ছোটো আমি পর্ব ৩
পুরো
উত্তরবঙ্গেই একটা জিনিস নিয়ে আমরা সবাই বাড়ি ফিরতাম। সেটা হলে জোঁক। আমরা অনেক
ধরণের জোঁক দেখেছি। দেখেছি কি করে সুতোর মতো সরু জোক রক্ত খেয়ে মোটা ঢাইস হয়ে যায়।
অনেকটা তো রামদিন পালওয়ানের মতো ক্ষমতার বাইরে চোদ্দ পোয়া ছাতু (রক্ত) খেয়ে পেট
ফেটেই শেষ। আবার ভদ্র জোঁকও আছে রক্ত খেয়ে পেট ভরে গেলে নিজেরাই খসে যায়। কেই আবার
লেগে থাকে তো লেগেই থাকে। এরাই বেশি জ্বালা দেয়। কোন জোঁকটা কোন পাতার মাথায় যাবে
এসব নিয়ে আমি খুব গবেষণা করতাম। আমার হাফপ্যান্টের ভিতর দিয়ে একেবারে মোক্ষম
স্থানে জোঁক ধরার ঘটনাও বেশ কয়েকবার হয়েছে। বক্সা রোডের জঙ্গলে ফেরত আমাদের গায়ে
জোঁক অবশ্যই আসত এবং আমাদের প্রথম কাজ ছিল নুন দিয়ে ঐ গুলোকে মারা। বামনহাটেও জোঁক
ধরত। ভালোই ধরত। জোঁক নিয়ে ছোটবেলায় যতো গবেষণা করেছি, সেটা বড় বয়স পর্যন্ত চালিয়ে গেলে জোঁক স্পেশালিষ্ট তো
হতামই। জোঁকের নোবেল পুরষ্কারও হয়তো পেয়ে যেতাম।
জোঁক
ছাড়া আর একটা জিনিস অবশ্যই আমরা বাড়িতে আনতাম। অবশ্য জোঁক আনতাম নিজের চামড়ায়
লাগিয়ে আর এটা আনতাম জামা কাপড়ে করে। বিশেষ করে প্যান্টে করে। আমি বলছি চোরকাঁটা।
আমার তো মনে হয় জোঁকের চাইতে চোরকাঁটা কষ্টদায়ক। চারিদিকে যেখানেই যাই, চোরকাঁটার আক্রমণ থেকে রক্ষা নেই। সে খালার মাঠই হোক আর
ছোটোখাটো জঙ্গলই হোক। লম্বায় আমাদের ছোটদের পায়ের হাঁটু অব্দি। সরু গাছের মাথায়
অসংখ্য ছোট ছোট কাঁটা। যদিও গোলাপকাঁটা বা অন্য কাটার মতো চামড়া ফুটো করে রক্ত আর
ব্যাথা দেয় না। কিন্তু চামড়ায় লাগলে একটু ব্যাথার ভাব হয়। আর তার চাইতেও বেশি
বিরক্ত আর অস্বস্তিকর একটা অনুভুতি হয়। চোরকাটার সবচাইতে সমস্যা হল একবার প্যান্টে বা কাপড়ে লাগলে
চট করে বের করা যায় না। আবার ছোট্ট ছোট্ট কাঁটা আঙ্গুল দিয়ে টানলেই হয় না, শুধু একটা দিক দিয়ে টানলে বের হয় – অন্য দিকে টানলে আরও গেঁথে যায়। চোরকাঁটা লাগানো জামাকাপড়
পরাও খুব আরামদায়ক নয়। কাজেই সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে বসে পরো চোরকাঁটা বাছতে। আমি
তো মাঝে মাঝে দিদির হাতে কাজটা ছেড়ে দিতাম। বেচারা বসে বসে আমাদের চোরকাঁটা বাছত।
বামনহাটে
একটা জমিদার বাড়ি ছিল। ঐ এলাকায় ওটাই ছিল সবচাইতে বড় বাড়ি। অট্টালিকা বলে যাকে।
স্থানীয় কোনও সমস্যা হলে জমিদারবাবু সালিশি সভা বসাত। মাঝে মাঝে নানা ধরণের
অনুষ্ঠানও হতো। ম্যাজিক শো, গান-বাজনা, যাত্রাপালা।
একবার ম্যাজিক শো দেখতে গিয়েছিলাম। আমি তখন মনে হয় ক্লাস থ্রি তে পড়তাম। অবাক হয়ে
সব যাদু দেখেছি। হঠাৎ যাদুকর আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, এই তুমি আমার কাছে এসো। আমার বুকটা ধরাস করে উঠল। বেশ মজা
করে ম্যাজিক দেখছিলাম। ইচ্ছা না থাকলেও যেতে হল। যাদুকর কি সব বলে যাচ্ছিল, হাত দিয়ে কী সব করছিল। তারপর একটা আংটি আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা কী?
- আংটি। আমার গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজই বেরোল না। যাদুকর বলল, জোরে বল যাতে সবাই শুনতে পায়।
- আমার গলার স্বর খুব একটা উঠল না। যাদুকর তখন নিজেই বলে উঠল, ও বলছে এটা আংটি।
- যাদুকর আমাকে একটা রুমালের মধ্যে আংটিটা রাখতে বলল। আমি রাখলাম। তারপর
কিছুক্ষণ মন্ত্র-তন্ত্র পড়ল।
তারপর একটা কাঁচা ডিম দেখিয়ে বলল, এটা কি?
- ডিম। আবার আমার মিনমিনে গলা।
- দেখো এর মধ্যে কিছু দেখা যাচ্ছে?
