সংশপ্তক: অধিকাংশ বাঙালিরই রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচয় সহজ পাঠের পাতায়! তারপর সেই
পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁর সাথে প্রথম আলাপ যার যার নিজস্ব পরিসরে এক এক রকম ভাবে গড়ে
ওঠে। আপনার ক্ষেত্রে সেই প্রথম আলাপ গড়ে ওঠার গল্পটা যদি একটু বলেন আমাদের!
স্বপন দেব: সৌভাগ্যক্রমে “জল পড়ে, পাতা নড়ে” এর অনেক আগেই, আমার জন্মলগ্ন থেকেই
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার আত্মিক পরিচয় ঘটে যায় আমার অজ্ঞাতসারেই। আমার মায়ের
গানের গলাটি ছিল খুব মিষ্টি আর তিনি আমায় ঘুম পাড়াতেন, রবি ঠাকুরের “আকাশ জুড়ে
শুনিনু ওই বাজে ওই বাজে” এই গানটি গেয়ে। প্রথম লাইনটি অথবা তার পরের লাইনটি
ক্রমাগত শুনতে শুনতে আমি যে শুধু ঘুমিয়েই পড়তাম তাই নয়। মা’র কাছে শোনা, আমি
কাঁদলে বা দুষ্টুমি কিংবা খুব বায়না করলেও নাকি তখনকার কলের গানে ওই গানটি চালিয়ে
দিলে আমি শান্ত হয়ে যেতাম ! আমাদের বাড়িতে
একটা বিশাল বড়ো হল ঘর ছিল। তার একটি দেওয়ালে আমার ঊর্ধতন ছ’পুরুষের ছবি টাঙ্গানো
থাকতো। আর একটি দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকাননন্দ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ
মনীষী দের ছবি টাঙ্গানো ছিল। প্রতিবছর বিজয়া-দশমীর সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়ীর
প্রতিমা বিসর্জনের পর আমাদের গোটা পরিবার ঐ ঘরে গিয়ে বসা হত। প্রথমে সবাই আমাদের
পূর্ব-পুরুষদের ছবিকে প্রণাম করতাম। তারপরেই প্রণাম করা হত মনীষীদের ছবিগুলিতে।
সেই ঘরে আমার এক ঠাকুর্দার সঙ্গে এক জনের যুগ্ম
ছবি ছিল। আবার তাঁরই একক ছবি ছিল উল্টোদিকের দেওয়ালে। ঐ ব্যক্তিটির সঙ্গে আমার
ঠাকুর্দার ছবি দেখে আমার বালক-সুলভ কৌতূহলে আমি এর কারণ জানতে চেয়েছিলাম। এবং তখনই
প্রথম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ আমার ঠাকুর্দার ব্যক্তিগত
বান্ধব ছিলেন এবং আমাদের বাড়িতে তিনি নাকি প্রায় ই আসতেন। তখনই জেনেছিলাম, “আকাশ
জুড়ে শুনিনু” গানটি নাকি তাঁর ই লেখা !! এটি আমার পাঁচ বছর বয়সের কথা। আর তখন স্কুলে যাওয়ার বয়েস ছিল ছ’বছর। সুতরাং, স্কুলে যাওয়ার একবছর আগেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে
গেছে !
সংশপ্তক: একটু
গভীর ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের যার যার জীবনে শৈশবের রবীন্দ্রনাথ কৈশরের
রবীন্দ্রনাথ যৌবনের রবীন্দ্রনাথ আসলেই ক্রমশ প্রকাশ্য রবীন্দ্রনাথের একটা
ধারাবাহিক পর্বই! আমরা যার জন্যে ঠিক প্রস্তুত থাকি না, অথচ এই ধারাবাহিক ভাবেই
কবি যেন আমাদেরকেই প্রস্তুত করে তোলেন আমাদের জীবনের পূর্ণ উদ্বোধনের জন্যেই!
