পাখিজন্ম
যদি হয় নারীদিবস
কিংবা মাতৃ-দিবস, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মেয়ে মেয়ে, মা’ মা’ ডাক কোলাহল করে । পুজোর দিনে দেবীমূর্তিকে প্রণাম করে সাজগোজে, খাবারের গন্ধে ভরে যায় রাস্তা । আর বিজ্ঞাপন ? সে তো মুখ ঢেকে দিতে সদাই পারঙ্গম । সকাল বিকাল সেখানে মেয়েরা ঝলমল করতেই থাকে, করতেই থাকে । নিয়ন আলোতে তাদের মসৃণ ত্বক, তাদের অবিশ্বাস্য হাসি, তাদের উজ্জ্বল ঘরসংসার আমাদের বিহ্বল করে তোলে অব্যর্থ ভাবে, যেন ওটাই আসল আয়না ।
তবে কেন স্টেশনের
ধারে, জলার পাশে, পোড়ো জমিতে ইতস্তত পড়ে থাকে রক্তের ছিটে ? মাছিরা উড়ে উড়ে বসে, খবরের কাগজের
পাতায় একদিনের
জন্য পিছলে যায় অন্ধকার
। সেই শীত শীত, চাপ চাপ, ঘন, গোপন অন্ধকার, যা অন্তরে চাপা দিতে দিতে জড়সড় হয়ে যায় প্রত্যেক মেয়ে । শিউরে ওঠে, সতর্ক হয়, আঁচল বা’ ওড়না অবচেতনে
জড়িয়ে যায় যেন । রাতে বা দিনে একা রাস্তায়
সেই ওড়না জড়িয়ে যায় পাকে পাকে । দমবন্ধ
লাগুক, তবু নিরাপত্তা , তবু স্বস্তি , তবু হাঁপ ছাড়ে মেয়ে । আমার মাথার ওপর আকাশ আরো নীল হতে থাকে, আমি চোখ বন্ধ করে থাকি । বৃষ্টিতে আমি আর একা রাস্তায় ভিজি না । বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনি, যেন টেলিফোনে মায়ের গলা । ল্যাব থেকে আর রাত করে একা একা ফিরিনা । ফিরলেও প্রাণপণ জোরে হেঁটে বাড়ি ফিরি । ঘরে ঢুকে , দরজা আটকে তবে শান্তি । এবার মেয়ে নিশ্চিন্তে চোখ ফেরাবে মোবাইলের স্ক্রীনে । টিভির পরদায় আবার ঝলমল করবে সোনালী বিজ্ঞাপন !
অথচ শালবনের
শেষে বৃষ্টি
জড়ানো কুয়াশায়
আবছা পড়ে থাকে এক পথ । আমার অর্জিত
সব স্বাধীনতা
নিয়ে, আমার অর্জিত সব একাকীত্ব নিয়ে, সেই দিকে হেঁটে যাবার কথা এখনো আবছা মনে পড়ে । নারী হয়ে নয়, পুরুষ হয়ে নয় । আমার কর্মপ্রাচীন
শীতার্ত
হাত দুটি নিয়ে, বহুদূর হেঁটে আসা মলিন পা দুটি নিয়ে ওড়নার প্রান্তে সূর্যের আলতো কিরণ সন্তর্পণে বাঁচিয়ে একজন সামান্য মানুষ হয়েই হেঁটে যাবার কথা ছিল যেন । সে কী অন্য কেউ ? অন্য কারো স্বপ্ন ? অন্য জন্মের
কথা ?
একলা চলার এই পথটুকু
খোলা না থাকলে কোথাও প্রাণ থাকে না । এই কথাটি পাখিরা
বোঝে, মানুষ বোঝে না । তাই বুঝি কোনো এক পাখিজন্ম আমার স্বপ্নের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে । তোমারও কি পাখিজন্ম ছিল ? মনে পড়ে ?
