সংশপ্তক: আমাদের সমাজ সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মানো
সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোন পর্বে?
সোনালী পুপু: হ্যাঁ। হয়েছে বইকি। অফিসে যাওয়ার আগে মা কেবল ই সাবধান করেছেন
যে। হরিনের মাংসই হরিনের বৈরী।
নিজের ছোট ঘর আর বই আর রংতুলি আর গান।আর
সারা দিন আয়নার সামনে একা একা নাচের রেওয়াজ। কিন্ত কারো সংগে কথা বলা মানা।
খুব খারাপ লাগতো মায়ের এত দুশ্চিন্তা দেখে।
সংশপ্তক: শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পৌঁছে
ছেলে মেয়েদের চলা ফেরা ওঠা বসার মধ্যে পার্থক্য গুলো প্রাথমিক ভাবে কেমন লাগতো আপনার?
সোনালী পুপু: সে বড় কস্টের সময়। কোএডুকেশান স্কুলের আল্লাদি ফার্স্ট গার্ল।
হঠাত দেখলাম চিরকালের বেস্ট ফ্রেন্ড ছেলেগুলো একেবারে অচেনা হয়ে গেল।
আমি বড্ড ডানপিটে ছিলাম। ছেলেরাই বন্ধু ছিলো। এনিড ব্লাইটনের লেখায় ফেমাস ফাইভ সিরিজের জর্জ একেবারে আমার মতন।
কদম ছাঁট চুল আর শার্ট প্য্যান্ট পড়া থাকত ।ট্রামের
মেয়েদের সিট থেকে কতবার উঠিয়ে দিয়েছে কন্ডাকটর।
এই খোকা উঠে যাও বল্লে কি খুসি হতাম।
প্রাণপন চেস্টা করতাম ছেলে হয়ে উঠতে। কারন মেয়ে মানেই প্রতিপদে খাটো হয়ে, সংকুচিত হয়ে, ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকা।যেটা
কোন দিন বরদাস্ত করতে পারি না।
সংশপ্তক: আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে সংসারের
ভেতরেই ছেলে মেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা বৈষম্য মূলক আচরণের ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমান
কালব্যাপি। পরিতাপের কথা, যে মেয়েটি নিজের বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে ওঠে,
সেই কিন্তু গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয়?
সোনালী পুপু: নিরাপত্তার কারণে সাবধান করা ছাড়া আমার মা কোন বিষয়ে আমার প্রতি বৈষম্য
হতে দেননি। আর আমার বাবা আমাকে তাঁর একমাত্র পুত্র
হিসেবেই বড় করেছেন। কাজেই আমি এই অসুবিধা নিজের জীবনে বুঝিনি।
মা নিজে তাঁর দিদিমা, সরোজিনী
ঠাইন বা ঠাকরুন এর কাছে
থেকে বিদ্রোহের বীজ নিয়ে
এসেছিলেন। তাঁকে ছোট্ট বেলা থেকে গাছের ওপর,
পুকুরের জলে, লাঠি সরকি খেলার রেওয়াজে ব্রতচারীতে
দেবী চৌধুরানীর মত করে বড় করেছিলেন এই গুপ্ত বিপ্লবী, আগুনের
শিখার মত মানুষটি। তাই শিশু আমাকে দেখে এক অতিথি "লায়াবিলিটি" বলায় তক্ষুনি প্রতিবাদ করে জানিয়েছিলেন যে তাঁর মেয়ে তাঁর দায় নয়, ঐশ্বর্য, এবং সেই ভদ্রলোকের ছেলের থেকে কোন অংশে খাটো
হবেনা বড় হয়ে।মায়ের কথা মিথ্যা হয়নি।
সংশপ্তক: পিতৃতন্ত্রের যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন,
সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কতটা প্রভাবিত করে?