আপনার ব্যক্তি জীবনের গড়ে ওঠার পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন
সেই গল্পটা যদি বলেন।
স্বপন দেব: এটা ঠিকই। শৈশব থেকে শুরু করে আজ জীবনের
প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও রবীন্দ্রনাথ এখনো আমার কাছে ক্রমশ প্রকাশ্য ! শৈশবে,
বীরপুরুষ কবিতাটি পাঠ করার সময়ে আমি যে কেমন করে সেই খোকা বীরপুরুষের সঙ্গে একাত্ম
হয়ে যেতাম! আবার যৌবনে “আমি ভয় করবনা, ভয় করবনা” বা “বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে
মোর প্রার্থনা” আমাকে এক সমাজসচেতন বিপ্লবী হতে সাহায্য করেছিল। শিখিয়েছিল, অন্যায়
যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনেই সমদোষে দোষী। আমি জেনেছিলাম, “প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে” তাঁরই শিক্ষায়, তাঁরই অনুপ্রেরণায়
আমি শোষণ-মুক্ত সমাজব্যবস্থা
গড়ার আশায়, সচেতন ভাবে সত্তরের দশকের যুগ-আন্দোলনে নিজেকে
সমর্পণ করেছিলাম নির্ভয়ে। সে আন্দোলন সফল হয়নি। কিন্তু, আমি হতাশায় ভেঙ্গে পড়িনি। কারণ, “আমি ভয় করবোনা ভয় করবোনা। দু’বেলা মরার আগে মরবনা ভয়ে মরবনা!” তাই পালটে দেবার আন্দোলনে
আমি আজও অধীর অপেক্ষায় আছি ডাক আসার! বসে আছি সেই ডাকের অপেক্ষায়,
“এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী”! আর যবে থেকে কলম তুলে নিয়েছি হাতে, তখন থেকেই তাঁর
পদতলে বসে, “তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি”।
সংশপ্তক: রবীন্দ্র-প্রতিভার ঠিক কোন দিকটি, আপনার যৌবনের
পর্বে বেশি মাত্রায় আন্দোলিত করেছিল আপনাকে?
স্বপন দেব: গৌতম চট্টোপাধ্যাকে বাংলা জীবনমুখী গানের জনক
বলা হয়। তাঁর একজন গুণগ্রাহী হয়েও আমার ব্যক্তিগত ধারণা
রবীন্দ্রনাথের থেকে বেশি আধুনিক এবং জীবনমুখী সাহিত্যিক শুধু বাংলায় নয়, বিশ্ব-সাহিত্যে বিরল। জীবনকে গভীর ভাবে, নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে দেখার যে প্রচেষ্টা রবিঠাকুরের
প্রতিটি সৃষ্টিতে সেটাই আমার যৌবনকালে আমাকে সবথেকে বেশিমাত্রায় আন্দোলিত করেছিল।
সংশপ্তক: এই যে জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে
নিত্য নতুন নানা ভাবে আবিষ্কার করি, এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আমাদের এই ধারাবাহিক ভাবে রবীন্দ্রমানস আবিস্কার আসলেই রবীন্দ্রনাথেরই সাথে পথ চলা
নয় কি? না কি এই আবিস্কারের সাথে আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আত্মিক যোগ ততটা নেই
যতটা মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির যোগ আছে?
স্বপন দেব: সত্যিই
জীবনের এক একটা পর্যায়ে এসে আমরা বোধহয় সবাই রবীন্দ্রনাথ কে নব নব রুপে আবিষ্কার
করি। আমাদের সকলের ই খুব চেনা একটি গান, “পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন
নেচে ওঠে” বহুবার শোনা। কিন্তু আমার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকায় এটি কখনই
ছিলনা। কিন্তু, লেখালেখি শুরু করার পর এই গানটি ই এক জায়গায় শুনতে গিয়ে চমকে উঠলাম! “আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে—যত মাতাল জুটে”! কি অসামান্য
একটা কাব্যিক বাক্য-বন্ধ! কত ব্যঞ্জনাময়!
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! ঠিক এমনি করেই জীবনে
যত পরিণত হয়েছি, যত সাহিত্য ও জীবনমুখী হয়েছি ততই গভীর ভাবে আবিষ্কার
করেছি তাঁকে অন্য এক ব্যঞ্জনায়, অন্য এক গভীর জীবনবোধে। আর যতবার তাঁকে আবিষ্কার করেছি নব নব রুপে, ততই পরিণত হয়েছি আমি নিজে, ততই পরিণত হয়েছে আমার জীবনবোধ। তাই, যেমন একদিকে, “আপনারে এই জানা আমার ফুরাবেনা” ঠিক এর সাথেই
চলমান, “এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা”। এই ধারাবাহিকতার পথ বেয়েই তাঁকে আমার নিত্য আবিষ্কার আর তাঁর
সাথেই পথ চলা। এতে আমার মেধা বা বুদ্ধিবৃত্তির থেকেও অনেক বেশি
করে জড়িয়ে আছে আমার নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আত্মিক যোগ।
সংশপ্তক: রবীন্দ্রপ্রতিভার কোন দিকটি আপনাকে বেশি করে
টানে ও কেন?
