ভ্যালেনটাইনস ডে ...
প্রতি বছর চোদ্দই ফেব্রুয়ারি বইটা খুলে স্মৃতি
রোমন্থন নোলোকের একটা অভ্যেসে পরিনত হয়েছে। গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে এটাই সে করে
আসছে। আজ সকালে বইটা নিতে গিয়ে দেখে নেই সেটা জায়গা মতো। খুবই
অবাক হলো; যে বইয়ের অস্তিত্ব তার কাছে ছাড়া আর কারুর কাছেই যেন নেই, ছিলনা কোনদিনও, এমনকি বিয়ের আগে তার যমজ বোন ঝুমকিও ধরেনি কখনো; সেই বই জায়গায় নেই? কি জানি মায়ের মন, তার মেয়ে পায়েলও তো এখন সেই বয়সেই যে বয়সে নোলোক পেয়েছিল বইটা।
পায়ে পায়ে ঘুমন্ত মেয়ের ঘরে এসে দেখে তার অনুমানই ঠিক; বইটা পায়েলের টেবিলে রাখা। আজ ছুটির দিন; পায়েলের উঠতে মনেহয় দেরীই হবে। যদিও ছুটির দিনে
ভ্যালেনটাইনসডে পড়ায় মেয়েটা কি বলছিল বন্ধুদের সাথে বেরোবে না
কি যেন। এখন এসব ভাবার সময় নেই, বইটা উঠিয়ে নিয়ে চলল নোলোক। অদ্ভুতও লাগলো তারই
বই আজ চুরি করে পড়তে হচ্ছে তাকে? বইটা হাতে সকালের চা নিয়ে তার প্রিয় বারান্দায় বসলো নোলোক। ব্রাউন পেপার এর মলাটের ভেতর থেকে সন্তর্পনে বের
করে দুটো ফুল; একটা মর্নিং গ্লোরি আরেকটা লবঙ্গলতিকা। এত বছরে ফুল দুটো
শুকিয়ে পাতলা কাগজের মতো হয়েগেছে; ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে না যায় তাই খুব সতর্ক নোলোক। আর ছোট্ট চিরকুট দুটো। অভ্যেসবশতঃ নিয়ে বসলো ঠিকই কিন্তু
আনমনা হলো, কারণ এবারের চোদ্দই ফেব্রুয়ারি দিনটাই কেমন অন্য রকম ; এলোমেলো করা।
নোলোক আর ঝুমকি প্রক্সি সিনেমার অপর্ণা সেন অভিনীত যমজ
বোনের চরিত্র দুটির মতই একজন মুখচোরা একজন হুল্লোড় বাজ, আইডেনটিকাল টুইন। প্রথম দিন কলেজ গেছিল একই রকম হলদে চুড়িদার পরে, ঝুমকির আইডিয়া। নোলোকের বাংলা আর ঝুমকির অঙ্ক; নিজের নিজের ক্লাস খুঁজে নিয়ে উপস্থিত। গিয়েই শুনলো
তারিকের নাম। সে নাকি ইউনিভার্সাল 'তারিকদা', পুরো নাম মহম্মদ তারিক ইসলাম; বেজায় ধনীর ঘরের যথেষ্ট বখাটে ছেলে; অ্যাংরি ইয়ং ম্যান মার্কা ইমেজ নিয়ে চলে। শুধু
মাত্র কলেজের এই হুল্লোড়ে জীবন ছাড়তে হবে সেই ভয়ে নাকি
পার্ট-টু পরীক্ষা সে দেয়না। (এখন যেটা ফাইনাল তখন সেটা পার্ট টু পরীক্ষা ছিল।) তার বয়সেরও গাছ পাথর নেই আর পয়সারও। আগামী পাঁচ প্রজন্ম বসে
খেতে পারে এমন পয়সা নাকি তার বাবার। কলেজের যাবতীয় অনুষ্ঠানে এক্স্ট্রা খরচ সব নাকি
তারিকের। একাই থাকে শহরের একটা পশ এলাকায় বিশাল এক ফ্ল্যাট হাঁকিয়ে। মাঝে মাঝেই
নাকি কারণে অকারণে নিজের ফ্ল্যাটে পার্টি দেয়; সাংঘাতিক দামী বাইক নিয়ে কলেজে আসে। তবে হ্যাঁ, দুটো অদ্ভুত ব্যাপার আছে তার মধ্যে এক তো, সে নেশা করেনা আর দুই মেয়েদের নিয়ে তার কোনো দুর্বলতা নেই। আজ অবধি
নাকি চেষ্টা করেও কোনো মেয়ে তারিকের বাইকে বসার সুযোগ পায়নি। তো, এইহেনো 'তারিকদা' তেনার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে প্রথমদিন 'পরিচয়' করতে আসে জুনিয়রদের সাথে। কথাটা শুনে নোলোকের যে কি হাল; ভয়ে গলা শুকিয়ে.কাঠ।
যথাসময়ে তারিক তার দলবল নিয়ে হাজির একেকজনকে যা খুশি করাতে লাগলো সাথে খ্যাক খ্যাক করে হাসি।