সোনালী পুপু: এর থেকে বেরিয়ে আশা কঠিন। বাবার নিরাপত্তার ছাতা মাথায় দিয়েই তো বড় হয়েছি।
খুব যে খারাপ লেগেছে এমন ও নয়।
বরং আরামের ঘেরাটোপ। কোন দিন উঁচু গলায় কথাও বলেন নি।
মুখ থেকে আব্দার বেরোতেই মিটিয়ে দেবার
চেষ্টা করেছেন। স্বামী র কাছে এসে প্রথম স্বাধীনতা কাকে বলে জানলাম।
কিছুদিন আগে কুইন বলে একটি সিনেমা দেখেছিলাম।
খুব আদরের ঘরোয়া একটি মেয়ে একলা ফ্রান্সে বেড়াতে গিয়ে
কেমন করে নিজেকে নিজের ক্ষমতা এবং স্বাধিকার বোধকে খুঁজে পাচ্ছে, তারি গল্প। আমার স্বামী সেই বন্ধুটি যিনি রাস্তাঘাট সম্বন্ধে খবর দিয়ে বলেছেন এবার নিজে খুঁজে
নাও। প্রথমে কষ্ট হলে ও নিজেকে খুঁজে পেয়ে
ভারি তৃপ্ত হয়েছি।
সংশপ্তক: নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই
জরুরী সে নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীও সমাজ
সংসারে সঅভিভাবকত্ব অর্জনে বাধা প্রাপ্ত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
সোনালী পুপু: এই লড়াই তো থাকবে।নিজের মতামত প্রকাশ
করাটা অহংবোধের লড়াই না হয়ে স্বাভিমান প্রতিস্থাপনের রাস্তা যাতে হয় সেটা খেয়াল রাখতে
হবে মেয়েদেরি। ব্যক্তিত্ব এবং তার বিকাশ
মেয়েদের ক্ষেত্রে ভীষন ভীষন জরুরি।
সংশপ্তক: কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু এর পেছনে পুরুষতন্ত্রের কৌশলগত অবস্থানটি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে
আমরা কতটা ওয়াকিবহাল?
সোনালী পুপু: সব্বাই ওয়াকিবহাল। একেবারে নিচেকার মানুষ থেকে উচ্চ অর্থবলসম্পন্ন মানুষ, সক্কলে।
মেয়েদের যে বুঝলেও বোকা মুখ করে থাকতে হয়, না হলে পদে পদে অপদস্থ করার চেস্টা চলবে সেটা প্রতিটি বুদ্ধিমতী মেয়ে প্রতিপদে খেয়াল রাখে।
সংশপ্তক: পেশাগত জগতে
একজন নারী কতটা স্বাধীন আর কতটা পরিস্থিতির শিকার,
সেটা নারীর ব্যক্তিত্বের উপর কতটা নির্ভর করে, আর কর্মজগতের বাস্তব অবকাঠামোর উপর কতটা নির্ভর করে?
সোনালী পুপু: বেশি’র ভাগ টাই
নির্ভর করে নারীর ব্যক্তিত্ব ও নিজের প্রতি সততার ওপরেই।
আপোষহীনভাবে এগিয়ে যাওয়া
একে বারে নিজস্ব সাহস।
সংশপ্তক: এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজ বাস্তবতায়
লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি একজন লেখিকা সোনালী পুপুকে কতটা বিচলিত করে। সেই বিচলনের রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি আমাদের অবহিত করেন!
সোনালী পুপু: যত দিন গৃহ কর্মকে পেশাদার কাজের সমান গুরুত্ব না দেওয়া হচ্ছে এবং শৈশবে
মায়ের উপস্থিতির প্রয়োজন কতখানি তা পুরুষেরা উপলব্ধি না করছেন, এই বৈষম্য দুর করা অসম্ভব।
মা হিসেবে মেয়েদের অসহায়তা আমায় প্রতিপদে তাড়া করে ফেরে। নিজে
অনেক কাজ,অনেক সৃস্টিশীলতা থেকে দুরে থেকেছি, জোর করেই, ছেলে মেয়েদের অসুবিধা হবে ভেবে। সেই
ত্যাগ টুকু যদি সংসার মনে রাখে আর পরবর্তী কালে আমার বাচ্চাদের মত এগিয়ে যেতে সাহায্য
করে, তবেই এর সমাধান করা সম্ভব।
সংশপ্তক: বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি
কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মনে হয় আপনার? সামাজিক ভাবে আমাদের ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে?
