চাঁদের পরিক্রমণ
“৬”
সকাল থেকে চাঁদ বইগুলো খুঁজে চলেছে , পাচ্ছে না...অথচ এন.ডি.ভাটের ড্রয়িং আর এম.কুরির স্ট্রাকচারের বই দুটো কোথায় যে রেখেছিল মনেই পড়ছে না.....বুক শেল্ফ গুলো সবই প্রায় দেখা হয়ে গেল....বাকি আছে পুরোনো বইয়ের তাকটা....ঐ তাক থেকে বইগুলো একটু নামিয়ে দেখতে পারলে ভালো হত...।
.......তাকের পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে চাঁদের চোখ এড়ালো না অবন ঠাকুরের হাতে আঁকা বইটা....আর তার পাশের পুর্ণেন্দু পত্রীর' একশো প্রেমের কবিতা'র বইটা । অবন ঠাকুরের বইটা খুলতেই চোখে পড়ল লেখাটা...."আমার জন্মদিনে আমি.....9.9.1999"....লেখাটা দেখে চাঁদ একটু হাসল....কবিতার বইটা খুলে একটু পাতাগুলো নাড়াচাড়া করতেই সব ওলোট পালোট হয়ে গেল... ।... মনে পড়ে গেল সেই চরম অধ্যায় ... ।
....সেই সেদিনের কথা...যেদিন সোহম তাকে রঞ্জার কথা বলেছিল.....সেদিন ড্রয়িং ক্লাসে ভুল সায়োগ্রাফি করায়...নবনীতা ম্যাম খুব বকেছিল চাঁদকে ....টিফিনের পর ক্লাস করতে আর ভালোই লাগছিল না...কেমন যেন মনটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল....তার কেটে যাচ্ছিল ....চাঁদ বেরিয়ে এল ক্যাম্পাস থেকে.... । রঞ্জা খুঁজতে এলো যখন জুন বলল....'ওর শরীর খারাপ লাগছিল তাই বেরিয়ে গেছে , রঞ্জাদি ।' রঞ্জা সোহমকে জানালো .....কথাটা শোনামাত্রই কেমন যেন অস্বস্তিটা বেড়ে গেল সোহমের....একে তো আসার পথে রঞ্জার সাথে সম্পর্কের কথাটা বলেছিল চাঁদকে....তার ওপর আগামী এগারোটা দিন দেখা হবে না ....কারণ সোহমের এন. সি.সি ট্রেনিং ফোর্ট উইলিয়ামে.... তাই চাঁদ কিছু ভুল বুঝে থাকলে ,সেটা ভাঙাবে কেমন করে!
......ওদিকে চাঁদ কলেজ থেকে একাই ফিরে এসেছিল দুপুরবেলা । মেঘলা আকাশ....ঝোড়ো হাওয়া....বিকেলের ম্লান আলোয় চুরি গিয়েছে রোদের দাপট....ভরা ভাদ্রমাস.....কিন্তু বৃষ্টি সঙ্গ ছাড়ে নি ।সন্ধ্যের মুখে আকাশ ভেঙে ভীষণ বৃষ্টি....প্রকৃতির আচরণে যেন এক তীব্র প্রতিবাদ....কি যেন এক অস্হিরতার পরিসমাপ্তি....অধীর আগ্রহে সোহম একটা ফোনের অপেক্ষা করছিল....ফোনটা নিজে থেকে করতে একটু ইতস্ততই করছিল.....ঠিক এমন সময় চাঁদের ফোনটাই এলো.....
হ্যালো....
ফোনের ওপারে নিস্তব্ধ চাঁদ আর রবীন্দ্র সংগীত ....'আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে/জানি নে ,জানি নে/কিছুতে কেন যে মন লাগে না.....'....সোহম জিজ্ঞেস করল 'কিরে গান শুনছিস....আজ হঠাৎ চলে এলি কেন ক্লাস ছেড়ে ?'
চাঁদ: মাথা যন্ত্রণা করছিল ।
সোহম: সত্যি???
চাঁদ: হুম
সোহম: ফিরে এসে কি করলি...ঘুমোলি?
চাঁদ: না, কবিতা পড়ছিলাম ।
সোহম: কার লেখা ?
চাঁদ: পুর্ণেন্দু পত্রী ।
সোহম: একটা কবিতা বল শুনি..
চাঁদ: থাক না আজ....পরে কোনোদিন বলব...
সোহম: আজ এত মেপে কথা বলছিস কেন !....আগে তো কত লেখা আমরা দুজনেই পড়ে শুনিয়েছি....বল না প্লিজ... ।
চাঁদ: (একটু চুপ করে থেকে) ....
সেই ভালো , শুধু শব্দে থাকো ।
সম্বোধনে, শুধু উচ্চারণে
তোরঙ্গে যেমন থাকে
তোলা শাড়ী পরিপাটি ভাঁজে,
সর্বাঙ্গের ভাঁজে সে থাকে না ।
খাম ও চিঠির মধ্যে
যেরকম অঙ্গাঙ্গি ও স্পষ্ট আলিঙ্গন
সেরকম তোমাকে পাব না ।
গমনাগমন বন্ধ
ভেঙে দাও সান্নিধ্যের সাঁকো ।
সেই ভালো ,শুধু শব্দে থাকো ।
চাঁদের এই কবিতায় সোহমের আর বুঝতে বাকি রইল না কিছুই ....অদ্ভুত একটা অজানা দমবন্ধ করা অনুভুতি নতুন করে ঘিরে ধরলো সোহমকে....বেশ কয়েকটা মুহূর্ত দুজনেই চুপ থাকার পর ....সোহম বলল 'আমাদের একসাথে যাতায়াতটা বন্ধ করতে হবে চাঁদ....সত্যি বলতে আমিও বোধহয় তরল হয়ে যাচ্ছি .....রঞ্জাও আমার প্রতি কেমন যেন শীতল হয়ে যাচ্ছে ....তুই পারবি না চাঁদ সব ঠিক করে দিতে....তোর কাছে তো সব কিছুর জবাব তৈরি....?'