আমি কি
আর দেখব। ডিমের শক্ত সাদা খোলার মধ্যে দিয়ে কি আর দেখা যাবে। আমিও কিছু দেখলাম না।
তারপর রুমাল জড়ানো আংটি আর ডিমটা টেবিলের ওপর রেখে আবার মন্ত্র পড়ল। এবার ডিমটা
হাতে নিয়ে বলল দেখো, এবার ডিমের
মধ্যে কী দেখছ? আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে
বাঁচি অবস্থা। কী দেখলাম জানি না। চুপ করে থাকলাম, যাদুকর তখন বলল, ভাল করে দেখো।
দেখতে পাচ্ছ? দেখো ডিমের মধ্যে আংটিটা
দেখা যাচ্ছে তো? ভালো করে দেখো।
সত্যি
বলতে আমি কিছুই দেখতে পারছিলাম না। বোধহয় আমার মাথা তখন কাজ করছিল না। তাই বাধ্য
হয়ে বললাম – হ্যাঁ।
আমি
এখনও জানিনা সে দিন ডিমের মধ্যে সত্যি আংটিটা দেখেছিলাম কিনা।
জমিদারবাবুর
বাড়িতেই একমাত্র একটা রেডিও ছিল। সামনে দিয়ে দেখছিলাম কাঠের একটা বড়সড় বাক্স। ওটাই
রেডিও। শনিবার দুপুরে অনেকবার দাদাদের সঙ্গে পিছনের জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। দাদারা
গান শুনত। ‘অনুরাধার গান’ । আমি বহু বছর জানলায়
দাঁড়িয়ে থাকতাম। পরে জানলাম ওটা অনুরাধার নয়, অনুরধের গান। একবার বিকেলে জমিদার বাবুর বাড়িতে সালিশি সভা বসেছিল। সব
ব্যাপারটা তখন ভালো করে বুঝিনি। আমাদের একজন স্কুলছুট পাড়ার দাদা কি যেন অন্যায়
করেছিলো বলে জমিদারবাবু আরামকেদারায় বসে পরিষদ দল আর সেই দাদা মুখ কালো করে কান
ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে দড়ি দিয়ে ধরা একটা ছাগল। দাদা বোধহয় ঐ ছাগলটার সঙ্গে কিছু
একটা খারাপ কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। ছাগলের একটা মজা ছিল। এমনিতে ও যতই তিড়িং
বিরিং করে লাফাক, কোনও রকম ভাবে
ধরে যদি একবার কাট করে শুইয়ে ফেলা যায় আর চোখ ঢেকে দেওয়া যায় একটা কচুপাতা দিয়ে
তবে ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটুকু না নড়ে ওভাবেই পড়ে থাকে। ঐ খেলাটা মাঝে মাঝে সবাই খলত। আমার কিন্তু ছাগলটার জন্য কষ্ট হতো।
আমি প্রায়ই কচুপাতাটা সরিয়ে দিতাম। আর এরজন্য বড়োদের কাছে বকুনিও খেতাম। ছাগলের
কথা যখন উঠলো, তখন পাঁঠার মাংস খাওয়ার
কথাটা কেন বাদ যাবে? একটা চলতি কথা
আছে বাঙালরা সবাই বাংলাদেশে জমিদার ছিল। সেই জন্যই আমাদের বরিশালের আদি বাড়ির কথা
বলে আর নিজেকে ছোট করতে চাই না। তবে কিঞ্চিত জমি জায়গা আমাদেরও ছিল। কাজেই বাবার
মধ্যে একটু- আধটু জমিদারি ভাব ছিল, কথাটা হচ্ছিল পাঁঠার মাংস খাওয়া নিয়ে। সাতদিন হোক, পনেরো দিন হোক, বা মাসে পাঁঠার মাংস খাওয়া মানেই বাজার থেকে কাটা মাংস নয় – বাবার অডার হতো গোটা পাঁঠা কেনার। আমাদের কিছুই করতে হতো না
–
বাবার মুখ থেকে অডার বেরোনো মাত্র লোকজন গিয়ে পাঁঠা কিনে
আনত। তাই সেই জ্যান্ত, ভীত পাঁঠাকে
গোরার কাছাকাছি থাকা দুটো গাছের দিকে টানটান করে দড়ি দিয়ে বাঁধা হতো। বলি দেওয়ার
জন্য একজন বিশেষ লোক ছিল – ঠিক সময় হাজির
হয়ে যেত,
বিশাল রাম দা নিয়ে। ছোটোখাটো ভিড় জমে যেত। এক কোপে পাঁঠার
ধর আর মুণ্ডু আলাদা হয়ে যেত। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটত আশেপাশে। কেউ কেউ আবার হাততালি
দিত। অন্যরা লেগে পড়ত পাঁঠার মাংস নিয়ে। প্রথমেই ভালো জায়গার মাংস আমাদের বাড়িতে
যেত। সেটা বাবার দেওয়া পয়সার জন্যই হোক বা উঁচু পদের সম্মানের জন্যই হোক। তারপর
চলত নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি। একটা জিনিস উত্তরবঙ্গে সব জায়গায় আমি দেখেছি খুব কম
