন করেন। অনেক আলাপ আলোচনার পর মাত্র দুটি বিষয় গৃহিত হয়। এক,
ফেডারেল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ,দুই,
নির্বাচন। শেখ মুজিব এই এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। আওয়ামী লীগ ও মোজাফফর ন্যাপ ছাড়া অন্যান্য বিরোধী দল এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
আইয়ুব এই সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করেন। হামিদুল হক বলেন, এটা জনগণের বিজয়, জামাতে ইসলামী একে সফল বলে অভিহিত করে। ভাসানী এই বৈঠকে যোগদান না করলেও বৈঠকের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
শেখ মুজিব DAC থেকে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাহার করলে মোজাফফর ন্যাপও তাকে অনুসরণ করে। ফলে ১৪ মার্চ DAC ভেঙে যায়। ছাত্রবৃন্দ আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ মোজাফফর কে অভিনন্দিত করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের যে সকল দল ৬ দফা ও ১১ দফার বিরোধিতা করেছিল তাদের নিন্দা করে। এ সময় জামাতের পক্ষ থেকে ইসলামী সংগ্রামী পরিষদ গঠিত হয়।
১১ মার্চ, ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা ও ১১ দফার আলোকে পাকিস্তান সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর খসড়া প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সমীপে পেশ করেন। এই খসড়া সংবিধান পাকিস্তানেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কারণ এখানে পাকিস্তানে এক ইউনিট ভেঙে ৪টি স্বতন্ত্র প্রদেশের দাবী করা হয়। এই দাবী পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেখানেও ব্যাপক ছাত্র-শ্রমিক গণআন্দোলন শুরু হয়। এতে আইয়ুব বুঝতে পারেন তার সময় শেষ হয়েছে। তারপরেও স্বৈরাচারী আইয়ুব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে ২৪ মার্চ ১৯৬৯ সালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ২৫ মার্চ দেশে সামরিক আইন জারি করেন। এইভাবে পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মত সামরিক আইন জারি হয়।
আইয়ুব খানের নিকট থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ এ ঘোষণা দেন যে, ১৯৭০ সালে ৫ অক্টোবর দেশের জাতীয় পরিষদের এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে। এব্যাপারে ইয়াহিয়া খান দুটি গুরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন। এক,
পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল করে চারটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি, দুই,
এক ব্যক্তি এক ভোট।
১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ ইয়াহিয়া খান আইন কাঠামো আদেশ (Legal frame work order) এর মূল ধারাগুলো ঘোষণা করেন। এই আদেশের বিরূপ সমালোচনা করলেও ভাসানী ন্যাপ ব্যতীত সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনকে সকল বঞ্চনা ও শোষণের প্রতিবাদ হিসেবে অভিহিত করেন।তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন হচ্ছে ব্যালটের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণের দাবি আদায়ের সর্বশেষ সংগ্রাম।ন্যাপ ওয়ালী নেতা মোজাফফর আহমেদ বলেন,নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সংসদ প্রতিষ্ঠা করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের দাবী আদায় করতে হবে। কিন্ত মৌলানা ভাসানী নির্বাচনের ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। তিনি একদিকে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, অন্যদিকে ভোটের আগে ভাত চাই বলে শ্লোগানও উত্থাপন করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।
১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পূর্ব বাংলায় বন্যা হওয়ার কারণে ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ পূনঃনির্ধারণ করা হয়। কিন্ত ১২ নভেম্বর উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের ফলে প্রায় দুই লক্ষ লোক মারা যায়। এই বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে প্রায় সকল দল নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবি জানায়। কিন্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচন পিছানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিবাদ করে। শেখ মুজিব বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে উপদ্রুত এলাকায় কয়েক লক্ষ মানুষ যেমন বিপর্যস্ত,তেমনি সারা দেশে কোটি কোটি মানুষ বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে বিপর্যস্ত। এ জন্যই নির্বাচন হওয়া অতি জরুরী। উপদ্রুত এলাকায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা শেখ মুজিবকে আরো বেশি অনমনীয় করে তুলে। তিনি বলেন, বিপর্যস্ত মানুষের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা প্রমান করে যে ৬ দফা এবং ১১ দফা্র বাস্তুবায়ন ছাড়া এ দেশের মানুষের কোন গত্যান্তর নেই।