চাঁদ: নিজের সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ না করাই ভালো.......ও ভাবে ভাবাটা বন্ধ কর ।
কয়েকটা কথা বলি ওম্...রঞ্জাদিকে যথেষ্টই আকর্ষক লাগে ...আর তুই ওকে উদ্ধার করার মানসিকতায় সম্পর্ক তৈরি করেছিস ....এটা বোঝাতে যাস না প্লিজ....ভালোবাসায় সুন্দর অসুন্দর বলে কিছু হয়না ....আর আমি ...মোটেই তোর প্রেমে পড়িনি....হ্যাঁ যেটা হয়েছিলো .....সেটা ইনফ্যাচুয়েশনস.....তার জন্যে কেউ কেঁদে ভাসায় না বা বন্ধুকে এড়িয়ে চলে না...একসাথে যেতে না চাইলে যাবি না....কিন্তু নিজের কাছে নিজে কি চাস সেটা যদি পরিষ্কার থাকে , তাহলে আমার মনে হয় সম্পর্কের রূপরেখাগুলোর কোনো পরিবর্তন হয় না ।
সোহম চুপ করে কথা গুলো শোনে....তারপর বলে...' যাক অনেক বকেছিস....আর নয়...তোকে একটা দায়িত্ব দিলাম...আমার আর রঞ্জার মাঝে যদি কেউ বোঝাপড়া করার অধিকার রাখে তো সে কেবল তুই....পারলে ওর কমপ্লেক্সটা কাটাতে চেষ্টা করিস....আর সামনের এগারোটা দিন কোনো কথা তো হবে না...ভালো থাকিস....নিজের আর রঞ্জার দুজনেরই খেয়াল রাখিস...আমি ফিরে জানাব ।
চাঁদ: নিশ্চয়ই ....তুই সাবধানে থাকিস...রাখছি বাই ।
....ফোনটা কাটার পর চাঁদ চুপচাপ খাটে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ । ....ভাবতে থাকল.....সময় বড়ো অদ্ভুত ...সময় বয়ে যায়...সাথে সাথে সম্পর্কও ...যে মানুষটা একদিন সবচেয়ে কাছের থাকে ,সময়ের ঘাত প্রতিঘাত তাকে কেমন ভাবে যেন দূরে ঠেলে দেয়...চাঁদ আর ওমের মাঝে একটা নদী বয়ে যাবে অথচ মধ্যবর্তী কোনো সাঁকো নেই যে হাতটা বাড়িয়ে ধরবে....কেন যে জীবনের সব অঙ্ক মেলে না?....তার কোনো উত্তর নেই!...এরপরও পরস্পর মুখোমুখি হবে কিন্তু চাঁদ কিছুতেই তার অভিব্যক্তির আঁচ বুঝতে দেবেনা....যে চাঁদ অভিনয় এড়িয়ে চলতে চায় সারাজীবন .....সময় তাকে বারবার সেই অভিনয়ের সাথেই অভ্যস্ত হতে বাধ্য করে....হঠাৎ করে তার নিজেকে ভীষণ একা লাগল....সে এই কথাগুলো কোনওদিন কাউকে বলে হালকা হতে পারবে না...বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ ....কিন্তু চাঁদের ভিজে চলা তো আজ থেকে শুরু....খুব রাগ হল তার বেয়াদপ মনটার জন্যে ...কোন অসতর্ক মুহুর্তে সে এমন কাঠিন্যের বেড়া টপকে ফেললো কে জানে? যার মাসুল আজ তাকে এমনভাবে দিতে হচ্ছে .....আর কেউ না জানুক, জানলার বাইরে উজিয়ে থাকা, একফালি রম্বসের মত শিফন আকাশটাই কেবলমাত্র তার সাক্ষী হয়ে রইল ।
.......পরদিন কলেজে রঞ্জাদিকে দেখে একরাশ অভিমান জোড়ো হচ্ছিলো ....তারপর চাঁদ নিজেকে একটু শাসন করল...রঞ্জার ওপর তার বিরক্তি বা রাগের কোনো কারণ থাকা উচিত নয়...তবে কি হিংসে ...না সেটাও উচিত না...যার যেটা ডেস্টিনি......॥
রঞ্জা: কিরে আজ এত চুপচাপ ...? মনখারাপ?
চাঁদ: আমি তো জানি , মন তোমার খারাপ !
রঞ্জা: মানেটা কি??
চাঁদ: (একটু হেসে)...মানেটা তুমি জানো না বলতে চাও...কিন্তু আমি তো জেনেই বলছি ।
রঞ্জা: ও বাব্বা!!!!....তোকেও বলা হয়ে গেছে!!
চাঁদ: হুম...শুধু তাই নয় তোমার দেখভাল করতে বলেছে...বুঝলে...আপাতত আমি তোমার লোকাল গার্জেন ।
রঞ্জা: বুঝলাম ....আর কি বলেছে শুনি?
চাঁদ: বলেছে অনেককিছু....বলব কেন ,সব কথা...?
রঞ্জা: বল না প্লিজ....আমার মতো এরকম একটা মেয়ের সাথে কিভাবে সম্পর্ক হল ...বলে নি তোকে....?
চাঁদ: একদম চুপ....'তোমার মত মেয়ে '....কথাটার মানে কি?...তোমার কিসের এত কমপ্লেক্স আমি বুঝি না...ইউ আর টু ব্রাইট ইন অল রেসপেক্ট.....
রঞ্জা: বুঝেছি তোকে এটাও বলেছে....তুই বুঝবি না চন্দ্রিমা...আমার সাথে আগে যার সম্পর্ক ছিল...আমি তাকে সবরকম ভাবে সাপোর্ট দিয়েছি ...বোথ মেনটালি এ্যান্ড ......
চাঁদ: (রঞ্জাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই )....তো কি হয়েছে?...তুমি ভালোবেসেছিলে বলেই তো.....সে যদি তোমায় ছেড়ে যায় তোমার অপরাধটা কোথায়?
