>

অলোক ভঞ্জ।

SongSoptok | 8/10/2014 |
                   মানুষ বনসাই



বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে - গাছেরাও প্রকৃতিতেই সুন্দর, অপ্রাকৃতিক অবস্থায় নয় গাছেদের এইরকম অপ্রাকৃতিক অবস্থার পরিণতিই বোধহয় বনসাই নামে অভিহিত  বনসাই এর অর্থ ট্রি ইন পটঅর্থাৎ পটের গাছ, পটের বিবিরই মত, যা শুধু সৌন্দর্য বর্ধন করে বনসাইকে গাছ বললে হয়তো একটু ভুল বলা হয়, বনসাই এর মধ্যে গাছের সৌন্দর্য থাকলেও গাছের উপকারিতা তেমন নেই, নেহাৎ ঘর সাজানো ছাড়া দোষটা বনসাই এর নয়, পুরো কৃতিত্বটাই তাঁর যিনি বনসাই বানিয়েছেন বনসাই গাছে ডালপালা থাকে, ফুলফলও থাকে তবুও অনেক কিছুই যেন নেই - নিজের খেয়াল খুশিতে বেড়ে ওঠা নেই, ফুলফলের বাড়বাড়ন্ত নেই, স্নিগ্ধ ছায়া নেই, সর্বাপরি - বিনাশ হওয়ার পরও অবিনাশী হয়ে বেঁচে থাকার কোন সুযোগই নেই

আজকাল মানুষও বনসাই হয়ে যাচ্ছে বা যেতে বসেছে দৈহিক বাড়বাড়ন্ত হলেও মনের দিক থেকে আমরা বনসাই হয়েই রয়ে যাই শিক্ষা-দীক্ষা, প্রেম-ভালবাসা, মায়া-মমতা সবই আছে, কিন্তু বনসাই গাছের শোভাবর্ধনকারি দু-একটি ফলফুলেরই মতো - হাতে গোনা, নিক্তিতে মাপা   গাছ বেড়ে উঠে প্রকৃতির নিয়মে, প্রয়োজন বলতে শুধূ একটু মাটি, সঙ্গে সামান্য জল-হাওয়া-বাতাস - সবই প্রকৃতি থেকেই পাওয়া তবে বেড়ে ওঠার জন্যমাটিছাড়াও যেমাএবংমানুষএর সাহায্য এবং সহানুভূতির প্রয়োজন সেটা মমতাদিদি বুঝলেও গাছেদের হয়তো জানা নেই, বা জেনেও করার তেমন কিছুই নেই, কারন ওরা মানুষের মতো প্রতিবাদ করতে পারে না তাই গাছেরা আমাদের এত কিছু দেওয়ার পরও মানুষ তাদের উপর নির্যাতন করে, এমনকি কেটে ফেলতেও কসুর করে না যদি মানুষের অগনিত হত্যাকান্ডের মূল কারণ নিয়ে কখনো বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে হয়তো দেখা যাবে বেশির ভাগ হত্যার পেছনে থাকে আক্রোশ কিম্বা প্রতিহিংসা, অথচ মজার ব্যপার গাছেদেরকে হত্যা করার পেছনে কিন্তু পুরোটাই লোভ - আক্রোশ কিম্বা প্রতিহিংসার কোন অবকাশই নেই     

আর এই বনসাই করণ - গাছেদের নির্যাতনেরই আর এক নামান্তার, জোর করে পঙ্গু করে দেওয়ারই সামিল গাছের শাখাপ্রশাখাকে তারের বেড়ী দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখে তার ডালপালাকে ছেঁটে ফেলে তার বাড়বাড়ন্তকে জোর করে আটকে রেখে বামন বানিয়ে ঘর সাজানোর সামগ্রী করে তোলা যেন সেই তথাকথিত অসাধু ছেলেধরার বাচ্চাদেরকে হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষে করানোর মতই ব্যবসায়িক অভিপ্রায় যে গাছ একদিন বড় হয়ে অনেক মানুষের ফলফুলের যোগান দিত পারতো, কিম্বা ক্লান্ত মানুষের কাছে স্নিগ্ধ ছায়া হয়ে দাঁড়াতে পারতো সে গাছকেই বনসাই হয়ে মাত্র একটি পরিবারের সৌন্দর্য সামগ্রী হয়ে রয়ে যেতে হয়   