সময়েই মানুষ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বা কথাকাটাকাটি করত। কাজেই মাংস ভাগ ও বেশ ভালো
ভাবেই মিটে যেত।
পাঁঠা
কাটার ব্যাপারটা কিন্তু একটুকুও মন থেকে মেনে নিতে পারতাম না। আমার খারাপ লাগত।
এমনকি বমি পেত, মাথা ঘুরত। এই ছিল একটা
জ্যান্ত প্রাণী এই হয়ে গেল পাতের রান্না করা মাংস। আমি মাংস প্রায়ই খেতামই না।
চোখের সামনে পাঁঠার কান্না, গলা কাটা, রক্তের ফিনকি ভেসে আসত।
বাবার
এই জমিদারি স্টাইলে পাঁঠার মাংস খাওয়া কিন্তু একদিন একটা ঘটনায় বন্ধ হয়ে গেল।
পাড়ার বড়বাবুর পাঁঠা কাটা হবে। কাজেই ছোটোখাটো একটা ভিড় হওয়া স্বাভাবিক। হোতোও। এর
মধ্যে থাকত দু-একজন নেপালি স্টাফ তারা হাতে
আলুমিনিয়ামের থালা বা বাটি নিয়ে ওত পেতে থাকত রক্ত ধরার জন্য। যে মুহূর্তে গলা
কাটা পড়ত আর রক্ত বেরোনো শুরু হয়ে যেত ওদের মধ্যে রক্ত ধরার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। কে কত বেশি রক্ত
ধরতে পারে। একটু ধাক্কাধাক্কিও চলত। একদিন রক্ত নেওয়ার আগ্রহে খাঁড়া নামছে আর একজন
নিজের মাথা গলিয়ে রক্ত ধরার জন্য নিজের মাথাটিই এগিয়ে নিয়ে গেছে। এমনভাবে যে কোপ
পড়লে পাঁঠার গলার সঙ্গে ওর গলাটাও নেমে যেত। শেষ মুহূর্তে বলি কর্তা খাঁড়াটা
থামিয়ে দিতে পেরেছিল কোনমতে। এরপর বাবা ঘোষণা করেছিল ও ভাবে মাংস খাওয়া বন্ধ। সত্যিই
বন্ধ।
রক্ত
নিয়ে এতো কাড়াকাড়ির কারণ হল রক্তের স্বাদ। শুনেছিলাম রক্তের স্বাদ নাকি খুব ভালো
এবং নেপালিদের খুব প্রিয়। কোনও পাত্রে রক্ত রেখে দিলে কিছুক্ষণ পরে তা জমে যায়। তারপর সেটা টুকরো করে
কেটে রান্না করা হয়। কী ভাবে রান্না করা হয় সেটা অবশ্য আমি জানি না।
পাঁঠার
গলা কাটার কথায় একটু আমার ঠাকুরদাদার কথা মনে পড়ে গেল। ওনার অনেক কথা পরে শুনেছি।
সে সব থাক। আমি বলছি নাক কাটার কথা। না, না,
এটা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ বা লোকের কোথায় নাক
কাটা যাওয়া নয়। সত্যিকারের নাক কাটা। বক্সা রোডে থাকতে যখন অ-আ-ক-খ-এর নিজস্ব
পদ্ধতিতে বন্দী অবস্থায় জোর কদমে অনুশীলন চলছে, তখন একদিন আমি মাকে বলেছিলাম, মা দেখো, বইতে ভুল লিখেছে।
মা বলল, ‘ভুল? কোথায় ভুল?’
- এই দেখো না। লিখেছে ঠাকুরদাদার শুকনো গাল।
- ঠিকই তো আছে। দেখছ না শুকনো জালওয়ালা বুড়ো মানুসটার ছবি।
- না মা, ওটা হবে ঠাকুরদাদার নাক
কাটা। মা কোনও কথা না বলে চুপ করে বেরিয়ে গেল। ঠাকুরদাদার গাল শুকনো, না নাক কাটা – এই বিভ্রান্তি আমাকে অনেকদিন ভুগিয়েছিল। আর একটু খোলসা করি।
দেশভাগ
হওয়ার আগে থাকতেই বাবা চাকরিসূত্রে এদেশে চলে এসেছিল। জ্যাঠামশাই ডাক্তার – উনিও কলকাতায় প্র্যাকটিস করতেন। কাকারাও চলে এসেছিল এমনকি
ঠাকুমাও ছেলেদের সঙ্গে এসেছিলেন পরে জমিদারি রক্তের মেজাজ নিয়ে একা ঠাকুরদাদা
ছিলেন। জমি জায়গা ফেলে তিনি আসবেন না। চলছিলো এভাবেই। আমরা তখন আমিনগাঁওতে। হঠাৎ
একদিন একজন স্টাফ মাকে একটা যুগান্তর কাগজ দিয়ে বলল, দেখুন মনে হচ্ছে বড়বাবুর বাবার খবর। সত্যি তাই যুগান্তর পত্রিকায় একেবারে
প্রথম হেডলাইন খবরটাতেই লেখা আততায়ীর হাতে নামি জমিদার নীলকণ্ঠবাবু গুরুতর আহত।
এসব কথা অবশ্য আমি পরে জেনেছি। খুঁজলে আদি বাড়িতে মায়ের রেখে দেওয়া বাক্সে এখনও
হয়তো খবরের কাগজটা পাওয়া যাবে। ঠাকুরদাদাকে গুরুতর আহত অবস্থায় কলকাতার ডাক্তার
জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে দিয়ে গেল ওখানকার কিছু লোক। আমরা দেখতে গেলাম কলকাতায়।