রঞ্জা: ....না...তা নয় ....কিন্তু তুই জানিস কিনা আমি জানি না....আমি ওকে সবটা বলেই উঠতে পারি নি....তার আগেই ওকে আঁকড়ে ধরেছি....এক ভীষণ বিপর্যস্ত অবস্থায় ওকে জাপটে ধরে থেকেছিলাম বেশ কিছু সময়....তখন ও আমার কে আমি ভাবতে চাইনি....কিন্তু তারপর থেকে ও আমার ওপর যথেষ্ট দায়িত্ববান...কিন্তু আমার মনে হয় তোর মত কারোর সাথে ওর সম্পর্ক হলে বোধহয় ভালো হত.....॥
চাঁদ ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল ....হয়ত বা পুড়েও যাচ্ছিল ....তবুও জোর করে বলল' না...এইসব বাজে কথা তুমি আর ভাববেও না....বলবেও না...তুমি যা তুমি তাই....ও তোমার সব অবস্থা বুঝেই তোমাকে ভালোবাসে ....সব কথা বলে বোঝাতে হয় না , রঞ্জাদি....তোমার এমন সুন্দর একটা মন ....সেটা কে কেন অপমান কর বারবারে....প্রতিটা মুহূর্তকে বাঁচার মত করে বাঁচো.... ।
রঞ্জা চাঁদকে কেমন যেন এক নির্ভরতার আশ্রয়ে জড়িয়ে ফেলল....তারপর বলল...'আচ্ছা কথা দিলাম তোকে....তোর কথা শুনব....তা তুই বেদুইনে খাওয়াবি কেন?...জন্মদিন?
চাঁদ: তোমাকে , যে বলল তাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন?
রঞ্জা: সোহম তো জানে না বলল...আমি বলি কি...ও আসলেই খাওয়াস...
চাঁদ: হুম....তাই ভেবে রেখেছি...ও আসুক আগে....তারপরই হবে ।
........এইভাবে বেশ কটাদিন কাটল...রঞ্জা আর চাঁদের গল্পগাছাও বাড়ল....ধীরে ধীরে সোহমের দোষ গুণ আলোচনায় ওর অনুপস্থিতিটা দুজনেই মানিয়ে নিয়েছিল ওদের নিজের মত করে ।
......আজ চাঁদের জন্মদিন....চাঁদের বাড়িতে জন্মদিনের উৎসব বারণ....তাই মা দিনের দিন কিছুই করেন না....শুধু ওর একটু পছন্দ মত রান্না হয় বাড়িতে....গত দুবছর ধরে চাঁদ বন্ধুদের সাথে একটু ঘোরাফেরা করে....বাবা আপত্তি করে না । ...সকালে চাঁদ কলেজে যাবে বলে বেরিয়েও গেল না...গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শনী তে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখল......একটা অবন ঠাকুরের আঁকার বই কিনল....দুপুরে কিছু খাবে বলে একাডেমীর সামনে এসে 'নাথবতী অনাথবত'...এর টিকিট কেটে থিয়েটার দেখল একা একা....তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল চার্চের ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল....চার্চের শান্ত সমাহিত পরিবেশে আত্মস্থ হওয়ার চেষ্টা করল চাঁদ....এইভাবে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার পর বাড়ি এল চাঁদ.....সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি....বাড়ি ফিরতেই মায়ের হুকুম ....দিদা....বড়পিসি....ভাইয়া ফোন করে পায়নি চাঁদকে ....তাই ওদেরকে পাল্টা ফোন করতে হবে....চাঁদ জানে এখন খাবারের কথা বললেই মায়ের হাজার প্রশ্ন কেন খাইনি....কোথায় ছিলাম...তাই সে কিছু না বলেই নিজের ঘরে গেল....ফ্রেশ হয়ে সবার আগে ব্যাগ থেকে বইটা বার করে লিখল....'আমার জন্মদিনে আমি'....তারপর একে একে ফোন করে কথা বলল সবার সাথে....তারপর চুপচাপ শুয়ে রইল ....ভাবল কত মজা হতে পারত...কিন্তু হল না....কি অবহেলায় একটা দিন কাটাল....উফ যেন একটা মাস ...কি দীর্ঘ !!!
.....এমন সময় রঞ্জাদির ফোন...
কিরে তোর ব্যাপার কি...আজ তো এলিই না কলেজে ....কার সাথে ঘুরে বেড়ানো হল ,বল?...আমরা সবাই বাদ...দাঁড়া সোহম আসুক....বলব...হচ্ছে তোর ।
চাঁদ : আরে না গো বেরোইনি আজ....
রঞ্জা : যাক গে....ছাড় পড়ে শুনব আজ কি করলি....বাই দ্য ওয়ে...আজ তোর জন্মদিনই তো....শুভেচ্ছাটা তো জানাতে দে...
চাঁদ হেসে বলল...' তোমাকে অতো ফর্মাল হতে হবে না....আমি জানি তোমার ওয়েল উইশ আমার সাথে সবসময় আছে....
রঞ্জা: তুই একটা পাগলী....কাল আয় কথা হবে....হ্যাপি বার্থ ডে....বাই
চাঁদ: থ্যান্ক ইউ...বাই...টাটা
....তখন প্রায় ন'টা বাজে...একটু ঘুম এসে গেছিলো চাঁদের...ঘুম ভেঙে গেল মায়ের ডাকে...'চাঁদ আমি চিলিচিকেন আর ফ্রায়েড রাইস বানিয়েছি....একটু পরে নেমে আয়....নীচে'
....চাঁদ বিছানায় উঠে বসল....নীচে নামতে যাবে....ফোনটা বেজে উঠল....
চাঁদ: হ্যালো
-মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে...কিরে আজ খাওয়ালি সবাইকে?
একঝলক খুশি সোহমের কন্ঠস্বরে.....
চাঁদের চোখটা চিকচিক করে উঠল....ভীষণ একটা ভালোলাগায় তার কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল ...বলল 'তুই ? কোথায় ? বাড়ি চলে এসেছিস ?
সোহম:নারে বাবা....ক্যাম্পেই ।
সকালেই করতাম কিন্তু....কখন ফোন করব এটা ভাবতে গিয়েই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম মার্চ পাস্টে....ব্যস কোর্ট মার্শাল হয়ে গেল....এই একটু আগে ছাড়া পেয়েছি ।
চাঁদ: এ বাবা....অত ছটফটানির কি আছে? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি ?
সোহম: না...তবে কেন জানিনা মনে হল তোর ভালো লাগবে ।
চাঁদ: হুম...ভালো তো লাগলো...কারণ আশাতীত....আমি ভাবিই নি ....
