‘আই এম ইন দ্য ডার্ক হেয়ার’
১
তুবার লাশটা
তখনো এসে পৌঁছোয়নি। আমি সামনের গোল বারান্দাটার সামনে উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
চারপাশে অনেক লোকের ফিসফিস। গভীর নিঃস্তব্ধতার মাঝেও যেমন শব্দের কিছু কারুকাজ
থেকেই যায় যাকে ঠিক সরব বলা যায় না আবার নীরবও বলা চলে না তেমনি একটা শান্ত সময়ের
ভেতর দাঁড়িয়ে আমি তুবাকে বিদায় জানাবার সকল আচার মনে মনে ঝালাই করে নিচ্ছিলাম।
ভাবছিলাম, ওর লাশটা দেখে আমি কেঁদে ফেলব কি না! নাকি ঠিক এভাবেই মুখের একটি রেখাও না বদলে বলে দিতে পারব, বন্ধু বিদায়! ও জীবিতাবস্থায় নিজে যেমন
অস্থির ছিল তেমনি মরে গিয়েও আমাকে কেমন বিভ্রান্ত করে রেখে গেছে। ওর মতো তরল কোনো
মানুষই আমি এ যাবতকাল এই পৃথিবীতে আর দেখিনি। কথায় কথায় হেসে গলে পরা, কথায় কথায় একটু ক্ষেপে যাওয়া আর প্রচন্ড ছটফটে দস্যিপনা এগুলো ওর স্বভাবে
থাকলেও কোথায় যেন ও ছিল ভীষন রকমের শীতল। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠেছি। খুব ভয় পেতাম ওকে সে সময়। কিনতু সেটা
অবিশ্যি খুবই ক্ষণিকের, সেটা কেবলমাত্র ঘটত ও যখন
নিজের পুরো শরীর কবিতায় ঢেকে ফেলত শুধুমাত্র তখনই। বাকীটা সময় তুবা সে-ই, জলবৎ তরলং।
মৃত্যুর বেশ
কিছুদিন আগে থেকেই ও আমাকে বলা শুরু করেছিল যে ওর আর ভাল লাগে না কিছু। আমি বলতাম, ‘গান করো, ছবি আঁকো বা কবিতা লেখো।
তোমার এত আছে, এমন আর ক’জনের আছে বলো?’ তুবা বিবশ হয়ে কেবল আমার এ
কথাগুলো শুনত, কিনতু চোখ থাকত জানালার
কাঠের পাল্লায় বসে থাকা শেষ বিকেলের একফালি রোদের দিকে। আমি প্রত্যক্ষ করতাম, সদুপোদেশ কিভাবে জলে নেমে হাবুডুবু খায়। তবে মাঝে মঝেই খুব আনমনে একটা
নিঃশ্বাস ফেলে বলত, ‘এসব অনেকেরই আছে এবং তারাও
আমার মতন সৃষ্টির সেরা সমৃদ্ধিটুকু ভেতর থেকে নিংড়ে বের করতে না পারার কষ্টে
জ্বলে।‘ কথাগুলো সে ভুল বলত না বলে আমি অতঃপর চুপ হয়ে যেতাম।
তুবা ছিল
জন্ম থেকেই বিষন্ন এক মানুষ। অনেক হাসত বলে লোকে ভাবত, এই মেয়ের চেয়ে চমৎকার কিছু আর ইহজগতে নেই। কিনতু আমি জানতাম, ও কেমন নিজের হাত খুইয়ে আসে বাজারে, ওর চোখ কেমন করে লেটুস পাতা হয়ে ওঠে মূহুর্তেই। আমাদের এক বন্ধু ওর প্রসঙ্গে
বলেছিল, মুগ্ধ হবার ক্ষমতাটাই হল তুবার সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। ঠিক তাই, তুবা মুগ্ধ হত নিমেষেই আবার সেই মুগ্ধতা কেটে যেতেও দেরী হত না। এই মুগ্ধতার
কারনেই ও প্রেম পড়ত মূহুর্তে মূহুর্তে আর এটা ছিল দারুন বিরক্তিকর। অনেকবার বারন
করেছি, ও শোনেনি। নিত্য নতুন পাখির গান কণ্ঠে তুলে নিত অনায়াসে। কবিতা লেখার কলম দিয়ে
চুলে চিরুনী করতে করতে দিব্যি সে বেরিয়ে যেত সামনের ডোবায় ফুটে থাকা কচুরীপানার
বেগুনী ফুলগুলোর সাথে প্রেম আঁকবে বলে। দু একবার মানুষের সাথেও প্রেম হয়েছিল ওর।
