কথা ওই অবধি হলেও মউলি বুঝল শমী রাজি। কারন মউলি জানে শমী
প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, রোজগার পাতি খারাপ নয়, ওর এক একটা ছবি প্রাইজ পেলে বা বিক্রী হলে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পায়;
সাথে এদেশ ওদেশ ঘুরে ওয়ার্কশপ করায় যে তাতেও কিছু রোজগার তো হয় বটেই।
আবার বাড়িতে ওর নামের একটা অংশ বরাদ্দ আছে। যে বিয়ে করে আরেকজনের দায়িত্ব নিতে
ইচ্ছুক সে এটুকু পারবে। আর তাছাড়া সোনামন থাকবে তো এখানেই শুধু নামেই যা শমী ওর
দায়িত্ব নেবে। অর্থাৎ শমীর বরাদ্দ থেকে সোনামনের জন্য খরচ হবে। ব্যস্ এতে মনেহয়না
বাড়িতেও কারোরই বিশেষ আপত্তি হবে।
ভোর বেলা শমীর ঘুম ভাঙ্গল মিষ্টি করে কেউ ভজন গাইছেশুনে। এক
লাফে শমী চটি গলিয়ে, ক্যামেরা নিয়ে গানের উৎস সন্ধানে চলল।
ঠাকুর দালান থেকে আসছে গান। মাইক লাগানো ঠাকুর দালানে, শমী
বেশ অবাক হোলো। কারন, পুজোর সময় ছাড়া মাইক লাগিয়ে গান
হোতোনা। তার অবর্তমানে কতো কিছুই বদলে যায়। প্রতিবার নতুন কিছুনা কিছু আবিষ্কার
করবেই সে। ঠাকুর দালানের সামনেই মউলি আটকালো শমীকে। দাঁত মাজেনি, কাপড় ছাড়েনি সে ঠাকুর দালানের কাছে যেতে পারবেনা। তবে গান গাইছে সোনামন
এইটুকু খবর পেলো শমী। তার সব কাজ সারতে সারতে ওদিকে গান শেষ, মউলি চা নিয়ে হাজির হোলো শমীর ঘরে।
"রেডি? তোর জন্য
সারপ্রাইজ আছে"
"সকাল হোলো, আর
তোর শুরু হোলো না? অ্যাই শোন্, কেস্ টা
কিরে, ঠাকুর দালানে কি মাইক পার্মানেন্ট নাকি রে? আগে শুধু পুজোয় লাগত"
"হ্যাঁ পার্মানেন্ট। এখন আসলে ঘরে কারোর
জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী থাকলেই ঠাকুর স্পেশ্যাল পুজো পান।
এতো বড় ফ্যামিলি প্রতি মাসেই কারো না কারোরটা লেগে থাকে। তাছাড়া রেগুলার
পালাপার্বন গুলো তো আছেই। কাজেই গান হবেই যখন তখন পার্মানেন্ট করে নেওয়া হোলো। সে
ও বেশ কয় বছর হয়েছে।"
"বুঝলাম। তা আজকের উৎসব টা কি?"
"ছোটো পুত্রের আগমন" বলে খিল খিল
করে হেসে নিল মউলি। তারপর দরজার বাইরে থেকে কাউকে একটা টেনে ঘরে আনল। শমী অবাক হয়ে
দেখে মেয়েটা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে, এমন চাহনি যেন
কতো যুগের চেনা, যেন কবের থেকে শমীন্দ্রর অপেক্ষায় রয়েছে
মেয়েটা।
"এই যে তোর ছাত্রী"
"ছাত্রী মানে?" কিছুটা তুতলে গেলো শমীর কথা, গলাও বোধহয় কেঁপে গেলো
কিছুটা; মেয়েটা এতো স্নিগ্ধ।
"আমার কি পড়াতে হবে নাকি?" শমীর চোখের ভাষা বুঝে নিলো মউলি।
"বা রে, তুই
স্পনসর করবি অথচ তাকে দেখবি না? না, মানে,
তুই দেখে নে সত্যিই ওকে স্পনসর করা যায় কিনা, আমি
বলেছি বলেই করে দিলি"
"কি যা তা বকছিস, যা
এখন, কাজ করতে দে" হঠাৎ একদম কাছে এসে খুঁক করে একটা
হাসি দিয়ে, গলা নীচু করে যাতে সোনামন শুনতে না পায় সেভাবে
মউলি বলল "অন্য কোনো কাজে এখন আর মন বসাতে পারবি? তার
চেয়ে কাজের কাজ কর" ওদের দুজনকে রেখে হাসতে হাসতে দ্রুত পালালো মউলি।
কি কথা বলা উচিত, কি
দিয়ে শুরু করবে ভেবেই পাচ্ছেনা যেন শমী। নিজেই অবাক হচ্ছে কেন নার্ভাস লাগছে ভেবে।
মেয়েটা মাথা নীচু করে অপেক্ষায়। চা য়ে একটা চুমুক দিয়ে গলাটা ঝেড়ে কথা খুঁজে বের
করল শমী
"তুমি সকালে গান গাইছিলে? বোসো না দাঁড়িয়ে আছ কেন?"
