একটা ঠিকঠাক নারীজীবন খুঁজতে গিয়ে হন্যে হয়ে গেলাম। ভাবতে শুরু করলাম যাকে বলে প্রকৃত নারী সেই রকম
কাউকে আমি চর্ম চক্ষে খুঁজে পাই কি না। প্রথমেই ধাওয়া করলাম আমার এক আত্মীয়ের ছেলের বোনটার দিকে। ছোট্ট একটা তুলতুলে বল। যাকে
পেটের কাছে নাক ঠেকালেই নাকে ভেসে আসে আন্তর্জাতিক কোম্পানির চেনা পাউডারের
সুগন্ধ। ঘুমন্ত বলটাকে তো কপালে কাজল টিপ পরিয়ে রাখতেই হয় তা না হলে বাড়ি শুদ্ধ
লোক তাকে চুমু খেয়ে চটকে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেবে আর কি জানি ...নজর না লেগে যায়!
তিনি জেগে থাকলে বাড়ি শুদ্ধ লোক তটস্থ। চোখ খুললেই এর ওর তাঁর কাঁধে চড়ে ই তার দিন
কাটে। মাটিতে নামালে আবার কিচ্ছুটি আস্ত থাকবে না...এই দিদির বই ছিঁড়ে কুটি কুটি
করে ‘পড়াশুনা’ করছে নয়ত ড্রেসিং টেবিলটাকে অপরূপ ভাবে পাউডার সজ্জিত করছে। তেনাকে
দেখলেই যতটা না মেয়ে তার চেয়ে ঢের বেশি রঘু ডাকাত বলে মনে হয় আমার। নাঃ এঁকে ঠিক
‘নারী’ বললে আমার নারীত্বেই সন্দেহ করবে লোকে।
চোখ ফেরানো যাক পাশের মৌপিসির ইস্কুলের প্রান্তিক শ্রেণীতে
পড়া কন্যে ঝিলিমিলির দিকে। গভীর মনোযোগ সহকারে তার প্রতিটি অনুপুঙ্খ দেখতে থাকি।
সেদিন কানে আসছিল সে তার প্রিয় বান্ধবী রাইকে জানাচ্ছিল সাত্যকি নাকি সমানে খাতার
পাতায় ব্যাগে জ্যামিতি বক্সে চিট গুঁজে দিয়ে ডেট এ যেতে বলছে। তিনি তো কিছুতেই ঘাড়
কাত করবেন না। তা সেই ছেলেটিও ধনুর্ধারী রামচন্দ্র...হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন। আমি চোখ
আকাশে তুলে ঠোঁটে কলম গুঁজে (মাঝে মাঝে কামড়েও!) ভেবে চললাম এই সব বয়ঃসন্ধির স্বাভাবিক
কান্ডকারখানার ভেতরে ঝিলিমিলির নারীত্বের কোন আভাস পাই কি না। খুজতে খুঁজতে চোখ
পড়ল সেদিন অফিস ফেরতা কাফেতে বসে চা কাটলেট সাবড়ানোর সময় ওদের দেখেছিলাম সেখানে।
একটা পরদা ঘেরা কেবিনে ছিল ওরা । হাওয়ায় পরদা উড়ছিল বলে আমার চোখে পড়ে গিয়েছিল।
আমিও একটা থামের আড়ালে বসে ছিলাম বলে দেখেনি আমায় । কি যেন একটা বিষয় নিয়ে ওদের
কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। মাঝে যেন দেখলাম
ঝিলিমিলি চোখও মুচ্ছছিল আর ছেলেটি অসহায়ের মত এদিক ওদেক তাকিয়ে দেখতে চাইছিল কেউ
এই সব ভুলভাল কান্ড দেখছে কি না। কানেও এল আবছা এই সব কথা... তুমি চার দিন হয়ে
গেলেও একটা এস এম এস পর্যন্ত করলে না? ক্লাসে নিধি আর রোহন কি ভাবে আমায়
খোঁচাচ্ছিল কোন ঝামেলা হয়েছে কি না! ওরা কি ভাবলো বলতো? ভাবলো আমি হ্যাংলা তাই বার
বার তোমায় ডাকি। এদিকে ওরা তো জানেই না যে তুমি কত্ত বার আমায় এই খানে মিট করতে
বলেছো। আর আজ যখন আমি চাইলাম তোমার পাত্তাই নেই...আরে তুমি এভাবে নিচ্ছ কেন?
