>

কথা কবিতা

SongSoptok | 3/10/2015 |



পূর্ব বাংলায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানকে চীন যদিও নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে, তারপরেও মে থেকে উপমহাদেশীয় প্রশ্নে চীন প্রকাশ্যে কোন মতামত ব্যক্ত করেনি। হতে পারে, স্বাধীনতার পক্ষে মওলানা ভাসানী চীন-সমর্থক কোন কোন বামপন্থী গ্রুপের ভূমিকা, পাকিস্তানী বাহিনীর বিরামহীন বর্বরতা, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তি, চীনের আভ্যন্তরীন অবস্থা প্রভৃতি ঘটনা চীনকে একটু সংহত করার পিছনে কাজ করতে পারে। ২৬ অক্টোবর কিসিঞ্জারের চীন সফরের পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদল চীন সফর করেন। চীনকে ভারতের উত্তর সীমান্তে সামরিক হস্তক্ষেপে রাজী করানোর উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের মিশন পরিচালিত হলেও চীন তার নিজস্ব অবস্থান থেকেই উপমহাদেশীয় বিষয়টি নিরীক্ষণ করতে থাকে অন্যদিকে, ইন্দিরা গান্ধীর শেখ  মুজিবের মুক্তি সংকটের নিরস্ত্র সমাধানের উদ্যোগের আশা নিক্সনের সাথে তিন ঘন্টার বৈঠক শেষে ভেস্তে গেলে তিনি ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মান হয়ে সফর শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। তবে, প্যারিসের সহানুভূতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে ইন্দিরা গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,পুর্ব বাংলার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা, শীঘ্র হোক, আর দেরীতে হোক, স্বাধীনতা আসবেই। ভারতের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবিরাম শরণার্থীর প্রবল চাপ যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা থেকে অব্যাহতি পেতে গেলে সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া গত্যান্তর নেই জেনেও পথে অগ্রসর হওয়া ভারতের জন্য সহজ ছিল না। কারণ, বাংলাদেশের জন্য ভারতের সর্ববিধ সহায়তা প্রদান,এমন কি মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে সীমান্ত সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করা এক কথা আর পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানকে পরাজিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করা আর কথা। এতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভারত আগ্রাসী ক্ষমতা হিসেবে ধিকৃত হবে, এবং জোট বহির্ভূত দেশ হিসেবে তাকে অনেকদিন বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। অথচ, যুদ্ধ ছাড়া উদ্ভূত সমস্যা নিরসনের অন্য কোন পথই খোলা নেই। একদিকে সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের মৌল প্রয়োজন অন্যদিকে সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে গুরুতর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশংকা--- এই পরস্পরবিরোধী বিবেচনার মধ্যে ভারতের সিদ্ধান্ত নিদির্ষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার আগেই পাকিস্তান যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতকে উভয় সংকট থেকে উদ্ধার করে। ২৩ নভেম্বর পাকিস্তান জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে এবং ঐদিন তক্ষশীলায় চীনা সাহায্যে নির্মিত ভারী যন্ত্রপাতি কারখানার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান দশ দিনের মধ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভবনা উল্লেখ করেন

