অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে ডঃ কমলেন্দু চক্রবর্তী
সংশপ্তক:
পেশাগত ভাবে একজন চিকিৎসক হয়েও, লেখালেখির পরিমন্ডলে আপনার আগমনের
সূত্র কি সাহিত্য প্রেম?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: আমার লেখালেখির
জগতে আমার মধ্যে কোনো সাহিত্য প্রেমটেম কিছুই নেই ৷ এটা
নেহাত একটা দুর্ঘটনা বলতে হয় ৷ সেই অর্থে আমার লেখালেখির
শুরু ১৯৯০ সালের পর ৷ মানে আমার বয়স তখন চল্লিশের উপর ৷
একটা মজার কথা হল, আমার হাতের লেখা অত্যন্ত খারাপ আর বাংলা বানান?
তা দেখে তো বৈকারনিকরা নেহাত ভিরমি খেয়ে যাবে ৷ তাই লুকিয়ে লুকিয়ে
দু-এক লাইন লিখলেও সঙ্গে সঙ্গে তা ছিঁড়ে ফেলতাম ৷ ভাববেন না যে আমি
ইংরাজী মাধ্যমের ছাত্র ৷ উত্তরবঙ্গের একটা অজপাড়া গাঁয়ের অনামী স্কুলের
ছাত্র ৷ আসলে আমার বিজ্ঞানের বিষয়ে মাথা ঘামাতে ভালো লাগত৷ সাহিত্য,
তা ইংরাজী হোক বা বাংলা
আমার কাছে নেহাত পাঠ্যপুস্তক ছাড়া আর কিছুই মনে হত না ৷ সেই
হিসাবে আমি সাহিত্য-অপ্রেমি বলাই বোধহয় ঠিক ৷
ছোটবেলায় গল্পের বই পড়তাম ৷ রবীন্দ্রনাথ,
বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, কিন্তু আমার খুব বেশী ভালো লাগত না ৷ বরং আমার ডিটেক্টিভ দীপক চ্যাটার্জীর
সিরিজের ছোট ছোট বইগুলো পড়তে ভালো লাগত ৷ ওগুলো গোগ্রাসে
পুরোটা গিলে ফেলতাম ৷ কাজেই সাহিত্যের প্রতি প্রেম আমার কোনো দিনও ছিল
না ৷ আমার প্রথম লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল যখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি ৷ আমরা
উত্তরবঙ্গের ছোটখাট নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে পড়াশোনা করেছি ৷
বাবা ছিলেন স্টেশন মাস্টার ৷ যাইহোক, দাদাদের মনে হল নাটক করবে ৷ কিন্তু কি নাটক করবে?
ওখানে তো বই-এর দোকানই নেই ৷ সেজদা নিজে কিছু একটা লিখেছিল ৷ আর আমি
কাউকে কিছু না বলে শরৎচন্দ্রের শ্রীনাথ বহুরূপী গল্পটাকে আমার মতো করে নাট্যরূপ
দিয়েছিলাম এবং সেটা মঞ্চস্থও হয়েছিল আমাদের বাড়ির বারান্দায়
৷ এই আমার তখনকার মতো সাহিত্যকীর্তি ৷ এরপর ডাক্তারি পড়ার সময় কেন
জানি না সবাই আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের পোস্টারের স্লোগান লিখতে বলত ৷ আমি খুব
মনোযোগ দিয়ে লিখতাম ৷ ওর মধ্যে তীর্যক ব্যঙ্গ থাকত,
রসিকতা থাকত দু-চার লাইনের কবিতাও থাকত৷
কিন্তু আমি এই ব্যাপারটাকে ইউনিয়নের কর্তব্য কাজ বলেই মনে
করতাম ৷ ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ারে আমি, একটা নাটক লিখেছিলাম, নাম 'র্যা গিং' ৷ র্যা গিং-এর বিরুদ্ধে ওটা একেবারে আমার
একার ধারণা নিয়ে লেখা, এই নাটকটি ছাত্র এবং শিক্ষক সবারই ভালো লেগেছিল ৷ আমি নিজেই এর পরিচালনা এবং
অভিনয় করেছিলাম ৷ এই নাটকটি আমার কলেজের ম্যাগাজিনে ছাপানো হয়েছিল এবং এটাই
আমার প্রথম ছাপানো লেখা ৷ তারপর এর-ওর অনুরোধে দু-একটা নাটক লিখেছিলাম ৷ কিন্তু আমি মন
থেকে কোনোদিনও ভাবিনি যে আমি লিখব বা লেখার প্রতি আমার
অনুরাগ আছে ৷ এরপর দীর্ঘকাল আমি ডাক্তারী নিয়েই কাটিয়েছি ৷ দরকারী