বারান্দায় সারাদিন বসে থাকতেন ঠাকুরদাদা। আর মেজাজ গরম করে ছোটদের বকাবকি করতেন।
ওনার এখানটা ভালো লাগত না। আততায়ীদের হাতে চোদ্দ জায়গায় কোপ পরেছিল। আর নাকটা কেটে
পড়ে গিয়েছিলো সম্পূর্ণ। জীবনে প্রথম আমার নিজের বা অন্য কারো ঠাকুরদাদার দেখা। আর তখন থেকেই আমার ধারণা দৃঢ় হয়ে গিয়েছিলো যে সব
ঠাকুরদাদাদেরই নাক কাটা হয়। হতেই হবে, নইলে সে ঠাকুরদাদাই নয়। ছয়মাসের মাথায় একটু সুস্থ হতে না হতেই কিন্তু
ঠাকুরদাদা আবার নিজের বরিশালের আদি বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন।
জায়গাটার
নাম মনে পড়ছে না – একটু গ্রামের
দিকে কালি পুজোর দিন বাইশ হাত কালি তৈরি হতো। মেলা বসত।
এতো বড়
কালি ঠাকুর যে পুজোর জায়গাতেই কালি ঠাকুর বানানো হতো। আর পুজোর জায়গাতেই কালি
ঠাকুর বিসর্জন দেওয়া হতো। আর পুজোর ক-দিন মেলাটেলা চলার পরে সাময়িক ভাবে বানানো ছাদটা খুলে ফেলা হতো। আর সারা বছর জলে – রোদ-
বৃষ্টিতে মাটি খসে পড়ে কাঠামো বেরিয়ে যেত। পরের বছর আবার
সেই কাঠামোতেই মূর্তি গড়া হতো। এখানকার বিশাল মূর্তি যতোটা দর্শনীয় ছিল না ওখানকার
বলি। ভোরবেলা থেকে শুরু হতো লোকজনদের দেওয়া জিনিসের বলি। চালকুমড়ো, আম, পেঁপে, এসব নিরামিষ ফল দিয়ে শুরু হত আর শেষ হত মোষ দিয়ে। পাঁঠা
বলির সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। সারাদিন ধরে চলছে তো চলছেই। একজন কোপ মারছে, পুরোহিত পাঁঠার মাথাটা ঠাকুরের পায়ে জমা রাখছে আর ধরটা
পাঁঠার মালিককে দিয়ে দিচ্ছে। মূর্তির সামনে রক্ত মাথা মুন্দুর পাহার হয়ে যেত। আমার
গা শিরশির করত। ভালো লাগত না। মোষবলি ছিল স্পেশাল প্রগ্রাম। দেখার জন্য ভিড়
ঠেলাঠেলি। আমি ওসব দেখতে মোটেই রাজী নই। কিন্তু দাদারা ভাগবতীকে অনুরোধ করে-টরে ওদের নিয়ে যেতে রাজী করাতে। ভগবতীর কথা আলাদা করে লিখতে হবে। যাই হোক ভগবতী আবার আমাকে ছাড়া কথাও যাবে
না। কাজেই আমাকেও যেতে হল ওর কাঁধে চেপে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। শুনলাম মোষ
বলির স্পেশালিষ্ট রেডি। মোষকে রেডি করাতে অবশ্য তিন- চার দিন সময় লাগত। পুজোর স্থানের অধীনেই একটা পুকুর ছিল। শুনেছিলাম পুজোর আগের
দিন নাকি পুজোর শেষে পুকুরের তলায় চলে যেত – কেউ সারা বছর আর অসবের খোঁজ পেত না। আমার কিন্তু ছোটো বয়সেও ওসব বিশ্বাস হতো
না মোষকে রেডি দেওয়া হতো আর দিনে কয়েকবার করে ওর ঘাড়ে গলায় ঘি-তেল মালিস করা হতো। উদ্দেশ্য জায়গাটা নরম করা যাতে ঘ্যাচাং
করে একবারেই মুণ্ডুটা নামিয়ে দেওয়া যায়। জানি না সেই কাটা মোষের মুণ্ডু আর শরীর নিয়ে কি করা হতো। এই বলি দেখার জন্য ভিড় একেবারে উপচে
পড়ত। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম – মোষ বলি তো
দূরের কথা, অতো উঁচু কালীমূর্তির
মাথাও দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা ভগবতী আমাদের সবাইকে নিয়ে একটা দোকানের টিনের ছাদে
উঠে পড়ল। অস্থায়ী দোকান নিচের বাসে খুঁটির মড়মড় শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ছাদেও
শুধু লোক আর লোক। ভীরের মধ্যে চিৎকার উঠল, এই বার হবে – এইবার হবে।
ভগবতী
চট করে আমাকে কাঁধে নিয়ে বলল, খোকা দেখো
এবার দেখতে পারবে। এক ঝলক দেখলাম। একটা লম্বা চুলওয়ালা ভয়ংকর মূর্তির হাতে বিশাল
খাঁড়া এই মোষের কাঁধের উপর পড়ছে
– আমি চট করে
চোখ বন্ধ করে নিলাম। বাড়ি ফেরার পথে ভগবতী বলল, কি খোকা, দেখলে মোষ বলি। কেমন দেখলে?
আমি
চুপ করে থাকলাম। এটা কি ঠাকুরপুজো না খুন?