কিনতু মানুষের গায়ে নাকি মোমবাতির সলতে পোড়া একটা গন্ধ সে পেত তাই সেসব প্রেমে খুব
বেশী রুচি ছিল না ওর। এই স্বভাবটা জানত না বলে একবার ওর এক প্রেমিক ওকে অন্য পুরুষ
নিয়ে সন্দেহ করা শুরু করেছিল আর বেচারা নিজেই তুবার মন থেকে উধাও হয়ে ঐ সামনের
বটঝুড়ির ভেতর বুক চাপা কান্না ঢেলে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। অবশ্য এসবকে তুবা থোড়াই
কেয়ার করত।
ওর ভেতরকার
এই ডিস্ট্রাক্টিভ মনোভাব আমাকেও খুবই ভাবনায় ফেলে দিত। মাঝে মাঝে ওকে আমার অহংকারী
মনে হত খুব। আবার কখনো বিনয়ের পরাকাষ্ঠা। এই দ্বৈত স্বভাবের মেয়েটিকে নিয়ে আমার
চেয়ে বিচলিত এ পৃথিবীতে আর কেউ হয়নি কখনো। তাই ওর মৃত্যুসংবাদ আমার জন্যে একটা
আশীর্বাদের মত মনে হয়েছিল। এমন নয় যে ও যখন মরবার কথা বলত, তখন খুব খুশী হতাম আমি। বরং বুকের গহীনে একটা গভীর যাতনার বাতি চিকমিক করে
জ্বলে উঠত এবং আমি অনায়াসে পুড়ে যেতে থাকতাম। এজন্যে ওকে বারন করতাম এসব বলতে। আর
এখন ওর মৃত্যুটা আমার মনে এমন স্বস্তিকর একটা আমেজ এনে দিল যেন ডাক্তারের বারন
সত্ত্বেও আমি এই মূহুর্তে দশটা পাউরুটি চিবিয়ে খেয়েও দিব্যি সুস্থই থেকে যাব, ইস্ট আমার লিভারের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।
তুবার লাশ
এলে ওরা প্রথমেই ওকে আমার হাতে তুলে দিল পোস্ট মর্টেমের জন্যে। আমার চেয়ে কাছের ওর
আর কেউ ছিল না তো! খুব কোমল হাতে আমি পেঁচিয়ে
নিলাম ওর শরীরটাকে আমার বুকের সাথে। ট্রলিতে যখন শোয়ালাম ওর একটা হাত বাইরে পড়ে
দুলতে শুরু করল। আমার শরীরটাকেও ফুলিয়ে তীব্র একটা কান্নার ঝোঁক ইতিমধ্যেই আমাকেও
কাবু করে ফেলতে শুরু করেছে। আমি আবারো তাকালাম হাতটার দিকে, এই হাত দিয়েই সে অনেকগুলো কবিতার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল মাত্রই
সেদিন। আমি তাই ওর হাতটার উপর খুব বেশী দয়াশীল হতে পারলাম না। এবার আমি তাকালাম
মাকড়শার জালের মত কুঁচো চুলে ঢেকে থাকা গালের দিকে, এখানে আমি হাত ছোঁয়ালাম। এই গাল বেয়েই আমি নামতে দেখেছি ওর বুক উৎসারিত অজস্র
কষ্টের দুই-তিনমুখী ধারা। আমি তাকালাম
ওর চোখের দিকে, বন্ধ দুই চোখে আর কোনো ভাষা
নেই অবশিষ্ট।
ওকে কবর
দিয়ে ফিরে এলাম একেবারে ঠিকঠাক। যেন কিচ্ছু হয়নি এমন এক ভঙ্গিতে আমি কিচেনের
ড্রয়ার থেকে বটল ওপেনারটা বের করলাম আর আসবার সময়ে পাশের দোকান থেকে কিনে আনা
সেভেন আপের বোতলের টিনের মুখটা খুলে ঢকঢক করে গলায় মিষ্টি ঐ পানীয়টুকু চালান করে
দিতে পারলাম অনায়াসে। র্যা কের উপরে নিরীহ চেহারায় পড়ে থাকা তুবার লেখা কবিতার
বইটা হাতে নিয়ে আমি টিভি অন করে এসে ডিভানে গা এলিয়ে দিলাম। বইটা খুলে একটা কবিতার
উপর চোখ পড়তেই আমারো ঠিক তুবার মতই এক আজব অনুভুতি হল। মনে হল, আসলেই তো কি সব ট্র্যাশ লিখত এই মেয়ে! আমি বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আর ওটা গিয়ে পড়ল আমার আর তুবার যৌথ ব্যাবহারের