ডাক্তারী প্রবন্ধ (আর্টিকেল) ছাড়া আর কিছুই লিখিনি ৷ প্রথমেই বলেছি যে আমার লেখা শুরু
করাটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা ৷ ১৯৯০ সালের সময় আমার স্ত্রীর দীর্ঘকালীন অসুস্থতা
এবং দুই-তিন বছরের ছেলে নিয়ে বেশ আর্থিক কষ্টে আমার দিন কাটছিল ৷
রাতে প্রায়ই একা একা জেগে থাকতাম আর তখন যা মনে আসত লিখতাম এবং অবশ্য তা ফেলে
দিতাম ৷ এই সময় আলাপ হল দীপকবাবুর সঙ্গে ৷ শ্রী দীপক
ভট্টাচার্য আমারই একেবারে লাগোয়া ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন ৷ উনি ত্রিপুরার লোক,
FCI তে কাজ
করতেন এবং ভালো ডকুমেন্টরি ফিল্ম বানাতেন ৷ উনি একদিন অনেক
রাতে আমার ফ্লাটে এলেন ৷ মৃদসভাষী এই ভদ্রলোক আমাকে বললেন যে,
ওনার বাচ্চাকে নিয়ে আমাকে দেখাতে আসার দিন আমার টেবিলে অনেক বাংলা পত্র-পত্রিকা দেখেছেন এবং আমার লেখা কিছু টুকরো টুকরো কাগজও
দেখেছেন ৷উনি আমার লেখা দেখতে চান ৷ আমি
খুব উৎসাহ দেখাই না ৷ কিন্তু উনি প্রায় প্রতিদিন রাত দশটার
সময় আমার ঘরে আসতেন ৷ আমার স্ত্রী-পুত্র অনেক আগেই ঘুমিয়ে
পড়ত ৷ আমাদের দুজনার আড্ডা হত
৷ চা খাওয়া হত ৷ দীপকবাবু কিন্তু নাছোড়, আপনাকে লিখতে হবে ৷ লেখার বিষয়ে
আমার কোনো উৎসাহও ছিল না ৷ আমার নিজের লেখার উপর নিজেরই
আস্থা ছিল না ৷ দীপকবাবু আমার লেখা নিয়ে ফিল্ম বানানোর লোভ দেখিয়ে তাঁর
কসরৎ নিয়মিত চালাতে চালাতে একদিন আমাকে দিয়ে প্রথম উপন্যাস 'স্তব্দ হও নিঃশব্দ মৃত্যু' নামে’ একটা গোটা উপন্যাসই লিখেয়ে নিলেন ৷ বিষয় এডস্ (AIDS)৷ দীপকবাবু কিন্তু সে
সময় এডস নিয়ে উপন্যাস লিখতে বলেননি ৷ শুধু রোগটা সম্বন্ধে
লিখতে বলেছিলেন ৷ আমি নিজের কেরামতিতে একটা উপন্যাসই লিখে ফেললাম ৷ সেই অর্থে
শ্রী দীপক বয়সে আমার চাইতে অনেক ছোট হয়েও আমার লেখালেখির দুনিয়ায় আনার
প্রথম এবং একমাত্র গুরু ৷ এরপর অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে বইটা ছাপা হল ৷ লোকে প্রশংসা করল ৷
সত্যিমিথ্যা জানি না আমার উপন্যাসটি রবীন্দ্র পুরষ্কারের জন্য মনোনীত
হয়ে শেষ দুই নম্বর পর্যন্ত এসে ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল।৷ এটা বিকাশ ভবনের ঐ
বিভাগের হেডক্লার্কের কাছে শোনা ৷
এবার অনেক আস্থা নিয়ে মায়ের দুধ নিয়ে উপন্যাস 'গরল নয় অমৃত' প্রকাশ পেল ৷ ধীরে ধীরে 'শিশুর পরিচর্যা', Pediatric
Neurology (দিল্লীর নামী
প্রকাশনা সংস্থা থেকে) প্রকাশ পেল ৷ এরপর আমি নিয়মিত ছোট গল্প,
প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা ইত্যাদি লিখতে শুরু করলাম ৷ ডাক্তারী করার ফাঁকে
ফাঁকে লেখার একটা নেশা জন্মালো ৷ আমার লেখা 'পত্রপাঠ', 'সুস্বাস্থ্য' ইত্যাদিতে নিয়মিত ছাপা
হলেও লেখক হিসাবে আমার
কৌলিন্য এখনও আসেনি ৷ 'দেশ' এই ধরনের পত্রিকাতে পাঠানো সব লেখাই আমার অমনোনীত হয়ে আবর্জনায় চলে গেছে ৷ এখন
তাই ওসব পত্রিকায় লেখা পাঠাই না ৷
এই হল আমার লেখালেখির ইতিহাস ৷ আমি সাহিত্যিক নই,
তবে প্রচুর লিখেছি বলে