কাউকে বলে বাঁদর নাচ, কাউকে বলে ফেরিওয়ালা সাজ; নোলোকের সামনের জনের আড়ালে এত সময় লুকিয়ে ছিল নোলোক; তাকে ডেকে নিতেই বেরিয়ে পড়ল ভীতু হরিনের মতো বড় বড় চোখ করে
তাকিয়ে থাকা নোলোক। তারিকের কি হলো কেজানে ওই হলদে
চুড়িদারকে দেখে; হঠাৎ যেন সব গুলিয়ে গেল কি করছিল কি বলছিল। সঙ্গীদের ওপর
দায়িত্ব দিয়ে সরে গেল একপাশে। সবাই তখন মজা করতে ব্যস্ত কাজেই টের পেলনা তারিকের চোখের
ভাষা বা মনের কথা। আচমকা রাগ রাগ গলায় তাড়াতাড়ি শেষ করতে বলে
বেরিয়ে গেল রুম থেকে। পরের দুটো তিনটে ক্লাস ঢুকলই না নিজে; বা ঢুকলেও নিজে কিছুই করলনা। মাথা ভন ভন করছে তার তখন। চেলাচামুন্ডারা একটু অবাক হলেও দমে
গেলনা কারণ তারিকদা ওই রকমই কখন যে কি করে আর তাছাড়া সেতো ওদের কে মানা করছেনা। শুধু
মজা হয়েছিল অঙ্কের রুমে গিয়ে। এমন বিষম খেল তারিক; চোখ কচলে সঙ্গীসাথীদের বলল
"আমি যা দেখছি তোরাও তাই দেখছিস? ওই হলদে চুড়িদার না বাংলার রুমে ছিল?"
কথাটা শুনেছিল ঝুমকি; ফিক করে হেসে তারিকের দিকে তাকিয়ে বলল
"কি হলো তারিকদা? বিষম খেলেন নাকি? আমি ম্যাজিক জানি তো, আপনি আবার বাংলার রুমে যান দেখবেন আমি উপস্থিত"
ঝুমকির কথায় ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে তারিক, একদম এক চোখ হলে কি হবে, দৃষ্টি আলাদা। এই চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো রিঅ্যাকশন হচ্ছেনা তার। হেসে বলল
"হ্যাঁ, তা একটু খেলাম বৈকি; কি নামরে তোর?"
"ঝুমকি"
" আর বাংলার"
"সেকি ওদের রুম ঘুরে এলেন আর নাম জানেননি?"
টুক করে বলে ঝুমকি।
"না না, মানে জিজ্ঞেস করেছি হয়ত এত ছেলেমেয়ে গুলিয়ে যাচ্ছে"
"ওর নাম নোলোক।"
ঝুমকি নাকি প্রথমদিনই তারিকের অবস্থা ধরে
ফেলেছিল। পরদিন থেকে অবশ্য আলাদা পোশাকে আসত ওরা। যাতে আর গোলমাল নাহয়। তারিককে দেখলে ঝুমকি
বেশ হাই হ্যালো করে বকবকও জুড়ত; নোলোক চুপ করে হয় চোখ নামিয়ে থাকত নয় সরে যেত।
বাড়ি ফিরে রোজ খেপাত ঝুমকি "আহারে, বেচারা, তোর প্রেমে হাবুডুবু; তুই একবার তাকালেই সে ধন্য হয়ে যায়; কি আকুল ভাবে তাকিয়ে থাকে যদি তুইও তাকাস সেই
আশায়। আর তুই কিনা--" নোলোক..রাগ..করে..বলত
"ওই বখাটে
ছেলেদেরকে তোর যে কি করে সহ্য হয় আমি বুঝিনা" "তোরও হবেরে প্রক্সি, ভালো করে তাকিয়েতো দেখ একবার; তারিকদা কিন্তু মোটেই বদ ছেলে না। হ্যাঁ, উরঞ্চন্ডি বলতে পারিস। অযথা বাবার পয়সা ধ্বংস
করে এইযা" মুখ ঘুরিয়ে চলে
যায় নোলোক। কিজানি আজও তারিককে দেখলে ওর কেমন গলা শুকিয়ে যায়, কথা বলার আগ্রহতো জাগেইনা। অথচ ঝুমকি কেমন ডেকে ডেকে কথা
বলে।
এই ভাবেই চলছিল,একদিন পথ আটকালো তারিক। "আজ তোদের একটা কবিতা শোনাই"
বলে গম্ভীর মুখে, সিরিয়াস গলায় "হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ি তার বাংলা, মুখেতার হাসি নেই দেখেছ? নেই তার মানে কি,কেউ তাহা জানেকি, কেউ কভু তার সাথে থেকেছো?" আবৃত্তি করতে শুরু করলো। ঝুমকি হেসেই কুটোপাটি।
নোলোকের উদ্দেশ্যেই যে বলা বুঝতে কারোর বাকি রইলোনা; নোলোক রেগে আগুন চোখে তাকালো। কিন্তু তাকিয়ে যে কি ভুল করলো; ভালবাসার আকুতি ভরা দুটো চোখে তারিক চেয়ে আছে, আর নোলোক তাকাতেই এমন করে চোখ বন্ধ করলো যেন সে নোলোকের ওই দৃষ্টিটাকেই বন্দী করে নিল। খুবই আশ্চর্য লাগলো