এক্ষেত্রে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে তাজউদ্দিন ছিলেন বিপাকে। কারণ সমস্যাগুলো একমুখী ছিল না, বরং তা ছিল ভিন্নমাত্রিক।তাই তার বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীন গোলযোগ আপাতত স্তিমিত হলেও সামগ্রিক পরিবেশ ছিল নাজুক। ২৭ অক্টোবর কলকাতার থিয়েটার রোড সংলগ্ন লর্ড সিনহা রোডস্থ বি এস এফ ভবনে এক বিশেষ জরুরী ব্রিফিংএ ডি পি ধর তাজউদ্দিন মাইদুল হাসানকে ( তাজউদ্দিনের যুদ্ধকালীন সময়ের বিশ্বস্ত সহকর্মী, যিনি তার পাশে থেকে ভারত সরকারের উচ্চতর নীতিনির্ধারকদের সাথে আলাপ আলোচনা করেছেন) মোশতাকচক্র মার্কিন প্রতিনিধিদের মধ্যে গোপন দেন-দরবারের প্রকৃতি উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে বিবরণ দান করেন, তাতে মোশতাক আর মাহবুবুল আলম চাষীর উপস্থিতিতে একান্ত গোপনীয় বিষয় মন্ত্রী সভায় আলোচনা করা তথ্য নিরাপত্তার জন্য ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাপারে তাজউদ্দিন তাদের নিষ্ক্রিয় করার বিষয়টি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি  সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে উপস্থাপন করলে, মাহবুবুল আলম চাষীর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের একটা অস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও মোশতাকের ব্যাপারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অনীহা দেখান অন্যদিকে প্রবাসী সরকারের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওসমানীর কিছু একগুয়েমি সিদ্ধান্ত মাঝে মাঝেই প্রবাসী সরকা্রের অস্বস্থি সৃষ্টি করেছে। ওসমানী ছিলেন নিয়মনিষ্ঠ যোদ্ধা, তাই যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক দিকটার চেয়ে রণনৈতিক দিকটাকেই প্রাধান্য দিতেন বেশি। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে যেখানে মাও-টিটো গিয়াপের মত বিপ্লবী রাজনৈতিক সামরিক প্রতিভার অভাব, সেখানে রাজনৈতিক সরকারের পৃষ্টপোষকতা ছাড়া যে রণনীতি নির্ধারণ রণ পরিচালনা সুষ্টুভাবে পরিচালনা সম্ভব নয় তা জেনারেলকে বুঝানো ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই মাঝে মধ্যেই জেনারেল ওসমানীর সাথে তাজউদ্দিনের মন মালিন্য ঘটতো। ভারতের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী সর্বাত্মক যুদ্ধ যখন প্রত্যাসন্ন তখনো ওসমানী সার্ভিস ম্যানুয়াল রচনার মত এমন সব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন যার সাথে প্রত্যাসন্ন চুড়ান্ত অভিযানের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। অথচ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত অভিযানের মূল দায়িত্ব ভারতীয় কমান্ডের কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার পরও শত্রু অবস্থানের পশ্চাতের তৎপরতা সংশ্লিষ্ট কৌশল পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামরিক কমান্ডের সহায়ক ভুমিকার প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে তাজউদ্দিন যখন যৌথ কমান্ডো গঠনের পক্ষে মনস্থির করেন তখন ব্যাপারে কোন বিকল্প প্রস্তাব না করেই যৌথ কমান্ড গঠন করা হলে পদত্যাগ করবেন বলে ওসমানী হুমকি দেন। ইতোপূর্বে বিভিন্ন আরো কয়েকটি ইস্যুতে তিনি ধরণের মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্ত এই প্রথমবার তাজউদ্দিনও বলেন, লিখিতভাবে পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তিনি তা গ্রহণ করবেন। কথা শুনে জেনারেল ওসমানী যৌথ কমান্ড অথবা পদত্যাগপত্র সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য আর করেন নি। তবে, ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে তার ধারণা তিক্তই থেকে যায়। ভারতের প্রতি ওসমানীর এই তিক্ত মানসিকতার বিভিন্ন কারণ ছিল।ভারত কর্তৃক মুজিব বাহিনী গঠন,মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা অনুযায়ী সহযোগিতা না পাওয়া, নিজে একজন জেনারেল হওয়াতে  ভারতের জেনারেল অরোরা বা মেজর জেনারেল জ্যাকবের সাথে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব তাকে ভারত বিদ্বেষী  করে তোলে। ফলে চুড়ান্ত অভিযানের প্রাক্কালে ওসমানীর এহেন ভূমিকার ফলে ভারতীয়দের সংগে গৃহিত তৎপরতা কৌশলের সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা অনেকখানি তাজউদ্দিনকে পুরণ করার চেষ্টা করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপের আব্দুল করিম খন্দকার বিমান বাহিনীভুক্ত অফিসার হলেও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি মতামতের স্বচ্ছতার দরুণ পরামর্শের জন্য তাজউদ্দিন তার শরণাপন্ন হতেন