লেখক কথা মানা যেতেই পারে ৷ যেমন মুদী ফর্দ লেখে,পুরোহিত পুজার উপকরণ লেখে, ব্যাঙ্কের কেরানী লেজার খাতায় অঙ্ক লেখে —
আমি সেই ধরণের লেখকের চাইতে
বেশি কিছু না। একে নিশ্চয়ই সাহিত্যপ্রেম বলা যায় না ৷ স্রেফ
নেশার জন্য লেখা ৷ আমি আজ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস যাই লিখি না কেন বিষয় থাকে
স্বাস্থ্য-শিক্ষা আর সামাজিক সচেতনতা নিয়ে ৷ আমি আজ পর্যন্ত প্রেমের গল্প বা
প্রকৃতির বিবরণ নিয়ে লিখিনি ৷ ওগুলো বোধহয় প্রকৃত সাহিত্যিকদের কাজ ৷ যা আমি করিনি বা
করতে চাই না৷
সংশপ্তক:
বাঙালির জীবনে সাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা আবেগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: এই শুরু হল সব গম্ভীর গম্ভীর প্রশ্ন ৷
আমি নিজের কাজ সম্বন্ধেই নিজে জানি না, তাই এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার তো ভয় লাগছে ৷ হ্যাঁ,
সবাই বলে বাঙালি আবেগপ্রবণ, কিছুটা হুজুগে ৷ আমার তো মনে হয় বাঙালিরা একটু
গতানুগতিক বটে ৷ বাঙালি বরাবরই সাহিত্য চর্চা করতে ভালোবাসে
৷ এমন কি মাটি কোঁপালে, বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধুপকাঠি বিক্রি করলেও যে সংসারটা চলে
যায় ভালো ভাবে, সেটা মনে না রেখে ধার-দেনা করে একটা চটি কবিতার বই ব্যাগে করে ঘুরে
বেড়ানোর নেশা ছাড়তে পারে না৷ বাঙালির ঘরে রবীন্দ্রনাথ না
জন্মালে বোধহয় ভালো হত বলে আমার মনে হয় ৷ উনি বড় বেশি বাঙালির মাথার উপরের
আকাশটা গ্রাস করে রেখেছেন। 'আলালের ঘরের দুলাল', 'ক্যারি সাহেবের মুনসি' 'বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ', 'সধবার একদশী', নীলদর্পন ইত্যাদি ইত্যাদি হয়ত বাঙালি জীবন বা
লেখনীতে আরও একটু জায়গা পেত ৷ আমি খুব বেশী বইটাই পড়ি না
তাই সব নামগুলো এখন মনে পড়ছে না ৷ প্রশ্ন হল সাহিত্যের ঐতিহ্য ৷ বাঙালির সাহিত্যের ঐতিহ্য
বরাবরই ছিল ৷ কিন্তু সামনে বিশাল কিছু মহীরুহ থাকার জন্য অনেক ঐতিহ্যবাহি
শাস্ত্র আড়াল হয়ে গেছে ৷ এদের আবার বাইরে আনার দরকার ৷ বাঙালির
হুজুগেপনার জন্য এই কাজটা করার কথা বোধ হয় কারো মাথায় আসে না ৷
সংশপ্তক:
সাহিত্য বলতে আপনি কি
শিল্পের জন্যেই সাহিত্যে বিশ্বাসী? না কি মনে করেন সাহিত্যের একটা সামাজিক
দায়বদ্ধতাও আছে?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: শিল্প বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন আমি
জানি না ৷ আল্পনা দেওয়াও শিল্প, ভালো ধান কোটাও শিল্প ৷ শিল্প যদি কেবল মনোরঞ্জন হয়,
তবে সেটা আমার কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হবে না বলেই বিশ্বাস ৷ শুধু প্রেম,
আকাশ-বাতাস, নদী-পাহাড়ে সীমাবদ্ধ থাকলে আবেগপ্রবণ বাঙালির খুব বেশী অগ্রগতি হবে না -
হচ্ছেও না ৷ সাহিত্যের একটা সামাজিক দায়িত্ব আছে ৷ সেগুলোকে অপাংতেয় করে
রাখলে জীবন ও সমাজ সমৃদ্ধ হয় না ৷ আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি যে বাঙালির যতো
প্রেমের কবিতা আছে, তার তুলনায় সামাজিক সমস্যা নিয়ে লেখার সংখ্যা অতি নগণ্য
