>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • সাঈদা মিমি

    SongSoptok | 3/15/2016 |



    ধোবিঘাট

    মানিকের দিনশুরু শেষ বলে কিছু নেই। বাবুদের বাসার কাপড়গুলো আনার পর একটু জিরিয়ে নেবে বলে খালপাড়ে বসেছিলো সে, ছোট  ছেলেটা এলো, বোঝাই যায় দৌড়ে এসেছে, হাফাচ্ছে। বাবা, দিদির খিচুনি হচ্চে, জ্বর বেড়েচে আরও। মানিকের মনটা ভারী হয়ে আসে । গৌরী তার একমাত্র মেয়ে, প্রথম সন্তান । বড় মায়া এই সন্তানটির জন্য । এরপর চারটে ছেলে, দুটো এই ধোবিঘাটে বসে তার সঙ্গে কাপড় কাঁচে । কাঠের গুড়ির ওপর একঘেয়ে কাপড় পেটানোর শব্দ, জলে ঝপাস ঝপাস সাইড রিদম । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় মানিক । ওই তনু, এই কাপড়গুলাও সাফা কইরা আনিস, আমি বাইত যাইতাছি, গৌরীর জ্বর আইছে আবার । গৌরী মারা গেলো অগ্রহায়ণের প্রথম তারিখে । এই মফস্বলে ডাক্তার, কোবরেজ যা পেরেছে দেখিয়েছে মানিক; পীর তান্ত্রিকও বাদ যায়নি । মুখ দিয়ে তাজা রক্ত উঠে আসতো, সেদিন কাশির সাথে আসছিলো বল্গাহীন রক্তের ধারা । মেয়েটা সন্ধ্যার একটু আগেই চলে গেলো । চিতার পাশেই সকাল এলো মানিকের, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝা বহনের পর তার চলার শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছিলো । পিণ্ডদান কিংবা গুরুদশা- সময়জ্ঞানহীন মানিক এই সব শেষ করলো নিজেরই অজান্তে । নিতাই কোবরেজ একবার বলেছিলো, এতো ক্ষয়রোগ নয় মানকে, কর্কট ব্যাধি! মানিক অন্ধকারে বসে থাকে শ্মশানের শেওড়াতলায় । গৌরী, ও মাইও, ওরে আমার ঘরের লক্ষী….. অনেকগুলি দিন পরে দানবীয় চিৎকারের স্বরে কান্না ছিটকে বেরোয় চিতার আগুনমাখা ছাইয়ের মতন । ব্যাস্ত ধোবিঘাট । কত বাহারী পোষাক পেশাই হচ্ছে এই ময়লা পানিতে! মানিকের সেদিকে নজর দেয়ার কথা কি! তার কাজ ঝকঝকে করে দেয়া, জলের রঙ দেখা নয় । তনু আকাশি রঙের একটা শার্ট মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো, সেটা লক্ষ্য করতেই মানিকের মনে পড়লো, একবার ড্রাইওয়াশ করতে আনা একটা দামী কাতান শাড়ি গৌরী কে একবেলা পড়তে দিয়েছিলো সে । চোখে জল আসার আগেই এক খাবলা পানি মুখে ছিটিয়ে দেয় মানিক । তনু তখন শার্টের বুক পকেটের কাছে বসে যাওয়া বেয়াড়া দাগের ওপর ক্লোরিন ঢালছে, মুখে রহস্যময় হাসি ।


