ধারাবাহিক: "পরগাছা" প্রথম পর্ব
এক.
বলার কথা অনেক। কিন্তু বলতে গিয়ে ভাষা আসে না
হাতে। নুলো মনে হয় নিজেকে। কাগজের পর কাগজ, দলাপাকানো পাহাড় জমে উঠতে
থাকে ঘরের মধ্যে। কী বিপদে যে আমায় ফেলল মালটা, মানে যাকে উচ্ছুগ্গ করে মা সরস্বতীর জোড়া পায়ের লাথি মাথায় নিয়ে অঙ্কমালার
প্রথম অঙ্কটি বানান করে খাতার মাথায় নামিয়ে আনা, যার
তাগিদ আর তাগাদার
চোটে অতিষ্ঠ হয়ে গদ্যলেখা সংক্রান্ত যাবতীয় কুঁড়েমি ঝেড়েঝুড়ে আমার ময়দানে
নেমে পড়া, আর যার মাথা থেকে আমাকে দিয়ে গদ্য লেখানোর ভূত তাড়াতে
তাড়াতে আমারই শরীর-মনে ভৌতিক আর রাসায়নিক
নানারকম বিক্রিয়া একের পর এক ঘটে যাওয়া। আপাতত এই বন্ধ ঘরে, যেখানে দরজার গায়ে মিকিমাউস হাসতে হাসতে দু'হাত বাড়িয়ে দিয়েছে দুনিয়ার
গুঁফো বেড়ালদের কোলে নেবে বলে, একটা গোবদা টিকটিকি এ
দেয়াল থেকে ও দেয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে পোকার খোঁজে, ফটোর মধ্যে থেকে রবীন্দ্রনাথ কটকট করে তাকিয়ে আছেন আমার
দিকে আর আমি অসহায়ের মতো ভাষার খোঁজে আমার ছেলেবেলা হাতড়াচ্ছি, সে ফোন করে বলল, 'বাবা-মায়ের কাছে খোঁজ নে, কেমন ছিল তাদের বংশ, কোথায় থাকত তারা, কী ছিল তাদের ভেসে আসার গল্প, কী খেত তারা, কী পরত...তথ্যের বিকৃতি যেন না হয়'। সে তো বলেই খালাস। আর আমি খালাসি, যেভাবেই হোক নেচেকুঁদে, গায়ের ঘাম ঝরিয়ে এই 'আত্মজীবনী' নামক জাহাজটিকে তিনমাসের ধাক্কায় কালসমুদ্র পার
করিয়ে দিলে তবেই আমার ছুটি। যতই বলি, ওরে দ্যাখ, এই তো ছারপোকার মতো জীবন, তার আবার আত্মা, তার আবার দীর্ঘ ঈ! তো কে শোনে কার কথা। ভবি যদি অত সহজেই ভুলত। বাবার কাছে খবর
নিতে গিয়ে এক মজার তথ্য মিলল। দমদেমর কাছে দত্তনগর মানসিক হাসপাতালে নাকি আমাদের
বংশলতিকা এখনও আছে আর ওই হাসপাতাল আমাদেরই এক পূর্বপুরুষের তৈরি। তার
নাম ছিল অতুল দত্ত। বাবার সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, আমাদের বংশে আর যাই হোক, পাগলের অভাব ছিল না। ঠাকুমার এক দিদি একবার পাগল হয়ে গিয়ে একটা জ্যান্ত
সাপকে কামড়ে ধরেছিল। আমি অবশ্য পাগল বলতে নিজের চোখে দেখেছি আমার সেজপিসী আর
মুক্তিপিসীকে। এদের মধ্যে মুক্তিপিসী ছিল বদ্ধ উন্মাদ। মুক্তিপিসীর বাবা, বাবার বড়মামা, স্নেহবশতঃ মেয়েকে হাসপাতালে না দিয়ে বাড়িতেই
রেখেছিলেন। তার ফল ভালো হয়নি। সে মেয়ে এত ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে তার দাদার
বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল একাধিকবার। মুক্তিপিসীকে
আমি শেষ যেবার
দেখি, সেভেন কী এইটে পড়ি তখন। যেকোনও কারণেই হোক, মুক্তিপিসী আমার ওপর প্রসন্ন হয়েছিল আর আমার কাছে তার
বড়বৌদি সম্বন্ধে নালিশ করেছিল, এটুকুই আমার মনে আছে। আর
মুক্তিপিসীর চেহারা বলতে একটা পাকানো নারকোল দড়ি ছাড়া আর কিছুই মনে নেই। সেজপিসী যখন
প্রথমবার পাগল হল, তখন সে প্রেগন্যান্ট। আমরা তখন সাহেববাগানে অরূপমামার বাড়ির
নীচের তলায় একখানা ঘরে ভাড়া থাকি। সেজ পিসেমশাই পিসীকে তার বড় ছেলেসুদ্ধু আমাদের
বাড়িতে তুলে দিয়ে ‘পরশুই আসছি’ বলে সেই যে কেটে গেল, তারপর একমাস কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না তার। আমি তখন নেহাৎ-ই ৩ কি ৪ বছরের, তাই ওই একমাসে সেজপিসী
ঠিক কীভাবে আমার মা-বাবার হাড় জ্বালিয়ে
ছেড়েছিল, অতি দূর চেষ্টাতেও তা মনে আনতে পারি না। তবে
তার পাগলামি যে এখনও মোটামুটি অক্ষুন্ন-ই আছে, সে ব্যাপারে অকাট্য
প্রমাণ আমাদের হাতে। বিভিন্ন উত্থানপতনের ফলস্বরূপ
সেজপিসী আর পিসেমশাইয়ের প্রায় ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল এবং তারা আলাদা আলাদা
জায়গায় বাড়িভাড়া করে থাকত। প্রায় দেড়-দু'বছর আলাদা থাকার পর, হঠাৎই একদিন, কোনও একটি রেলস্টেশনে,
সেজপিসী দেখতে
পায় পিসেমশাইকে। পিসী তখন ছিল ট্রেনে, জানলার ধারে মেজাজে বসেছিল, আর পিসেমশাই ছিল স্টেশনে
দাঁড়িয়ে। প্রায় দু'বছর পরে দুজনের মোলাকাত, ভবিষ্যতে আর দেখা হবে কিনা তার সম্ভাবনাও বিশ বাঁও জলে, সেজপিসী সেদিন ডাকতে পারেনি মানুষটাকে। যদি সে কথা
বলতে চায়, যদি জায়গা ছেড়ে উঠে যেতে হয়, যদি জানলার ধারের অমন সুখের জায়গাটা হাতছাড়া হয়ে যায়। তো এই হল বংশ। এই
বংশের মেয়ে আমি। আমার মাথা নিয়েও চারপাশের লোকজন, মানে যারা আমায় সহ্য
করে আর কি, যথেষ্টই সন্দেহপ্রবণ। আমারও অবিশ্যি এ নিয়ে কিঞ্চিৎ সংশয়
আছে। ছোটবেলা থেকে আমার মাথায় উকুন প্রায় হতই না, হলেও বেশিক্ষণ থাকতে
পারত না, বেরিয়ে ঘাড়ের কাছে চলে আসত। কারণ আমার মাথা ছিল অত্যন্ত গরম আর
সাধারণত মাথাগরম লোকদেরই পাগল হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। তবে হ্যাঁ, আমি অন্তত নিজের হাত-পা আর জুতোর সুখতলা
চিবিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করিনি কোনওদিন। পাগলরা জেনারেলি যেটা
করে থাকে।
দুই.