মানুষের জীবনও প্রকিতির নিয়ম মেনেই চলে, নিজের খেয়াল খুশিতে বেড়ে উঠতে চায় দয়া-মায়া, প্রেম-ভালবাসা, সততা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ সবই যেন জীবনের এক-একটি শাখাপ্রশাখা, সময়ের সাথে সাথে তা বিকশিত হতে চায় কিন্তু আমরা তাকে বেঁধে ফেলে, ছেঁটে ফেলে বনসাই বানিয়ে ফেলি বা ফেলতে চাই আমরা সবকিছু যে জেনেবুঝে করি, তা নয় - অনেক সময় আমাদের আচার ব্যবহার শিশুর মানসিক বিকাশের ডালপালাকে অজান্তেই ছেঁটে ফেলে, যা আমরা টেরও পাই না  এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল,
একটি বাচ্চা স্কুল থেকে তার সহপাঠির পেন্সিল, রাবার চুরি করে নিয়ে আসার পর বাড়িতে জানাজানি হাওয়ায় মা খুব বকাবকি করেন মায়ের তিরস্কারই হয়তো ভবিষ্যতে শিশুটির সততার ডালপালাকে মেলে ধরতে সাহায্য করতো কিন্তু তারপর মা যখন চেঁচিয়ে বলে উঠেন, দিনদিন তোমার স্বভাবটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে, সব কিছুই বেশি বেশি চাই - আমি অফিস থেকে এত পেন্সিল, রাবার এনেদি তাতেও তোমার মন ভারে না তখন মায়ের কথাটাই শিশুটির সততার ডালপালাকে মনের আজান্তেই ছেঁটে ফেলে তার বনসাইকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে

এই রকম উদাহরণ ভুরিভুরি, ছেলে নিয়ম মেনে টিকিটের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আর বাবা বলছেন কি এতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছিস দশটা টাকা দিয়ে পাশ থেকে কেটে নে সত্যি এই না হলে পিতা - পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, কত সহজে মূল্যবোধের ডালপালাটাকে কেটে ফেলা হোল  পাশের বাড়ির সহপাঠি স্কুলের হোম-ওর্য়াক এর ব্যাপারে জানতে এসেছে, ছেলে খোলা মনে বন্ধুকে সব বলে দেয়, পরে মা বকাবকি করেন, তোর সব কিছু বলার কি দরকার ছিল, সব জেনে নিলে তুই আর ফাস্ট হতে পারবি না এবার বন্ধুত্বের গজিয়ে ওঠা ডালপালাগুলোকে একটু ছেঁটে দেওয়া হোল

এই যে বিভিন্ন জনসভার নানান মঞ্চে পুরুষরা নারী স্বাধীনতার জন্য গলা ফাটিয়ে লেকচার দিয়ে বেড়ায় আর বাড়ি ফিরে বউকে বলে আমার কথাই শেষ কথা, না পোষাl চলে যাও কারণ সেই একই, মুখে যাই বলি না কেন, আসলে কিন্তু মন থেকে চাই নারী স্বাধীনতার শাখাপ্রশাখাকে ছেঁটে ফেলে তাকে বনসাই বানিয়ে ঘরের মধ্যে সাজিয়ে রাখতে 