নোলোকের; তারিকের মতো একটা ছেলের এহেন আচরণে। সাথে এটাও বুঝলো তারিকের তার
মানে এই গুনটা আছে, ভালো আবৃত্তি করে সে। একটু একটু আগ্রহ জন্মালো
তারিকের ব্যাপারে।
ফার্স্ট ইয়ারটা এভাবেই কাটল; সেকেন্ড ইয়ারে নোলোক টের পেল অনেকটা আগ্রহী হয়ে
পড়েছে সে তারিকের ব্যাপারে। যদিও সেভাবে কথা বলা বা
মেলামেশা এখনো করেনা। তবে ভয় কেটেছে আর আজকাল রাগের বদলে কেমন মায়া হয়। মনেহয় ছেলেটার
প্রকৃত বন্ধু কেউ নেই; যারা আছে তারা সব তাঁবেদার। কোনো দিন যদি তারিকের টাকা পয়সা
শেষ হয়ে যায় এরাও কেউ আর তারিককে পুছবেনা। টুকটাক বলতে
থাকে ঝুমকিকে; কথাগুলো সরাসরি তারিককেই বলার পরামর্শ দেয় ঝুমকি।
বুদ্ধিও ঝুমকিই বের করলো; সেদিন তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ,গরমের দুপুর, বাড়ি না ফিরে নোলোককে টানতে টানতে নিয়ে এসে তারিক আর ঝুমকির ক্লাসের নিবিড়, বাইকওয়ালা দুজনকে বলল "আমাদের একটু ড্রপ করে দিলে ভালো হয় খুব পা ব্যথা করছে"
বলেই নোলোককে অবাক করে দিয়ে নিবিড়ের বাইকে উঠে টাটা করে দিয়ে চলে গেল।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নোলোক। ইশারাটা বুঝলো তারিক; হাত এগিয়ে দেখালো "প্লিজ" অনন্যোপায় নোলোক উঠে বসার পর আসতে করে বলল "ম্যাডাম, ধরে বসুন আমি কিন্তু রাফ ড্রাইভার"
আলতো হাতে কাঁধ ছুঁয়ে বসেছিল। খানিক সময় এরাস্তা সেরাস্তা
ঘুরে একটা নিঝুম পাড়ায় বাড়ির ছায়ায় বাইক দাঁড় করালো। নোলোকের অস্বস্তি হচ্ছিল খুব; তারিক হেসে..বলল.."এই..প্রথম"।
"কি?"
"কোনো মেয়েকে আমি বাইকে রাইড দিলাম।"
লাজুক লাজুক খুশি হলো; বুকের মধ্যে কি অদ্ভুত অচেনা একটা ধুকপুকানি
নোলোকের।
"কিছু বলবেনা?" তারিক হাসে।
"অনেক কিছু বলব; তুমি শুনলে তো"
"আমিতো সেই প্রথমদিন থেকেই শুনব বলে অপেক্ষা করে
আছি" চোখ ঝিকমিক করে
তারিকের।
"আচ্ছা তুমি পরীক্ষা দাওনা কেন? অনেক বছর নষ্ট করেছ তাইনা?"
নোলোকের প্রশ্নের উত্তর বাধ্য ছাত্রের মতো দিয়েছিল
তারিক। নাঃ, অনেক না মাত্র দু বছর সে পরীক্ষা দেয়নি।
তারিকের মা বাবা দূর্গাপুর থাকেন। সেখানে বেশ
কয়েকটা বড় বড় দোকানের মালিক, অঢেল পয়সা; আর যেহেতু ওনারা নিজেরা তেমন লেখাপড়া জানেন না তাই তারিক যে কলেজ যায় এতেই গর্বিত।
ওনারা ঠিক বুঝতে পারেননা তারিক কি করছে। বিশাল এক ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে কারণ সিনেমার
মতো বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে। খাওয়া দাওয়া হই হুল্লোড় করে জীবনের
এই সময়টা উপভোগ করছে সে। নিজের পড়াশোনার হাল নিজে খুব ভালো জানে; সে যে কোনদিনও ইউনিভার্সিটির দোরগোড়ায় পৌঁছবেনা এটা তার কাছে স্পষ্ট। কাজেই
কলেজ ছেড়ে দিলে এই স্টুডেন্টলাইফ ব্যাপারটা মিস করবে আর তাই সে
পরীক্ষা দেয়না। নোলোক বুঝেছিল প্রথম দিনেই হবেনা কিন্তু সে হয়ত পারবে বোঝাতে। একটু একটু
করে এগিয়ে গেছিল।
এরইমধ্যে তারিকের বাড়ি পার্টি, এবারে ঝুমকি নোলোকেরও নিমন্ত্রণ; গিয়ে ঘরবাড়ি দেখেতো হাঁ...