আলমিরাটার পেছনে। জায়গাটা একটু অন্ধকার, আমি পা দিয়ে ঠেলে বইটাকে আরো ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, ভাল থাকো তুমি এইখানে, ভাল থাকো তুবাপাখি।
রাতে ঘুমাতে
গিয়ে আমার ভয় করতে শুরু করল। এই এক জীবনে আবারো আমি তুবাকে ছাড়া ঘুমাচ্ছি। এবার
আমি পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে শুরু করলাম। মানুষ কি তবে এতই শূন্য হয়? এবার ওর মৃত্যুর আগে সত্যি ভাবিনি যে ও মরে যাবে কিংবা ও মরে গেলে আমার কেমন
লাগবে! আমি তুবার শোকে প্রায় পাগল হয়ে উঠলাম কিনতু একই সাথে ওর না থাকাটাও দারুন শুভ
কিছু বলে মনে হতে থাকল। আমি মুখ-হাত ধুয়ে
মুখে ক্রীম ঘঁষতে ঘঁষতে যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন ছোট একটা ধাক্কা খেলাম
বুকে। আয়নায় প্রতিফলিত তুবার দিকে তাকিয়ে আমার আবারো কান্না পেল। বললাম, ‘কেন, কেন তুমি এভাবে নিজেকে হত্যা করলে? বারবার আমি কত একা হয়ে যাই বোঝো না তুমি?’ আয়নার ভেতর থেকে ও হাসল, বলল, ‘আমি আবার জন্মাব। তুমি তো জানোই এভাবে কতবারই না আমি মরেছি, ফিরে কি আসিনি? তুবা তো বারবার মরে
জন্মাবার প্রয়োজনেই, তুমি তা জানো।‘ আমি বললাম, ‘দয়া করে এর পরেরবার একটু
স্থিরমতি হয়ে জন্মিও, শরীরে নারী অন্তরে ক্লীব
হয়ে আর জন্মিও না প্লীজ।‘
২
তুবাকে ছাড়া
থাকাটা এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। এখন আর আগের মত নিজেকে শূন্য শূন্য
লাগে না। অন্যান্যবার ওর মৃত্যুর পর নিজের গরজেই আমি ওকে ফিরে আসবার আহবান জানাতাম।
এবারে আর তেমন কিছু হল না। আমি মনের সুখে ঝাড়া হাত-পা হয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। এখন আর কবিতা পড়ি না কোথাও। অথচ আগেরবার
ও গান ছেড়ে দিয়ে যখন মরেছিল আমি তখন ওর গান শুনবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠতাম। আর সে
কারনেই পরবর্তীতে ও কবিতা সাথে নিয়ে ফিরেছিল। দুধের সাধ ঘোলে মেটাবার মত করে আমিও
কবিতার গ্লাসে মুখ রেখে চুমুকে চুমুকে সুখ পান করে যেতাম। এবার ফিরলে কি নিয়ে
ফিরবে, এই ভাবনাটা মাথায় আসামাত্রই আমি সেটাকে উড়িয়ে দিলাম সামনের কানা গলিটার দিকে।
তারপরও ভেতর ভেতরে একটা অপেক্ষা যেন থেকেই গেল, তুবার ফিরে আসবার অপেক্ষা।
তুবাবিহীন
একটা জীবন পার করে দিতে দিতে এবং নানা জায়গা ঘুরে বেড়তে বেড়াতে হঠাৎ একদিন মনে হল
তুবার কবরটা দেখিনি বহুকাল। যখন ওর কবরের কাছে পৌঁছুলাম তখন দুপুর প্রায় শেষের
দিকে। দেখলাম সব ঠিক তেমনি করে সাজানো আছে। সেই ওর চুলের কাঁটা, সেফটিপিন, মন খারাপের বিষন্ন পোষাক সব
সবই আছে পরিপাটি। ভাবলাম, এখানে কি চোর টোর নেই? পরমূহুর্তেই মনে হল, এমন শূন্য মানুষের জিনিষে
হাত ছোঁয়াবে কে? ওর কবরের উপর শুধু পড়ে আছে
