>

জয়ন্ত ঘোষাল

SongSoptok | 3/10/2015 |




বহু ধারার সঙ্গম~ শ্যামলী খাস্তগীর
গত বছর সেপ্টেম্বরে শ্যামলীদির সঙ্গে শেষ দেখা ও কথা---চেতলার কাছে একটি  অন্যধরনের ইস্কুলএর এক্সিবিশন দেখতে ডাকলেন। তখন কলকাতা ছাড়ছি বরাবরের মতো, শেষ মুহুর্তে নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম তবু শ্যামলীদির ডাকে যেতেই হয়কে জানতো ওই শেষ দেখ ও কথা। গত ১৫ই আগস্ট প্রবাসে বসে দুঃসংবাদটা পেলাম আমার ব্যাঙ্গালোর প্রবাসী এক বন্ধুর থেকে---- কলকাত্তাইয়া মিডিয়া তখন কেবল আন্না-কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুকেই টি আরপির জন্যে দরকারি মনে করেনা----দু একটি প্রিন্ট মিডিয়া হপ্তাখানেক পড়ে লিখেছে দু-এক ছত্র হয়তো। বিগ মিডিয়ার কাছে এমন প্রচারবিমুখ শিল্পি ও দেশে বিদেশে প্রতিবাদী আন্দলনে অংশ নেওয়া আপোষহীন নারীর জীবনাবসান কোনও খবর নয় মানা গেল কিন্তু কফি হাউসে তুফানতোলা তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল (একদিকে ঠিকই হয়েছে , কেননা এই সব প্রচারমুখি ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালিকে শ্যামলীদি বরাবর এড়িয়ে চলতেন) বাঙালিও! এদের ধ্যাস্টামোর যে কোনো পরিবর্তননেই তা এই নীরবতা দেখে বোঝা গেল। যারা সাধারনের শিক্ষা গোল্লায় গেলেও প্রেসিডেন্সি নিয়েই ব্যাস্ত ও খবর তৈরি করে তাদের বিপ্রতীপে শ্যামলি লিখেছেন ---খোলা আকাশের তলে সবাই মিলে মাঝে মাঝে বসে ভাবা দরকার আমরা কত ক্ষুদ্র সুধীর চক্রবর্ত্তি মহাশয় সম্পাদিত ধ্রুবপদএর ২০০৭ এ অন্যরকম বাঙালিশ্যামলীদিকে নিয়ে অধ্যাপিকা স্বাতী গাঙুলির এক মননশীল লেখা প্রকাশ হয়। বছরখানেক পর শান্তিপুরে ধ্রুবপদেরএকটি অনুষ্ঠানে শ্যামলীদির সঙ্গে আলাপ এবং সেখানেই আবদার করি শুন্য দশকেরবাইশতম সংখ্যায় লেখার জন্যে।  প্রথমে নিমরাজি শ্যামলীদি একটি দীর্ঘ লেখা লেখেন , যা সম্ভবত ওঁর শেষতম লেখা। কলকাতায় এলে, মিডিলটন স্ট্রিটের আর্থ কেয়ারবুক স্টলে বিকেলের দিকে আসতে বলতেন, লেখার প্রুফ ঠিক করতে করতে স্কেচ করতেন। প্রখ্যাত শিল্পী সুধীর খাস্তগীরের মেয়ের কাছে ছবি আঁকা, স্কেচ করা, কাগজ না কেটে স্রেফ ভাঁজ করে করে জাপানি পদ্ধতিতে পুতুল বানানো সহজাত ছিল। স্কেচের মুল বিষয় গুলো ছিল পারমানবিক অস্ত্র বিরোধী আন্দলন আর পরিবেশ রক্ষা।

“......কানাডা থেকে ১৯৮১ সালে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরছি একাই। টরেন্টোয় একটা আর্ট গ্যালারিতে হেনরী ম্যূরের বেশ কিছু মুর্তি দেখে থামলাম। একটা ভয়ঙ্কর মাথার খুলি---সেটি এটামিক এনার্জি কমিশনের জন্যে উনি করেছিলেন। ১৯৭৪ এর পর থেকে আমি পারমানবিক রশ্মি---ক্ষয়ক্ষতি-যুদ্ধাস্ত্র ও পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, ইউরেনিয়াম মাইন ও যুদ্ধ ব্যবসা এবং ক্ষতিকর প্রযুক্তিতে শোষিতদের চাকরি  এই সব নানান প্রশ্নে চেনা অচেনা সকলকে প্রশ্ন করে অতিষ্ট করি, নতুন করে উৎসাহ পেলাম হেনরি ম্যূরকে দেখার। অত সুন্দরভাবে পারমানবিকের স্বরুপ ফুটে উঠেছে---তাঁর বক্তব্য তাই। অন্তর থেকে শিল্পের ভাষায় এত স্পষ্ট ভাবে বলার সাহস এনে দেয়।
সেদিন আমিও সাহস করে চাইতে শ্যামলীদি সবকটা স্কেচ দিয়েদিলেন শুন্য দশকেরবাইশতম সংখ্যার প্রচ্ছদ ও ভেতরে ব্যাবহার করতে।