        
    নগরবাড়ি ফেরীঘাট

    আরও দুটো দিন থাকার ইচ্ছে ছিলো, বগুড়া শহরের এই জায়গাটা নামটা একটু অদ্ভুত, 'ঠনঠনিয়ার নাজিরবাড়ি'সবাই মিলে ছাদে বসলেই সামনে এডওয়ার্ড পার্ক; অপূর্ব । কালও ওখানে ঘুরেছি, আজ বাসে, ঢাকায় ফিরছি । ঝর্ণার বিয়েকে কেন্দ্র করে দারুণ এক জমায়েত হয়েছিলো। আমরা সেজেছিলাম, নেচেছিলাম, গেয়েছিলাম এবং রঙখেলায় মেতেছিলাম । অস্বীকার করবো না, গরমটা একটু বেশি, বাবা আর থাকতে চাইলেন না । বাস ছুটছে, এখানে স্টপেজে দাঁড়ানোর তাড়া নেই, নির্বাচিত গান বাজছে সহনীয় সুরে, এসি বাস । বাবা আয়েশ করে ঘুম দিয়েছেন । বাসে? কিভাবে পারেন? আমি গাঢ় সবুজ প্রকৃতি দেখছি । কাল রাতে খাবার পর যখন ছাদে যাচ্ছিলাম, তখন খালাত বোনের দেবর পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলো । -কি? কিছু বলবেন? অনেকক্ষণ আমতাভাবের পর সে কিছুই বলতে পারেনি। একটু ঝাঁকুনি, ফেরীঘাট আইচ্চে... নামেন... নামেন । তবে কি আমিও তন্দ্রাঘোরে হারিয়েছিলাম? ফেরীঘাটে এলে যাত্রীরা নেমে যায়, তারপর বাস ফেরীতে ওঠে । কয়েকবার নৃশংস কিছু দূর্ঘটনা ঘটেছিলো, যাত্রীসহ বাস পড়ে গিয়েছিলো নদীতে । প্রায় তিরিশটা বাস, কয়েকটা প্রাইভেট কার, আর ট্রাক লোড হতে ঘন্টাখানেক । উজানপাড়ি, তাই, আরিচা পৌঁছুতে পাঁচঘন্টা । তখন তো সেতুনির্মাণ হয়নি, পদ্মা আর যমুনার সঙ্গম মোহনায় জল ঘোলা ঢেউ কেটে পরস্পরে সমর্পিত হয় । ফেরীঘাট মানেই এক আশ্চর্য রঙের বাজার! রাস্তার দুইপাশে রেস্টুরেন্ট, সেরকমই তো লেখা! গুলগুল্লা হোটেল এণ্ড রেস্টুরেন্ট, মায়ের দোয়া, পারাপার, একটু জিরান, বারবার আসি, রহমতের বরকত... এত মনে রাখা যায়? এরকম কোথাও বসে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছি । তীব্র ঝাঁঝালো, মশলাদার কিন্তু স্বাদু । -বাবা, এতো ভাতের দোকান! ওরা রেস্টুরেন্ট লিখেছে কেনো!! -তোর মতন ভাতমগজ নিয়ে হোটেল চলবে? মগজে ঘুটা দে, রেস্টুরেন্টের মর্মার্থ বুঝে যাবি । আমার বাবা মানুষটা বড্ড ভালো, রসিকতা পছন্দ করেন । একদিনের কথা বলি, পাঁচদিন জ্বর হয়ে ঘরে পড়েছিলেন বাবা, সেই পঞ্চমদিবস পার হয়ে যাওয়ার পর দেখি, বাবা মা কে জড়িয়ে ধরে গাইছেন, 'ও হাসিনা, মন আমার বাইরম বাইরম করে;মা প্রবল মোচড়ামুচড়ি করছেন, 'মিনসে পাঠা, ঘরে বড় বড় ছেলেমেয়ে' তবু বুইড়ার রস কমে না ।' বাবা কয়েকমিনিট ব্যবধানে অনেককিছু খাওয়ালেন। মুড়িবানানো, ডিমসেদ্ধ, পরোটা-মাংস, ভাত-মাছ... রাক্ষুসির মত সবই খেলাম। -কেমনে পারছি বাবা! -পদ্মার বাতাসে খিদে পায়। -এটা পদ্মা? -না, যমুনা । বাবা উদাস হলেন, আমার কেনো জানি মনে হলো, বাবা দেশভাগের আগের সময়ে চলে গেছেন, তার কৈশোরে, আলিপুরদুয়ারের বাড়ির উঠানে । ফেরি ছেড়েছে, অপ্রয়োজনীয় মানুষেরা নেমে গেছে । বাসের সিটে বসে আছি। বাবা বলেছেন, আর ঘন্টাদেড়েকের মধ্যে আবার খিদে পাবে, তখন ফেরির ডাইনিং থেকে খাইয়ে আনবেন । এমন সময় স্বর্গীয় সুর, "তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি/ মনে আপন মেনেছি/ তুমি বন্ধু আমার মন জানো না...." কে? এক পথবাউল; গান শুনিয়ে যার উপার্জন । একতারায় সুর মাতাল হচ্ছে, "তুমি জানো নারে প্রিয়, তুমি মোর জীবনের সাধনা..........." কেমন করছে, আমার মন খুব কেমন করছে। কোনো এক অচেনা প্রিয়র মুখ প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যস্নাত যমুনায়।