কিছু শুকনো পাতা আর ঘাসগুলো উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার হাঁটু অবধি। নিজেকে কেমন
অপরাধী মনে হল। আমার তো আরো আগেই এখানে আসা উচিত ছিল। যে তুবাকে ছাড়া একটা মূহুর্ত
আমার কাছে ছিল অচল সেই তুবাকে ছাড়া কিভাবে পার করে দিচ্ছি এতগুলো সময়? আমি নিঃশ্বাস ফেলে একমাত্র বন্ধুর কবরের আগাছাগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
সবগুলো ঘাস
উপড়ে ফেলে আর শুকনো পাতাগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে আমি কবরটায় মোটামুটি সুস্থ
পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলাম। তারপর ক্লান্তি দূর করবার জন্যে ওখানেই বসে পড়লাম।
বিকেলটাও শেষ হয়ে আসছে আর আমার শরীর জুড়ে কেমন অবসাদ। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম, আহা সেই উচ্ছল তুবাকে কতদিন দেখিনি! এটা মনে হতেই আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তুবার মাথার কাছ থেকে গায়ে গায়ে লেগে
থাকা জমাট বাঁধা শক্ত মাটির ঢেলাগুলো দৃঢ়হাতে সরাতে শুরু করলাম। বেশীদূর খুঁড়তে হল
না, আমি দেখলাম ঘুমন্ত তুবার অতৃপ্ত তাজা মুখ। আমি আবারো নতুন করে শোকাভিভূত হয়ে
কাঁদতে শুরু করলাম। গলা পর্যন্ত মাটি সরানো হয়েছে, আরো সরাতে মন চাইল। ঠিক তখুনি তুবা, ওহ- তুবা চোখ মেলে চাইল। আমরা চোখে চোখে তাকিয়ে থাকলাম এক সেকেন্ড। আমার চোখ তখনো
ভেজা আর ওর ঠোঁটের কোণে প্রত্যাশার ছোট্ট এক টুকরো হাসি। আমিও হেসে ফেললাম কিনতু
তখন তুবার চোখে ফুটল বিরক্তি। আমার মনে পড়ল, এই সেই মেয়ে যে কিনা বিষন্নতার মালা গেঁথে গেঁথে আমার জীবনটাকেও বিষিয়ে
তুলেছিল। মনে মনে ভাবলাম, আজ কোথায় তোমার সেই
ছেলেমানুষী অহংকার?
ঈশান কোন
থেকে ছুটে আসা বাতাসে আমি দেখলাম একখন্ড মানবাকৃতির মেঘ নীচে নেমে আসতে শুরু করেছে, যীশুখ্রিষ্ট যেভাবে ভেসে ভেসে চলে গিয়েছিলেন আকাশের দিকে ঠিক তেমনি করে এই
মেঘটাও সোনালী হয়ে নেমে আসছে আমারই দিকে। আমি আর বেশী ভাবতে চাইলাম না। একটু আগে
আলগা করে ফেলা মাটিগুলোই কাঁপা কাঁপা হাতে কবরের ভেতর ছুঁড়ে দিতে লাগলাম, আমি চাইলাম ওকে আবারো মাটির নীচেই প্রোথিত করতে। প্রথমে তুবা একটা বিষ্ময়সূচক
শব্দ করল আর তারপরই ওর চোখ থেকে একটা একটা করে কচুরীপানার ফুল লাফিয়ে পড়তে লাগল ওর
কানের পাশের মাটিতে। মাটির সবচেয়ে বড় চাকাটা ওর চোখের উপর ফেলতেই চলে গেল আমার সকল
অস্বস্তি। আমি মাটিগুলোর উপর হাত রেখে আবারো কাঁদতে শুরু করে দিলাম। মেঘটা ততক্ষনে
আমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধুয়ে দিতে লাগল সকল মলিনতা। আমি দেখলাম মেঘজল আর মাটির
মাখামাখিতে কখন আমার হাত থেকে একটা মানুষের মূর্তি ভাস্কর্য হয়ে ফুটে উঠতে শুরু
করল তুবার কবরের উপর।
ভীরু, কোমল আমি এবার বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম তুবার সেই পরিচিত অহংকারী আর
উন্নাসিক ভঙ্গিটিকে সাথে নিয়ে।