৷ অনেক গল্প-উপন্যাস বা সিনেমা সামাজিক সমস্যা নিয়ে শুরু হলেও শেষ
পর্যন্ত তা গতানুগতিক ধারায় সমস্যাটাকে পাশ কাটিয়ে প্রেম আর
সংঘর্ষতেই আবদ্ধ থাকে ৷ এডস্ নিয়ে উপন্যাস বা মায়ের দুধ নিয়ে উপন্যাসের মাধ্যমেও ঐ
বিষয়ে সাধারণকে সচেতন করা যায়, সেটা আমি প্রথম থেকেই বিশ্বাস করি ৷ আমার সমস্ত গল্প,
নাটকই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা ৷ সেজন্য আমার লেখাকে অনেকে
প্রচার সর্বস্ব বলে ছাপ মেরে দেয় ৷ এতে আমার কোনো আপত্তি নেই ৷
সংশপ্তক:
এই সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যেকের সমাজসচেতনতা কতটা
জরুরী বলে মনে হয় আপনার?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: আগেই বলেছি মানুষ সামাজিক জীব ৷ পাশের
বাড়িতে গণধর্ষণ হচ্ছে, আমি এখানে নারীর বর্ণনা লিখে বাহবা কুড়োচ্ছি,
এটা সরাসরি আমাকে বেদনা দেয় ৷ আপনার
হাতে যখন লেখনীর মতো এত শক্তিশালী একটা অস্ত্র আছে,
সেটা সমাজের কোনো কাজেই আপনি লাগালেন না, কেবল সাহিত্য যশোপ্রার্থি হয়ে মনে আবেগ নিয়েই জীবন
কাটালেন, সেটা অসামাজিকতার পর্যায় পড়ে বলে আমার মনে হয় ৷ যে লোক পাথর
ভেঙ্গে রাস্তা বানান, তিনিও রাস্তার মসৃণতা নিয়ে শিল্প করেন৷
যে শিক্ষক বিশেষ ভাবে ছাত্রদের শিক্ষার পদ্ধতিকে একটা উচ্চপর্যায় নিয়ে
যান,
তিনি ও শিল্প গড়েন৷ এসব শিল্প মানুষের সরাসরি উপকারে লাগে ৷ এঁরা
একাধারে শিল্প করেন, আবার সামাজিকতাও করে৷ কিন্তু শুধু সাহিত্যের চর্চা বা
সাহিত্যসভা যে আপনি করছেন সেটার জন্য যে বেঁচে থাকার নূন্যতম মুল্য সেটা
যোগাবে কে? পাড়ায় একজন লোক থাকে, সে কাগজ কেটে ফুল বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায় ৷ কিন্তু
সেইসঙ্গে পাড়ার ছোট শিশুদের কী করে কাগজের ফুল
বানায় সেটা ভালোবেসে শিখিয়ে দেখ ৷ কিন্তু একজন বিশাল পন্ডিত-সাহিত্যিক নিজেকে নিয়ে আর তার কিছু
সহমনন ব্যক্তির সঙ্গে দিন কাটায় ৷ স্ত্রী চাকরি করে সংসারের
রসদ যোগায় ৷ সমাজের চোখে কে বড়-শিল্পি? প্রশ্ন এটাই ৷ সমাজের আশেপাশে কী হচ্ছে তার কোনো প্রতিফলন যদি সাহিত্যিকর
কলমে না থাকে, তবে সমাজকে সে কি দিচ্ছে? আর তার বদলে যদি তাঁকে শ্রদ্ধা-ভক্তিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়, তবে সমাজও ভুল কাজ করে ৷ রবীন্দ্রনাথকেও 'স্যার' উপাধি ত্যাগ করতে হয়েছিল, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ৷ কাজেই সমাজকে উপেক্ষা করলে
শিল্পির কোনো মূল্যই সমাজের কাছে থাকে না,
থাকতে পারে না বা থাকা উচিত নয়।
সংশপ্তক:
এখন এই সমাজসচেতনতার
প্রসঙ্গে সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: প্রথমেই ভাবতে হবে সমাজ সচেতন হওয়ার
জন্য যেমন সাহিত্যিক হওয়ার প্রয়োজন নেই, তেমনি সাহিত্যিকের সমাজ সচেতনা বা রাজনৈতিক মতাদর্শকে সঙ্গে
নিয়ে চলার কোনো বাঁধা নেই৷ সমাজ সচেতনার কোনো গণ্ডি নেই ৷ এটা পরিমাপ করারও কোনো
যন্ত্র নেই ৷ সাহিত্যিক কোনো বিশেষ প্রাণী নয় ৷ রামকৃষ্ণদেবের কথায়,
তোমার (বিদ্যাসাগরের)কি দুটো শিং বেরিয়েছে যে দেখতে যাব?