    মাইছা দেউ

    এত রাত্তিরে কেউ ডোঙা ভাসায়? আমরা ভাসালাম, আমি, হাতেম আর ডোঙার মাঝখানে বসে নানি মা। এই কুলক্ষণা চিন্তা নানির মাথা থেকে এসেছে, আজ ছাইবাবা পীরের জলসায়ে জশন, সারারাত চলবে, নানি পীর বাবার মুরিদ, তাকে যেতেই হবে । গাঁও গেরামে রাত আটটা মানেই মাঝরাত, আর এইসময় আমি আর হাতেম বৈঠা চালাচ্ছি? ডোঙা ডুবলে বুঝবা বুড়ি! কথা না কইয়া জোরে বৈঠা চালা, হাতেম তো আমার চাইতেও ছোট, ওর কব্জিতে কি এমন জোর? তারপরও নানিকে বাবার আখড়ায় পৌঁছে দিলাম দেড়ঘন্টার মধ্যে, পথ কিন্তু আধাঘন্টার, আমরা কি দক্ষ মাঝি এ্যাঁ? আমরা দুই ভাইবোন কিন্তু মহাখুশী, পীর বাবাজীর জলসায় খানাদানার ব্যাবস্থা জম্পেশ, অনেক সবজি আর মাংসের ছোট ছোট টুকরোর মিশেল দেয়া ঢিলা খিচুরী, দুধের ঘি ওঠা পায়েশ, অপেক্ষা করে আছি সময়টা কখন আসবে,কলাপাতার পাতে রাখা সব খাবার চেটেপুটে খাবো । ভাবনা পিছলে পড়লো পীর সাহেবের নুরাণী তবকের ডিব্বায়, আমাদের ডাক পড়েছে হুজরার ভিতর । নানি বলেই যাচ্ছেন…. (ও বুড়ি এই ছিলো তোমার মনে?) আমার নাতিনডারে দেখেন হুজুর, এই বয়সে ছেচুনি দিয়া ছেইচ্চা পান খায়, ভর দুপুরে খালপাড়ে বইস্যা মাছ ধরে, রাইতের বেলায় একলা একলা পিছন দুয়ারের কৃষ্ণচূঁড়ার নীচে বইস্যা থাকে, নিজের লগে নিজে কতা কয় আর হাসে, এইরকম ত্যানাপ্যাঁচানো হরেক বর্ণনার পর হুজুর হুংকার ছাড়লেন, :ঐ করিম্মা তর তুলারাশি না? একজন রোগাভোগা জুব্বাধারী করিম উঠে এলো, সে বিশেষ কিছু দেখতে পায় যা আমরা দেখি না, কারণ করিম তুলারাশির পুরুষ । হুজুর পানিতে ফুঁ দিলেন, :ভালো কইরা জলে চোখ রাখ, পরীক্ষণ কইরা ক । এই পরীক্ষণ কি জিনিস? যখন এই চিন্তা আমার মাথায় ঘুরছে এবং নাকে এসে লাগছে খিচুরী ও পায়েশের সুবাস, তখন করিম জানালো, পানিতে একটা ডানাওয়ালা মাছ দেখা যাচ্ছে ।  সর্বনাশ.. পুনরায় দ্বিগুণ তেজে হুংকার ছাড়লেন বাবাজি. মাইছা দেউ ।বড়ই বিচিত্র কথা. একটা মেছো দেউ হুজুরেরর পড়া পানির মগে! অতঃপর যা শুনলাম তাতে আমার ঘোর কেটে গেলো। :তোমার নাতিন রে মাইছা দেউয়ে ধরছে । আমি আতকে উঠি, পরশু আমার পুঁটি মাছের খলুই অর্ধেক সাফা ছিলো, এইতো কয়েকদিন আগেই নলখাঁগড়ার আড়ালে চিমসে মতন কালো একজন বামনকে দেখেছি, কোনদিন রাতে যেন একটা ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাসে আমার ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো….! :তোমার নাতিনরে বইলা আটকাইতে পারবা না, দেউ তারে দিবানিশি ডাকে । :তয় উপায় হুজুর? নানি কেঁদেই ফেললেন । :কবচ দিতাছি, এহনই ডাইন বাজুতে বাইন্ধা দিমু, দুইটা তাবিজ লেইখা দিতাছি, রুপার মাদুলিতে ভইরা জুম্মাবারে গলায় ঝুলাইয়া দিবা, আর পানি পড়া তো দিমুই, খরচ পড়বো সাড়ে পাঁচশ টাকা আট আনা, একমাস হেরে চোখে চোখে রাখবা, দেউ রে আমি আটকামু এরই মধ্যে । হুজুর ধরা খেলো হাটবারের দিনে, না দুপুর না বিকেলে। ছোটদের সব কথা জানতে মানা, বড়রা বলাবলি করে, শুনি, হুজুরের দ্বিতীয় বিবির কুমারী বাদি রশনীর পেট খসাতে গিয়ে, সত্যটা জানাজানি হয়ে গেছে।


