পদক্ষেপ
বেশ
কিছুদিন হলো এই শহরটাতে এসেছে সুমনা আর দীপেশ| দীপেশের চাকরির সুবাদেই ওদের এখানে আসা| সুমনা আর দীপেশ রায়| বছর
পাঁচেক হলো ওদের বিয়ে হয়েছে| দীপেশ একটা বেসরকারি সংস্থায় উঁচু পদে চাকরি করে. সুমনা একটা স্কুলে
পড়াতো| পাকাপাকি নয়, অস্থায়ী
ভাবে| বাড়ির কাজ শেষ করে সারদিন বড্ডো ফাঁকা ফাঁকা লাগতো ওর| নিজেই একদিন পাড়ার স্কুলে চলে গিয়েছিল| সেই সময় ওদের ইংরেজির টীচার মেটারনিটী লীভ এ ছিলেন, সুমনাকে রেখেদিয়েছিলেন বড়দিদিমনি| ক্লাস থ্রীর ইংরেজি টীচার হিসেবে| সংসারে মানুষ বলতে ও আর দীপেশ| ঠিকে কাজের লোক সকালে এসে বাসন ধোয়া, ঘর মোছা এসব কাজ করে দিয়ে যায়| ওদের বাড়ি থেকে ঘন্টা দুয়েকের দুরত্বে সুমনার শ্বশুর বাড়ি| ওখানে শ্বশুর, শাশুড়ি
ছাড়াও উনাদের দেখাশোনা করার জন্য সবসময়ের একজন লোক আছে| বিয়ের পর বছর তিনেক একসাথেই ছিল| কিন্তু সইলোনা| একদিন
দুদিন করে রোজই কথাটা, 'কথাটা' না বলে বলা ভালো খোঁচাটা শুনতে লাগলো সুমনা| "তিন বছর বিয়ে হলো এখনো নাতি নাতনির মুখ দেখতে পেলাম না| আমাদের কপালে যে কবে সে সুখ লেখা আছে কে জানে?"
হাসতো সুমনা আর বলতো "সময় হলে সব হবে মা, তুমি এতো চিন্তা করো কেনো?" এসব চলছিলো ঠিকই কিন্তু পরিস্থিতি আরো জটিল হলো যখন জানা গেলো যে "মা" হওয়ার সৌভগ্য সুমনার নেই,
তখন সেটা চরম আশান্তিতে পরিণত হলো|
কলেজের
দুবছর প্রেমের পর বিয়ে করেছে ওরা| রোজ
রোজের আশন্তিতে একদিন দীপেশ রেগে গিয়ে বললো " আহ! মা, তোমার এই এক কথা রোজ রোজ না শোনালেই নয়? দেখছো তো মেয়েটা এমনিতেই কতো চুপ চাপ হয়েগেছে, রোজকার এই আশান্তি তে ওর মনের অবস্থাটা কি বুঝতে পারোনা তুমি? কান্নাকাটি করে, ঠিক
করে খাওয়া দাওয়া করছেনা, তোমার
তো ওর পাশে থাকা উচিত এই সময় তা না করে খোঁটা দাও, এতে মন আরো বেশি কষ্টো পায় বোঝনা তুমি?"
অনেক কিছুই তো করা হলো, পসিটিভ
কিছু তো হয়নি, সেটা না বুঝে এরকম অশান্তি করার কোনো মানে হয়?
-হ্যা তুই তো তোর বউকেই সাপোর্ট করবি, এদিকে আত্মীয় স্বজন বলাবলি করতে শুরু করেছে|
"দীপেশের কপালটাই খারাপ", " কি দেখে বিয়ে দিয়েছিলে বৌদি?"
" ওই তো তোমার একমাত্র ছেলে, তোমার আর বংশে বাতি দেওয়ার কেউ রইলনা|"
-
"ও, তার মানে তোমার কাছে ছেলে, ছেলের বউ এর থেকে উনারা বেশি বড়ো হলেন? উনাদের মুখ যাতে বন্ধ হয় তার জন্য তুমি নাতি নাতনি চাও? তা উনাদের সত্যি কথা বলতে পারছনা যে এটা সম্ভব নয়?"
"
দীপ!"
ডাক দিয়ে থামায় সুমনা| “তুমি
আমাকে নিয়ে মায়ের সাথে ঝামেলা করছিলে?"
একবার
ওদের দুজনকে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যায় রমা |
-"বুঝিনা কেনো এনারা ছেলে মেয়েদের থেকে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শিকে বেশি গুরুত্ব দেন| উনাদের কাজই হলো অন্যের বাড়ির কথা নিয়ে অড্ডা জমানো| ডিসগাস্টিং!"