স্বপন দেব: এক কথায়, তাঁর জীবন-দর্শন। যে
সময় স্বামী ছাড়া পরপুরুষের মুখ দেখাও পাপ
ছিল...সেই যুগে রবীন্দ্রনাথ নারী পুরুষের সম্পর্ক কে শুধু প্রেম নয়, বন্ধুত্বের বাঁধনে বেধেছেন, “শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু
হে প্রিয় ...মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশ খানি দিও” ! যে
সমাজে নারীর কোন সম্মান অধিকার ছিল না সেই যুগে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন মহামায়া চরিত্র। যে তার ভালবাসার মানুষ কে অনায়াসে পরিত্যাগ করে যায় শুধুমাত্র কথা না রাখার
অপরাধে! জালিনওয়ালাবাগের নারকীয় হত্যাকাণ্ডে
শুধু তাঁর লেখনী নয়,
কন্ঠও গর্জে ওঠে! অনায়াসে বিসর্জন দেন স্বদেশবাসীর রক্তের দাগ লাগা নাইট-হুড উপাধি। শিক্ষা
মানুষের মনকে উদার করার জন্য, প্রসারিত করার জন্য। পুঁথিগত বিদ্যার আ-জন্ম বিরোধী রবীন্দ্রনাথ তাই প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তিনিকেতন। জন্ম দিলেন অগণিত কবি, শিল্পী, ভাষ্কর এবং সর্বোপরি প্রকৃত মানুষের। প্রাক-রাবীন্দ্রিক
বাংলার কোন নৃত্যরুপ ছিলনা। রবীন্দ্রনাথ ভরিয়ে দিলেন বাংলার এই শুন্যস্থান। সৃষ্টি করলেন, বাংলার নিজস্ব নৃত্যরুপ, রবীন্দ্রনৃত্য। ১৯০৫…বঙ্গ-ভঙ্গ। আবার পথে নামলেন রবীন্দ্রনাথ। দুই বাংলা কে বাঁধলেন রাখীবন্ধনের
নিবিড়তায়। রবীন্দ্রনাথ তাই আমার কাছে শুধু কবি নন, লেখক নন, শিল্পী নন,
সুরকার নন, শিক্ষাবিদ নন রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে একটা আদর্শ, একটা জীবনবোধ, একটা আশ্রয়। তাই রবীন্দ্র-প্রতিভার যেদিক টি আমাকে বিশেষ করে টানে, সেটা তাঁর জীবন-বোধ। কারণগুলি আগেই বলেছি।
সংশপ্তক: বর্তমানে আপনার ব্যক্তিগত জীবন যাপন ও সংস্কৃতি
চর্চার পরিসরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির চিত্রটির স্বরূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি কিছু
বলেন।
স্বপন দেব: বর্তমানে আমার ব্যক্তিগত জীবনচর্চায় ও সংস্কৃতির
পরিসরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি আগের থেকেও অনেক বেশি প্রকট। যৌবনে যেটা মনে হত রবীন্দ্রনাথের সীমাবদ্ধতা বিস্ময়ের
সঙ্গে এই অবসর জীবনে দেখছি সেটাই সত্য
!! সেটা কি বিজ্ঞান-চিন্তায় কি তাঁর দূরদর্শিতার
নিত্য-নতুন বোধোদয় ঘটছে…ঘটেই চলেছে
! বর্তমানে আমার জীবনযাপন ও সংস্কৃতি চর্চার পরিসর যেহেতু লেখালেখি,
কবিতা বা গদ্য রচনা, তাই আমার মননে, আমার চিন্তায়, তাঁরই অনুসরণ, তাঁর
ই অনুগমন। আর সত্যি কথা বলতে কি বাংলা সাহিত্যে এমন কেউ
আছেন কি যিনি রবীন্দ্রোত্তর যুগে জন্মেও তাঁর প্রভাব-মুক্ত হতে পেরেছেন ? গান
বলতে এখনো আমি বুঝি রবীন্দ্র-গীতি। যে শব্দ প্রয়োগ কোন লেখায় মনের ভাব প্রকাশের জন্যে
একান্ত আবশ্যিক অথচ চলতি শব্দগুলি কে হয় অশালীন নাহয় বহু ব্যবহৃত মনে হয়, খুঁজে পেতে আমি
রবীন্দ্রনাথের শব্দভাণ্ডার থেকে চয়ন করে আনি ওই একই শব্দের সুললিত প্রয়োগ। যেমন, সেদিন একটা লেখায় শীৎকার শব্দটি প্রয়োগ করেও মানসিক তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। রবীন্দ্রনাথ কে একটু নাড়াচাড়া করেই পেলাম এর এক
সুললিত অথচ অনেক বেশি ব্যঞ্জনাময় শব্দ হর্ষনাদ!!