আমাদের কলেজে সিনিয়রদের ফেয়ারওয়েল ছিল। বহুত ফেঁসে গেছিলাম কাজকারবারে। নইলে আমি
তোমায় ইগনোর করি? প্লিজ...প্লি ই ই ই ইজ এভাবে কেঁদো না। তোমার দাদা টাদা এইখানে
এসে পড়লে একদম কেস জন্ডিস হয়ে যাবে। শোনো আইসক্রিম খাবে? চল আজই টিউশনের টাকাটা
পেলাম। চলো পকেট গরম থাকতে থাকতেই খাওয়ে দিই। নাহলে তুমি আমায় ভাববে প্রপোজ করতে
পারি কিন্তু এক নম্বরের কিপ্পুস!...কি যে বলো সাত্যকিদা! আমি কখন বললাম এইসব!
তাহলে মহারানীর কান্না থেমেছে? অ্যাঁ? আজ তো আমার তাহলে ফিল্ড ডে... এই
শোনো......... ।
আর বেশিক্ষণ আড়ি পাতলে যা তা কান্ড দেখতে হবে এইভেবে উঠে
পড়লাম টেবিল থেকে। বিল মিটিয়ে মৌরী চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে আসার সময় ভাবতে লাগলাম
...নারীত্ব তাহলে কি কান্নাকাটি? ঝিলিমিলি যেভাবে ছিঁচকাঁদুনের মত জল ফেলছিল্
সেক্ষেত্রে নারীত্ব মানে চোখের জল? ভাবতে ভাবতে দীপুমাসির কথা মনে পড়ল। আমার
ছোটবেলার ফ্যান্টাসি ছিল বড় হয়ে দীপুমাসির মতই হবো। বেশ সাজতে ভালোবাসতো মাসি। খুব
একটা তফাত ছিল না আমার সঙ্গে বয়সের। আমি যতই ছিরিছাঁদ হীন বইপোকা টাইপ গুডি গুডি
হই না কেন মাসির একান্ত হনমদ্ভক্ত ছিলাম। আজ মাসি কি ভাবে কাজল দিল...কাল মাসি কোন
নতুন ফ্যাশানের শাড়ি কিনল কিংবা চুলের কোন স্টাইলটা এবার নিল এইসব আড়চোখে দেখে
রাখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মাসির নাকের ডগায় কালো ফ্রেমের চশমা যখন ঝুলত মনে হত
হে ভগবান আমার কবে চোখ খারাপ হবে... আমিও তবে চশমিশ হবো। তা সেই দীপুমাসির বিয়ের
সম্বন্ধ দেখা হবে ঠিক হলো। বাড়িময় ব্যস্ততা, মাঝে মাঝেই অচেনা লোকেদের সাড়ম্বর
যাতায়াত আর আমার ভেবলু হয়ে একবার তাদের দেখা আর একবার মাসির মুখের অবস্থা দেখার
চেষ্টা জারী থাকত। আমি নিজেও তখন ইস্কুল পার করার পথে। বইয়ের ফাঁকে ন হন্যতে আর
মিরচা এলিয়াদ...আর ঠোঁটের ফাঁকে ‘অজো নিত্যঃ শ্বাশ্বতয়ং...” উপনিষদ বাণী আর ডায়রীর
পাতায় কলমের আঁচড় আর লেট নাইট ফিল্ম গভীর মনোযোগ দিয়ে দূরদর্শনে দেখা। যতদূর