তখনকার
মতো ঝামেলা মিটলেও আগুনটা পুরোপুরি নিভলোনা | আঁচটা পেয়ে দীপেশই ঠিক করলো যে আলাদা থাকবে | বাবাকে বললো অফিস যাতায়তে খুব অসুবিধা হচ্ছে তাই অফিসের কাছাকাছি
থাকবে| আসল কারণটা বুঝেছিলেন দেবেশ| কখনো কখনো কিছু ভালোর জন্য কষ্টটা লুকিয়ে রাখতে হয়| তাই আর ছেলেকে আটকাননি|
তারপরই
ওরা চলে আসে |
*****************************************************
এখন
আবার এই নতুন শহরে নতুন করে বাঁচার লড়াই| এখানে আসার আগে বাবা মাকে প্রণাম করে এসেছিলো| প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিলো ভাষার জন্য| পরে অবশ্য খেয়াল করেছে যে চালিয়ে নেওয়ার মতো ইংরেজি সবাই জানেন| সবজিওয়ালা থেকে শুরু করে
ঠিকে কাজের লোক, সবাই| এতেই
বেশ ম্যানেজ করে ফেলেছে সুমনা|
এই
অফিসে দীপেশের শনিবারও অফিস, আর
রবিবার পুরো ছুটি| একদম
বিশ্রাম পায়না ছেলেটা| রবিবারের
জন্য তাই আর কিছু ফেলে রাখেনা সুমনা| বাজার হাট সব একাই করে | আস্তে আস্তে বাস্তবটাকে মেনে নিয়েছে| অনেক স্বাভাবিক হয়েছে| একদিন বিকেলে চারপাশে হেটে বেড়ানোর সময় চোখ গেলো একটা বাড়ির
সাইনবোর্ডে| " ডে কেয়ার অন্ড প্লে স্কুল" বাহ!
এইতো একটা সুন্দর জায়গা পাওয়া গেছে| দীপেশ বাড়ি আসলে ওর সাথে কথা বলতে হবে | ভেবে একটু হাসি মুখে বাড়ি ফিরলো|
******************************************************
ডিনার
শেষ হলে শোয়ার সময় আস্তে আস্তে কথাটা পারলো সুমনা|
- “জানো, এখানে
একটা ডে কেয়ার আছে| ভাবছিলাম
ওদের সাথে গিয়ে কথা বলি|
- “কি ব্যাপার?” সুমনা
কে আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো দীপেশ |
- “তুমি অফিস চলে গেলে আমি তো সারাদিন একা, ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটবে আমার|”
কপালের
উপর থেকে চুল সরাতে সরাতে দীপেশ বললো " তোমার কোনো কিছুতেও তো আমি বাঁধা
দেইনি মন! আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো
ওর কপালে| আমি চাই তুমি সব সময় খুশি থাকো| যেটাতে তুমি ভালো থাকবে, যা করলে তোমার ভালো লাগবে সেটাই করবে |"
আরো
শক্ত করে গলাটা ধরে বললো সুমনা " তাহলে কালকেই যাই?"
-"যাও" বলে নাইট ল্যাম্প টা নিভিয়ে দিলো দীপেশ|
******************************************************
পরেরদিন
দীপেশ বেরিয়ে যেতেই সুমনা গেলো স্কুলটাতে| গিয়ে দেখে হামাগুড়ি দেয় এমন বাচ্চাগুলোও রয়েছে এখানে| সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সময় কাটবে এরা এখানে | মেইন অফিস ঘরে গিয়ে কথা বললো ওদের ইনচার্জের সাথে| সঙ্গে করে সব কাগজপত্র নিয়েই এসেছিলো আর তার সাথে আগের স্কুলের
এক্সপেরিয়েন্সে সার্টিফিকেট| কথাবার্তা
বলে একটা ব্যাবস্থা হয়েগেলো ওখানে| ডে
কেয়ারের মেয়েদের গ্রুপে থাকবে ও| ভীষণ
খুশি হয়ে বাড়ি আসলো | আগামীকাল
থেকেই কাজে যাবে| দীপেশকে
ফোন করে সব জানালো যে কাজটা ওর হয়েগেছে| খুব খুশি ও| ফোনের
অপরপ্রান্ত থেকেই সেটার অনুভূতি পাচ্ছিলো দীপেশ| দীপেশ আরো খুশি হলে এইভেবে যে বাচ্চাদের মধ্যে থেকে মন ওর নিজের কষ্ট
কিছুটা ভুলে থাকবে|
******************************************************
স্কুলটা
খুব ভালো লাগছিলো সুমনার| এই
ছোটো ছোটো বাচ্চাদের স্নান করানো, খাওয়ানো,তারপর গান গেয়ে ঘুম পারানো| নিজেকে উজার করে দিয়েছে একেবারে| কার কখন কি দরকার সেদিকে পরিপাটি নজর রাখছে| কোনো বাচ্চা যেন না কাঁদে| এটাই লক্ষ্য| পরিবর্তনটা
চোখে পড়ছিল দীপেশেরও| আনন্দ