কিসে লাগে একা একটা মানুষের এত বড় ফ্ল্যাট? এঘর ওঘর টুকটুক করে ঘুরেছিল নোলোক। ভেতরের ঘর গুলোয় যেখানে
সেখানে জিনিষপত্র ছড়ানো ছিটোনো; বিছানার ওপর স্তুপিকৃত দামিদামি কাপড়জামা, কোনটা ধোওয়া আর কোনটা পরে ছেড়ে রাখা বোঝার উপায় নেই। বাইরের
দিকের ঘরগুলো পরিষ্কার, কিছুটা সাজানো গোজানো; সে এক কাজের লোক আছে সেই নাকি দেখভাল করে আর
রান্নাতো ঘরে হয়ইনা, কিনে আনা হয়। নোলোক
কালবিলম্ব না করে বোঝাতে শুরু করলো; তারিকের বাবারও বয়স হচ্ছে, তিনি তাঁর ছেলেকে পাশে পেলে খুশি হবেন, ভরসা পাবেন। এইরকম উশৃঙ্খল জীবনতোঠিক নয় না? খুব অসুবিধা হয়নি তারিককে পরীক্ষার জন্য তৈরী করতে। কারণ সে তখন নোলোক ছাড়া কিছুই
বোঝেনা। তখনতো মোবাইল ফোন ছিলনা, রোজ সকালে লুকিয়ে একটা ফোন করত ল্যান্ডলাইন থেকে যাতে তারিক
উঠে পড়তে বসে। চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হলো, হঠাৎই বিক্রি করে দিল সেই ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট; একটা সাধারণ দুকামরার ফ্ল্যাট কিনলো। খরচাপাতিও কমিয়ে দিল, দেখল নোলোকের কথাই ঠিক, সরে যেতে লাগলো এত দিনের সঙ্গীসাথীরা। পড়ে রইলো
ঝুমকি নোলোকের সাথে হাতে গোনা কয়েকজন। মা বাবাও ছেলের
এই পরিবর্তনে অবাক, খুশিও। ছেলের এমন বদলের কারণ জানার জন্য একদিন সক্কাল
সক্কাল হাজির ছেলের ফ্ল্যাটে। কেমন সব পরিপাটি করে রাখা, বিছানায় কাপড় জামার বদলে বই-খাতা, রান্না ঘরে কিছু রান্নার ব্যবস্থা। বাবা আসায় তারিক গেল চা
নাস্তার ব্যবস্থা করতে, সেই সময় এলো ফোন। তারিকের বাবা ফোন ধরতেই শুনলেন
মিষ্টি গলায় কড়া নির্দেশ "উঠে পড়, আর ঘুম নয়, পড়তে বসো।" বুঝলেন ছেলের পাল্টে যাবার জন্য কে দায়ী; আস্তে করে বলেন "যার জন্য বলছ সে উঠে পড়েছে, চা নাস্তার ব্যবস্থা দেখে আমি তার আব্বা"
লজ্জা পেয়েছিল নোলোক।
মাঝে মাঝেই হানা দিত তারিকের ঘরে; গোছগাছ করে দিত সব। ভাবটা এমন ছিল এই ঘর সংসার সব নোলোকেরই। টবে করে দুটো লতানে ফুল গাছ লাগিয়ে
ছিল যার প্রথম ফুল দুটো আজও নোলোকের জিম্মায়; তুলে দিয়েছিল তারিকই। এমনি কোনো এক বৃষ্টির দিনে তারিকের ঘরে আটকে পরে নোলোক; গুনগুন করে গান গাইছিল গলা মেলালো তারিকও। মুগ্ধ হয় নোলোক কত গুন এই মানুষটার। সেইদিনই
কবিতা পরে শোনানোর পর জয় গোস্বামীর কবিতার বইটা তারিক দিয়েছিল নোলোককে। 'প্রিয় কবির বই প্রিয় মানুষের কাছে থাক'একটা চিরকুটে লিখে ছিল, আরেকটায় লিখেছিল 'এতদিন একা আমার সঙ্গী ছিল আজ থেকে আমাদের সঙ্গী হলো এই
বই।বলাবাহুল্য সেবারে পাশ করলো তারিক। ঠিক করেছিল কলকাতাতেই কোনো দোকান বা বিজনেস করবে তার
বাবারই মতো; যেই শহরে নোলোক সেই শহর ছাড়ে কি করে সে?