জানতাম মাসির একটা ঘ্যাম সম্পর্ক ছিল বাচ্চুদার সঙ্গে। ইয়ে মানে আমি চেষ্টা করতাম
মনে মনে মেসো বলার কিন্তু এক আধবার যা দেখেছি তাতে দাদাই বেরোত মনে মনে। বেশ লম্বা
কালো বুদ্ধিদীপ্ত মুখ আর মাসির ছিল টুকটুকে রাঙা আলু টাইপ। যা হয়ে অপোজিট
অ্যাট্রাক্টস...। বেশ জানতাম ওদের হচ্ছেই বিয়ে। কিন্তু তখনো বাচ্চুদা নিজের পায়ে
দাঁড়ায় নি...ইয়ে মানে পকেট খুব একটা মালকড়ি থাকত না...। দুম করে একদিন ব্যাঙ্কে
চাকরী হলো বাচ্চুদার। আমার মনে খুব আনন্দ আর মাসির তখন পরিত্রাণ পাবার সুখ। পাত্র
দেখা উল্টে দিয়ে কতক্ষণে সে বাচ্চুদার হাত ধরে নতুন জীবনে পা রাখবে তার স্বপ্নে
বিভোর। হঠাৎই শুনি মাসি কলেজ থেকে ফিরে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। চার পাঁচ ঘন্টা কেটে
গেলেও দরজা খুলছে না। আমার সদাশয় দাদুভাই আর বুদ্ধিমতী দিম্মা আকুল হয়ে দরজা
ধাক্কাধাক্কি করলেও কোন সাড়া নেই। তারপর মামারা পাড়ার বন্ধু দুয়েকজনকে ডেকে এনে
দরজা ধাক্কিয়ে সে যাত্রা অজ্ঞান মাসিকে বের করে আনে। না মাসি কোন আত্মহত্যা করার
চেষ্টা করে নি। কিন্তু গভীর হতাশায় জ্ঞান হারিয়েছিল। কদিন খুব দুশ্চিন্তায় গিয়েছিল
কারণ মাসি কথা বলছিল না বেশ কদিন। সম্পূর্ণ নির্বাক। খাচ্ছিলও না। দিম্মা চোখে জল নিয়ে আর বুদ্ধিমতী সুন্দরী
পড়ুয়া মেয়ের এই অবস্থা দেখে ডাক্তার বদ্যি আর শুধু জপ এর আশ্রয় নিয়েছিল। খোঁজ করে
জানা গেল চাকরিটা পাবার পরই রাতারাতি ফোন করে বাচ্চুদা মাসিকে বলে বিয়েটা করে নিতে
কেননা তার অন্য জায়গায় সম্বন্ধ ঠিক হয়েছে। পাত্রীর বাবা ধনী এবং বাচ্চুদার মাও
নাকি মাসির সঙ্গে বিয়েতে রাজি নয়। দশ বছরের সম্পর্কের এই পরিণতির পরে রাতারাতি
দীপুমাসির জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি টাই বদলে যায়। তারপর থেকে আমার চেনা মিষ্টি
মাসিটা রুক্ষ বদমেজাজী স্বার্থপর একটি সম্পূর্ণ নতুন জন্ম হয়। আমার জীবনে প্রথম
আদর্শের ও এই অপমৃত্যু ঘটে। কিন্তু এ তো গেল একটি ভুল প্রেমের করুণ পরিণতি। সফল
নারীত্বের এটি কে কি উদাহরণ ধরা যায়?
