মাংস (ছয়):
_____________
গ্র্যাজুয়েশন পাশের পর আরও কিছুটা পড়তে চেয়েছিল নীপা, কিন্তু অশোকবাবু রাজি হননি। একে নীপা তাঁদের বড় মেয়ে, ছোটোটি এখনও স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি, তায় চাকরিতে থাকাকালীন যদি একটি মেয়েরও বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন, তাহলে যৎসামান্য সরকারি-বেতনে ধার-দেনাগুলো শোধ করতে খানিক সুবিধেই হবে।
তাই চেনাশোনার ভিতরেই যখন মুকুলদের বাড়ি থেকে প্রস্তাবটা এলো,
তখন অশোকবাবু আর বিশেষ আপত্তি করলেন না।
মুকুলের হার্ডওয়ারের ব্যবসা,
বাড়ির কাছেই দোকান। মাবাবা দুই ছেলেমেয়ে, পাত্র
ছোটো, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন.. নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। মাথার
উপর ছাদ আছে, দু'বেলা দু'মুঠো অন্নের সংস্থান আছে, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে
মানুষ আর কি চায়?
সামর্থ খুব বেশি না হলেও বড় মেয়ের
বিয়েতে সাধ্যাতীত খরচা করেছিলেন অশোকবাবু। না চাইতেই যতটুকু পেরেছিলেন,
সম্পূর্ণ করে দিয়েছিলেন, কোথাও যেন এতটুকু
ফাঁক না থাকে, মেয়ে যেন তাঁর সুখী হয়...
নীপা এমনিতে খুব হাসিখুশি প্রকৃতির,
দুঃখকে সে সহজে কাছে ঘেঁসতে দেয় না.. কিন্তু অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি
আসার আগেই শাশুড়িমা যখন বারবার আত্মীস্বজন-প্রতিবেশীর আড়ালে-অগোচরে বাবার বাড়িতে
নিজের হিসেবটুকু ভালো করে বুঝে নেওয়ার সদুপদেশ দিতে লাগলেন, এবং
মুকুলও পরম উৎসাহে মায়ের কথায় হ্যাঁ মেলালো.. তখন কাজলটানা নীল গভীর চোখদুটি
স্বাভাবিকভাবেই এক অব্যক্ত বেদনায় ঝাপসা হয়ে উঠলো...
অথচ মাবাবাকেও কিছুই বললো না নীপা,
তাঁরা তো শুধু জামাইয়ের আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত -"বাবাজীবন, তুমি তো কিছুই খেলে না.. আর একটু পোলাও
দিই, আর একটু মাংস..."মুকুলও যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ,
হাসিমুখে উত্তর দেয়, একমাত্র শ্যালিকার সাথে
রঙ্গরসিকতায় দিব্যি ফুরফুরে মেজাজ...নীপা নিজেকে সান্তনা দেয় মনে-মনে -
"নাহ.. মানুষটা খারাপ নয়, হয়তো সেদিন
মায়ের সামনে কিছু বলতে পারেনি।"
দ্বিরাগমনে স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ি ফেরে নীপা, পুরানো কথা ভুলে নতুনের স্বপ্ন দেখে...
বিয়ের পর মাসখানেক তখনও হয়নি,
দুপুরে দোকান বন্ধ করে প্রতিদিনের মতোই ভাত খেতে বাড়ি ফিরেছে মুকুল,
মুখে তার গভীর চিন্তার ছাপ.. নীপার হাত থেকে বাতাসা-ভেজানো জলের
গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখে, ইশারায় বলে -
কিছু কথা আছে তোমার সাথে...নীপার কেমন যেন অস্বস্তি হতে থাকে - কি
এমন কথা? ভয়ও করে একটু...