মা বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করেছিল নোলোকের পরিবর্তন; যেই মেয়ে অমন ভীতু ভীতু হয়ে থাকত, ঝুমকি তাকে টেনে মেনে নিয়ে বেরোতো আজ কিসসা এক্কেবারে
উল্টো? ঝুমকিকে টানতে টানতে নিয়ে যায় নোলোক। রান্না বান্নার আগ্রহ আরো
বেড়েছে, আর কি একটা নাম তারক না কি, দুজনে কেমন করে বলে ঝুমকিদাদা লাগিয়ে বললেও নোলোকের মুখে কি
দাদা সহ শুনলো? হঠাৎই এরমধ্যে একদিন শরীর খারাপ করলো নোলোকের; তারিক বাড়িতে এসে উপস্থিত। সুন্দর চেহারা, ভদ্র কথাবার্তা শুনে মা ও ইম্প্রেস্ড। তারিক-নোলোকের চোখের ভাষা পরে ফেলেছিলেন মা। জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে নিয়েছিলেন যে, তারিক মাবাবার একমাত্র সন্তান আর তারিকের বাবার
অঢেল পয়সা। তারিক চলে যাবার পর মায়েরও কত প্রশংসা "তোদের এই তারকদা কিন্তু ভারী ভালো ছেলে, আজকের দিনে এমন ছেলে কটা হয়? যেমন দেখতে তেমন কথাবার্তা, কেমন সুন্দর খোঁজ নিতে এলো" ইত্যাদি ইত্যাদি। ঝুমকি নোলোক হেসি কুটোপাটি "ওমা তারকদা নয়; তারিক, তারিক, মহম্মদ তারিক ইসলাম" মায়ের মুখের আলো যে এক ফুঁয়ে..নিভে..গেছিল..খেয়াল..করতে..পারেনি..দুইবোন।
একটু সুস্থ হতেই মাবাবা ছোট মাসির বাড়ি নিয়ে গেল দুইবোনকে। সেখানে মাসির
প্রতিবেশিনী এক ভদ্রমহিলা অনেক সময় ধরে নোলোকের সাথে আলাপ জমালেন; ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি ঝুমকি- নোলোক। হুট করে বিয়ে ঠিক করা হলো ওই ভদ্রমহিলার ছেলে আকাশের
সাথে। ঝুমকি তারিককে খবর দেবার চেষ্টা করে বিফল; বন্ধুদের থেকে শুনলো ঠিক তখনি নাকি তারিকের বাবার শরীর খারাপ বলে তারিক শহরে নেই। সেই যুগে মোবাইল
থাকলে হয়ত কোনো লাভ হত। অসহায় দুইবোন কেঁদে আকুল; কেউ বুঝলনা, কেউ শুনলনা বিয়ে হয়ে গেল..নোলোকের।
আকাশ এমনি খারাপ ছেলে নয়; বেশ মিশুকে, দেখতেও ভালো। নোলোকের পড়াশোনার ব্যাঘাত নাহয় তার বন্দোবস্ত করল। বিধবা মাকে
নিয়ে সংসার মেডিকাল রিপ্রেজেন্টিটিভ আকাশের। এক্কেবারে গোছানি সংসারী নাহলেও
ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে নেই আকাশ। খুব কিছুতে কৌতুহলও নেই তেমন, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। আলাদা করে গান বাজনা কবিতা শোনা ওইসব হলেও হলো না হলেও হলো
টাইপ। তেমন উল্লেখ করার মতো কোনো গুন না থাকলেও, আকাশের একটা খারাপ অভ্যেস ছিল, সে ড্রিঙ্ক করত। আর তার মা বাধা না দিয়ে উল্টে বলতেন "এতো পরিশ্রমের কাজ; কত নামিদামি মানুষের সাথে ওঠাবসা এইটুকু তো....
"
নোলোক অনভ্যস্ত এই জীবনে; তুলনা এসে যেত প্রতি পদে। ঝুমকি খবর আনতে চেয়েছিল; নোলোক বারণ করে, নাঃ সে ঠকিয়েছে তারিককে। যে ছেলেটা নোলোক ধ্যান নোলোক জ্ঞান
হয়েছিল, তাকে বিয়ে করবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। প্রায়শঃই বলত "কবে বউ হয়ে আসবে? সেদিন আদরে ভরে দেব"
লজ্জা পেত নোলোক কিন্তু অসম্ভব শ্রদ্ধাও হয়েছিল
কারণ সুযোগ পেয়েও নোলোকের অস্বস্তি হয় এমন কিছু করেনি তারিক। এত ভালবাসত যেই মানুষটা,তাকে ছাড়তে পারল নোলোক; পারেনিতো তার ভালবাসার জন্য লড়তে, পারেনিতো মা বাবাকে বোঝাতে, তাহলে আজ তারিকের খোঁজ নেবার অধিকার তার কোথায় শুধু বইটা নিয়ে এসেছিল..নিজের..কাছে..সবার..অলক্ষ্যে।
পার্ট টু পরীক্ষা হতে হতেই নোলোক টের পেয়েছিল নতুন প্রানের আগমন বার্তা; এত তাড়াতাড়ি মা হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি না থাকলেও মনে করলো এ ভালই হলো। আকাশের সাথে
কিছুটা হলেও দুরত্ব রাখা যাবে। ইতোমধ্যেই অনেকটা দুরত্ব তৈরী করে নিয়েছিল সে। আকাশ অবশ্য