তোমার দয়া, তোমার গুণের জন্য তোমাকে দেখতে এসেছি। সাহিত্যিকদেরও সামাজিক প্রাণীর
চাইতে আলাদা চোখে দেখাটা সমাজের একটা মানুষিক দুর্বলতা ৷
ছবির হিরো, নামী চিত্রকর, বিশাল সঙ্গিতশিল্পি বিরাট বিজ্ঞানী থেকে চাষী,
শ্রমিক, গৃহবধূ প্রত্যেকেরই একটা
সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে ৷ সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধ গড়ে ওঠে
ছোটবেলার বাবা-মায়ের শিক্ষা, তারপর বিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং সর্বোপরি নিজের মননশীলতা
একজন মানুষকে সামাজিক দায়বদ্ধ করে তোলে ৷ কাজেই সমাজকে বাদ
দিলে কাগজে যতো বড়ই আঁচড় কেটে বিখ্যাত হন না কেন, এমন শুকনো সাহিত্যিকের সমাজের প্রতি
দায়বদ্ধ থাকার কথা নয় ৷
রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই ৷ কারণ,
এক তো আমি রাজনীতি ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারি না ৷ দলীয় রাজনীতি আমার কাছে
কোনো রাজনীতিই নয় ৷ আর নীতির ভিত্তিতে রাজনীতি?
আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, সারা দুনিয়ায় এখনও কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মত গড়ে ওঠেনি ৷মার্কসিয় রাজনীতি
এখন বিফল হওয়ার মুখে, সামাজ্রবাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত
ক্যাপিটালিজম, জাতীয়তাভিত্তিক, ধর্মীয়ভিত্তিক রাজনীতি সব ভেঙে চুড়ে একাকার হয়ে গেছে এবং
এমনটাই হওয়ার কথা ৷ এই বিশাল দুনিয়ায় এত বিচিত্র সব দেশে এত বিচিত্র মানুষের
মধ্যে কখনই একটি রাজনৈতিক মতবাদ চলতে পারে না ৷ আমি নিজেকে কোনো রাজনৈতিক
মতের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারিনি ৷ সব ধরনের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কিছু না কিছু
কাজ করে দেখেছি, মানুষকে কোনো রাজনৈতিক ছাপ নিয়ে চলতে গেলে তার মধ্যে
সীমাবদ্ধতা আসবেই ৷ আর সীমিত রাজনৈতিক চৌকাঠে আবদ্ধ থেকে বড়
সাহিত্যকীর্তি করা খুব বেশী সম্ভব বলে আমার মনে হয় না৷
এখানে আমি একটু নিজের কথা বললে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না ৷
আমার সরকারী চাকরি জীবনের পুরোটাই প্রায় কেটেছে দীর্ঘকালীন চলা একটা
রাজনৈতিক দলের রাজত্ব কালে ৷ প্রায় সব
ডাক্তারই তখন সেই শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের গঠিত
ডাক্তারি সংগঠনের সদস্য ৷ এদের বিরোধী
একটা দলীয় সংগঠন থাকলেও, তার কার্যকারিতা প্রায় ছিল শূন্য ৷ মনে হয় সেইসময় আমি
একমাত্র একজন ছিলাম যে
কোনো সংগঠনে নাম লেখায় নি ৷ ফলে প্রতিনিয়ত আমাকে চাকরির
ক্ষেত্রে হেনস্থা হতে হয়েছে ৷ এমন কি শারীরিক নির্যাতনও সইতে হয়েছে ৷ কিন্তু
এতেও আমাকে আমার পথ ও মত থেকে সরাতে পারেনি ৷ আমার সাফ কথা ডাক্তার যদি কোনো
বিশেষ রাজনৈতিক দলে নাম লেখার তবে কি অন্য রাজনৈতিক মতের রোগীকে চিকিৎসা করবে না,
ভুল চিকিসা করবে বা মেরে ফেলবে?
কারণ যে কোনো দলীয় রাজনৈতিক মূল কথা
শত্রুপক্ষকে খতম করা ৷ রাজনৈতিক ডাক্তারের তবে উচিত শত্রু-রোগীকে শেষ করে ফেলা ৷ আমাকে কিছুতেই স্বমতে না আনতে পেরে আমাকে একদিন একজন
ডাক্তার-নেতা এসে বলল, দাদা, আমি জানি আপনার চাকরির ক্ষেত্রে অনেক অন্যায় হয়ে চলেছে ৷
আমি এটা বন্ধ করতে চাই ৷ আপনাকে যোগ্যপদে নিয়ে যেতে চাই ৷
আমি বললাম, এতো ভালো কথা ৷ তুমি যখন জানোই যে অন্যায় হচ্ছে,
তবে তুমি তার প্রতিকার করলে তো ভালোই ৷
এর উত্তরে ডাক্তারটি বলল, তা হলে আপনি আমাকে মেম্বারশিপের চাঁদাটা দিয়ে
দিন৷ কেউ জানবে না ৷ আপনাকে আমাদের মিটিং মিছিলেও যেতে হবে
না ৷ শুধু আমাদের দলে নাম লিখিয়ে রাখবেন ৷ তারপর সব আমিই করব ৷ কেউ
কিছু জানতে পারবে না ৷ মাথা ঠান্ডা রেখে সেদিন আমি ওকে বলেছিলাম,
কেউ না জানুক আমি তো জানব? সেটা খুবই কষ্টকর ব্যাপার হবে ৷
ডাক্তারটি গম্ভীর হয়ে বলল, তবে আর কিছু করা গেল না ৷ এত জেদ হলে কি চলে?