বাই দ্য ওয়ে আমি খাওয়াই নি..তুই এলেই হবে ।
সোহম: ওহ গড....কেন?..তুই একটা পাগলী...আচ্ছা রাখছি...কমান্ডার অফিসার এদিকে আসছেন..বাই
চাঁদ: বাই বাই...টেক কেয়ার
.....অদ্ভুত একটা ভালো লাগা তার সারাদিনের কৃচ্ছসাধনের যন্ত্রণাকে এক লহমায় ভুলিয়ে দিল......এবার তার ভীষণ ক্ষিদে পেতে লাগল....নীচে গিয়ে মায়ের গলাটা জড়িয়ে চাঁদ বলল...কই কি বানিয়েছো....দাও আমায়!!!!মা বলল.... ‘ বস, বাবা অপেক্ষা করছে কখন থেকে'....চাঁদ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল....এই তোমার আসার সময় হল ....অফিস থেকে....আজকেও এত দেরী ?'....বাবা বলল 'এবার খেতে বস... পরে ঝগড়া করবি'.... ।
“৭”
লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে চাঁদ আর বৃন্দা । কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে সবেমাত্র বসেছে, বৃন্দার মোবাইলটা বেজে উঠল ।
বৃন্দা বলল: জাস্ট আ মিনিট...চন্দ্রিমা....সুরম্যর ফোন...
চাঁদ: ..ইটস ও কে....ক্যারি অন....টেক ইওর টাইম....
চাঁদ আশপাশটা লক্ষ্য করছিল....সব পড়ুয়ারা নিজেদের মধ্যে হৈ হৈ করছে .....তার মাঝে মাঝে সুরম্য আর বৃন্দার প্রেমালাপের টুকরো টুকরো কথা । চাঁদ চলে যাচ্ছে তার অতীতে । মনে পড়ে যাচ্ছে কলেজ ক্যান্টিনের কথা ।......জন্মদিনের খাওয়াটা সোহম আসার পরই হয়েছিল , তবে ওরা কেউ বেদুইনে রোল খেতে যায়নি.....ক্যান্টিনে চিকেন মোমো খেয়েছিল । সেদিন বেশ হৈ হৈ করেছিল বন্ধুরা । সোহম বলল "আচ্ছা তোকে আমরা কি উপহার দি বলতো, চাঁদ ?"
চাঁদ : উপহারের প্রয়োজনটা কি আছে? আমি তোদের কাছে এই যে হাসি মজা ভালোলাগাটুকু পেলাম.....তাই তো আমার সেরা উপহার ।
সোহম: দেখ, সত্যি বলতে আমি টিউশানে যা হাত খরচা পাই ....তার সবটাই প্রায় ফোনের এক্সট্রা বিল পেমেন্ট করতে চলে যায়....মা বলে দিয়েছে, মাসে নর্মালই যা ওঠে তাই দেবে....এর বেশিটা আমায় দিতে হবে, যেহেতু ফোন ছাড়া আমার চলে না....তাই হাত আমার সবসময় খালি ।
সৈকত: হাত খরচে আমারও কুলিয়ে ওঠে না..... কিন্তু না........ তাও তোকে আমাদের কিছু দেওয়াই উচিত ।
.....এতসব আলোচনার মাঝে দীপা আর রঞ্জা চাঁদকে একটা মনিপুরি ওয়ালম্যাট দিল উপহারে ।
রুদ্র : দেখেছিস মেয়েরা কতটা গোছানো হয়....বাঁচালি বটে আমাদের ।
সবাই খুব হাসল । চাঁদ খুব খুশি হয়েছিল ওদের অকপট সারল্যে।
মনে মনে ভেবেছিল সোহমের উপস্থিতিটাই তো তার সবচেয়ে বড়ো পাওয়া । যদিও চাঁদ এখন সোহমকে কিছুটা এড়িয়েই চলে । ফোনে কথা হয় না...একসাথে ফেরার জায়গাটাই রাখতে চায় না ....আগে আসে আর আগে আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যায় .....সোহম বুঝতে পারে সবই কিন্তু কিছুই প্রশ্ন করে নি কখনও । এরই মাঝে ওদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয়েছে .....রুদ্র আর সোহম এল. এন. টি তে চান্স পেয়েছে...আর সৈকত গ্রুপ থেকে ছিটকে গেল ই.আই.এল এ।
এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছু সময় । হঠাৎ একদিন বাসে মুখোমুখি সোহম আর চাঁদ ।....চাঁদ গড়িয়াহাট গিয়েছিল দীপার সাথে টিফিনের সময় ....আর ভালো লাগছিল না ক্লাস করতে....দীপাকে অটোতে তুলে , ধর্মতলার বাসে উঠেই দেখে সোহম ....ব্যস আর যায় কোথায় ?
সোহম: কিরে আমার পাশের সিটটা তো ফাঁকা ....তাও পরেরটায় বসলি?
চাঁদ: না....গরম লাগছে ...তাই জানলার ধারটা খুঁজছিলাম....বাস তো ফাঁকা !
সোহম উঠে গিয়ে পিছনে চাঁদের পাশে বসল ।
সোহম: আমায় এড়িয়ে চলছিস চাঁদ !!!
চাঁদ: (একটু ইতস্তত করে ) না, সেরকম কিছু না....তবে....
সোহম: কি তবে?
চাঁদ: তুই তো চেয়েছিলি যাতায়াতটা বন্ধ হোক ।
সোহম: হুম ....মুখে অবশ্যই বলেছিলাম কিন্তু মন থেকে চাই নি ।
চাঁদ : ও ....(চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ )
সোহমকে চুপ থাকতে দেখে চাঁদ বলল..." যা হোক , সব ঠিকঠাক আছে তো ? "
সোহম: হুম....তবে রঞ্জার সাথে একটু সমস্যা হয়েছে ।
চাঁদ: রঞ্জাদিকে নিয়ে আবার কি হল?
সোহম: তুই ওর সাথে একটু কথা বলবি?
চাঁদ: কি হয়েছেটা কি?
সোহম: রঞ্জার পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার কথা...কিন্তু এর মাঝে শুনলাম ইন্দ্রদা ওর সাথে যোগাযোগ করেছিল ।
চাঁদ: তো!!
সোহম: না....আমার ধারণা ছিল ও ইন্দ্রদাকে এন্টারটেইন করবে না....কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল....ও এখনও মনে মনে ওই জায়গাটায় বেশ দুর্বল ।
চাঁদ: এমন মনে হল কেন তোর? রঞ্জাদি কিছু বলেছে? কারণ আমি ওকে যতটুকু বুঝেছি তোর প্রতি ও যথেষ্ট দায়বদ্ধ....