অবশেষে পূর্বঘোষিত সময় অনুসারেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন ইত্তেফাক পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে লেখা হয়,
বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচন অনিদির্ষ্টকাল বন্ধ রাখার জন্য প্রেসিডেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করা হইয়াছে। বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে,
শেখ মুজিব যদি নির্বাচনের দাবীতে অটল অনড় না থাকিতেন,তবে হয়ত ৫ অক্টোবরের পরে ৭ ডিসেম্বরও অতিক্রান্ত হইত--- নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইত না । নির্বাচনে মৌলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান,
ইউসুফ আলী চৌধুরী, কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ এস এম সোলায়মান ভোট দেননি।
জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৪৪ আসনের মধ্যে ৮৮টি আসনে লাভ করে। ১০দিন পর অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়ে বিজয়ী হয়।
সংগঠনের দিক থেকে আওয়ামী লীগ ও পিপিপি --উভয়ই ছিল আঞ্চলিক। পূর্ব পাকিস্থানে আওয়ামী লীগ জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সব গুলি আসন লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানে তারা কোন আসন পায় নি। এমনিভাবে ভুট্টোও পূর্ব পাকিস্তানে কোন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে না পারলেও পশ্চিম পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মূলত পাকিস্তানে তখন পর্যন্ত সর্বপাকিস্তান ভিত্তিক কোন দল গড়ে উঠেনি। যা ছিল তাও নামে মাত্র।
দুই প্রদেশে দুটি দল প্রাধান্য লাভ করায় পাকিস্তানে নির্বাচোত্তর অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতি এই বিপুল রায় প্রকারান্তরে ৬ দফা কর্মসুচির প্রতি গণরায়। কাজেই ৬ দফাভিত্তিক রচিত সংবিধান ছাড়া কোন সংবিধান গ্রহণযোগ্য নয়। এর পালটা জবাবে জনাব ভুট্টো বলেন, তার সহযোগিতা ছাড়া কেন্দ্রে কোন সরকার প্রতিষ্ঠা বা সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না। তিনি আরো বলেন যে,
পিপিপি পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। কাজেই কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় এই দুই প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব অবশ্যই থাকতে হবে। এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুদ্দীন আহমেদ বলেন,যেহেতু এক ব্যক্তি এক ভোট ভিত্তিতে নির্বাচন হয়েছে সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের পাঞ্জাব ও সিন্ধুর প্রতিনিধিত্ব আবশ্যক---- ভুট্টোর এ দাবী ঠিক নয়। ভুট্টো আরো বলেন, জাতীয় সংহতি অক্ষুন্ন রাখার পর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পরিমান নির্ধারণ করা হবে। এভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমুহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে দুই মেরুতে অবস্থান করে। আওয়ামী লীগ ছয়দফার ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অনঢ় থাকে।অন্যদিকে পিপিপিসহ অন্যান্য ডানপন্থীদল সমুহ শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করতে থাকে।
শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এক র্যালী সমাবেশে বলেন, মৌলিক নীতির প্রশ্নে কোন আপোস নাই। আমরা অনেক কষ্ট ভোগ করেছি, অবিচার সহ্য করেছি। এর কী জ্বালা আমরা তা বুঝি। সুতরাং আমরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতি ন্যায়বিচার করব।
১৯৭১ সনের মধ্য জানুয়ারিতে ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে বৈঠক করেন। জানুয়ারির শেষের দিকে ভুট্টোও একই বিষয় নিয়ে মুজিবের সাথে বসেন। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন,
সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে জাতীয় সংসদের অধিবেশন ঢাকায় বসবে ৩ মার্চ ১৯৭১। কিন্ত ভুট্টো তার মতামত গ্রহণের অঙ্গীকার না দিলে উক্ত অধিবেশন বয়কটের হুমকি দেন। তিনি বলেন, তার দল কেবল মাত্র অন্য একটি দল কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের সম্মতি দেয়ার জন্য ঢাকা যেতে পারে না । শেখ মুজিব স্পষ্ট ঘোষণা দেন,
আমাদের অবস্থান পরিস্কার। যদি পশ্চিম পাকিস্তান তার দলের ৬ দফা কর্মসুচি পুরোপুরি মেনে না নেয় তাহলে তিনি একাই সংবিধান প্রণয়ন করবেন। কিন্ত ইয়াহিয়া ভুট্টোর দাবির কাছে মাথা নত করেন।
[পরবর্তী সংখ্যায়]