আমার বেলায় সমস্যাটা
অন্য। অল্প বয়েসেই আমি যেটা খুব মসৃণভাবে চিবিয়ে খেয়েছিলাম, তা হল আমার নিজের মাথা। ফলে পরবর্তী প্রায় সমস্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখেছি, মাথার বিশেষ কোনও কার্যকারীতাই থাকত না। শরীর ভেসে যেত কাগতাড়ুয়ার মতো। শেষে
ফুলে ওঠা, কাগে-ঠোকরানো গরু-মোষের মৃতদেহের গায়ে এসে ঠেকত। সেখানে দু'দণ্ড জিরিয়ে আবার শুরু হত তার ভেসে যাওয়ার গল্প। এই দ্যাখো, গল্পের গরু গাছে উঠতে না উঠতেই বেজে ওঠে টেলিফোন, পালাগানের বিবেকের মতো
শোনায় তার গলা, 'মনে রেখো তুমি পর্নোগ্রাফি লিখতে বসোনি'। বোঝো! কী করে বোঝাই তাকে, পর্নোগ্রাফি-টাফি নয়, এ আমার বছরের পর বছর সারাগায়ে জমে
থাকা, শুকিয়ে হলুদ হয়ে যাওয়া পর্ণমোচনের উল্লাস। ভার
নেমে যাওয়ার স্বস্তি। ক'মিনিটের জন্য একটু হাঁফ
ছাড়া। আবার অপেক্ষা। একটা-দুটো করে নতুন পাতায়
সেজে ওঠার। এই সাজ ব্যাপারটা যে আমার মাথায় ঠিক কবে ঢুকল! মনে আছে, অন্তত এইট-নাইন পর্যন্ত, দু'ভুরুর মাঝখানে প্রায় নাকের ওপরে ফুলস্টপের মতো
একটা টিপ, এ ছাড়া অন্য কোনও প্রসাধন
ছিল না আমার। এই টিপটাকে অনেকেই, বিশেষ করে উঁচু ক্লাসের মেয়েরা, তিল বলে ভুল করত। উঁচু ক্লাসের মেয়েগুলো আবার আমায় দাঁড় করিয়ে আঙুল দিয়ে চেপে
দেখত, সত্যিই ওটা তিল কিনা। আর একটু ছোটবেলায়, মোটামুটি ফাইভ-সিক্স অব্দি. ছেঁড়া জামা পরতে আমি বিশেষ ভালবাসতাম আর তাই পরে মাঠে কিতকিত
খেলতেও যেতাম। আমার প্রথম প্রেমিকের আপত্তির কারণে এই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
আলোবাতাস খেলার প্রভূত সুবিধেযুক্ত এই জামাগুলো শেষজীবনে পোঁটলায় স্থান
পেয়েছিল। মনে আছে,গোপালপুরে সেজদাদুর ঘরে
টিভি দেখতে দেখতে খাটে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছি,পাশে বসে আছে শিখামাসি আর শুভামাসি। তখন আমার ক্লাস সিক্স,ছোট ছোট চুল,পরনে প্যা ন্ট-শার্ট,যাচ্ছেতাই ছিলাম দেখতে।
আর শিখামাসি ছিল আগুনের মতো সুন্দরী। শিখামাসি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে
শুভামাসিকে বলল,"শুভা,চিনেম্যান দেখেছিস?" আমি তখন কথাবার্তায় একেবারে বোবার বাচ্চা। মুখে
রা নেই। খাট থেকে নেমে বাড়ি চলে এলাম। হয় তো ওইদিন একটা
অপমানের বীজ বুকের ভেতর পোঁতা হয়ে গেল যার ফুল ফুটলো
আরও প্রায় কুড়ি বছর পরে,যখন আমি জেনে গেছি,আসলে কিছুই না,আসল কথাটা হ'ল ফুটে ওঠা আর ঝরে যাওয়ার মাঝখানে ফুলটার
পরিক্রমা। সে তার রূপে আলো করল কিনা,গন্ধে ভরিয়ে দিল কিনা বাগানের হাওয়া। আসল মজার ব্যপারটা হ'ল,ফুটে ওঠা আর ঝরে যাওয়ার আপাতমধুর,আপাতবিষণ্ণ গল্প। তাই বছরতিনেক আগে, আমার থেকে মোটে দু'বছরের বড় শিখামাসির মুখে একফোঁটাও লাবণ্য না দেখে অবাক হইনি। অবাক
হইনি আমার চিবুক ছুঁয়ে "কী সুন্দর হয়েছিস তুই" বলাতেও। কারণ আমি জানি,এর মূলেও আছে সেই মজা। আমি জানি, আগামী কুড়ি বছর পরে আয়নাতে আমার জন্য
কোন মুখ অপেক্ষা করে আছে। আমি সেই মুখের মুখোমুখি হতে চাই।
[ক্রমশ]