তার উত্তরে তাতক্ষণিক যে তাতক্ষণিক উত্তর দিয়েছিলাম সেটার
কথা লিখতেই এতগুলো কথা বলতে হচ্ছে ৷ আমি বলেছিলাম,
রাস্তায় কোনো লোকের দুর্ঘটনা ঘটলে
কিছু লোক 'আমার কি দরকার, আমার কাজ আছে' বলে নিজের কাজে চলে যায় ৷ আরেক
শ্রেণী লোক আছে যারা দৌঁড়ে গিয়ে লোকটাকে সাহায্য করে-দরকারে হাসপাতালে নিয়ে
যায় ৷ তোমার কথায় মনে হল শুধু এই দুই শ্রেণী নয়,
তৃতীয় এক ধরনের লোকও আছে, যারা দৌঁড়ে আসে ৷ তারপর দুর্ঘটনায় আহত
লোকটাকে কানে কানে জিজ্ঞেস করে,
'তুমি কি আমার আত্মায়'?
অর্থাৎ মানেটা হল যদি সে আত্মীয় (দলীয় সদস্য) হয়, তবেই সে সাহায্য পাবে।
সংশপ্তক:
আবার এই সমাজসচেতনতার
ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে
করেন আপনি,
এবং কেন?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: এতো বেশ ঝামেলায় পড়া গেল ৷
সাহিত্যিকদের প্রশ্ন করার মধ্যে এতো সাহিত্য যে সেটার মানে বুঝতেই আমার অনেক সময় চলে গেল ৷ সত্যি কথাই বলছি,
আপনার এই প্রশ্নটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কাজেই উত্তর
দিতেও পারব না ৷ এখানে সাহিত্যের ঐতিহ্যের কথা যখন উঠলও তখন অনেকদিনে একটা
মনের কথা বলি ৷ যদি কিছু উদ্যমী লোক বাংলার সাহিত্যের প্রাচীনতম প্রাচীন
সাহিত্যকে পুনরোদ্দার করে এক জায়গায় আনার প্রচেষ্টা করে তবে বাংলা
সাহিত্যের ঐতিহ্যের ইতিহাস রক্ষায় একটা বিশাল কাজ
হয় ৷ আছে কিছু লোক এমন আমাদের মধ্যে?
সমাজ সচেনতা কখনই কেবলমাত্র সাহিত্যিক বা শিল্পী দের বরাদ্দ
কাজ নয় ৷ এটা আসে সাহিত্যিক এবং অসাহিত্যিক,
শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত ধনী এবং গরীব,
উচ্চবর্ণ বা নিন্মবর্ণ সবার মাধ্যম থেকে ৷ যার যার নিজস্ব
মানসিকতা থেকে ৷
সংশপ্তক:
এই যে স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে
আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: দেখুন যে যেই
ক্ষেত্রেই কাজ করতে চাক না কেন, প্রত্যেকেই চায় নিজের
কাজের পরিধিকে বাড়াতে। আন্তর্জাতিক হব বলে ধরে নিয়ে নিজের ঘর-পরিবার, সমাজ, ধর্ম, দেশ এসবের প্রতি অবহেলা করে কাজের কাজ যে কিছু হয় না,
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ৷ জীবনের শেষের দিকে
বাংলা ভাষায় মুক্ত ছড়িয়ে গেছেন, সেটা যদি প্রথম থেকে করতেন, তবে তাকে আর আফসোস করে লিখতে হত
না, "এ বঙ্গ ভান্ডারে…" নিজের ভাষাকে নিজের দেশকে না জানলে না ভালবাসলে
আন্তর্জাতিক স্তরে কেন, কোনো স্তরেই হালে পানি পাওয়া যায় না ৷ নিজের কথা
বলেই কিন্তু বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আন্তর্জাতিক সন্মান
পেয়েছেন ৷ অনেকে মনে করেন যে বাংলা ভাষার সীমাবদ্ধতা লেখককে আন্তর্জাতিক আঙিনায়
অপাংতেয় করে রেখেছে ৷ যদি বিষয় সমৃদ্ধ হয়, তবে ভাষা কোনো অন্তরায় হতে পারে না ৷ সে তার
উচ্চতায় উঠবেই ৷
সংশপ্তক:
কালোত্তীর্ণ
সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম
স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: একই ধরনের প্রশ্নের উত্তর একই হবে ৷