আসন্ন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যে বিষয়গুলো নিয়ে তাজউদ্দিনকে উদ্বিগ্ন হতে হয় তা হলো-- শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষা, ঢাকা শহর রক্ষা,পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি, স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র পাকিস্তান যাদের অস্ত্র দিয়েছিল, তা উদ্ধার,এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে ১৬ নভেম্বর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত  ডি পি ধরের সাথে তাজউদ্দিনের চার দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা শহর, শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষা পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের মুক্ত করার চিন্তা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ঢাকার উদ্দেশে দ্রুত অভিযান চালিয়ে সম্ভাব্য পাকিস্তানী অবরোধ প্রতিহত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পাক বাহিনীর সকল পলায়ন পথ রুদ্ধ করে দেয়া, যাতে পণবন্দী হিসেবে তাদের ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে একটা সম্ভাব্য সমীক্ষণে এটাই প্রতীয়মান হয় যে,একদিকে হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের নির্যাতনের ফলে গণ-মানসে জীঘাংসা, দালাল শ্রেণী, মুক্তিবাহিনীর সংগ্রামী চেতনা, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্র---- এই সব কিছুর সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সামাজিক নৈতিক জীবনে যে তোলপাড় অনিবার্য,  তা নিয়ন্ত্রণ করা যে কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষেই প্রায় অসম্ভব। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যুদ্ধ পরবর্তী দেশে সংগ্রামী তারুণ্যের ন্যায় বিপ্লবী চেতনা থেকে এক ধরণের সমাজবিপ্লব ঘটে। এই ন্যায়বোধের অতি প্রাবল্য আর নব মূল্যবোধের আধিক্যের কারণে অনেক সময় সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।বাংলাদেশে শত্রুর রেখে যাওয়া সহযোগী, বহুধা বিভক্ত সশস্ত্র গ্রুপ, রাজনৈতিক বিভেদ--- ইত্যাদির সশস্ত্র হানাহানির আবর্ত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন মুক্তিযোদ্ধা অন্যান্যদের অস্ত্রশস্ত্র ফেরত নেয়া। এরই প্রেক্ষিতে বহুদলীয় কমান্ডব্যবস্থার অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় অস্ত্র পুনরুদ্ধারের কর্মসূচী কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতির সময়সীমা তাদের পরোক্ষ সহয়তার বিষয়টি উত্থাপিত হলে ভারত সরকার নিয়োজিত বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মধ্যস্থতাকারী ডি পি ধর জিজ্ঞাসা করেন, সর্বাধিক কতদিন ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাকতে পারে বলে অনুমান করা যেতে পারে ?প্রকৃতপ্রস্তাবে স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতের সেনাবাহিনী কতদিন অবস্থান করবে--- প্রশ্নের সাথে জড়িত ছিল, পাকিস্তানীরা চলে যাওয়ার সময় কী পরিমানে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে, হারানো উপনিবেশ ফিরে পাওয়ার জন্য অব্যবহিত পরবর্তীকালে পাকিস্তানীরা নতুন কোন সামরিক উদ্যোগ গ্রহণ করবে কী না তার উপর। তারপরেও তাজউদ্দিন আশা প্রকাশ করে বলেন, হয়ত তিন চার মাসের মধ্যেই অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি দেশে একটা সহনীয় পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে। আর যদি শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হন, তাহলে হয়ত তার আগেও অস্ত্র উদ্ধারসহ অরাজক পরিস্থিতি প্রতিরোধ করা সম্ভব

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বিভক্তি মুক্তিযুদ্ধ বানচালের অভিসন্ধি, পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধিয়ে বৃহৎ মিত্রদের হস্তক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধকে অবলুপ্ত করার পাকিস্তানের প্রয়াস, হানাদারদের ছিন্নভিন্ন করে রেখে যাওয়া বিপর্যস্ত সমাজ অর্থনীতি,এবং তারুণ্যের নব মূল্যবোধ সমন্বিত জটিল আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে বাঙালি জাতিকে একটি সুসংহত পথ নির্দেশনা এবং স্বাধীনতা লাভের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ২৩ নভেম্বর এক বেতার ভাষণে বলেন'মুক্তিবাহিনী এখন যে কোন সময়ে, যে কোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমন কী শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে।... ক্রমেই অধিক জায়গায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য সামগ্রী মনোবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ ততই হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে... তারা এখন চায় ভারতের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি করতে। তারা আশা করে যে,এমন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গোপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতি উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্টপোষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। কিন্ত আমি প্রত্যয়ের সাথে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না ... বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটিই -- আর তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা... ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষাই দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই---- এমন কী বিশ্বশক্তির সমরসম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না