সোহম: না আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলি নি ....কিন্তু ও কেমন যেন ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যাচ্ছে চাঁদ ....একটু যেন উদাসীনও ....আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি করব....ও যা চাইবে তাই হবে....কিন্তু ও কি চায় সেটা বলুক তো নিজের মুখে.... ।
চাঁদ: ঠিক আছে আমি কথা বলব রঞ্জাদির সাথে ।
সোহমকে চুপ করে থাকতে দেখে চাঁদ একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলে...." ইন্টারভিউ তো হল, ট্রেনিং কোথায় পড়বে ?
সোহম: জানি না...ফার্স্ট লিস্টে নাম আছে...ওরা একশো পঁচিশ জনের মধ্যে দশ জনকে একেবারে কনফার্মেশন লেটার দেবে...দেখি কোথায় হয়...দূরে হলে মাকে নিয়ে চিন্তা !
চাঁদ বুঝতে পারছিল , যে কঠিন বর্মটা সে তৈরি করে রেখেছিল সেটা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে ....তার খুব ইচ্ছে করছিল তার নিজের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করুক সোহম। সোহমের আনত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল ,সোহম যেন একটু ক্লান্ত ....একটু অসহায় ....চাঁদের মন চাইছিল তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে ....একদৃষ্টে চাঁদ চেয়েছিল সোহমের দিকে...দেখছিল তার চওড়া কপাল , টিকালো নাক, চশমার ফাঁকে আনত চোখ, বলিষ্ঠ চোয়াল....পাতলা ঠোঁট ....জলে ভরে যাচ্ছিল চাঁদের চোখদুটো....জোড় করে চাঁদ মুখটা ফিরিয়ে জানলার দিকে চাইল চোখের জল লুকোতে.....কিছুটা সময় চুপচাপ ....কলকাতার বুকে যানজট এড়িয়ে বাস ছুটে চলেছে....সেই চলন্ত পথের দিকে চেয়ে রইল চাঁদ....হঠাৎ সোহম বলল, "আমি যাতায়াতটা বন্ধ করতে বলেছিলাম ....তার একটাই কারণ ছিল...আমার প্রথম আকর্ষণ আমার মা....দ্বিতীয় আকর্ষণ সিগারেট ...তৃতীয় আকর্ষণ রঞ্জা...আমি আর কোনো আকর্ষণে নিজেকে বাঁধতে চাইনি ।
চাঁদ: মানে....?
সোহম: মানে, ধীরে ধীরে তুইও আমার নেশা হয়ে যাচ্ছিস....রোজকার যাতায়াতে ...কথায় ,লেখায়, হাসি ঠাট্টায় তুই আমাকে আকর্ষণ করছিলি....আমি রঞ্জাকে মনে করতে চাইলেও তুই আমার ভাবনায় চলে আসছিস...আমার অদ্ভুত একটা যণ্ত্রণা হচ্ছে চাঁদ ...তাই তোকে ফোন করাটা কমিয়েছি...চোখের বাইরে তবু ঠিক আছে কিন্তু রোজ চোখের সামনে হলে....আমি নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে যাচ্ছি।
চাঁদ চুপ করে রইল অপরাধীর মত....কিন্তু তার মনে হতে লাগল একবার সোহমকে আঁকড়ে ধরে সে যদি বলতে পারত...তারও এখন আর কিছুই ভালো লাগেনা...জীবনের সব আনন্দ কেমন যেন হারিয়ে গেছে...সব কিছু বেরঙিন হয়ে গেছে....কিন্তু এসব কিছুই সে বলতে পারল না! শুধু মুখ নিচু করে রইল ।
সোহম : কিছু বলবি না?
চাঁদ: নাহ! আমার কিছুই বলার নেই । তোর চাওয়াটাকে সম্মান করি । তুই চেয়েছিস ফোন কমাতে...যাতায়াত বন্ধ করতে ...করেছি তো ।আর এখন বলেছিস রঞ্জাদির সাথে কথা বলতে...বলব ।
সোহম: তোর নিজের কোনো চাওয়া নেই?
চাঁদ: না...
সোহম: কেন ?
চাঁদ ক্ষয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে ....তবুও অসম্ভব কাঠিন্য বজায় রেখে বলল..." আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি ,আমি তোর প্রেমে পড়িনি...তাই তোর আমার ব্যাপারে কি কি হল তাই নিয়ে আমার আর কি বলার থাকতে পারে ।এসব সিলি ইমোশনের কোনো মূল্য নেই ।তুই রঞ্জাদিকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারিস না ।"
সোহম: তুই নিজেকে আড়াল করতে চাইছিস কেন চাঁদ ? আজ যদি সত্যিটাকে অস্বীকার করিস তাহলে সারাজীবন পালাতে হবে জেনে রাখ!!
চাঁদ: এত সত্যি মিথ্যে বুঝিনা ওম....আমার জন্যে তোদের সম্পর্কে চিড় ধরুক আমি চাই না...এটা হতে দেব না...আমি বলেছি তো আমি রঞ্জাদির সাথে কথা বলব....আপাতত আমার আর কিছু বলার নেই ।
....চাঁদের এই আপাত কঠিন চেহারাটার পিছনে যে আবেগ ...যে যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল তা বোধকরি সোহম বুঝে উঠতে পারল না ।
সোহম: তোকে আমার আজ বড়ো অচেনা লাগছে । আমি তো ভেবেছিলাম যদি রঞ্জা চায় ইন্দ্রদার কথা ভাবতে আমি সরে আসব....বাধা দেব না...কিন্তু তখন তুই আমার পাশে থাকবি তো চাঁদ?
চাঁদ: ইউ জাস্ট স্টপ অল দিজ ননসেন্স....আমি আমার মত..আমি কারও বিকল্প হতে চাই না । আমার অ্যাটাচমেন্টে বড় ভয় ওম...সম্পর্কের বোঝাপড়ায় যে কষ্ট , আমি তার একধাপ আগেই কষ্টটা বইতে পারি তাতে কষ্টের বোঝাটা একটু কম হয় । আর তাছাড়া আজ রঞ্জাদির পরিবর্তে আমি...কাল আমার পরিবর্তে যদি অন্য কেউ .......
সোহম চাঁদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অদ্ভুত একটা রাগে চাঁদকে থামিয়ে দিয়ে বলল "ব্যস অনেক বলেছিস...আর নয়...আর একটা কথা বলি, তুই ভুলেও আর রঞ্জার সাথে কথা বলবি না....ওটা অ্যাবসলিউটলি আমাদের ব্যাপার ....আমাদের মাঝে তোর তো কোনো জায়গাই নেই.....আমার ই ভুল ....রাস্তার সম্পর্ক রাস্তায় রাখাই ভাল....তাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া বোকামি.... ।
চাঁদ: রাস্তার সম্পর্ক ? হোয়াট ডু ইউ মিন ?