মানবজীবনের আশংকিত ভবিষৎ আর পারমানবিক যুদ্ধপ্রয়াসের বিরুদ্ধে তিনি মেনে নেন বিদেশের জেল। তাঁর জাদুগড়ার ডায়েরীও দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলেছে। অনুদিত হয়েছে। জাদুগড়ার আন্দলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নানা প্রান্তের মানুষ।সারা ভারতে তাঁর পরিচিতি ও শ্রদ্ধার স্থানটি বোঝা যেত কোন অনুষ্ঠানে গেলে---মনে আছে গত ২০০৯ এ ব্যারাকপুরে National Alliance for Peoples Movement (NAPM) এর একটি অনুষ্টানে মেধাপটেকর অনুরাধা তলোয়াররা দেখামাত্র কেমন জড়িয়ে ধরেছিল শ্যামলীদিকে। একবার আমায় একটি ই-মেলে দিল্লির CSDS এর বেলা ভাটিয়া শ্যামলীদির প্রসঙ্গএ জানিয়েছলেন তার অফুরন্ত শ্রদ্ধার কথা। 

গ্রীষ্মের বাস্তার তখন ৪৮ ডিগ্রির ওপরে তাপ। দু বছর আগে লাঠি হাতে হাঁটা শ্যামলীদি গেছিলেন সাওলাজুদুম এর বিরুদ্ধে গন আন্দলনের পাশে দাঁড়াতে। শ্যামলীদি সেই গুটিকয়েক মানুষের একজন যাঁরা খুব ভেতর থেকে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপথিক শব্দকে আত্মস্থ করেছিলেন----শুধু কি প্রতিবাদী আন্দোলন, আর্ট ক্যাম্প --- পাপেট শো করতে চলে যেতেন ভারতের নানা প্রান্তের অখ্যাত অজানা গ্রামে--- কখনো রাঁচীর কাছে বুন্দু কি উত্তর প্রদেশে হারদই জেলার কাছে লালাপুর গ্রামের আস্থা আশ্রম। ওঁর স্বপ্ন ছিল আত্মনির্ভরশীল গ্রাম---বলতেন গ্রাম আমাদের বাঁচিয়ে রাখে আর গ্রামকেই অবহেলিত হতে হয়পাপেট শো এর মাধ্যমে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের শেখাতেন প্রকৃতি সংরক্ষনের কথা , বোঝাতেন ভোগবাদী উপনিবেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপদ। ঝোলায় তো কিছুনা কিছু বই থাকতই সবসময়---বই উপহার দিতেন , আর প্রথম পাতায় এঁকে দিতেন ছবি। পারমানবিক অস্ত্রের বিপদ আর পরিবেশ বাঁচানোর বিষয়গুলো যে ছোট থেকেই বোঝা দরকার এই ভাবনা থেকে আমার পুত্রকে উপহার দিয়েছিলেন কার্বন কথা

তিনি সেই বিরল বাঙালি নারী যিনি টেলিভিশনের অর্বাচীন সাংবাদিকের বুম আর ক্যামেরার জুম এর তোয়াক্কা করেননি কোনদিনবরং ওঁর কথা জানতে চাইলে বলেছেন-কি হবে ওসব শুনে ? কাগজ নষ্ঠ করবে লিখে?” একদিন রাতে জোর করে রেখে দিয়েছিলাম আমাদের বাড়িতে...শ্যামলীদি এসে অনর্গল কথা বলে গেলেন আমার বৃদ্ধ বাবা ও অসুস্থ মা এর সঙ্গে--তারপর যখনই ফোন করতাম বা দেখা হত আগে জিঞ্জাসা করতেন আমার মা বাবা কেমন আছেন--এমনি মানবিক ছিলেন।

অনেকেই জানেন না ভারত-মার্কিন পরমানু চুক্তিতে ক্ষুব্ধ শ্যামলীদি একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন প্রধান মন্ত্রি মনমোহন সিং কে এদেশের নির্দয় শাসকের কোন হেলদোল হবে না জেনেও চুপ করে মেনে নেওয়ার মত মানুষ তো ছিলেন না শ্যামলীদি। কয়েকদিন আগে বর্তমানে সিমলাবাসী যোগিনদার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল-দীর্ঘদিন ধরে শ্যামলীদিকে চিনতেন জানতেন এমন এক মানুষের মুল্যায়ন মুল্যবান মনে হল তাই যোগিন সেনগুপ্তের কথাগুলো তুলে দিলাম এখানে -----