কখনো কখনো আবার তর্ক জুড়েদি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ! আপনি যে শেষের কবিতায় অমিতের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন যে কবি মাত্রেরই পাঁচ বছরের
বেশি কাব্যচর্চা করা উচিত নয়। অথচ, আপনি তো প্রায় জীবনের শেষদিন
পর্যন্ত অকাতরে লিখে গেছেন! আমি তো কোথাও আপনার লেখায় পৌনপুনিকতা
দোষ দেখিনি! আমার কল্পনায় স্মিত হাস্যে রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন,
অমিতের সঙ্গে শেষবেশ আমার তুলনা করলে তুমি? আমি
লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ আমার যাপন ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলছেন। আর আমাকেও দিকনির্দেশ করছেন অহরহ আরো ভালো, আরো সুসমঞ্জস ভাবে আমার লেখক জীবনের উত্তরণে।
সংশপ্তক: আধুনিক
বাঙালির সমাজ জীবনে রবীন্দ্রনাথের অপরিসীম প্রভাব সম্বন্ধে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল,
তবু তিনি যে সমাজ-ভাবনার দিশা দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সমাজ আদৌ সেই পথে এগোয়নি।
তিনি জোর দিয়েছিলেন গ্রামীন অর্থনীতির স্বনির্ভরতার উপর। তিনি চেয়েছিলেন
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সমবায় প্রথার বিকাশ সাধন। আমরা কবির
সমাজ-ভাবনার এই দিকগুলিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছি। এই বিষয়টিকে আপনি
কিভাবে দেখেন?
স্বপন দেব: আমরা বলতে কারা ? রবীন্দ্রনাথ রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দেখে
গিয়েছেন তাঁর মৃত্যুর বহু পূর্বেই। ধন্তান্ত্রিক অর্থনীতির বিপদ এবং তার বিকল্প সম্পর্কে তাঁর কোন অস্বচ্ছ ধারণা তো
থাকার কথা নয়। তবে, সমবায় প্রথার বিকাশ কিন্তু ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প নয় এবং নিশ্চিৎ ভাবেই
রবীন্দ্রনাথ এটি জানতেন। আমার ধারণা, সমবায় প্রথা বা গ্রামীন অর্থনীতির
স্বনির্ভরতার কনসেপ্ট টাই তাঁর মাথায় এসেছিল। সোভিয়েত যৌথ-খামার এবং সমাজতান্ত্রিক বণ্টন ব্যবস্থার ভারতীয়করণের মাধ্যমে। গ্রামীন অর্থনীতির স্ব-নির্ভরতার জন্যেই তো তেভাগা থেকে নকশাল বাড়ীর
কৃষকরা বার বার সংগ্রামে অবতীর্ণ
হয়েছেন। কিন্তু, একটা সমাজ-ব্যবস্থা বা একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তো আমাদের
কেবলমাত্র ইচ্ছের দ্বারাই পালটে দেওয়া যায়না। যেমন যায়না বিনা আন্দোলনে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন
করা। সেই পালটে দেওয়ার আন্দোলনটা আমরাই
করে উঠতে পারিনি। আর ক্ষমতাসীন কায়েমী স্বার্থই বা কেন বিনা লড়াইয়ে ছেড়ে দেবে তাদের রাজ্যপাট? তাই নতুন সমাজভাবনার যে দিশা তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন
সেটিকে অগ্রাহ্য না করলেও সেটার রুপায়নের কাজ টা আমরা করে উঠতে পারিনি। আমাদের আন্দোলনকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমাদের না ছিল রাশিয়ার লেলিনের মত বা চিনের মাও-সে-তুং এর মত কোন নেতা ! অবশ্যই এটাও মানতে হবে যে রবীন্দ্রোত্তর পুঁজিবাদ কিন্তু আগের থেকে অনেক বেশি
শক্তিশালী হয়েছে আর সেই পুঁজিবাদের বিরোধিতার ধার ক্রমশ ভোঁতা হয়েছে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েতের উত্থান দেখেছিলেন আর আমরা
দেখেছি সোভিয়েতের পতন !