"হ্যাঁ গাইছিলাম। আমায় কেউ তুমি করে বলে
না, আপনিও তুই করেই বলতে পারেন। আমি এখন বসবো না, এটা কাজের সময় তো, ছোটোবৌদি বললেন তাই আপনার চা টা
বানিয়ে নিয়ে এলাম, আপনারও তো কাজ আছে বলছিলেন। হয়ে গেলে
কাপটা নিয়ে যাবো" কোথাও জড়তা নেই কেমন শান্ত ভঙ্গীতে কথা বলে মেয়েটা।
"তুমি করেছ চা? খুব
ভালো হয়েছে। কাজের সময় তো বটেই, তুমি পড়াশোনা করতে ভালোবাস
ছোটোবৌ বলছিলো, এই সময়ে পড়তে না বসে কাজ করো কেন?"
কোনো উত্তর যোগালো না সোনামনের মুখে।
আর কথা খুঁজেই পেলোনা চা শেষ করার মধ্যে, কাপ নিয়ে চলে গেলে সেই দিকে তাকিয়ে বসে রইল শমী। একটু পরে মা এসে দাঁড়ালেন,
সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুরের বিশেষ আরতি আর দুপুরে তার অনারে ভোগ দেওয়া হবে
জানিয়ে চলে যেতে গেছেন যেই শমী কেমন আকুল হয়ে ডাক দিলো,
"মা। একটু বসবে আমার কাছে?"
ছেলের গলার আওয়াজ যেন কেমন ঠেকল, কাছে এসে
মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন "কি হয়েছে রে? মন খারাপ?"
"জানিনা মা, শুধু
মনে হোলো তোমার কাছে থাকি একটু, তোমার গায়ে কেমন ঠাকুর ঘর
ঠাকুর ঘর গন্ধ"
"সেকিরে? দেখি
শরীর খারাপ নয়ত? আয় দেখি কাছে, ওমা,
শুয়ে পড়লি যে বড়? এই দেখো বলেনা কিছু, মুখ গুঁজে থাকলে চলে? ওরে তোরা এখন বড় হয়েছিস এখন কি
আর মা সব কথা ধরতে পারে?" কতসময় তবু মায়ের কোলে মুখ গুঁজেই
রইল। তারপর হঠাৎ এমন প্রসঙ্গে কথা শুরু করল যে মা অবাক না হয়ে পারলেন না।
"আচ্ছা মা, তুমি
ওই যে পুবের বাড়ির মেয়েটাকে অ্যাডাপ্ট করছ, ওর নাকি খুব
শার্প মাথা, ছোটোবৌ বলছিল আরকি। ওর বয়স কতো? এখন আর কোনো স্কুল নেবেনা ওকে? মেয়েটা কেমন শান্ত,
নির্বিকার। ওর মা বাবা থাকলে জীবনটাই অন্যরকম হোতো তাইনা? ওর নাম কি তুমি রেখেছ? অন্য কোনো নাম নেই ওর?
কোনো একটা সুন্দর ফুলের নাম রাখতে, পাঁপড়ি বা
কিছু; কেমন ঠাকুরের থালার ফুলের মতো মেয়েটা"
"ও মা!! তুই হঠাৎ ওকে নিয়ে পড়লি যে?