    বয়রা সোবাহান

    খটাস খটাস শব্দ তুলে কাঠ ফাঁড়ছিলো সোবাহান মামু, কান ধরে যায় । চৈত্তির শেষ হইলো বইলা…. বাইশ্যা আইতে আরও পরায় আড়ই মাস…. তারপর নাও ভাইসপো…. মামু বিড়বিড় করে, ‘অ মামু, কি কও?’ মামু উত্তর দেয় না, শোনেইনি। মুরুব্বীদের কাছে শুনেছে সে, মামুর বৌ ছিলো ইয়া তাগড়া, তেলতেলে কালো । একবার কি তাণ্ডব যেন ঘটেছিলো পরিবারে, মামী বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পর বসিয়ে দিয়েছিলো তার কানে, সেই থেকে সোবাহান বয়রা । মামু হিলহিলে মানুষ, কারো সাতে-পাঁচে নেই । এই যে চার চারটে জওয়ান ছেলে তার, কেউ তাকে খেতে দেয়না, থাকার জায়গাও দেয় না । এইসব নিয়ে তাকে আফসোস করতে শোনা যায় না তাকেকেবল মামীর প্রসঙ্গ এলে তার চোখ ছলছল করে ওঠে ।নিজের কিছু তো ছিলো না তার, বর্গাতি করতো, বাড়ী বাড়ী কাঠ কাটতো, আম-নারকেল-সুপারী পেড়ে দিতো, যে কয়টা পয়সা মিলতো তাই দিয়ে চলতো সংসার । মামী কিছু হাঁস মুরগী, একটা গাই আর কয়েকটা ছাগল পেলে কিছু রোজগার করতো । এই ভেবেই মামুর কান্না । বুড়িটা বেঁচে থাকতে খাওয়া থাকার চিন্তা তো ছিলো না । এখন সে থাকে পীর বাড়ির আখড়া ঘরের ভিতর, ওখানেই দুইটা ফুটিয়ে খায়, বেশির ভাগ সময় মিয়া বাড়িতে পেটে ভাতে কাজ জুটে যায় । বুড়ো শরীর, কাজ করতেও পারেনা আগের মতন, তবু মিয়ারা কাজ দেয় তাকে, কারণ মামু ভিক্ষা করতে রাজি না । গুনে গুনে টাকা কয়টা খুতির ভিতর রাখে সে, ভালাই জইমছেএই বাইশ্যাকালেই যায়া পারুম… ‘কি কও মামু?’ এবার জোরে জিজ্ঞেস করে মিয়ার বেটি, মামু শুনতে পায়, সৈদাবাদ যামুরে মা । সেইটা আবার কোনহানে? ‘আরব দ্যাশ…..’  হাসতে হাসতে বিষম খায় মেয়েটা । হাসতাছাও ক্যান বেটি? এই যে এত বচ্ছর ধইরা টেহা জমাইবার নাগছিতাইতো! মেয়েটার হুঁশ হয়, এই বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট দেয়ার অপরাধে লজ্জা লাগে তার । সৈদাবাদ কেম্বায় যাইতে হয় জানো মামু? , সোবাহান তড়িত উত্তর দেয়, বাইশ্যাকালে গাঙে পানি আইলেই গয়নার নৌকায় উইঠা পড়ুম, পোনারো দিনের মোদ্যে সৈদাবাদ । 