খুব বুঝতে পারেনি; সে ধরেই নিয়েছিল নোলোকের শান্ত স্বভাব, চুপচাপ থাকে, তাছাড়া আকাশ বা তার মায়ের কোনো অযত্ন তো নোলোক করেনি, তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অবকাশ কোথায়? এমনকি আকাশের অনেক বন্ধুর স্ত্রীরা তাদের এই সপ্তাহান্তে পানের আসরের বিরোধিতা করত; কিন্তু নোলোক কোনো দিন কিছু বলেতনি ই বরং তাদের ভাজাভুজি যা লাগে নির্বিবাদে বানিয়ে দেয়। কাজেই
আকাশ তার মতো করে সুখীই ছিল; অপরপক্ষের খবর সে জানেইনি।মেয়ের বছর তিনেক বয়সে
আকাশের মা মারা যান তখন নোলোকই সর্বেসর্ব্বা। মেয়েকে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটু
একটু করে গান কবিতার স্বাদ দিল সে।
**********
ঝুমকি, নোলোকের বিয়ের পর মাবাবার সাথে তুমুল অশান্তি করে বেরিয়ে
যায় ঘর থেকে, সে দ্বিতীয় নোলোক হতে চায়না। সে আরও পড়াশোনা করবে, তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে; নিজের জীবন নিজের মতো করে বাঁচবে। বেশ কিছু
টিউশন জুটিয়ে নিল, পেয়িং গেস্ট থাকতে লাগলো আকাশের পরিচিত এক কেমিস্ট শপের
মালিকের বাড়ি। মাস্টার্স শেষ করার পর ঝুমকি বুঝলো কবে যেন সে
ওই বাড়ির একজন ইম্পর্টান্ট সদস্যে পরিনত হয়েছে নিজের অজান্তেই।
এতদিন এত ছেলের সাথে মিশেছে, হুল্লোর করেছে, প্রেম করেছে, কিন্তু তার জীবনের সত্যিকারের ভালবাসা কবে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে ঝুমকি যেন টেরও
পায়নি। বিয়ে করে নিল সুবর্ণকে। সংসার, দোকান সব ঝুমকি সুবর্ণর কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দেখভাল করে। একমাত্র বোন্ঝি পায়েল তার চোখের মনি। পায়েলের
টানেই প্রায়শঃই উপস্থিত হয় নোলোকের বাড়ি। মনের মধ্যে আজও প্রশ্ন ঘোরে ঝুমকির, নোলোক কি সত্যিই সুখী? সে কি সত্যিই ভুলে গেছে তারিককে? কেমন ভয় ভয় হয় জিজ্ঞেস করতে। দিব্যি তো মানিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে; হয়ত এত বছরে চাপা পরে গেছে তারিক, খুঁচিয়ে মনে করানো..ঠিক..হবেনা।
**************
এমনি করেই কেটেছে দিন, মাস, বছর... শুধু কেউ জানতনা আজও শুকোয়নি ক্ষত। প্রতি ভ্যালেনটাইনসডে তে যখন বাকি দুনিয়া প্রেম
দিবস উদযাপনে মাতোয়ারা; সেন্ট ভ্যালেনটাইনের বার্তা নোলোক পালন করত তার নিজের
মতো করে। তারিকের ফটো ছিলনা ঠিকই কিন্তু তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের একটা ছোট্ট টুকরো
তো আছে নোলোকের কাছে; তারিকের হাতের ছোঁয়া, তার তীব্র ভালোলাবাসা মিশে আছে ওই বইতে। আর তাইতো সে দিয়েছিল বইটা নোলোকের
প্রযত্নে। বইটা নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে নোলোক; তারিকের আওয়াজে যেন শোনে কবিতা গুলো। বিশেষ করে 'স্পর্শ' কবিতাটা। কারণ এমন একটা অদ্ভুত সিচুয়েশনে তারিক তার
উদ্দেশ্যে আবৃত্তি করে ছিল এই কবিতাটা। তখনও নোলোক তেমন কথা বলতনা তারিকের সাথে; একদিন কলেজের সিঁড়িতে বসে বই না দেখে তারিক
আবৃত্তি করে, বাকিরা না বুঝলেও নোলোকের বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয়েছিলনা যে কার
জন্য বলল তারিক। সেদিনের তারিকের আওয়াজের সেই আকুতি এখনও যেন শিহরিত করে নোলোককে।
ধীরে ধীরে প্রতিটা লাইন ধরে ধরে পড়ে।
"এতই অসার আমি,চুম্বনও বুঝিনি মনেমনে দিয়েছিলে তাওতো সে না
বোঝার নয়, ঘরে কত লোক ছিল, তাই ঋণ স্বীকার করিনি ভয়, যদি কোনো ক্ষতি হয়। কি হয়? কি হতে পারত? এসবে কি কিছু এসে যায়? চোখে চোখ পড়া মাত্র ছোঁয়া লাগলো চোখের পাতায় সেইতো যথেষ্ট
স্বর্গ -- সেই স্পর্শ ভাবি আজ। সেই যে অবাক করা গলা অন্ধকারে
তাও ফিরে আসে....