সংশপ্তক: আরও একটি বিষয়কে কবি দ্ব্যার্থহীন ভাবে তুলে ধরেছিলেন, সে হল শিক্ষায়
মাতৃভাষার গুরুত্ব! তিনি খুব সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন বারো বছর বয়স অব্দি শিশুদের
শুধুমাত্র মাতৃভাষাতেই শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। অথচ আজকের দুই বাংলায় নার্সারি থেকেই
স্বছ্বল পরিবারের শিশুদের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই ভর্ত্তি করার জন্যে
অভিভাবকরা আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লাগেন। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
স্বপন দেব: রবীন্দ্রনাথ যেমন মাতৃভাষায় শিক্ষাকে গুরুত্ব
দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনভাবেই কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন
যে স্বাধীন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা যেন ইংরাজি হয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে যে, একটি শিশু তার ছ’বছর বয়সের
মধ্যে দুটি ভাষাই খুব দ্রুত এবং অনায়াসে শিখে যেতে পারে। আর মাতৃভাষা ব্যাপারটাই আমার কাছে কেমন গোলমেলে
মনে হয় ! ধরুন, একটি বাচ্চার বাবা অ্যামেরিকান আর মা বাঙ্গালী। (
যা এখন আকছার ই হচ্ছে ) এক্ষেত্রে শিশুটির মাতৃভাষা
কি হবে? অথবা, একটি শিশুর বাবা-মা দু’জনেই বিহারের কোন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কোলকাতায়
এসে বাংলায় কথা বলে ( এটাও এখন হামেশাই দেখা যায় ) এবং তাদের দেখাদেখি শিশুটিও বাংলাই বলছে! সুতরাং আমার
মনে হয়, যেহেতু ইংরেজি এখন আর শুধুমাত্র ইংরেজদের ভাষা নয়,
এটি এখন একটি গ্লোবাল ভাষা এবং
যেহেতু বিশ্বায়নের পরে পৃথিবী এখন অনেক ছোটো
হয়ে গেছে, তাই ভাব আদানপ্রদানের সুবিধের জন্যে একটি শিশুর জন্মের
ছ’বছরের মধ্যেই তাকে মাতৃভাষা এবং ইংরাজি ভাষা দুটিতেই পারদর্শি করে গড়ে তুলতে
হবে।
সংশপ্তক: বর্তমান শতাব্দিতে বিশ্বায়ন নিয়ে আমরা সবাই বিপুল ভাবে উৎসাহিত, কিন্তু
রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কোনে কোনে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ততটা উৎসাহ নেই
বলেই মনে হয়। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি? কি ভাবে ও কারা এই বিষয়ে সঠিক দায়িত্ব নিতে
পারে বলে মনে করেন আপনি?
স্বপন দেব: আপনাদের কেন মনে হল যে রবীন্দ্রনাথ কে বিশ্বের
কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দেওয়ায় আমাদের ততটা উৎসাহ নেই? আমি অবশ্যই গোটা বিশ্ব ঘুরে দেখিনি। কিন্তু, ইউ কে, অষ্ট্রেলিয়া আর অ্যামেরিকা মহাদেশে ঘোরার অভিজ্ঞতা
থেকে বলতে পারি যে এই সব দেশের নাগরিকেরা কিন্তু এখনও ভারত বলতে বোঝেন টেগোর বা গান্ধী!
বিশ্বায়নের ফলে এই কাজটি বরং আরো দ্রুত গতিতে এবং সুচারুভাবে সম্পন্ন
হচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে এবং বাঙ্গালির মেধা আউটসোর্সিং
এর ফলে এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোণায় পৌঁছে গেছে আইটি সেক্টরে বাঙ্গালিরা। এবং তাঁরা যে কোন উৎসবে, মজলিশে রবীন্দ্রনাথকে তুলে আনছেন নিজেদের ই স্বার্থে। তাঁদের বিদেশে জন্মানো বাচ্চাটিকে তার শিকড় চেনাতে।
সংশপ্তক: আমাদের বাঙালি সমাজের তরুণতর প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কি
ক্রমহ্রাসমান? যদি তাই হয়, তবে তার মূলগত কারণ কি বলে আপনার মনে হয়?