অশ্রু রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি,সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতম হয়েছে।কিন্ত তার জন্য আরো আত্মত্যাগ,কষ্টস্বীকার জীবন দানের প্রয়োজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অনেক অর্থগর্ভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধ অবস্থায় আমরা কী মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কী ব্যবহার করি তার উপর। শত্রুসংহারের প্রতিজ্ঞার সাথে সাথে তাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে।বাংলাদেশের শহরে গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদের বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য সুবিধাভোগের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম

বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিকচক্রের হাতে বন্দী হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস,তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়া। তা করবার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তা- করতে যাচ্ছি"
ডিসেম্বর,১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধী বিকেলবেলায় কলকাতার এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন,এমন সময় খবর এলো পাকিস্তান ভারতের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে। খবর শুনে ইন্দিরা গান্ধী তাড়াতাড়ি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রীসভার জরুরী বৈঠকের পর বেতার বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন, এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে  ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী এক জরুরী চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান,পাকিস্তানের সর্বশেষ আক্রমনের সমুচিত জবাব প্রদানে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মিলিত ভূমিকা সফল হতে পারে যদি এই দুটি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর WSAG এর বৈঠকে হেনরি কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের আহূত অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিতে মার্কিন প্রস্তাব পেশ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিরাপত্তা অধিবেশন শুরু হওয়ার পর মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণাসহ ভারত-পাকিস্তানের সৈন্য স্ব স্ব সীমানায় ফিরিয়ে নেয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদান করার জন্য এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্ত সোভিয়েত রাশিয়া এই সমস্যার মূল কারণ পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষকে নিপীড়ন এবং শরণার্থী সমস্যা জর্জরিত ভারতের অবস্থা বিবেচনা না করে ভারত পাকিস্তানকে একই মানদন্ডে বিচার করায় এই প্রস্তাবকে এক তরফা বলে অভিহিত করে ভেটো প্রয়োগ করে। পোল্যান্ডও এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়।ফ্রান্স বৃটেন ভোটদানে বিরত থাকে।  ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে সোভিয়েত প্রতিনিধি প্রস্তাব করেন যে, পুর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তির প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সহিংসতার অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে। সে সাথে পাক-বাহিনীর সহিংসতার কারণে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে তাও অবিলম্বে বন্ধ করার প্রয়োজন। শুধু পোল্যান্ড এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে, চীন ভেটো দেয়, অন্যান্য সদস্যদেশ ভোটদানে বিরত থাকে

ডিসেম্বর ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করে।এই দিন থেকেই পাকিস্তানের সৈন্যরা ঢাকা সমুদ্রোপকূলোবর্তী অঞ্চলের দিকে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। ওয়াশিংটন পাকিস্থানের আসন্ন পরাজয় রোধ করতে মরিয়া হয়ে উঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র কুটনৈতিক চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসন uniting for peace ধারার অধীনে যুদ্ধবিরতি সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যেতে তৎপর হন

ডিসেম্বর যশোর দুর্গের পতন ঘটে। এই তা্রিখেই গভর্ণর আব্দুল মালেক নিয়াজীর অভিমত উদ্ধৃত করে ইয়াহিয়াকে জানান, আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সামরিক সহায়তা যদি না পৌঁছায় তাহলে জীবন রক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্চনীয়। গভর্ণর মালেকের চিঠি তাৎক্ষণিকভাবে কিসিঞ্জারের কাছে পৌঁছানো হয়। কিন্ত নিজ দেশে নিক্সন প্রশাসনের জন্যও সমস্যা তখন কম নয়। মানবিক দৃষ্টি মার্কিন জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তান নীতি নিয়ে মার্কিন গণপ্রতিনিধি সংবাদ মাধ্যমগুলির সমালোচনা তখন তুঙ্গে। মার্কিন সিনেটে এবং হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে ডেমোক্র্যাট দলের কোন কোন সদস্য পাকিস্তানী জান্তার গণহত্যার প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন জাতিসংঘের একদেশদর্শী ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। জনমতের এই প্রবল চাপে ডিসেম্বর কিসিঞ্জার নিজেই এক অজ্ঞাতনামা 'সরকারি মুখপাত্র' হিসেবে আস্থাভাজন কিছু সাংবাদিকদের কাছে পরিবেশিত এক সমীক্ষার দ্বারা মার্কিন জনমত পরিবর্তনের প্রয়াস চালান