স্বর্গ থেকে আরো স্বর্গে উড়ে যাও আর্ত রিনিঝিনি প্রথমে
বুঝিনি, কিন্তু আজ বলো, দশক শতক ধ'রে ধ'রে ঘরে পথে লোকালয়ে
স্রোতে জলস্রোতে আমাকে কি একাই খুঁজেছ তুমি? আমি বুঝি তোমাকে
খুঁজিনি?"
কখন যেন ঝাপসা হয়ে যায় নোলোকের দৃষ্টি; প্রথম প্রথম বুক ফাটা কান্না আসত, ক্রমশঃ সয়ে গেছে। তবু ভুলতে পারেনি হয়ত চায় ও
নি। এতো বছর পরেও তার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসতে চায় তারিককে। মনেমনে প্রতিজ্ঞা করেছে সে, পায়েল তার মেয়ে, তার সাথে যেন এমন না হয় সেটা নোলোক অবশ্যই
দেখবে। সর্ব শক্তি দিয়ে পায়েলের ভালবাসার হয়ে লড়বে। খুব
তাড়াতাড়ি মা হওয়ার ফলে আজ মেয়ে পায়েল তার খুব ভালো বন্ধু। কলেজের নানান গল্প শোনায় নোলোককে; নোলোকের কাছেও শুনতে চায়। অনেক ঘটনা বললেও লুকিয়ে গেছে তারিকের কথা; পারেনি মা হয়ে মেয়ের কাছে মন খুলতে।
**************
তাদের নাম নিয়ে নোলোকের বন্ধুদের মতো পায়েলের
বন্ধুদেরও কৌতুহল; বংশ পরম্পরায় গয়নার নাম। নোলোকের দিদার মায়ের অনেক অনেক গয়না
ছিল। তখনকার দিনে কি সুন্দর সুন্দর নাম ছিল সব গয়নার; ওনার শখও ছিল বিভিন্ন গয়নার আর তাই নোলোকের দিদা হলেন বকুলমালা; নোলোকের মা কঙ্কন, একমাসি টায়রা, একমাসি হাঁসুলি, আর ছোটমাসি মান্তাসা। তারা দুজনে হলো নোলোক-ঝুমকি আর নোলোকের মেয়ে পায়েল। কলেজে
এই নিয়ে মজার মজার সব অভিজ্ঞতা পায়েলের, মা কে এসে শোনায় আর নোলোকের মনে পরে তারিক কেমন মজা করে বলত "আমার খাঁদা নাকের নোলোক।" সত্যি বলতে কি পায়েলের নাম তারিকেরই ঠিক করা। "নোলোকের মেয়ে কি তবে পায়েল হবে?" হাসতে হাসতে বলত। সেই সময় লজ্জায় মিশে গেলেও যখন
সত্যিই তার মেয়ে হলো তার নাম রাখল পায়েল। দুনিয়ায় এক
আকাশেরই বোধহয় কোনো উৎসাহ ছিলনা এই নামের ইতিবৃত্ত নিয়ে। পায়েলের
হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার ঠিক মুখোমুখী তাদের জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত সময় উপস্থিত। আকাশ
একদিন অর্ডার নিতে ঝুমকিদের কেমিস্টশপে; আচমকা শরীর খারাপ করে। ঝুমকি উপস্থিত থাকায় সঙ্গেসঙ্গে হাসপাতাল নেওয়ার ব্যবস্থা করলেও
ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ফলে বাঁচানো গেলনা আকাশকে। এমন বিপদের জন্য নোলোক প্রস্তুত
ছিলনা। তবে এই সময় হাসপাতালের পাশের ওষুধের দোকানের মালিককে
দেখে অবাক না হয়ে পারলনা নোলোক। তারিক!!! এই শহরেই একটা কেমিস্ট শপ চালায়? বিপদের দিনে অনেকটা সহায় হলো তারিক; পায়েলের লেখাপড়ার ক্ষতি না হয়। 'মাই প্রিন্সেস' ডাকছে পায়েলকে। পায়েল শুধু এটাই জানলো মা মাসিদের
সিনিয়র ছিল তারিক আঙ্কল। এমন অসহায় নোলোক বুঝি আগে এর আগে কোনদিন হয়নি। আকাশ নেই কিন্তু
তারিক এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। কি করে সে মুখ দেখায় তারিককে? কোন সম্পর্কের অধিকার সে ফলাবে? আর পায়েল যদি আসলটা জানতে পারে কোনদিন, কিভাবে রিয়াক্ট করবে সে?
