>

অরুনদ্ধতী চক্রবর্তী

SongSoptok | 3/10/2015 |




পাখিজন্ম

যদি হয় নারীদিবস কিংবা মাতৃ-দিবস, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মেয়ে মেয়ে, মামাডাক কোলাহল করে পুজোর দিনে দেবীমূর্তিকে প্রণাম করে সাজগোজে, খাবারের গন্ধে ভরে যায় রাস্তা আর বিজ্ঞাপন ? সে তো মুখ ঢেকে দিতে সদাই পারঙ্গম সকাল বিকাল সেখানে মেয়েরা ঝলমল করতেই থাকে, করতেই থাকে   নিয়ন আলোতে তাদের মসৃণ ত্বক, তাদের অবিশ্বাস্য হাসি, তাদের উজ্জ্বল ঘরসংসার আমাদের বিহ্বল করে তোলে অব্যর্থ ভাবে, যেন ওটাই আসল আয়না    

তবে কেন স্টেশনের ধারে, জলার পাশে, পোড়ো জমিতে ইতস্তত পড়ে থাকে রক্তের ছিটে ? মাছিরা উড়ে উড়ে বসে, খবরের কাগজের পাতায় একদিনের জন্য পিছলে যায় অন্ধকার সেই শীত শীত, চাপ চাপ, ঘন, গোপন অন্ধকার, যা অন্তরে চাপা দিতে দিতে জড়সড় হয়ে যায় প্রত্যেক মেয়ে শিউরে ওঠে, সতর্ক হয়, আঁচল বাওড়না অবচেতনে জড়িয়ে যায় যেন রাতে বা দিনে একা রাস্তায় সেই ওড়না জড়িয়ে যায় পাকে পাকে দমবন্ধ লাগুক, তবু নিরাপত্তা , তবু স্বস্তি , তবু হাঁপ ছাড়ে মেয়ে আমার মাথার ওপর আকাশ আরো নীল হতে থাকে, আমি চোখ বন্ধ করে থাকি বৃষ্টিতে আমি আর একা রাস্তায় ভিজি না বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনি, যেন টেলিফোনে মায়ের গলা ল্যাব থেকে আর রাত করে একা একা ফিরিনা ফিরলেও প্রাণপণ জোরে হেঁটে বাড়ি ফিরি ঘরে ঢুকে , দরজা আটকে তবে শান্তি এবার মেয়ে নিশ্চিন্তে চোখ ফেরাবে মোবাইলের স্ক্রীনে টিভির পরদায় আবার ঝলমল করবে সোনালী বিজ্ঞাপন !  

অথচ শালবনের শেষে বৃষ্টি জড়ানো কুয়াশায় আবছা পড়ে থাকে এক পথ আমার অর্জিত সব স্বাধীনতা নিয়ে, আমার অর্জিত সব একাকীত্ব নিয়ে, সেই দিকে হেঁটে যাবার কথা এখনো আবছা মনে পড়ে নারী হয়ে নয়, পুরুষ হয়ে নয় আমার কর্মপ্রাচীন শীতার্ত হাত দুটি নিয়ে, বহুদূর হেঁটে আসা মলিন পা দুটি নিয়ে ওড়নার প্রান্তে সূর্যের আলতো কিরণ সন্তর্পণে বাঁচিয়ে একজন সামান্য মানুষ হয়েই হেঁটে যাবার কথা ছিল যেন সে কী অন্য কেউ ? অন্য কারো স্বপ্ন ? অন্য জন্মের কথা ?  
একলা চলার এই পথটুকু খোলা না থাকলে কোথাও প্রাণ থাকে না এই কথাটি পাখিরা বোঝে, মানুষ বোঝে না তাই বুঝি কোনো এক পাখিজন্ম আমার স্বপ্নের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে তোমারও কি পাখিজন্ম ছিল ? মনে পড়ে ?