খুব দৃঢ় স্বরে বলছি, না, করে না ৷ বরং উল্টো ৷ দেশপ্রেম ছেড়ে বিদেশপ্রেম কোনো দিনও সফল হয় না,
হতেই পারে না ৷ হ্যাঁ, এটা একটা বিষয় যে ইংরাজী একটি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং পৃথিবীর
অনেক দেশ ইংরাজীর রকমফেরকে মাতৃভাষার রূপ দিয়েছে, তারা অনেক তাড়াতাড়ি দুনিয়ার
কাছে পৌঁছে দেয় নিজেদের কথা ৷ তারাও কিন্তু বক্তব্যে
নিজেদের কথাই বলে ৷ মোট কথা আন্তর্জাতিক হওয়ার অতি উৎসাহ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই
নৈরাশ্যের সৃষ্টি করে ৷ ইংরাজী ভাষাকে রপ্ত করে,
নিজের দেশের কথা লিখতে বাঁধা কোথায়?
যদি দুনিয়ার কাছে প্রমাণ করতে চান তবে নিজের কথা সুন্দর
উপযুক্ত মানে এনে ইংরাজীতে লিখলেই তো সবসমস্যার সমাধান হয়ে যায় ৷ আন্তর্জাতিক
সাহিত্য বলে কিছু হয় না ৷ সব দেশের কথা একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করে
আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগত ৷
সংশপ্তক:
বর্তমান বিশ্বায়নের
যুগ সাহিত্যের পক্ষে আশীর্বাদ না অভিশাপ?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: সাহিত্যের পক্ষে
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগ না আর্শিবাদ, না অভিশাপ ৷ আদিম কালে পাথরে খোদাই একটি ছবির আকৃতি দুটো অক্ষরের অবয়ব থেকে
শুরু করে তালাপতা, খড়ি, কলম, টাইপ রাইটার, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট কোনো বিপ্লবই
সাহিত্যের আসল মূল্যকে ছুঁতে পারেনি,
পারবেও না ৷ সাহিত্যের মান নির্ভর করে সাহিত্যিকের নিজের চিন্তন-মননের উপর ৷ মাধ্যমের
সুবিধা-অসুবিধার উপর নয় ৷ আমারা কেউ কোনোদিন মানুষের অগ্রগতি (ভালই হোক বা মন্দ)রোধ করতে পারিনি, পারব না ৷ অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই এর সঙ্গে তাল
মিলিয়েই সাহিত্যকে চলতে হবে৷ আজ যে যান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য
বিশ্বায়ন অতি সহজেই বিস্তার লাভ করেছে নিজের সাহিত্য মানকে ঠিক রাখতে
পারলে এই বিশ্বায়ন লেখকদের কাছে আর্শিবাদ বলেই মেনে নিতে হবে ৷ আজ বিশ্ব-সাহিত্য আপনার ঘরে যেমন মূহুর্তে চলে আসছে, তেমনি আপনার সাহিত্যও অতি দ্রুত অন্যের
কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ৷ এটা তো খুব ভালো দিক,
আমি আবারও বলছি সাহিত্যে মূল্যবোধের
কাছে এই বিশ্বায়নর না আর্শিবাদ না অভিশাপ ৷ তবে কিছু
ভেজালকারীদের পক্ষে এটা একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতি ৷ তবে তাকে প্রকৃত সাহিত্যিক
কি বলা যায়?
সংশপ্তক:
আধুনিক জীবনেরর গতি
সর্বস্বতা ও ভোগবাদী সংস্কৃতি সাহিত্যকে কি ক্রমেই কোণঠাসা করে দিয়ে
ভবিষ্যতের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে বলে মনে করেন আপনি?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: আপনি কোন সময় থেকে আধুনিক জীবন বলবেন,
কাঁচা মাংস থেকে পাথরের আগুনে
ঝলসানোকে? বিজলির আবিস্কারের ফলে পাখার তলায় বসে কলম দিয়ে তাল পাতার
বদলে কাগজে লেখা? রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের জাহাজে চড়ে বিদেশ যাওয়ার বদলে
বর্তমানদের প্লেনে করে যাত্রা?