    একটি রাতছবি

    গভীর রাতে যখন বেওয়ারিশ কুকুরগুলো কাঁদে অথবা রাতপাখিরা ছটফট করে ওঠে, ঠিক সোয়া একটায় একজন মানুষ সামনের বাড়িটার চাঁতালে পোটলাপুটলি খুলে খায়, তারপর চিটচিটে চাদরটা বিছিয়ে জিকির করতে করতে ওখানে ঘুমিয়ে পড়ে, দুটো ভিন্নরঙের বাচ্চা নিয়ে মা বেড়ালটা গোল হয়ে শুয়ে থাকে, কাছের সাততালায় ছাদে কবুতরের ঘর, কেমন যেন গলার ভেতর আটকে রেখে ওরা ভুতভুতুম ডাক তোলে! ঠিক উত্তর ঘেঁষে দাঁড়ালে কোন আড়াল নেই, উদোম লেক, রাতবাতির চিমসে আলো মিহিন ঢেউয়ের ওপর কাটিকুটি খেলে, নিশাচর কতেক দুপেয়ে প্রায় সারারাত বসে থাকেনেশা করে, কখনো উচু স্বরের দরবাজি, ভিন্ন মাত্রার গান, পলিথিন আর পরিত্যাক্ত টিনঘেরা কতেক ঘরে অচেনা মানুষজনের আনাগোনা শুরু হয়, আর সারাদিনের বর্জ্যগুলো থেকে একটা উদ্ভট গন্ধ বোঁটকা বাতাসের সঙ্গে নাইট্রোজেন বিলিয়ে চলে, নাইটগার্ড মানুষটা বৃদ্ধ, কিইবা করার আছে লোকটার? কেউ তাকে শোনে? সে বাঁশিটা গলায় ঝুলিয়ে ঝিমায়, হঠাৎ কোন নেশাতুর কন্ঠের হুংকার, ‘ওই গণি, ফুঁ দে,’ অমনি সে ধড়মড় করে জেগে হুঁইশেল বাজায়, সবুজ রঙের জলপোকাগুলির কামড়ে চামড়া জ্বলে ওঠে, সব ঘরগুলির বাতি নিভে গেছে, কেবল সিঁড়িঘর বাদে , পাশের বাড়ির চিলেকোঠায় একজন মানুষকে গাঢ় অন্ধকার বুকে নিয়ে রোজ বসে থাকতে দেখা যায়, দিনের আলোতে কোনদিন তাকে দেখা হয়নি । প্রহর ঢলছে, রাতপাখিরা বিশ্রামে যাবে, গণি বুড়ো বসার ভঙ্গিতেই ঘুম, কুকুরের দল গুটিশুটি; উৎকর্ণ কান, কবুতরদের সাঁড়া নেই, বস্তিপাড়া সুনসান, ঘোরলোকের মানুষেরা কখন যেন ফিরে গেছে, নিঃসঙ্গ শিরিষের বুকে তখনো কালচে আভা, হঠাৎ বাতাস পলকা হয়ে ওঠে, নিমফুলের মসৃণ ঘ্রাণে ঘর ভরে যায়।