এবার প্রেম-ভালবাসার কথায় আসি - মানুষের জীবনে প্রেম-ভালবাসা অনেকটা ফুলফলেরই মত পরিপূর্ণতার এক অমোঘ নিদর্শন পরিণত বৃক্ষ যেমন অগণিত ফুলেফলে সেজে উঠতে চায়, ঠিক সেইভাবে আমাদের জীবনও অফুরন্ত প্রেম-ভালবাসায় ভরে উঠতে চায়, কিন্তু আমরা যে বনসাই হয়ে থাকতে চাই প্রেম-ভালবাসা সবই থাকবে কিন্তু তা শুধু শোভাবর্ধনের নিমিত্তে, দু-একটি ফুলফলে সুসজ্জিত হয়ে, তাই তার বাড়বাড়ন্তকে বেঁধে রাখতেই হবে, প্রেমের জোয়ারে ভেসে যেয়ে তাকে কোন মতেই বিকশিত হতে দেওয়া চলবে না, যা শুধূ ভ্যলেন্টাইনস ডে কিম্বা ফ্রেন্ডশিপ ডে উদযাপনের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবে  

আগে একটা কথা ছিলবিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর” – এখন মানুষ মেলাতে চায় না, বরং তর্ক জিইয়ে রাখতে চায়, তাই অগাধ বিশ্বাসের কোন প্রয়োজন নেই, বনসাইয়ের মত শো-পিস হিসাবে একটু-আধটু থাকলেই চলবে

পরিশেষে দয়া-মায়া, মানবিকতার প্রসঙ্গে আসি -   স্কুল থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় আহত পথচারীকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে বাড়ি ফিরতে ছেলের দেরী হাওয়ায় মা-বাবা যখন বকাবকি করে বলেন - তোমার এত দরদ দেখিয়ে মাতব্বারি করার কি দরকার ছিল তখন ছেলেটির সদ্য গজিয়ে ওঠা মানবিকতার কচিপাতাগুলো মনের অজান্তেই খসে পড়ে  দেশের বর্তমান হিংসাত্মক কা্র্য্যকলাপ শিশু মনে দয়া-মায়ার কোমল ডালপালাগুলকে নষ্ট করে নিষ্ঠুর বানিয়ে দেয় তাইতো এখন সরষের তেল ছাড়া আমাদের চোখে আর জলই আসে না, তাও আবার সুনীলবাবুর চোখে জল আনার মত খাঁটি হওয়া চাই

একান্নবর্তী পরিবার, পুরনো সংস্কৃতি সামাজিক ঐতিহ্য মানুষকে বেঁধে রাখতে চায়, তাই সেই মূল শেকড়গুলিকে সযত্নে ছেঁটে ফেলে মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক বানানো খুবই জরুরী এটাও বনসাইকরণ প্রক্রিয়ার  অন্যতম অঙ্গবিশেষ, যাতে করে সে শুধুমাত্র একটি পরিবারের সৌন্দর্য সামগ্রী হয়ে বিরাজ করতে পারে এইভাবেই জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সততা, মানবিকতা, মূল্যবোধ, মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা, বিশ্বাসের সবরকম শাখাপ্রশাখা ডালপালাগুলো ছাঁটা পড়তে পড়তে মানুষ একদিন বনসাইএ রুপান্তরিত হয়, আর তারই রূপে মুগ্ধ হয়ে আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব তাকে সংসারের বৈঠকখানায় বনসাই এর মতো সাজিয়ে রেখে বিকিকিনির আসর বসায়       

কথায় আছেঅতি বড় হয়ো নাকো ঝড়ে পড়ে যাবে”, সেইজন্য আজ আর কেউ বড় মানুষ হতে চায় না আবার ছোট হয়ে থাকার ঝামেলাও আনেক, ছাগলে মুড়িয়ে খাবার সম্ভাবনা থাকে, তাই বনসাই হয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে সুরক্ষিত থাকাই শ্রেয় আধুনিক জীবনযাত্রার এই ইঁদুরদৌড়ে আমরা সবাই বনসাই মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে সাঁই-সাঁই করে ছুটে চলেছি, মনের সায় থাক বা না থাক তাই মাঝে মাঝেই সেই আত্মগ্লানি আমাদেরকে তাড়িয়ে বেরায়, আর মনে হয় সত্যিই আমরা বৃক্ষ হতে পারিনি, বনসাই হয়েই রয়ে গেছি   





Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.