কোনোরকম ভনিতা না করে সরাসরি বলে
মুকুল- "বাবার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে এসো,
ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে, বাজারে অনেক দেনা,
শোধ করতে হবে..."তার পরের ছবি ক্রমশঃ পাল্টাতে থাকে, নীপার পায়ের তলার মাটি সরে যায়...প্রথম-প্রথম ব্যাপারটি স্বামী-স্ত্রীর
ভিতর সীমাবদ্ধ থাকলেও, অবিলম্বে মুকুল নিজের মাবাবাকেও সঙ্গী
করে নেয়। শাশুড়িমা তো অনেকদিন আগেই মনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, কাজেই এ ব্যাপারে তাঁদের সহযোগিতা পেতে বিশেষ অসুবিধা হয় না, বরং উৎসাহের পরিমাণ কিছু বেশিই...অতএব চিরাচরিত সেই পণপ্রথা আর
নারীনির্জাতনের কাহিনী, যা যুগে-যুগে কখনও বদলায় না। সারাদিন
অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে কোনোদিন দু'মুঠো ভাত, আর কোনোদিন শাশুড়িমা'র কুনকেতে ঠিক এক মুঠো চাল কম
পড়ে যায়...
বোকা মেয়েটা তবু বাড়িতে কিছু জানায়
না, এই বুড়ো-বয়সে বাবামাকে কষ্ট দিতে তার চোখ ফেটে জল
আসে।এদিকে টাকা না পেয়ে অসহ্য রাগে, অত্যাচারের সীমা ক্রমশঃ
বাড়ছে...
এক ছুটির সন্ধেতে রঙীন-পানীয়ের আড্ডা
জমেছে বসার-ঘরে, কারো কোনো আপত্তি নেই। বরং শাশুড়িমায়ের নির্দেশেই
গরম-গরম মাংসের পকোড়া ভেজে থালা ভ'রে রেখে আসছে তথাকথিত
বাড়ির-বৌমা। এমন সময় মুকুলের সাড়া পেয়ে বেশ একটু অবাকই হয় নীপা, জমাটি-আড্ডা ফেলে এ সময় শোবারঘরে কি করছে মুকুল? রান্নার
কাজ ফেলে উঠে আসে তাড়াতাড়ি, দেরি হলে কপালে আবার দুঃখ
আছে...কিন্তু আশ্চর্য... ঘর তো ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। তাহলে?
ভাবতে-ভাবতেই পিছন থেকে দরজা বন্ধের শব্দ পায় নীপা, চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকায়, দম তার বন্ধ হয়ে আসে –
"এ কি মৈনাকবাবু, আপনি এখানে কি করছেন? দরজা খুলুন, যেতে দিন আমাকে.. নাহলে আমি কিন্তু ভীষণ জোর চিৎকার করবো, আর মুকুল জানতে পারলে আপনার রক্ষা থাকবে না..."
হায়নার হাসি বাস্তবে কখনও শোনেনি
নীপা.. তবে শুনলেও, তা মনে হয় এর থেকে ভয়ঙ্কর হতো না। চার-দেয়ালে
প্রতিধ্বনি হতে থাকে জান্তব-অট্টহাসি, ক্ষুধার্ত নরখাদক
নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীপার উপর। ঘেন্নায়-যন্ত্রণায় ছিন্ন-ভিন্ন হতে-হতে মৈনাক ঘোষের
কিছু কথা কানে আসে -"তোর জন্যে পাঁচহাজার দিয়েছি,
তার উপরে ধারের সুদ মাপ.. কোনো মুকুলের চোদ্দ-গুষ্টি তোকে উদ্ধার
করতে আসবে না, তিন লাখের দেনা শোধ মুখের কথা নয়..."
নীপা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে
না, মুহূর্তের জন্য মনে হয় -কোনো দুঃস্বপ্নের মায়াজালে
সে ঘুমন্ত। ধীরে-ধীরে তার আড়ষ্ট শরীর প্রতিরোধের ক্ষমতা হারায়, ভীষণ বমি পাচ্ছে.. শুধু নোনাজলে আগুন জ্বলে ধিকিধিকি, আর পরতে-পরতে লাভা জমা হয়...