আর খুশিটা চোখে মুখে ফুঁটে উঠেছে ওঁর| নিজের থেকেই কখনো খেলনা কিনে আনতো বাচ্চাদের জন্য| অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবার খুব প্রিয় হয়ে উঠলো সুমনা, কি স্কুলে কি বাচ্চাদের বাড়ির লোকেদের কাছে| মাসের শেষে মাইনা দেওয়ার সময় স্কুলের ইনচার্জ সুমনাকে বললেন "
সত্যি সুমনা, তুমি এতো যত্ন করো বাচ্চাদের, কে বলবে যে তুমি ওদের মা নও? আর বাচ্চাকে ভালোবাসতে হলে, খেয়াল রাখতে হলে, জন্ম
না দিয়েও হয়, শুধু মনটা মায়ের হতে হবে -গড ব্লেস ইউ! " মাইনা হাতে নিয়ে অবাক চোখে দেখতে থাকে
সুমনা|
******************************************************
ঘুম
আসছেনা একদম| খালি এপাশ ওপাশ করছে| কথাটা
বারে বারে কানে বাজছে সুমনার " সত্যি কি বাচ্চাকে ভালবাসতে হলে, নিজের করতে হলে, তাকে
মানুষ করতে হলে, জন্ম দিতেই হবে?" কেউ কি পারবেনা আমাদের শুন্য স্থান পূরণ করতে? আমি কি পারবনা একজনকে নিজের করে নিতে? একটা তীব্র ইচ্ছে আবার করে মনের ভিতর টা তোলপার করে যাচ্ছে| দীপেশ কে বলব কথাটা? কিন্তু
ও যদি মানা করে দেয়? কিন্তু
কেন করবে? আমার খুশি তো ওর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ? তবে কেন মানা করবে?
তবু বলতে পারছিনা কেন? খুশি
রাখা এক আর একজনের দায়িত্ব নেওয়া, তাকে
নিজের পরিচয় দেওয়া আরেক জিনিস|
******************************************************
কিছুদিন
ধরেই লক্ষ করছিল সুমনা খুব অন্য মনস্ক আছে , কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু আবার চুপ হয়ে যাচ্ছে | কিন্তু নিজের থেকে জিজ্ঞেস করলনা দীপেশ, ভাবলো “মন
যদি ভাবে যে আমাকে বলবে তবে নিজের থেকেই বলবে,”
এর জন্য অপেক্ষা করতে রাজি| কিন্তু তিনচারদিন পরেও যখন কিছু
বললনা তখন ওদের স্কুলে একবার ফোন করলো দীপেশ এই ভেবে যে ওখানে কেউ ওকে কিছু
বলেনি তো ? সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি তো?|
*****************************************************
রবিবার
সকালে চায়ের টেবিলে সুমনাকে বলল
-“তোমাকে আজকে এক জায়গায় নিয়ে যাব|”
-“কোথায়?”
-“চলই না| কিছুদিন
ধরে দেখছি তুমি কি নিয়ে যেন বড্ড চিন্তিত, ঠিক করে কথা বলছনা, খাচ্চনা, আর “হাসি”? সেটা যে কবে দেখেছি ভুলে গেছি | দেখি সেসব যদি ফিরিয়ে আনতে পারি|”
একটু
তাকালো, মনে মনে বলল যে " সেটা তুমি করতে পারবে দীপ? যে কথাটা তোমায় বলতে পারছিনা সেটা যদি বলেফেলতাম তবে হয়ত অনেক হালকা
লাগত" মুখে বলল "চল"
******************************************************
গাড়িটা
যেখানে থামল বোর্ড টা দেখে চমকে উঠলো সুমনা "Adoption
centre”
-"দীপ!" বলে চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করলো সুমনার|
- আমার "মনের" হাসি কোথাও হারিয়ে গেছে, সেটাকে খুঁজছিলাম জানো, কিন্তু
পাচ্ছিলাম না | শেষে তোমার স্কুলে ফোন করলাম, তোমাদের ইনচার্জ বললেন তোমার কাজে সবাই খুশি, মনেই হয়না যে তুমি ওদের মা নও, এতটা খেয়াল রাখো ওদের| আর
এরপরেও যদি বুঝতে না পারি যে যে তুমি কি চাও, তাহলে আর তোমাকে ভালবাসা কেন? একবার যখন খুঁজে পেয়েছি হারানো জিনিস, সেটকে পাকাপাকি ভাবে নিজের কাছে করে রাখতে হবে না?
গাড়ির
মধ্যেই জড়িয়ে ধরল সুমনা, অজস্র
কান্নায় ভেসে গেল দীপেশের বুক|
-সেকি? “হাসি” খুঁজতে এসে দেখছি এখন “কান্না”
নিয়ে এলাম! দেখি, এদিকে
তাকাও? চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে মুখটা তুলে ধরল দুই হাতে " চল, তোমার মেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে"
(সমাপ্ত)
[শান্তা বর্মন দাস। মুম্বাই]