    সাধ ও ইচ্ছে

    নদী এখন টইটুম্বুর, সংযোগ খালগুলির জল পুকুরের যৌবনকে টলটলে করে তুলেছে, জলে একটু ছোঁয়া লাগলেই লাজতরঙ্গ । এসেছে বেদেবহর নৌকাগুলি, ভিড়ে আছে বাজারের ঘাটে, এই জীবন একটা ফানুস স্বপ্নের  রঙ এঁকে দেয় । সকাল জাগার আগেই ওরা ব্যাস্ত, গলুইয়ের কাছে রাখা চুলায় ফুটছে মোটা চালের লাল ভাত, মশলা জড়ানো সালুনের ঝোল, যুবতীরা আটোসাটো প্যাঁচে পড়ে আছে হাঁটুঝুল শাড়ি, বাহারী খোঁপায় আলগা বিনুনির কাজ, হাতভর্তি চুড়ি, চোখে গাঢ় কাজল, আছে রূপলাগি ওষ্ঠরঞ্জনী, একটু পরেই ওরা বেরোবে । কেউ লেস-ফিতা, চুড়ি, প্রসাধনী নিয়ে, কেউ সাপের ঝাপি, ওস্তাদ যাদুকর, কেউ জরিবুটি নিয়ে সুর করে বলতে বলতে চলবে, ‘দাঁতের পোকা খসাই…. শিঙা লাগাই…. বাণমন্ত্র কাটাই….’ গায়ের মানুষদের কাছে ওদের বেশ কদর, বছরের এই সময়টাতে ওরা একটু ভালো রোজগার করে । তুলনামূলক বয়স্ক বেদেরা নৌকাতেই থেকে যায় বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে, রান্নাবান্না গুছিয়ে রাখতে, সাপের ঝাপিগুলি একটু সামলে রাখতে হয়, বিষদাঁত খসিয়ে দেয়ার কিছুদিন পরেই আবার নতুন দাঁত গজাতে শুরু করে সাপগুলোর । এই বর্ষায় সাপের উপদ্রব বেড়েছে, ওঝা বেদেরা সাপ ধরায় ব্যাস্ত, বিষ সংগ্রহে, অনেক দামে বিক্রী হবে বিষ থেকেই বিষের নিরোধক । তরুণ বেদেরা তরুণী বেদেনীদের ছায়াঘ্রাণে উম্মত্ত হয়ে হাঁটে, ‘ও মিয়ার ব্যাটারা, ওগের দিকে নজর দিও না, অরা বদ্যির জাত, বাণটোনা জানে,’ এরকম কথাগুলি শোনা যায়, যদিও ছেলে ছোকরারা একটু আধটু লাইন মারার চেষ্টা করে কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারে না । সন্ধ্যের বেদে নৌকাগুলি সরগরম, এখন যৌথ উনান জ্বলবে, ছইয়ের গায়ে ঝোলানো হারিকেনগুলি দুলছে, সেদিকে তাকিয়ে মনটা বেখেয়ালী হয়, একটা নৌকা নিয়ে আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার সাধটা ইচ্ছেয় রূপ নিতে শুরু করে ।


    [সাঈদা মিমি]


    Comments
    0 Comments

    No comments:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.