ঠাকুরপুজো
বলতে সবাই বোঝে একটাই। দুর্গাপুজোর সময় ওখানে গোনাগুনতি কয়েকটা পুজো হতো। জমিদারবাবুর
বাড়ির পুজোতেই বেশি জাঁকজমক হতো। আমরা অবাক হয়ে যেতাম দুর্গামূর্তি দেখে। পরে
শহরের বিশেষ করে কলকাতার ঠাকুর নির্মাণ দেখে মনে হতো তখনকার আমাদের দেখা অবাক করা
মূর্তিগুলি নেহাতই খেল – কাঁচা শিল্পীর
কাজ। ভাগ্যিস আগে বড় শহরের ঠাকুর দেখিনি তবে আর ছোটবেলার অবাক হয়ে অসুরের ঝাঁকরানো
চুল,
চোখের রাগ, সিংহের কেশর, দাঁত বের করা হাঁ-মুখ,
গণেশের বিশাল ভুঁড়ির পাশে ছোট্ট ইদুর, কার্তিকের মতো চেহারা দেখতে উৎসাহ পেতাম না। ঠাকুরের
প্যান্ডেল মানে কয়েকটা বাঁশের উপর কোনোরকম একটা ত্রিপল টানিয়ে চারদিকে রঙিন কাগজের
শিকল। ওখানে বিদ্যুৎ ছিল না, কাজেই আলোর
রোশনাই বলতে কয়েকটা হ্যাজাক। হ্যাজাক এক অদ্ভুত দর্শনীয় বস্তু। ভিতরে একটা নেটের
মতো
(ম্যানটেল) ঝুলন্ত ওটা থেকেই আলো বেরত। মজা হল ঐ নেট পুরো কালো হয়ে গেলেও আলো দিত। কিন্তু
একবার হাত ছোঁয়ালেই ঝুরঝুর করে ভেঙে যেত। সবাই অবশ্য হ্যাজাক জালাতে পারত না।
স্পেশালিষ্টরাই পারত। ।
দুর্গাঠাকুর
দেখার মজা পুজোর একমাস আগে থেকেই শুরু হতো। সত্যি কথা বলতে কি পুজোর ক’দিনের চাইতে আগের দিনগুলোই আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। এই
কাঠের ফ্রেম বানানো শুরু হল এই খড়ের উপর দড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একেকজনের মূর্তি বানানো
চলে বেশ কয়েকদিন। সব মাথাছাড়া ধরের মূর্তি। দেখলে মাঝেমাঝে ভয়ও লাগতো। তারপর মাটি
লাগানো চলছে তো চলছেই। একদিন ঠাকুরগড়া কারিগরদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম করেছিলাম – খড় আর মাটি একসঙ্গে করে বানালে তো তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। ঠাকুর দেখার জন্য অতো দেরি দেরি করতে হয় না। তার সব কথা বুঝিনি তখন। উত্তর দিল একে বলে নির্মাণ – ধীরে ধীরে। উনি অজান্তে আমাকে এমন একটা ভালো কথা
শিখিয়েছিলেন যে এমন কথাটা আমার কাজে লাগে। আমি মায়েদের বলি যে শিশুদের শিশুদের
শুধু খাইয়ে-পড়িয়ে বড় করলেই হয় না – ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়। কে বলে শিশু থেকে ধীরে ধীরে ‘মানুষ’ নির্মাণ। সময় লাগে – লাগে ধৈর্য্য
। আমরা অপেক্ষা করতাম কবে গর্জন তেল লাগানো হবে। বার্নিশ করলে যেমন কাঠ চকচক করে
তেমনি মূর্তি রং করার পরে গর্জন তেল লাগালে মূর্তি চকচকে করে। জৌলুস বাড়ে ।
জৌলুসহীন ঠাকুর বেশি দিন ভাললাগত না। তাই আমার গর্জন তেল লাগানোর জন্য বেশি তাগাদা
দিতাম। সবচাইতে মজার অনুষ্ঠান ছিল নারকেল কাড়াকাড়ি খেলা। এখনকার ছেলে মেয়েরা মনে
হয় খেলাটা দেখেনি। ক্রিকেটের T- 20 এর
চাইতে উত্তেজনায় ভরা খেলা।
নারকেল
কাড়াকাড়ি খেলোয়াড় আলাদা হতো। গাট্টা-গট্টা, শক্তিধারী, সাহসী ভয়ডরহীন এবং তৎপর না হলে এই খেলায় নামার কথা ভাবতেই
পারতাম না। আমরা তো কোনদিনই ঐ খেলার কথা স্বপ্নেও ভাবতাম না। হ্যাঁ, তবে দেখার উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। এক একদিন একক মণ্ডপে এই খেলার
ব্যবস্থা হতো। আর খবর পেয়ে আমরাও ছুটতাম। গিয়ে দেখতাম খেলার প্রস্তুতি শেষ।
মূর্তির বেদি থেকে পনেরো-বিশ হাত দূরে
একটা চৌকো মতো জায়গায় বানানো হতো। ক্রিকেটে যেমন পিচের খুব মাহাত্ম তেমনি এই
জায়গাটাই আসল। আট-দশ হাত একটা
চৌকো জমিকে সামান্য নিচু করে গর্ত করা হতো। মানে এক হাত গভীর পুকুর বলা যায়। তারপরে ঢালা হতো
জল আর আলগা মাটি। তারপরে কয়েকজন পা দিয়ে এই মাটি চটকে চটকে একেবারে কাদা কাদা করে
দিত। একেবারে কাদাকার কাদাকার করে ফেলা হতো জায়গাটাকে। এই খেলায় দুজন খেলোয়াড়
থাকত। হাট্টাগোট্টা চেহারার দুজন নারকেল কাড়াকাড়ি খেলোয়ার হতো একজন অন্যজনের প্রতি
পক্ষ। পরনে ল্যাংগটের করে ছোট কাপড়ে পেঁচিয়ে খালি গায়ে একজন খেলোয়াড় একটা খোলসহ
নারকেল কোলের মধ্যে নিয়ে কাদা জায়গায় ঠিক মাঝখানে গিয়ে বসত। সময় নিয়ে নারকেলটাকে