সোনালী পুপু: সমাজ কি খুব পাল্টেছে? কি জানি। মৃচ্ছকটিকের মাটির খেলনাটি সফট টয় হলে
গেলেই কি মানুষ খুব বদলায়? আমি তো দেখি
আগে যা ছিল তার বাইরের পোশাক আর প্রযুক্তিগত কিছু সংযোজন ছাড়া বিশেষ কিছুই বদলায় নি।আমরা
বিদেশী পোষাক পড়ার স্বাধীনতা পেয়েছি।
আর নানা রকম যন্ত্র হাতে এসেছে।
মানসিকতা পাল্টেছি কই? মেয়েদের
চোখে তাকিয়ে জবাব দেওয়া অপরাধ। মুখে মুখে কথা বলা পাপ। তা হলেই ধমক। অপমান।
চুলে টান।গালে চড়। কি
উচ্চ কি নিম্ন অর্থ নৈতিক অবস্থান।
ছবি পাল্টাচ্ছে কই। আগে মানুষের
দৈনিক জীবন পাল্টাক ।তবেই রাষ্ট্র পাল্টাবে।
সংশপ্তক: বাড়ির বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়টি
আজও কেন এত অবহেলিত! কি মনে হয় আপনার? দেশের
প্রশাসনের শীর্ষপদে মহিলারা নেতৃত্ব দিলেও অবস্থার উন্নতি হয় না কেন? গলদটা রয়ে যাচ্ছে কোথায়?
সোনালী পুপু: গলদ মিডিয়া। সাধারণ মানুষ গড্ডলিকার মত উত্তম বাবুর সিভ্যালরি, অমিতাভ বচ্চনের চুলেরছাঁট, নকল
করেছে। এখন ইভ টিজিং আর
শারীরিক জবরদস্তি করাও নকল করছে। মেয়েরা বলছে সেক্সি হওয়া জরুরি।
কিন্তু সেক্স যে অতি সুন্দর গভীর একটি বিষয়।
প্রচুর ভাবনা চিন্তা করে ব্যবহার করার একটি শক্তি, তাকে রাস্তা য় টেনে নামাতে হবে কেন, এটা কেউ তাদের জিজ্ঞাসা করতে শেখাচ্ছে না।
আমার একান্ত নিভৃতের দামি অলংকার দেখিয়ে আমি রাস্তার লোক কে লুব্ধ করব
কেন? আর তাতে যৌন সুড়সুড়ি লেগে যদি কাগজ কুড়ানো ছেলেটা গায়ে
হাত তোলে তাতে আমারো দোষ কিছুই কি থাকে না? নিরাপত্তার দায় সরকারকে নিতে হবে কঠোর হাতে।
সমাজকে নিতে হবে নিজের ঘরের ছেলে এবং মেয়েটিকে উপযুক্ত
শিক্ষা দিয়ে। তবেই এই ব্যাধি সারানো সম্ভব।
সংশপ্তক: আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন আর সারা
বছর নারী নির্যাতনের ধারাবাহিক ব্রেকিং নিউজ, এর মধ্যে সমন্বয়
হবে কি করে? মেয়েদের এই বিষয়ে কি কর্তব্য আপনার মতে?
সোনালী পুপু: মেয়েদের কাজ নিজেদের সম্মানের সংগে তুলে ধরা।
আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। নির্ভয়ে সততার সাথে জীবনের পরীক্ষাগুলোর সামনে দাঁড়ানো।লড়তে
পিছপা হলে চলবে না।
সংশপ্তক: সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত না
হলে কোনো দেশ জাতি সমাজ উন্নত হতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?.
সোনালী পুপু: আমার আশা অনেক। আমি ভালবাসাকে সব সময় বেনিফিট অফ ডাউট দেবো।
আশা করব সামনের প্রজন্ম মনে রাখবে এক জন মেয়ে দেবী ও নয় আবার পায়ে ঠেলে
দেবার সামান্য প্রানীও না।হাতে হাত ধরে জীবনের
রাস্তায় এগিয়ে যাবে মানুষ। মেয়েমানুষ যে মানুষও আবার আগামির ছোট্ট মানুষের মা ও হতে পারে,সেটা মাথায় রেখে মেয়েকে এক মুঠোভরা ভালবাসা আর সম্মান ছোট বেলা থেকেই
বরাদ্দ করলে,সমস্যার
সমাধান সহজে হবে বলে মনে হয়।
[ড: সোনালী মুখোপাধ্যায় পেশাগত ভাবে,
চিকিৎসক। এর বাইরে কবি লেখক ও নৃত্যশিল্পী রূপে সমধিক পরিচিত।]