হ্যাঁ মা বাবা থাকলে তো কথাই ছিলো না।"
"নাঃ, সকালে গান
শুনলাম কি না, তাই, এমনি, হঠাৎ মনে হোলো। তবে বয়স হলে তো ওর বিয়েও দেওয়া উচিত এতো গুনী"
"সে দেখবি ওপরওয়ালা ঠিক জুটিয়ে
দেবেন" এই হতে হতে হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো মউলি উপস্থিত।
"বড়মা। ওকি গো? তোমার
লাডলা দেখি মাতৃক্রোরে? ওরে ব্বাস। তাইতো বলি, বাছাধন চুপটি করে আছেন কেন। আর বড়মাকে ও খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?"
"হয়েছে, কি জন্য
খুঁজছিস? চল যাচ্ছি"
"দাঁড়াও দাঁড়াও তোমার কনিষ্ঠ কি তার
মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে তোমার কাছে?"
"আঃ, জ্বালাস না
আর ওকে, চল"
"ও বড়মা তবে তো তুমি অন্ধকারে"
"মানে কি রে? আমি
তো কিছুই বুঝছিনা"
"তোমার ঠাকুর কে ভোগটা আরেকটু বেশী
দিও" বলে গলা নীচু করে বলল "তেনার মত হয়েছে"
"অ্যাঁ, বলিস কি?"
আনন্দের আতিশয্যে মা বোধহয় কিছুটা জোরেই বলে ফেলেছেন। মউলি দুই হাত
প্রদীপ নেভানোর মতো করে নাড়িয়ে "আস্তে আস্তে। শুধু তুমি আর আমি আর কেউ শুনলে
অতিষ্ঠ করে মারবে"
বড় করে জিভ কেটে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করেন মা। ঠাকুরের
উদ্দেশ্যে জোড়হাত করে কপালে ঠেকিয়ে হাসি মুখে আরেকবার ছেলেকে দেখে নিজের কাজে
গেলেন। যাবার সময় মউলিকে ডাক দিয়েও গেলেন, যদিও
জানতেন সে এখন খানিকক্ষন শমীর পিছে লাগবে। মউলিকে দেখেই পিঠ ফিরে শুয়েছে শমী।
"কি ব্রাদার একে বারে ফেলাট?"
বলে খোঁচা মারল শমীর পিঠে। রাগ রাগ মুখ করে ঘুরল শমী।
"সে কি এর মধ্যে আবার রাগ এলো কোত্থেকে?
অবশ্য রাগ আর অনুরাগের মধ্যে অনু মাত্র তফাৎ"
"তুই যাবি?" ঝঙ্কার
দিয়ে ওঠে শমী।
"উ হুঁ কেস্ খানা তো সুবিধের ঠেকছেনা।
কি হয়েছে রে?" লাফ দিয়ে উঠে বসে শমী, কোলের ওপর পাশ বালিশটা টেনে নিয়ে বসে বলে "দেখ তুই বড্ড বাড়াবাড়ি
করছিস। কে না কে তাকে একেবারে আমার ঘরে নিয়ে এলি বলা নেই কওয়া নেই। আবার রেখে দিয়ে
চলে গেলি"
"তো? সে কি বাঘ না
ভাল্লুক? সুন্দর একটা ছোট্ট মেয়ে বৈ তো নয়"
"হ্যাঁ, তুই কি
বুঝবি? তুই জানিস ওকে দেখলে আ আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, কেমন বুকের ভেতর ধুম ধুম করে, খবরদার আর যদি ওকে
এনেছিস; শুনছিস তুই?" মউলি
ততোক্ষনে বুঝে গেছে যা বোঝার, সে অন্য অন্য দিকে তাকায়,
টেবিলের কাগজ গোছায়।
"ও এই ব্যাপার? বেশ
তো আর আনবো না" বলে তারপর খ্রুঁক খ্রুঁক করে হাসি চেপে পালালো।
(ক্রমশ)
[মৈত্রয়ী
চক্রবর্তী]