ভালোভাবে আস্টেপৃস্টে ধরে রেডি হলে তখন যে খেলোয়াড় মাঠে মানে কাদায় নামত যে বসে
থাকত তার কাজ হল নারকেল হাত ছাড়া না করা আর অন্যজনের কাজ হল নারকেল কেড়ে নিয়ে কাদা
পেরিয়ে ঠাকুরের বেদীতে কাছে নারকেল রেখে আসা। শুরু হতো এক অদ্ভুত লড়াই। কেউ কাউকে
ছাড়বে না। আমরা উত্তজনায় টানটান করে দেখে যাচ্ছি কে জেতে? খেলোয়াড়দের আবার নিজস্ব সাপটারও থাকত। তারা হাততালি আর
চিৎকার করে নিজের পক্ষকে উৎসাহ দিত। এদিকে খেলোয়াড়দের চেহারা কাদায় মাখামাখি হয়ে
বীভৎস হয়ে উঠেছে – বোধহয় হিংসতাও
চলে এসেছে মনে। কেউ কাউকে ছাড়বে না। গড়াগড়ি কাড়াকাড়ি চলছে তো চলছেই। হয়তো
দ্বিতীয়জন অন্যজনের হাত থেকে নারকেল কেড়ে নিয়ে কাদার উপর দিয়ে দৌড়তে চেষ্টা করছে, ততক্ষণে অন্যজনের হাত থেকে নারকেল কেড়ে নিয়ে কাদার উপর দিয়ে
দৌড়তে চেষ্টা করছে, ততক্ষণে
অন্যজন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তাকে আবার ঝাপটে ধরেছে। আবার শুরু হয়ে গেছে কাদার মধ্যে
ঝাপটাঝাপটি। খেলার কোনও সময় সীমা থাকে না। যতক্ষণ যে কোনও একজন নারকেল নিয়ে বেদীতে
পৌছাচ্ছে,
ততক্ষণে খেলার যুদ্ধ চলতেই থাকবে। কখনও কখনও বম্ভারম্ভে
লঘুক্রিয়া-ও হয়ে যেত। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব শুরু হওয়ার আগেই চোখের নিমেষে প্রতিদ্বন্দ্বী ??? চিলের মতো ছোঁ মেরে নারকেল কেড়ে নিয়ে বেদির কাছে পৌছে
বাজিমাত করে দিত। হতভম্ব হয়ে কাদার মধ্যে বসে থাকত অন্যজন। আমাদেরও আনন্দেও কাদা
মাখিয়ে দিত। আবার উল্টোও হতো। কাড়াকাড়ি চলছে তো চলছেই। খেলোয়াড়রা ক্লান্ত তো হতোই – দর্শকদের ক্লান্তি চলে আসত। হয়তো শেষমেশ দেখা যেত দর্শক
বলতে প্রায়ই কেউ নেই। একা নারকেলটা কাদায় পড়ে আছে আর মাত্র একহাত দূরেই পড়ে রয়েছে
শক্তিহীন দুটো কর্দমাক্ত দুটো মানুষ। খেলা ড্র।
আসলে
মজা হতো কালীপূজোর দিন। কারণ সেদিন অন্ধকার রাতে আমাদের প্রতেকের হাতে থাকত টর্চ।
একটা নারকেল মালার আধ-কাটা খোলের
সঙ্গে একটা কাঠি বেঁধে তৈরি হতো হ্যান্ডেল আর সেই খোলার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হতো
ছোট্ট একটা জলন্ত মোমবাতি। তাতে আলো না যতো বেরত দেখাত তার চাইতে মোমবাতি জলন্ত
রাখাটার দিকে সব মন দিতে গিয়ে হোঁচট খেতাম বেশি। ঠাকুর- ঠাকুর দেখা চলত – কিন্তু সেটা ছিল গৌণ। কার মোমবাতি কতক্ষণ জ্বলে সেটাই ছিল আসল খেলা। আর যদি
মোমবাতি শেষ হয়ে যায়? কোনও পরোয়া
নেই সব বাড়ীতেই মোমবাতি জ্বলছে। সেখান থেকে একটা তুলে নিলেই হতো।
কালীপূজোর
পরের দিন ছিল আরও মজা। গলে জমে থাকা মোম কুড়ানো। অন্যের চাইতে আমারই বোধহয় এই
কাজটা বেশি পছন্দের ছিল। কুড়নো মোম গলিয়ে তাতে সুতো দিয়ে আবার নতুন মোমবাতি বানানো, আর মোমের দলা হতে নিয়ে খবরের কাগজের কোনও ছবির উপর ভালো করে
ঘষতাম। খবরের কাগজের ছবিটা সাদা কাগজটার গায়ে লেগে যেত – আর সেটা কেটে যত্ন করে রেখে দিতাম।
হাট
একটা বেশ মজার ব্যাপার। সপ্তাহে দুদিন হাট বসত। একটা রোববার অন্যটা সপ্তাহের মাঝের
যে কোনও দিনে হাট ছিল বেশি আনন্দের । সেদিন স্কুল হাফ ছুটি হয়ে যেত। ছাত্র-শিক্ষক সবাইকেই হাটে যেতে হতো। আমাকে কোনোদিন বাজার করতে
হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি এই তেষট্টি বছর বয়সে আমি কত দিন বাজার করেছি বোধহয় গুনে
বলতে পারব। বাজারের দায়িত্বে থাকল মেজদা। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে গার্জিয়ান মেজ দা। ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে গার্জিয়ান দিদি আর বাইরের
গার্জিয়ান মেজদা। আমাদের তাতে ভালো হতো। নিশ্চিত হয়ে মেজদার পিছন পিছন ঘুরে
বেড়াতাম। বাজারের জন্য বরাদ্দ হতো আট খানা কি এক টাকা। বেশি জিনিস কিনতে হলে বড়জোর
দুই টাকা। মেজদা প্রথমে আমাদের নিয়ে একটা চানাচুরয়ালার কাছে হাজির হতো। এক পয়সা বা