এটি একটি চলমান জগত ৷ ভালো হোক আর মন্দই
হোক- এর গতি চলতেই থাকবে ৷ আপনি যে ভোগবাদের কথা বলছেন,
সেটা কোন কালে ছিল না? তখনও ঊনচল্লিশ সমাদ্দারের দল ছিল(ঊনচল্লিশবার বিয়ে), তখনও মদের আসরে বাইজি নাচতো ৷ তখনও অর্থলোলুপ মহাজন ছিল,
তখনও রাজা ছিল, তাদের বিলাস ছিল৷ তখনও সারা শরীর জুড়ে সোনার গয়না ছিল ৷ মানুষ
সব সময়ই ভোগবাদী ৷ কাজেই
নতুন করে ভোগবাদিতা সাহিত্যের আসল মূল্যকে ছুঁতে পারে না ৷
পারবেও না ৷
সংশপ্তক: সাহিত্যিকের প্রত্যয়ে
মানুষের ওপর বিশ্বাস কতটা জরুরী? আর বিশ্বাসভঙ্গেরর দহন
তার প্রতিভাকে কি ভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: বিশ্বাস,
বিশ্বাস আর বিশ্বাস মানুষের উপরে বিশ্বাস আর নিজের উপরে
বিশ্বাস ছাড়া কোনো দিনই কোনো কাজ সফল হয় না ৷ সাহিত্যিকের
নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাস, সততা এবং নিষ্ঠা রাখতেই হবে ৷ সাহিত্যিক কোনো উটকো প্রাণী
নয়, যে সে কেবল নিজেকে নিয়ে বাঁচবে ৷
যদি কোনো শিল্পী-সাহিত্যিক কেবল নিজের মধ্যেই নিজের সৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ
রেখে মানুষের কাছে পৌঁছে না দেয়, তবে সে তো নিজের মনেই সাহিত্যের জাল
বিস্তার করতে পারে ৷ কেউতো তাকে বাধা দেবে না ৷ মানুষের
কাছে পৌঁছে দেবে বলেই তো সে লেখক অর্থাৎ লেখে ৷ আর
নিজের কথা প্রত্যেয়ের সঙ্গে না লিখলে
অন্যরা সেই লেখার উপর আস্থা দেখাবে কেন?
নিজের প্রত্যেয়ই শেষ কথা নয়, প্রতিটি পাঠকেরই ভালমন্দ বিচার করার অধিকার আছে ৷ সে আপনার
লেখা নিয়ে তার রায় দেবেই ৷ আশা নিয়ে শুরু করলে কোনো কাজের ফল খুব ভালো হয় না ৷ মা
ফলেষু কদাচন ৷ আপনার সবচাইতে আদর, বিশ্বাস এবং প্রত্যয় দিয়ে লেখা যদি মানুষের কাছে
গ্রহণযোগী না হয়, তবে মনকষ্ট হয় ঠিকই তাতে ভেঙ্গে পড়লে মানুষ হিসাবে কেবল
নয়, সাহিত্যিক হিসাবেও আপনি অসফল ৷
সৃষ্টিশীল লোকেরা যেমন অন্যরকম ভাবে জীবনযাপন করে,
সমাজ অনেক সময় তাদের কষ্ট দেয় ৷ সেই কষ্টই সাহিত্যের রূপ নেয় ৷ কষ্ট আসল মানুষকে
আরো শক্ত করে তোলে, নড়চড়ে মানুষকে গুঁড়িয়ে দেয় ৷ কাজেই দুঃখ কষ্ট থেকে হয়তো
সাহিত্যের মান ভালো হয় ৷ তবে এটাও ঠিক যতোই শক্ত মানুষ হোক না কেন
বারংবার বিফলতা মানুষের প্রতিভাকে একেবারে ভেঙ্গে ফেলতেও পারে ৷
বিফলতা মানেই আরো ভালো সৃজন- একথা সব সময় সত্যি নাও হতে পারে ৷
সংশপ্তক: ভবিষ্যত প্রজন্মের
সাহিত্যের কাছে আপনার প্রত্যশা ও দাবী কি?
কমলেন্দু চক্রবর্তী: আমি সাহিত্যিক নই ৷ কাজেই সাহিত্যিক
হিসাবে আমি কি দাবী করতে পারি ৷ তবে মানুষ হিসাবে নিশ্চয়ই কিছু আশা করি ৷ সেটা হল মানুষের প্রতি
ভালোবাসা,
শ্রদ্ধা আর নিজেকে সাহিত্যিক বা অসাহিত্যিক যাই ভাবুক কেন
মানুষের মতো ব্যবহার ৷আমার চাওয়ার উপর সাহিত্য নির্ভর করবে না ৷ শুধু
নিজের প্রতি নিষ্ঠা আর অন্যের উপর বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এটাই --
কাম্য ৷