“শ্যামলীদি অনেকগুলো আলাদা আলাদা ধারার একটা সঙ্গম ছিলেন। যেমন ধর র‍্যাডিকাল, রবীন্দ্রনাথের ধারা, গান্ধীর ধারা , এসব তো ছিলই আবার রাষ্ট্রবিরোধী, Industrial Capitalism বিরোধী ধারা। তারপরে যুদ্ধবিরোধী ধারা। শান্তিনিকেতনে যে কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধে শ্যামলীদি একদম সামনে থাকতেন। এই Urbanization, Mega Housing প্রকল্প,নদী নিয়ে্ সমস্যা এসব নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধে শ্যামলীদি একদম সামনে থাকতেন। এই যে প্রতিবাদ প্রতিরোধের যে ধারা আবার অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ গান্ধী এঁদের ধারা, অনেক ধরনের ধারার উনি একটা সঙ্গমস্থল ছিলেন। এটা ওনার প্রথম পরিচয়। এত ভিন্ন ভিন্ন ধারার সঙ্গম, এটা খুবই কম দেখা যায়।“

“ওনার কতগুলো Important বিষয় ছিল, উনি কোনো ধরনের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধী ছিলেন।তত্ত্ব চাপিয়ে দেওয়া,Centralizedসংগঠনের খুব বিরোধী ছিলেন। ভীষন অনুচাকাঙ্খী ছিলেন। ক্ষমতা ও নেতৃত্বের উনি দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। আরো একটা বৈশিষ্ঠ ছিল যে Industrial Capitalism Development Model এর উনি চুড়ান্ত Critic ছিলেন। যেটা আমাদের বা্মপন্থী পরম্পরায় নেই। কারন বামপন্থী পরম্পরাও তো Industrial Development এ বিশ্বাস করে । বামপন্থীরা বলে যে ভোগবাদের পথে বড়লোকেরা আজকে রয়েছে , আগামীদিনে শ্রমজীবিরা ভোগবাদের মধ্যে আসবে। শ্যামলীদি ভোগবাদী Civilization এর খুব বিরোধী ছিলেন। তারপরে, শ্যামলীদির যেটা ছিল নিজের Life Style দিয়ে বিদ্রোহ। মানে উনি ওনার ব্যাক্তিগত জীবন, Energy Consumption pattern , আমি কতটা ভোগ করব, কিভাবে বাঁচবো, এ সব ব্যাপারে উনি যা বিশ্বাস করতেন সেভাবে চলতেন। এটাকে বলে Life Style-- তোমার জীবন, দৈনন্দীন জীবনযাপন করছো যেটা দিয়ে ভোগবাদ বা Consumerism যাকে বলছি আমি--- High Energy .ক্ষমতাবাদী জীবনের বিরোধীতা করছো, উচ্চাকাঙ্খী জীবনের বিরোধীতা করছো ----এটা শ্যামলীদির ভিতর গভীর ভাবে ছিল। ধর্মের ব্যাপারে যেটা ছিল, যে Radical Spirituality যেমন ধর বাউল ফকির ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সংগঠীত ধর্মের বিরুদ্ধে যে আন্দলনগুলো, শ্যামলীদি তার থেকে গভীরভাবে শিক্ষা নেওয়ার পক্ষে ছিলেন।“

“এইখানে পারম্পরীক বামপন্থা বা বা্মপন্থীধারার শূন্যতা, ব্যাথর্তা বা অন্ধতা----তারা আমাদের দেশের সংগঠীত ধর্মের বিরুদ্ধে যে Radical Spirituality-র যে ধারা আছে সে ব্যাপারে অন্ধ। সেখানে কিন্তু শ্যামলীদি অনেকখানি এগিয়ে। আমরা সংগঠীত ধর্মের প্রতিবাদ কি করে করব? তাতো Victorian Materialist world বা Victorian যুগের Scientific achievement দিয়ে হবেনা। এটার যে অনেক গভীর দিকগুলো আছে সেগুলোতো আমরা দেখতেই শিখিনি। সেখানটাতে শ্যামলীদি অনেক open আর আমাদের সামনে দরজা খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।“

শ্যামলীদি দারুন রান্না করতেন আর খাওয়াতেও ভালবাসতেন খুব। শুনেছি তিতুলিয়ার ওঁর সমাধির পাশে একটি কুল গাছ আছে। গ্রামের বাচ্চারা হুটোপাটি করে কুল পেরে খাবে এই ভাবনা থেকেই হয়তো সেই গাছটা পুঁতে ছিলেন শ্যামলীদি। স্নেহময়ী শ্যামলীদি চলে গেলেন নীরবে----আমাদের লোভী-ভোগী জীবনকে থোড়াই কেয়ার করতেন শ্যামলী খাস্তগীর

[জয়ন্ত ঘোষাল ]


Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.