দু পয়সায় চানাচুর কিনে নিয়েই আমাদের সবাইকে ভাগ করে দিত। তারপর শুরু করত বাজার
করা। মেজদা খুব ভালো বাজার করত। কোনও সবজি সঙ্গে কোনও অনুসঙ্গ কিনতে হবে সব ঠিক
মতো কিনত বাজার ঘুরে ঘুরে সেরা অথচ কম দামে সব কিনত। আমাদের শুধু কাজ ছিল থলে ভরা।
প্রায়ই থলে ভীষণ ভারি হয়ে যেত কিন্তু ওটা আমাদের জন্যই বরাদ্দ কাজ কাজেই আমাদের
দায়িত্ব।
বামনহাত
কিন্তু এক কথায় বলা যায় বর্ধিষ্ণু জায়গা। কারণ এখানে প্রচুর পাটের ব্যবসা ছিল।
প্রচুর পাট গাছ হতো। চাষিরা চাষ করত ঠিকই কিন্তু বেশিরভাগ ব্যবসাই থাকত বারয়ারিদের
হাতে। পাট যেত বাইরে কোথায় জানি না। তবে যেত সবই মাল গাড়িতে। কাজেই স্টেশনের সঙ্গে
সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্দ্য। মাল গাড়ী বুক করতে হত বাবাকে। কে আগে মালগাড়ীর আলটমেন্ট
কুরতে হতো। আর এসব করতে হোতো বাবাকে। কে আগে মালগাড়ী পাবে এ নিয়ে ব্যাবসায়িদের
মধ্যে এমন কি বাবার সঙ্গে একটু
আধটু মন কষাকষি হতো। তবে এটা তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। আমাদের চোখ থাকত পাটের
গাঁটগুলির দিকে। তখন অতো বুঝতাম না, কিন্তু এখন ভাবি আর অবাক হই। আমরা সবাই জানি পাট দিয়ে বস্তা, দড়ি, ব্যাগ এবং
সুন্দর সুন্দর নক্সা করা হয়। কিন্তু একসঙ্গে পাটের সুতোগুলোকে নিয়ে গাঁট বাঁধা
আমার মনে হয় বিশাল একটা আর্ট। একবারে জ্যামিতির মাপে চৌকো পাটের গাঁটগুলো মনেই হবে
না যে ওগুলো সব আলগা পাটের সুতো দিয়ে তৈরি। আমি দক্ষিণবঙ্গেও পাটের বাণ্ডিল দেখেছি
যেগুলো নেহাতই এলেবেলে করে জড়ানো। কিন্তু উত্তরবঙ্গে সেই ছোটবেলার দেখা পাটের গাঁট
দেখলে এখন মনে মনে অবাক হয়ে যাই। আর একেকটা গাঁটের ওজন? ঠিক মনে নেই তবে দু’মন কিংবা আড়াই মণ। একটা শক্ত সামর্থ্য কুলিরও ওটা মাথায় নিয়ে মাল গাড়িতে তুলতে
পা টলমল করত। কখনও দুজনে মিলে মাথায় নিত। এসব এতো বিস্তারে না লিখলেও চলত। কিন্তু
আমাকে যে ভগবতীর কথা বলতেই হবে।
ভগবতী
সম্ভবত বিহারের অধিবাসী। বামনহাটের রেলের কুলি। প্যাসেঞ্জারদের মালপত্র তোলার কাজ
প্রায় থাকতই না বলা চলে তবে পাটের গাঁট তোলার কাজটা নিয়মিত থাকত। কেন জানি না আরও
অনেক কুলি থাকতেও ভগবতী আমাদের বারিতেই বেশি সময় পড়ে থাকত। মায়ের ফাই-ফরমাস খাটত বিনা পয়সায়। বদলে দুপুরে আর রাতের খাওয়া।
ব্যবস্থাটা আপনা থেকেই হয়ে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে ভগবতী যে আমাদের সদস্য হয়ে উঠবে
সেটা আমরা কেউই ভাবিনি। সদস্য বললে ভুল হবে, আমাদের গার্জিয়ানই হয়ে উঠলো। মা নিশ্চিন্ত হয়ে ভগবতীর উপর ছেড়ে দিল। সকালে ঘুম থেকে তোলা, স্কুলের জন্য তাড়া দেওয়া – এসব ভগবতীর রোজকার কাজ। ভগবতীর মাঝে মাঝে আমাদের এখানে –ওখানে ঘুরতে নিয়ে যেত। যেমন কোচবিহারের রাসমেলা। কোচবিহারের
রাস মেলা ছিল বিখ্যাত। সারাদিন ঘুরে দেখতে পা ব্যথা হয়ে যেত সবার। কিন্তু আমার
বিশেষ অসুবিধা ছিল না। কারণ বেশীরভাগ সময় আমি ভগবতীর কাঁধে চড়েই ঘুরতাম। বিশাল
পুতনা রাক্ষসীর বুকের উপর ছোট্ট নীল কৃষ্ণ এখনও আমার চোখে ভাসে। ভগবতী মেলায় ঘুরত আর আমাকে বলত, দেখো কোনও মেম সাহেব পছন্দ হয় কিনা। যাকে পছন্দ করবে, তার সঙ্গেই তোমার বিয়ে দিয়ে দেব। মায়ের চাইতেও ভগবতীর আদেশ
আমাদের বেশি শুনতে হোতো। অবশ্য আমাদের ভালো লাগতো । আমরা বছরে একবার কলকাতায় যেতাম
বেড়াতে। একবার ভগবতীও আমাদের সঙ্গে কলকাতায় জ্যাঠামশায়ের বাড়ি, বিহারে কাকাবাবুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলো। একবাড়ে বাড়ির লোক
হয়ে যাওয়া ভগবতীকে কিন্তু একদিন আমাদের বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছিলো। বাবা, মা আমাদের চাইতেও ভগবতীকে বেশি বিশ্বাস করত। একদিন বাবা
ভগবতীকে একশো টাকার মানিঅডার করতে গেল – গেল তো গেল। আর দেখা নেই আমাদের খুব চিন্তা হচ্ছিল ভগবতীর কোনও বিপদ হয়েছে