সন্ধ্যের
নরম আলো মেখে ঘরে ফেরে পাখিরা
। ঘরকে ডানায় মুড়ে আদর করে, সোহাগ করে ডাকে নীড় । উষ্ণ পালকের স্পন্দনে স্বপ্ন স্বপ্ন, সত্যি সত্যি ছন্দে ডিমডিম করে মাদল বাজে । দুলে ওঠে শালবন, দুলে ওঠে একা পথ, সুরের ঝঙ্কারে
সংসারে
রন্ধ্রে
রন্ধ্রে
বেজে ওঠে রক্তমাংসের
পাখিজন্ম
।
কোন দেশের বেনেদের
বউ, কার সে গঞ্জনার ভয়ে ডালের কড়াই মাথায় ভেঙ্গে, হলদে হয়ে, কালি মেখে আকাশে উড়ে গিয়েছিলে ! সেই ভয় এখনো শিরশির
করে পালকে পালকে ?
কিন্তু
তোমারই
হাতের পরমান্নতে
শান্তির
সুধা মেশানো
ছিল, তোমারই আলোতে শিখা জ্বলেছিল গৃহকোণে । কেউ মনে রাখলো না বলে, নিজেরাও
ভুলে গেলে সেই কথা ? কোনো রাতে ছায়াপথে
হেঁটে চলো একা একা । দেখো, নির্বর্ণ মহাকাশে কোটি কোটি আলোর পাখি উড়ছে । চোখ ভরে, মন ভরে, নিঃশ্বাসের প্রতিটি কণায় ভরে নিও সে আলোর ইতিহাস ।
কার কাছে ঋণী আমি ? কোনো পুরুষ, কোনো নারী, কোনো ভালোবাসা অথবা কোনো সময় ? ধোঁয়াটে ঝর্নার
নদীতে ঝাঁপিয়ে
পড়বার মতো কোনো অতীত ? না’কি বহতা নদীর সাগরের বুকে লীন হয়ে যাওয়ার মতো কোনো ভবিষ্যত ?
কার কাছে ? সমাজের
ভান্ডারে
এর উত্তর না পাওয়া গেলে সেই প্রশ্ন
কি হারিয়ে
যাবে ? তলিয়ে যাবে সাজপোষাক, গয়না, অর্থ ও সামাজিক কৌলিন্যে ? নিজেকে আর কতোকাল অন্যের প্রশ্নে , অন্যের জবাবে, অন্যের ইতিহাসে খুঁজবে বেনেবউ ? এভাবে ধীরে ধীরে নিজের ইতিহাস অন্যের হাতে লেখা হতে থাকবে যে ! আর তুমি দায়ী করবে সেই অন্যের
প্রতিভূ
হয়ে দাঁড়িয়ে
থাকা পুরুষ কিংবা সমাজকে !
ভোরবেলায়
সূর্যের
প্রথম কিরণে যে প্রেমের
উন্মেষ
হয়েছিল, সেই প্রেম ডানায় মেখে নিচ্ছে পাখি । উড়ান তো’ একলারই
। পাশাপাশি
ওড়ে যারা, হয়তো ডানা ছুঁয়ে যায়, হয়তো পরস্পরের
উষ্ণতা
অনুভূত
হয় শোণিত স্পন্দনে, তবুও চলতে হয় একা । সত্যিকারের আয়নার দিকে । ভালোবাসার দিকে।
ভালোবাসা
প্রাণে
ভরো পাখি । ভালোবাসা
ডানায় মাখো । পুরোনো
হলেও এই একটি মাত্র কথাই টিঁকে গেছে তোমার এত যুদ্ধ, তোমার এত রক্তপাতের পরেও ! তুমিও তো উড়ে চলেছ সেই কতোকাল থেকে । টিঁকে আছো যন্ত্রনা পেরিয়ে । শুনছো বেনেবউ ?
উড়বে যদি নিজের পানে ফেরো । তোমার সোনালী
ডানা জুড়ে খেলা করুক সূর্যাস্তের
আলো । ভালোবাসার
আলো । নিজেকে
চেনার আনন্দে
তুমি খুঁজে পাও নিজস্ব
আকাশ । নিজস্ব
পথ । নীড়ের খোঁজে, সমুদ্রের খোঁজে পাখিজন্ম যেন ফিরে পাও তুমি এই সাধারণ মানুষী অবয়বে !
[অরুন্ধতী চক্রবর্তী]