সোহম: ইয়েস আই মিন ইট । তুই ভুলেও আমাকে আর ফোন করবি না...ভুলেও আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না...কলেজে দেখা হলে আর পাঁচটা জুনিয়ারের সাথে যতটুকু কথা হয় তোর সাথেও তাই হবে....দ্যাটস এনাফ ফর ইউ।
.....এই কথা বলে সিট ছেড়ে উঠে পড়ল ওম....বাসটা থামতেই রাসবিহারীতে নেমে পড়ল সোহম । অপমানে চাঁদের চোখ জলে ভরে গেল । তবু স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ....সোহম ভিড়ে মিশে গেল....বাস ছেড়ে দেওয়ার মুখে চাঁদ ভাবল , একবার কি নেমে যাবে সে? ছুটে গিয়ে ওমের হাতটা ধরে বলবে কিভাবে রাতের পর রাত সে নির্ঘুম কাটায়....তারপর ভাবল ভালোই হয়েছে যা হয়েছে....কি অবলীলায় সোহম বলল....রঞ্জা না হলে চাঁদ...স্বার্থপরের মত শুধু নিজের কথাই ভাবল ওম...রঞ্জাদির সাথে সব মিটে গেলে তখন ভুলেও চাঁদকে মনে পড়বে না হয়ত তার....চাঁদ যে একা সেই একাই থাকবে.....। ভীষণ অস্হির লাগছিল চাঁদের ....রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর ।
বাড়ি এসে তার কিছুই ভালো লাগলো না ।...মা কিছু বলার আগে নিজেই বলল ...."আমার শরীরটা ভালো লাগছে না মা ..আমি একটু রেস্ট নিয়ে নি ...পরে খাব ...""
......ওপরে উঠে নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল চাঁদ.....তা প্রায় অনেক্ষণ....তারপর সন্ধ্যেবেলা কিছুটা ইতস্তত করে সোহমকে একটা ফোন করল....
বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল সোহম....গম্ভীর ভাবে বলল..." হ্যালো ফোন করেছিস কেন ?"
চাঁদ চুপ করে রইল ।
সোহম: কি বলবি বল....
চাঁদের ইচ্ছে করছিল নিজেকে একটু ভাঙতে তবু কেন যে ভাঙতে পারল না কে জানে ! বলল..." না ....আসলে তুই হঠাৎ নেমে গিয়েছিলি তো....তাই....আর হ্যাঁ আজকের পর তোকে ফোন না করতেই চেষ্টা করব....বিশাল থেকে তো একধাপে শূন্যে আসা যায় না...একটু সময় লাগে...সেই টুকুর অপেক্ষা মাত্র ...তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে...ভালো থাকিস ।"
সোহমও বেশ কঠিন ভাবে বলল..." হ্যাঁ আমি ভালোই থাকব....কারণ ভালো থাকতে জানাটাও শেখার আছে জীবনে....তুইও ভালো থাকিস ।"
এই বলে সোহম ফোনটা কেটে দিল । চাঁদের গলার কাছে কিছু একটা উঠে আসছিল যেটা বেরোনোর পথ পাচ্ছিল না....একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ ....চাঁদ চেষ্টা করেও নিজেকে সংবরণ করতে পারল না.....বালিশে মুখ লুকোলো ।
...........................................(ক্রমশঃ)
বৃন্দা বলল: জাস্ট আ মিনিট...চন্দ্রিমা....সুরম্যর ফোন...
চাঁদ: ..ইটস ও কে....ক্যারি অন....টেক ইওর টাইম....
চাঁদ আশপাশটা লক্ষ্য করছিল....সব পড়ুয়ারা নিজেদের মধ্যে হৈ হৈ করছে .....তার মাঝে মাঝে সুরম্য আর বৃন্দার প্রেমালাপের টুকরো টুকরো কথা । চাঁদ চলে যাচ্ছে তার অতীতে । মনে পড়ে যাচ্ছে কলেজ ক্যান্টিনের কথা ।......জন্মদিনের খাওয়াটা সোহম আসার পরই হয়েছিল , তবে ওরা কেউ বেদুইনে রোল খেতে যায়নি.....ক্যান্টিনে চিকেন মোমো খেয়েছিল । সেদিন বেশ হৈ হৈ করেছিল বন্ধুরা । সোহম বলল "আচ্ছা তোকে আমরা কি উপহার দি বলতো, চাঁদ ?"
চাঁদ : উপহারের প্রয়োজনটা কি আছে? আমি তোদের কাছে এই যে হাসি মজা ভালোলাগাটুকু পেলাম.....তাই তো আমার সেরা উপহার ।
সোহম: দেখ, সত্যি বলতে আমি টিউশানে যা হাত খরচা পাই ....তার সবটাই প্রায় ফোনের এক্সট্রা বিল পেমেন্ট করতে চলে যায়....মা বলে দিয়েছে, মাসে নর্মালই যা ওঠে তাই দেবে....এর বেশিটা আমায় দিতে হবে, যেহেতু ফোন ছাড়া আমার চলে না....তাই হাত আমার সবসময় খালি ।
সৈকত: হাত খরচে আমারও কুলিয়ে ওঠে না..... কিন্তু না........ তাও তোকে আমাদের কিছু দেওয়াই উচিত ।
.....এতসব আলোচনার মাঝে দীপা আর রঞ্জা চাঁদকে একটা মনিপুরি ওয়ালম্যাট দিল উপহারে ।
রুদ্র : দেখেছিস মেয়েরা কতটা গোছানো হয়....বাঁচালি বটে আমাদের ।
সবাই খুব হাসল । চাঁদ খুব খুশি হয়েছিল ওদের অকপট সারল্যে।
মনে মনে ভেবেছিল সোহমের উপস্থিতিটাই তো তার সবচেয়ে বড়ো পাওয়া । যদিও চাঁদ এখন সোহমকে কিছুটা এড়িয়েই চলে । ফোনে কথা হয় না...একসাথে ফেরার জায়গাটাই রাখতে চায় না ....আগে আসে আর আগে আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যায় .....সোহম বুঝতে পারে সবই কিন্তু কিছুই প্রশ্ন করে নি কখনও । এরই মাঝে ওদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয়েছে .....রুদ্র আর সোহম এল. এন. টি তে চান্স পেয়েছে...আর সৈকত গ্রুপ থেকে ছিটকে গেল ই.আই.এল এ।
এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছু সময় । হঠাৎ একদিন বাসে মুখোমুখি সোহম আর চাঁদ ।....চাঁদ গড়িয়াহাট গিয়েছিল দীপার সাথে টিফিনের সময় ....আর ভালো লাগছিল না ক্লাস করতে....দীপাকে অটোতে তুলে , ধর্মতলার বাসে উঠেই দেখে সোহম ....ব্যস আর যায় কোথায় ?