সন্ধ্যের নরম আলো মেখে ঘরে ফেরে পাখিরা ঘরকে ডানায় মুড়ে আদর করে, সোহাগ করে ডাকে নীড় উষ্ণ পালকের স্পন্দনে স্বপ্ন স্বপ্ন, সত্যি সত্যি ছন্দে ডিমডিম করে মাদল বাজে দুলে ওঠে শালবন, দুলে ওঠে একা পথ, সুরের ঝঙ্কারে সংসারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেজে ওঠে রক্তমাংসের পাখিজন্ম

কোন দেশের বেনেদের বউ, কার সে গঞ্জনার ভয়ে ডালের কড়াই মাথায় ভেঙ্গে, হলদে হয়ে, কালি মেখে আকাশে উড়ে গিয়েছিলে ! সেই ভয় এখনো শিরশির করে পালকে পালকে

কিন্তু তোমারই হাতের পরমান্নতে শান্তির সুধা মেশানো ছিল, তোমারই আলোতে শিখা জ্বলেছিল গৃহকোণে কেউ মনে রাখলো না বলে, নিজেরাও ভুলে গেলে সেই কথা ? কোনো রাতে ছায়াপথে হেঁটে চলো একা একা দেখো, নির্বর্ণ মহাকাশে কোটি কোটি আলোর পাখি উড়ছে চোখ ভরে, মন ভরে, নিঃশ্বাসের প্রতিটি কণায় ভরে নিও সে আলোর ইতিহাস

কার কাছে ঋণী আমি ? কোনো পুরুষ, কোনো নারী, কোনো ভালোবাসা অথবা কোনো সময় ? ধোঁয়াটে ঝর্নার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বার মতো কোনো অতীত ? নাকি বহতা নদীর সাগরের বুকে লীন হয়ে যাওয়ার মতো কোনো ভবিষ্যতকার কাছে ? সমাজের ভান্ডারে এর উত্তর না পাওয়া গেলে সেই প্রশ্ন কি হারিয়ে যাবে ? তলিয়ে যাবে সাজপোষাক, গয়না, অর্থ সামাজিক কৌলিন্যে ? নিজেকে আর কতোকাল অন্যের প্রশ্নে , অন্যের জবাবে, অন্যের ইতিহাসে খুঁজবে বেনেবউ ? এভাবে ধীরে ধীরে নিজের ইতিহাস অন্যের হাতে লেখা হতে থাকবে যে ! আর তুমি দায়ী করবে সেই অন্যের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ কিংবা সমাজকে !

ভোরবেলায় সূর্যের প্রথম কিরণে যে প্রেমের উন্মেষ হয়েছিল, সেই প্রেম ডানায় মেখে নিচ্ছে পাখি উড়ান তোএকলারই পাশাপাশি ওড়ে যারা, হয়তো ডানা ছুঁয়ে যায়, হয়তো পরস্পরের উষ্ণতা অনুভূত হয় শোণিত স্পন্দনে, তবুও চলতে হয় একা সত্যিকারের আয়নার দিকে ভালোবাসার দিকে।

ভালোবাসা প্রাণে ভরো পাখি ভালোবাসা ডানায় মাখো পুরোনো হলেও এই একটি মাত্র কথাই টিঁকে গেছে তোমার এত যুদ্ধ, তোমার এত রক্তপাতের পরেও ! তুমিও তো উড়ে চলেছ সেই কতোকাল থেকে টিঁকে আছো যন্ত্রনা পেরিয়ে   শুনছো বেনেবউউড়বে যদি নিজের পানে ফেরো তোমার সোনালী ডানা জুড়ে খেলা করুক সূর্যাস্তের আলো ভালোবাসার আলো নিজেকে চেনার আনন্দে তুমি খুঁজে পাও নিজস্ব আকাশ নিজস্ব পথ নীড়ের খোঁজে, সমুদ্রের খোঁজে পাখিজন্ম যেন ফিরে পাও তুমি এই সাধারণ মানুষী অবয়বে !
            

[অরুন্ধতী চক্রবর্তী]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.