ডিসেম্বর রাতে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত এক প্রস্তাবে ভারত-পাকিস্তানকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পরস্পরের সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করার আহবান জানানো হয়।প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪টি ভোট আর  বিপক্ষে ১১ ভোট পড়ে।বৃটেন ফ্রান্সসহ ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে পাকিস্তান ১৯৫৯ সালের দ্বিপাক্ষিক চুক্তিমোতাবেক যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ দাবি করে। ডিসেম্বর ভিয়েতনাম ফিলিপিন উপকূলে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত হয়

সপ্তম নৌবহর ফিলিস্তিন উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছতে চার-পাঁচদিন সময় লাগে। জন্য সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছার সময় দেবার জন্য যে অবস্থায় আছে সে- অবস্থায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য ভারতকে রাজি করানোর উদ্দেশ্যে রাশিয়ার উপর সর্বাধিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। ১০ ডিসেম্বর মার্কিন সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালীতে পৌঁছে যায়। ১১ ডিসেম্বর ডি পি ধর ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি মোতাবেক আলোচনার জন্য মস্কো যান। ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান আরো দ্রুততর করা হয় এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলো সতর্কাবস্থায় মোতায়েন করা হয়। ১২ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার সোভিয়েত প্রতিনিধিকে চূড়ান্তভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, ভারত যদি যুদ্ধবিরতি না করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। সময় সিকিম ভুটানের উত্তর সীমান্তে চীনা সৈন্যের সমাবেশ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ইন্দিরা গান্ধী চরম সাহসিকতা দৃঢ়তার সাথে এই সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন এবং সোভিয়েত রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের উপর্যুপরি হুমকি অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নেন
 যুক্তরাষ্ট্র যে সময় চীনের ভূসামরিক হস্তক্ষেপের প্রত্যাশা করছিল সে সময় অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর হুয়াংহুয়া নিউইয়র্কে আলেক্সজান্ডার হেগকে জানান যে ,চীন শুধুমাত্র আরেকবার নিরাপত্তা পরিষদ অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি বিষয়ে আলোচনা করতে চায়, সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে নয়। এদিকে তখন সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করেছে। সামরিক হস্তক্ষেপে চীনের এই অনাগ্রহে চব্বিশ ঘন্টা পথের দুরত্বে সপ্তম নৌবহরকে নিশ্চল করে দেয়া হয়

১৩ ডিসেম্বর দুপুরে লেঃ জেনারেল গুল হাসান নিয়াজীকে জানিয়েছিলেন যে,উত্তর দক্ষিণ দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে। কিন্ত বিকেলে নিয়াজীকে আবার জানানো হয় যে,প্রত্যাশিত বন্ধুদের সাহায্য আটচল্লিশ ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র এই সময় চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপে রাজী করানোর প্রচেষ্টা চালায় দিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী সদরদপ্তরে বাংলাদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক অসফল প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। ১৩ ডিসেম্বর সকালে  প্রায় মাসখানেক আগে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুবুল আলম চাষী যুদ্ধবিরতির এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেন। এই প্রস্তাবিত বিবৃতির প্রধান বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয় তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবেন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী তখন যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। সে সময় যদি বাংলাদেশ একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হত তাহলে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পিছনে কোন নৈতিক ভিত্তি থাকতো না। সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম উক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিতে অসম্মত হন, এবং বিষয়টি তাজউদ্দিনের গোচরে আনেন
(ক্রমশ)
[কথা কবিতা]





Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.