সোহম: কিরে আমার পাশের সিটটা তো ফাঁকা ....তাও পরেরটায় বসলি?
চাঁদ: না....গরম লাগছে ...তাই জানলার ধারটা খুঁজছিলাম....বাস তো ফাঁকা !
সোহম উঠে গিয়ে পিছনে চাঁদের পাশে বসল ।
সোহম: আমায় এড়িয়ে চলছিস চাঁদ !!!
চাঁদ: (একটু ইতস্তত করে ) না, সেরকম কিছু না....তবে....
সোহম: কি তবে?
চাঁদ: তুই তো চেয়েছিলি যাতায়াতটা বন্ধ হোক ।
সোহম: হুম ....মুখে অবশ্যই বলেছিলাম কিন্তু মন থেকে চাই নি ।
চাঁদ : ও ....(চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ )
সোহমকে চুপ থাকতে দেখে চাঁদ বলল..." যা হোক , সব ঠিকঠাক আছে তো ? "
সোহম: হুম....তবে রঞ্জার সাথে একটু সমস্যা হয়েছে ।
চাঁদ: রঞ্জাদিকে নিয়ে আবার কি হল?
সোহম: তুই ওর সাথে একটু কথা বলবি?
চাঁদ: কি হয়েছেটা কি?
সোহম: রঞ্জার পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার কথা...কিন্তু এর মাঝে শুনলাম ইন্দ্রদা ওর সাথে যোগাযোগ করেছিল ।
চাঁদ: তো!!
সোহম: না....আমার ধারণা ছিল ও ইন্দ্রদাকে এন্টারটেইন করবে না....কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল....ও এখনও মনে মনে ওই জায়গাটায় বেশ দুর্বল ।
চাঁদ: এমন মনে হল কেন তোর? রঞ্জাদি কিছু বলেছে? কারণ আমি ওকে যতটুকু বুঝেছি তোর প্রতি ও যথেষ্ট দায়বদ্ধ....
সোহম: না আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলি নি ....কিন্তু ও কেমন যেন ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যাচ্ছে চাঁদ ....একটু যেন উদাসীনও ....আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি করব....ও যা চাইবে তাই হবে....কিন্তু ও কি চায় সেটা বলুক তো নিজের মুখে.... ।
চাঁদ: ঠিক আছে আমি কথা বলব রঞ্জাদির সাথে ।
সোহমকে চুপ করে থাকতে দেখে চাঁদ একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলে...." ইন্টারভিউ তো হল, ট্রেনিং কোথায় পড়বে ?
সোহম: জানি না...ফার্স্ট লিস্টে নাম আছে...ওরা একশো পঁচিশ জনের মধ্যে দশ জনকে একেবারে কনফার্মেশন লেটার দেবে...দেখি কোথায় হয়...দূরে হলে মাকে নিয়ে চিন্তা !
চাঁদ বুঝতে পারছিল , যে কঠিন বর্মটা সে তৈরি করে রেখেছিল সেটা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে ....তার খুব ইচ্ছে করছিল তার নিজের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করুক সোহম। সোহমের আনত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল ,সোহম যেন একটু ক্লান্ত ....একটু অসহায় ....চাঁদের মন চাইছিল তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে ....একদৃষ্টে চাঁদ চেয়েছিল সোহমের দিকে...দেখছিল তার চওড়া কপাল , টিকালো নাক, চশমার ফাঁকে আনত চোখ, বলিষ্ঠ চোয়াল....পাতলা ঠোঁট ....জলে ভরে যাচ্ছিল চাঁদের চোখদুটো....জোড় করে চাঁদ মুখটা ফিরিয়ে জানলার দিকে চাইল চোখের জল লুকোতে.....কিছুটা সময় চুপচাপ ....কলকাতার বুকে যানজট এড়িয়ে বাস ছুটে চলেছে....সেই চলন্ত পথের দিকে চেয়ে রইল চাঁদ....হঠাৎ সোহম বলল, "আমি যাতায়াতটা বন্ধ করতে বলেছিলাম ....তার একটাই কারণ ছিল...আমার প্রথম আকর্ষণ আমার মা....দ্বিতীয় আকর্ষণ সিগারেট ...তৃতীয় আকর্ষণ রঞ্জা...আমি আর কোনো আকর্ষণে নিজেকে বাঁধতে চাইনি ।
চাঁদ: মানে....?
সোহম: মানে, ধীরে ধীরে তুইও আমার নেশা হয়ে যাচ্ছিস....রোজকার যাতায়াতে ...কথায় ,লেখায়, হাসি ঠাট্টায় তুই আমাকে আকর্ষণ করছিলি....আমি রঞ্জাকে মনে করতে চাইলেও তুই আমার ভাবনায় চলে আসছিস...আমার অদ্ভুত একটা যণ্ত্রণা হচ্ছে চাঁদ ...তাই তোকে ফোন করাটা কমিয়েছি...চোখের বাইরে তবু ঠিক আছে কিন্তু রোজ চোখের সামনে হলে....আমি নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে যাচ্ছি।
চাঁদ চুপ করে রইল অপরাধীর মত....কিন্তু তার মনে হতে লাগল একবার সোহমকে আঁকড়ে ধরে সে যদি বলতে পারত...তারও এখন আর কিছুই ভালো লাগেনা...জীবনের সব আনন্দ কেমন যেন হারিয়ে গেছে...সব কিছু বেরঙিন হয়ে গেছে....কিন্তু এসব কিছুই সে বলতে পারল না! শুধু মুখ নিচু করে রইল ।
সোহম : কিছু বলবি না?