স্বপন দেব: আমার কখোনই মনে হয়না যে তরুণতর বাংগালি প্রজন্মে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা ক্রমহ্রাসমান। বরং ঠিক উল্টোটাই মনে হয় । গতবছর আমি অ্যামেরিকার এক ছোট্টো শহরে বাঙ্গালিদের
আয়োজিত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম। তাঁরা কোলকাতা থেকে এক নবীনা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীকে
নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, বিদেশে অ্যামেরিকার মত একটি দেশে হল ভর্তি দেশি
এবং বিদেশি শ্রোতাদের সামনে ঐ তরুনী মহিলাটি জিন্স আর শার্ট পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন
করলেন একটার পর একটা প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে আর প্রতিটি গানের শেষে
দেশি-বিদেশি শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়ে তুমুল করতালি দিয়ে উৎসাহিত
করে গেলেন সর্বক্ষণ ঐ নবীনা শিল্পিটিকে। আর দেশে তো, ট্র্যাফিক সিগনালে রবীন্দ্রগীতি বাজা ছাড়াও এবং এমন কি পঁচিশে
বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবন ছাড়াও বছরের প্রায় অর্ধেক দিন রবীন্দ্র-সদন বা অ্যাকাডেমি মঞ্চে কেবলমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীতেরই অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং এগুলির
বেশির ভাগেরই আয়োজক আমাদের নবীন প্রজন্ম।
সংশপ্তক: রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ছোট আমি থেকে বড়ো আমি হয়ে
ওঠার গুরুত্বের কথা, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের
পাবি সাড়া”; তবু যেন আমরা ক্রমেই ছোট ছোট আমির দূর্ভেদ্যে খোলসের মধ্যেই ঢুকে
যাচ্ছি ক্রমশ। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা আহত করে বা বিচলিত করে?
স্বপন দেব: এটা খুব ই সত্যি কথা এবং এটা আমাকে ভীষণ ভাবে
বিচলিত করে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বার করা না গেলে
আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষমা করতে পারবোনা একদিন। আর ঠিক এই কারণেই আমাদের নবীন প্রজন্মের উচিৎ
শুধুমাত্র একটি রাবীন্দ্রিক সন্ধ্যার আয়োজন করে তাঁর গোটা কয়েক গান আর কবিতা পাঠ
না করে, তাঁর সাহিত্য-সম্ভার আর একবার পড়ে দেখা।
সংশপ্তক: আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের বাংলায় রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু থাকবে
বলে আপনি আশাবাদী?
স্বপন দেব: মাত্র ৩৫ বছর বয়সে কবি লিখেছিলেন ,
“আজি হতে শত বর্ষ পরে কে তুমি
পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে” ! দূরদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের
দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ঐ মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরেই তিনি যা লিখেছেন, সেটা মানুষ পড়বেন শত বর্ষ পরে। যুবক কবি তখনো বিশ্ব-দরবারে তাঁর আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন নি। নোবেল পুরষ্কার পান নি। কিন্তু এর পরে? আরো ৪৫ বছর তিনি সমৃদ্ধ
করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। কবি থেকে হয়েছেন কবিগুরু। মিশে গেছেন বাঙ্গালির ভাবনায়, চেতনায়, ঘুমে, জাগরণে, ভালোলাগায়,
বিষাদে, রাগে, দুঃখে,
অভিমানে, যন্ত্রণায়, খুশিতে
। বাংগালীর ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের তন্ত্রিতে
তন্ত্রিতে । সুতরাং, পঁয়ত্রিশ বছরের কবি যদি আশা করে থাকেন যে শতবর্ষ পড়েও তাঁর কবিতা পড়া হবে,
আশি বছরের প্রজ্ঞা নিয়ে কবি নিশ্চয় জানতেন যে, বাংলা ভাষা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন প্রাসঙ্গিক
থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের প্রিয় কবিগুরু। আমাদের সকলের রবি ঠাকুর।
[স্বপন দেবঃ লেখক ও চিন্তাবিদ]