ভেবে। সকালে বাবা নিজে গেল ভগবতীর ছোট্ট কোয়াটারসে। ওর সঙ্গে আরও একজন থাকত। সে বলল, ভগবতী তো কাল দুপুর থেকেই আসে নি। আমি ভাবলাম আপনাদের
ওখানেই বোধহয় রাত কাটিয়েছে। এরপর ভগবতীর আর দেখাই পাওয়া গেল না। ওর বদলে অন্য লোক
রাখা হল। নতুন লোকটির নাম ছিল চলিত্তর। ওর অনেক গল্প। তবে তাতে আর ঢুকতে চাই না।
ধীরে ধীরে ভগবতীর কথা আমরা ভুলে গেলাম। মাঝে মাঝে ওর জন্য খুব মন খারাপ হোতো। আমার
ছোট ভায়ের সঙ্গে ছবি তুলে নিজের হাতে আমাদের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো। আমাকে ঘাড়ে করে
মেমসাহেব দেখানো, কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করানো। কিন্তু আসতে আসতে সবাই মন থেকে মুছে যেতে লাগল।
হটাৎ
একদিন জ্যাঠামশায়ের চিঠি এল। ভগবতী ওখানে এসেছে। ভালোই আছে। খুব ভালো লোক। এখন
বিহারে আমাদের কাকাবাবুর বাড়িতে যেতে চাইছে। বাবার কথা মতো ওকে কিছু টাকাও দিয়েছেন
জ্যাঠামশাই।
চিঠি
পড়ে আমরা সবাই খুব অবাক। বাবা জ্যাঠামশায়কে টাকা পয়সা দিতে বারন করে পোস্টকাডে
চিঠি লিখে জানাতেই কাকাবাবুর চিঠি এল। তাতে কাকাবাবু লিখেছে ভগবতী এসেছে। ওকে
পাঠিয়ে ভালই করেছো বাবা। বাড়ির সব কাজ করে দিচ্ছে। বাচ্চাদের দেখাশোনা করছে। একটু
বেশিদিন থাকলে ভালোই হবে। আমি ওর ফিরে যাবার সময় খরচাপাতি দিয়ে দেব।
বাবা
অবাক। ভগবতী আমাদের জ্যাঠা –কাকাদের বাড়ি
ঘুরে বেরাচ্ছে অথচ ওরা জানেই না যে ও বাবার একশো টাকা নিয়ে পালিয়েছে। একশো টাকা
বাহান্ন-
তিপান্ন সালে অনেক টাকা। কিছুদিন পরে কাকার চিঠি আবার এল
ভগবতী ফিরে গেছে মানে আমাদের কাছে এসেছে। কিন্তু ভগবতী এল না।
কয়েক
মাস কেটে গেছে হটাৎ ভগবতী মাথা নিচু করে চোরের মতো আমাদের বাড়িতে এল। উঠনে দাঁড়িয়ে
থাকল চুপ করে। বাবা তখন ছিল না। সে এক অদ্ভুত অবস্থা আমরা মাথা নীচু একটু একটু করে
ভগবতীকে দেখছি আর সেও একেক বার মাথা তুলে দেখছে। কোনও পক্ষই কথা বলছে না। আমরা
জেনে গেছি ভগবতী অন্যায় করেছে। ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে না। আবার ওকে দেখে কোথা
বলতেও ইচ্ছা করছে – ইচ্ছা করছে
কাছে যেতে। মনে হয় ভগবতীর মনের অবস্থাও সে রকমই। এর মধ্যে মা চুপচাপ এসে ভগবতীর
হাতে একটা রুটি আর চা দিয়ে গেল। চুপচাপ করে খেয়ে ভগবতী বেরিয়ে গেল। বাবা বাড়ি ফিরে
সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। কোনও কথাই বলল না। ভগবতী দুপুরবেলা মাথা নিচু করে হাজির
হল। হাতে ঘটি। ঘটির কথা আগে লিখিনি। ভগবতীর একটা সুন্দর চকচকে পিতলের ছিল। ওর
খাওয়ার পাত্র। যখনই যেতে আসত হাতে করে ঘটিটা নিয়ে আসত। বাঁ-হাতটার ভর ঘটিতে দিয়ে অদ্ভুত ভাবে খেতে বসত। সত্যি বলতে
আমরা যে ভাবে পায়খানায় হাঁটু মুড়ে বসি সে ভাবে। মা কয়েকবার ওকে বলেওছিল ওভাবে ভাত
খেতে না বসার কথা। কিন্তু ভগবতী ওভাবেই পাকা উঠোনে বসে ভাত খেত। সেদিনও ভগবতী ঘটি
হাতে এলো। মা বোধহয় অনুমান করেছিলো যে ও আসবে। তাই কোনও কথা না বলে ওকে ভাত
ইত্যাদি বেড়ে দিল। ভগবতী চুপচাপ খেয়ে কোনও কথা না বলে চলে গেল। আবার রাতে এলো ঠিক
খাওয়ার সময়। আমাদের ভাইবোনদের ওর জন্য কষ্ট হচ্ছিল। ভগবতী ছিল আমাদের গার্জিয়ান
আমাদের খুব প্রিয় লোক। তার অবস্থা দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল ও যদি আবার আগের মতো
হতো। কিন্তু তখনও জানতাম না – কিন্তু এখন
কথামৃততে পড়া জমিদার আর নায়েবের গল্পটা মনে পড়ল। নায়েবের বিশাল প্রতাপ। সবার মাথা
হাতে কাটে ধরণের। কিন্তু যেদিন জমিদারবাবু অখুশি হয়ে ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করল, নিজের জারিজুরি সব শেষ। নিজের তরঙ্গটাও বওয়ার কেই নেই।
নিজেই মাথায় তুলে বেরিয়ে গেল এ ভাবেই দু-তিন দিন চলল। ভগবতী আসে চুপচাপ খায়। তারপর বেরিয়ে যায়। আমাকে খুব ইচ্ছে করত
কথা বলতে। মা আগের মতই যত্ন করে খেতে দিত। কিন্তু কোনও কথা হতো না।
তারপর
একদিন ভগবতীর আসা বন্ধ হয়ে গেল। ভগবতী হারিয়ে গেল – দেওয়ালে ঝোলানো রইল ওর ছবি।