চাঁদ: নাহ! আমার কিছুই বলার নেই । তোর চাওয়াটাকে সম্মান করি । তুই চেয়েছিস ফোন কমাতে...যাতায়াত বন্ধ করতে ...করেছি তো ।আর এখন বলেছিস রঞ্জাদির সাথে কথা বলতে...বলব ।
সোহম: তোর নিজের কোনো চাওয়া নেই?
চাঁদ: না...
সোহম: কেন ?
চাঁদ ক্ষয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে ....তবুও অসম্ভব কাঠিন্য বজায় রেখে বলল..." আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি ,আমি তোর প্রেমে পড়িনি...তাই তোর আমার ব্যাপারে কি কি হল তাই নিয়ে আমার আর কি বলার থাকতে পারে ।এসব সিলি ইমোশনের কোনো মূল্য নেই ।তুই রঞ্জাদিকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারিস না ।"
সোহম: তুই নিজেকে আড়াল করতে চাইছিস কেন চাঁদ ? আজ যদি সত্যিটাকে অস্বীকার করিস তাহলে সারাজীবন পালাতে হবে জেনে রাখ!!
চাঁদ: এত সত্যি মিথ্যে বুঝিনা ওম....আমার জন্যে তোদের সম্পর্কে চিড় ধরুক আমি চাই না...এটা হতে দেব না...আমি বলেছি তো আমি রঞ্জাদির সাথে কথা বলব....আপাতত আমার আর কিছু বলার নেই ।
....চাঁদের এই আপাত কঠিন চেহারাটার পিছনে যে আবেগ ...যে যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল তা বোধকরি সোহম বুঝে উঠতে পারল না ।
সোহম: তোকে আমার আজ বড়ো অচেনা লাগছে । আমি তো ভেবেছিলাম যদি রঞ্জা চায় ইন্দ্রদার কথা ভাবতে আমি সরে আসব....বাধা দেব না...কিন্তু তখন তুই আমার পাশে থাকবি তো চাঁদ?
চাঁদ: ইউ জাস্ট স্টপ অল দিজ ননসেন্স....আমি আমার মত..আমি কারও বিকল্প হতে চাই না । আমার অ্যাটাচমেন্টে বড় ভয় ওম...সম্পর্কের বোঝাপড়ায় যে কষ্ট , আমি তার একধাপ আগেই কষ্টটা বইতে পারি তাতে কষ্টের বোঝাটা একটু কম হয় । আর তাছাড়া আজ রঞ্জাদির পরিবর্তে আমি...কাল আমার পরিবর্তে যদি অন্য কেউ .......
সোহম চাঁদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অদ্ভুত একটা রাগে চাঁদকে থামিয়ে দিয়ে বলল "ব্যস অনেক বলেছিস...আর নয়...আর একটা কথা বলি, তুই ভুলেও আর রঞ্জার সাথে কথা বলবি না....ওটা অ্যাবসলিউটলি আমাদের ব্যাপার ....আমাদের মাঝে তোর তো কোনো জায়গাই নেই.....আমার ই ভুল ....রাস্তার সম্পর্ক রাস্তায় রাখাই ভাল....তাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া বোকামি.... ।
চাঁদ: রাস্তার সম্পর্ক ? হোয়াট ডু ইউ মিন ?
সোহম: ইয়েস আই মিন ইট । তুই ভুলেও আমাকে আর ফোন করবি না...ভুলেও আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না...কলেজে দেখা হলে আর পাঁচটা জুনিয়ারের সাথে যতটুকু কথা হয় তোর সাথেও তাই হবে....দ্যাটস এনাফ ফর ইউ।
.....এই কথা বলে সিট ছেড়ে উঠে পড়ল ওম....বাসটা থামতেই রাসবিহারীতে নেমে পড়ল সোহম । অপমানে চাঁদের চোখ জলে ভরে গেল । তবু স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ....সোহম ভিড়ে মিশে গেল....বাস ছেড়ে দেওয়ার মুখে চাঁদ ভাবল , একবার কি নেমে যাবে সে? ছুটে গিয়ে ওমের হাতটা ধরে বলবে কিভাবে রাতের পর রাত সে নির্ঘুম কাটায়....তারপর ভাবল ভালোই হয়েছে যা হয়েছে....কি অবলীলায় সোহম বলল....রঞ্জা না হলে চাঁদ...স্বার্থপরের মত শুধু নিজের কথাই ভাবল ওম...রঞ্জাদির সাথে সব মিটে গেলে তখন ভুলেও চাঁদকে মনে পড়বে না হয়ত তার....চাঁদ যে একা সেই একাই থাকবে.....। ভীষণ অস্হির লাগছিল চাঁদের ....রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর ।
বাড়ি এসে তার কিছুই ভালো লাগলো না ।...মা কিছু বলার আগে নিজেই বলল ...."আমার শরীরটা ভালো লাগছে না মা ..আমি একটু রেস্ট নিয়ে নি ...পরে খাব ...""
......ওপরে উঠে নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে রইল চাঁদ.....তা প্রায় অনেক্ষণ....তারপর সন্ধ্যেবেলা কিছুটা ইতস্তত করে সোহমকে একটা ফোন করল....
বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল সোহম....গম্ভীর ভাবে বলল..." হ্যালো ফোন করেছিস কেন ?"
চাঁদ চুপ করে রইল ।
সোহম: কি বলবি বল....
চাঁদের ইচ্ছে করছিল নিজেকে একটু ভাঙতে তবু কেন যে ভাঙতে পারল না কে জানে ! বলল..." না ....আসলে তুই হঠাৎ নেমে গিয়েছিলি তো....তাই....আর হ্যাঁ আজকের পর তোকে ফোন না করতেই চেষ্টা করব....বিশাল থেকে তো একধাপে শূন্যে আসা যায় না...একটু সময় লাগে...সেই টুকুর অপেক্ষা মাত্র ...তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে...ভালো থাকিস ।"
সোহমও বেশ কঠিন ভাবে বলল..." হ্যাঁ আমি ভালোই থাকব....কারণ ভালো থাকতে জানাটাও শেখার আছে জীবনে....তুইও ভালো থাকিস ।"
এই বলে সোহম ফোনটা কেটে দিল । চাঁদের গলার কাছে কিছু একটা উঠে আসছিল যেটা বেরোনোর পথ পাচ্ছিল না....একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ ....চাঁদ চেষ্টা করেও নিজেকে সংবরণ করতে পারল না.....বালিশে মুখ লুকোলো ।
...........................................(ক্রমশঃ)