এবারের ভ্যালেনটাইনসডে টা তাই বুঝি নোলোকের কাছে
বড্ড এলোমেলো করা। পুরনো অভ্যেসে বসেছে ঠিকই বইটা নিয়ে কিন্তু প্রথমত বইটা পেল
পায়েলের ঘরে, মেয়ে কি কিছু সন্দেহ করেছে? নাকি বুঝতে পেরেছে সবটা? আর দ্বিতীয়তঃ এত বছর যে ছিল অন্তরালে, শুধু তার মনের গোপন ঘরে, সে আজ সশরীরে তার এবং তার মেয়ের সামনে উপস্থিত। একটু একটু করে ঝুমকির থেকে জেনেছে নোলোক, তারিকের সাথে ব্যবসায়িক সুত্রে ঝুমকির দেখা হয়। ওষুধের দোকান
করার প্রধান কারণ তারিকের বাবার সেই অসুস্থতা। সেই সময় কিছু জীবনদায়ী ওষুধের জন্য যে
ভাবে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছিল তাকে সেটাই অন্যদের ক্ষেত্রে না
ঘটে তার চেষ্টাতেই তারিক কেমিস্টশপ খোলে। দোকান করবে বা বিজনেস করবে এই প্ল্যান তো তার ছিলই। বাবা দেহ রেখেছেন ঠিকই কিন্তু ছেলের দোকান দেখে
গেছেন। নোলোকের সব ঘটনা সে জানে; কিন্তু ঝুমকিকে বারণ করে নোলোককে জানাতে যে ঝুমকির সাথে
আবার তার যোগাযোগ হয়েছে। মা কে নিয়ে একাই থাকে সে; বিয়ে না করার কারণ অন্যদের যা খুশি বোঝালেও ধরা পড়েছিল ঝুমকির-কাছে।
**************
সকালের মিঠে রোদে কখন যে চোখ লেগে গেছে নোলোকের; পায়েলের আলতো ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে অপ্রস্তুত। বইটাকে ঠিক কি করবে ভেবে
পেলনা; মেয়ের সামনে ধরা পরে গেছে। লুকোবে? ধরা দেবে? নাকি কিছুই না এমন ভাব দেখিয়ে কাটিয়ে দেবে? চুপ করে কিংকর্তব্য ভাবতে লাগলো; নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো পায়েলই "মা, এই বইটা তারিক আঙ্কেলের ছিল তাইনা?" মাথা নীচু করে হ্যাঁ বলে নোলোক। চোখ তার এখনও
ভেজা। আসতে করে জড়িয়ে ধরল পায়েল "তোমরা পরস্পরকে এখনও এতো ভালোবাসো?"
অবাক চোখে তাকে নোলোক। কবে যেন তার ছোট্ট পুতুলের মতো
মেয়েটা অনেক অনেক বড় হয়ে গেছে; আজ কে মা, কে মেয়ে, বোঝা যেন মুস্কিল হচ্ছে। মায়ের চোখের জল মুছিয়ে বলল
"মাগো, সারাদুনিয়া খুঁজে মরে এমন সত্যিকারের ভালবাসা। বাবার সাথে
তোমার যেটা ছিল ওটা নেহাতই অ্যাডজাস্টমেন্ট বা একটা
অভ্যেসে পরিনত হয়েছিল সেটা। তোমার আসল ভালবাসা তারিক আঙ্কল; ওনারও তুমি। আমি অনেক ছোট তেও লক্ষ্য করেছি তুমি এই বইটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখো আর কান্না কর।
যখন তারিক আঙ্কলকে প্রথম দেখি, তখন কিছু বোঝার মানসিক অবস্থায় ছিলামনা। আমি জানতাম তুমি আজ
এই বইটা নিয়ে বসবে; কাল রাত্রে তাই চুরি করে দেখছিলাম, বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে কি আছে বইটায়। তারিক আঙ্কলের লেখা চিরকুট দুটো দেখে
হাতের লেখা চিনে ফেলে সবটা পরিস্কার হলো আমার। একটা কথা ভাব মা, সেদিন উনি আমার পড়াশোনার কেয়ার না নিলে আজ আমি কি আদৌ পাশ করতাম? ভালো রেজাল্ট তো ছাড়ো। বাবা চলে যাবার পর উনি যেভাবে আগলাচ্ছেন আমাদের, বিনিময়ে আমাদের তরফেরও তো কিছু যোগদান থাকা উচিত তাইনা?" উঠে পড়ল পায়েল নোলোককে কিছুটা ভাবার সময়ও দিল আর
নিজে তৈরী হয়ে নিল। সুন্দর সাজুগুজু করে এসে বলল "শোনো আমি এখন বেরোচ্ছি ফিরতে দেরীই হবে; জানোই তো মা সেন্ট ভ্যালেনটাইন কি চেয়েছিলেন?"
মিষ্টি করে মা কে আদর করে বেরিয়ে গেল..পায়েল।
ডোরবেলটা বাজছে আবার.....বইটা হাতে ধরা অবস্থাতেই দরজা খুলল নোলোক...
সকালের রোদটা কি আজ অন্যদিনের চেয়ে বেশি সোনালী?
[মৈত্রেয়ী
চক্রবর্তী]