আমার পাড়াতেই তাকে দেখতাম। ফুটপাথে শুয়ে থাকত। আমার চোখ
টেনেছিল ওর সৌন্দর্য। পাগলী বলে ভুল করেছিলাম প্রথম দেখায়। ধুলো মাখা শাড়ি পড়ে এমন
ভাবে ফুটপাথে গড়াগড়ি করে ঘুমোত মনে হত পালকের বিছানায় শুয়ে আছে। বাড়ির পিছনেই একটা
অখ্যাত কিংবা বিখ্যাত বস্তি আছে আমার পাড়ায়। সেইখানে বস্তির অদূরেই এর বাস। একটা
পুঁচকে ছেলেও ছিল মহিলার। আমি দেখতাম আর পাঁচজন মেয়ের মত তার আচরণ নয়। সবার সঙ্গে
মারামারি করে টিউকল থেকে জল তোলে না, মাদার ডেয়ারির সামনের রাস্তাটায় নিজের খোকাকে
ল্যাংটো হয়ে মারামারি করে ক্রিকেট খেলতে দিত না। কোথা থেকে ওর খাবার জুটত জানি না।
কিন্তু হররোজ রাস্তার ধারে তিনটে ইট পেতে কাগজ জ্বালিয়ে দিনান্তে একবার কিছুমিছু
ফোটাতে দেখতাম টগবগ টগবগ। আট নবছরের বস্তির ছেলে পিলেরা হরদম ল্যাংটো হয়ে শহরের
রাস্তায় মারামারি করে, প্লাস্টিকে মোড়া পেপসি বরফ চোষে কিংবা পাশের ঝুপড়ি র সদ্য
বুক গজানো কিশোরী সঙ্গিনীর বুক চটকানোর ধান্দায় থাকে। ওর বাচ্চাটিকে দেখতাম খালি
খালিই নিজের থাকার কোণটাকে সাজাতো। হয়তো প্লাস্টিকের চাল দেওয়া দুর্গাপুজোয় মন্ডপ
থেকে তুলে আনা বাঁশ পুতে একটা ঘরের রূপ দিয়ে বর্ষা শীতে মায়ে পোয়ে সেখানেই সেঁধোত।
একবার দেখলাম আমাদের বারোয়ারী পুজো মন্ডপে ওর ছেলেটাকে আস্ত একটা প্যান্ট পড়ে বেদম
নাচছে। এই বস্তির ছেলেরা সাধারণত পনের ষোল বছর থেকেই চুল্লুর নেশায় পড়ে যায়। হঠাৎই
দেখি একদিন ছেলেটা মহানন্দে নাচতে নাচতে কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি ঠেলছে। সেই গাড়ির
গন্ধে আমার নাড়িভুঁড়ি উল্টোলেও তেনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রায় রোজই দেখতাম তাদের
রাস্তার কোণটাকে একটু একটু করে ঘর বানিয়ে তুলছে মায়ে পোয়ে। কোনদিন দেখতাম
রাস্তার কলি ফেরানোর সময় চেয়ে চিন্তে
তাদের ঘরের ইট গুলোকেও রঙিন করেছে। আস্তে আস্তে খাড়া করেও ফেললো একটি সিমেন্ট লেপা
চার দেওয়াল। এমনকি কোথা থেকে ঢলঢলে মিষ্টি একটা মোটাসোটা মেয়েকেও সিঁদুর পরিয়ে ঘরে
এনে তুলল। একটাই ঘর। তাতে তার মা আর ছেলে ছেলে বউয়ের বোঝাপড়া আছে। ঘরের সামনে দড়ির
খাটিয়া পাতা। কখন ঘর কখন বাহিরে শুয়ে তাদের পুত্র পুত্রবধূ আর শ্বশ্রূমাতার
কাচকড়ির সংসার চলে। শত দারিদ্র্যেও তাদের সম্ভ্রম বজায় আছে। পশু জীবন যাপন করে না
এক ঘরেই শুয়ে। এখন আর মেয়েটি রাস্তায় লুটোয় না। ছেলে তাকে একটা উল্টোনো কাঠের
বাক্সের ওপরে সিগ্রেট আর খইনির কটা প্যাকেট ঝুলিয়ে দোকান করে দিয়েছে। গর্বিত মা
বাঁ হাতে খদ্দেরকে জিনিষ দেয় ( মেয়েটি ন্যাটা বরাবরই), আর ডান হাতে জোয়ান ছেলের
ঘরে নাতিকে খেলা দিচ্ছে। বড় কষ্ট করেছিল মেয়েটি। তার জীবনের বাঁধা গতে গা ভাসায়
নি। বুকে আগলে তার আদর্শে ছেলেকে বড় করেছে।
অনেক খুঁজলাম জীবন ভোর প্রকৃত নারী খুঁজে পাবার জন্য। নারীত্ব
কাকে বলে? জবাব পেয়ে গেছি।
****************************************************
[জয়া চৌধুরী]