সংশপ্তক: অধিকাংশ
বাঙালিরই রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচয় সহজ পাঠের পাতায়! তারপর সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁর সাথে প্রথম
আলাপ যার যার নিজস্ব পরিসরে এক এক রকম ভাবে গড়ে ওঠে। আপনার ক্ষেত্রে সেই প্রথম
আলাপ গড়ে ওঠার গল্পটা যদি একটু বলেন আমাদের!
মনোরমা বিশ্বাস: আর দশটা বাঙ্গালী
মধ্যবিত্ত পরিবারে যেভাবে ঘটে আমার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি । স্কুল পাঠ্যসূচির
অন্তর্ভুক্ত ছিল রবীন্দ্রনাথের শিশু পাঠ্য ছড়া এবং সে ছড়া পড়তে গিয়ে উৎসুক শিশুমনে
প্রথম রবীন্দ্রনাথের অস্পষ্ট ছায়াটি পড়া । কিই বা বুঝতে শিখেছি তখন , বর্ণমালা আয়ত্ব করার কাল সবে শেষ হয়েছে ।
হাতে এসেছে ক্লাশের বাংলা বই । মজার অলংকরণ, ইলাস্ট্রেশনও
সুন্দর । তখন বয়সটাই এমন নতুন নতুন ছড়া পড়তে পেলে মন খুশিতে বিভোর হয়ে যেত ।এভাবে
শুরু হলেও অনেকের ক্ষেত্রে যা ঘটে অর্থাৎ ধারাবাহিকতায় যে ছেদটি পড়ে আমার ক্ষেত্রে
তা ঘটেনি ।বরং স্কুল শিক্ষক এবং শিক্ষানুরাগী বাবা বাসায় যে সকল বই আনতেন আমরা সকল
ভাই গভীর উৎসাহে সেসব পড়তাম এবং বাবা চাইতেনও যে আমরা তা পড়ি । শৈশবে
রবীন্দ্রনাথকে প্রথম আবিস্কার করলেও একটু পর থেকে যেন চেনা-জানাটা হয় । এই তো শুরুর গোড়ার কথা ।
সংশপ্তক: একটু গভীর ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের যার যার জীবনে শৈশবের রবীন্দ্রনাথ
কৈশরের রবীন্দ্রনাথ যৌবনের রবীন্দ্রনাথ আসলেই ক্রমশ প্রকাশ্য রবীন্দ্রনাথের একটা
ধারাবাহিক পর্বই! আমরা
যার জন্যে ঠিক প্রস্তুত থাকি না, অথচ
এই ধারাবাহিক ভাবেই কবি যেন আমাদেরকেই প্রস্তুত করে তোলেন আমাদের জীবনের পূর্ণ
উদ্বোধনের জন্যেই! আপনার
ব্যক্তি জীবনের গড়ে ওঠার পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সেই
গল্পটা যদি বলেন।
মনোরমা বিশ্বাস: খুবই সঠিক কথা । আমি নিজেও দেখেছি
রবীন্দ্রপাঠ যতই এগিয়ে নিয়েছি ততই
যেন আমি আমার অন্তর্ভুবনটাকে নতুন করে সাজিয়ে নিতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্ত
চিন্তার সাথে নিজের পরিচয় বাড়ার সাথে সাথে নিজেকেও পরিণত করতে পেরেছি । এ যেন একজন
পাঠক হিসেবে আমার রবীন্দ্রভুবনে পৌঁছুনোর জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার শামিল। শৈশবে, কৈশরে, যৌবনে
রবীন্দ্রনাথ ক্রমাগতভাবে আমার ব্যক্তিমানসে প্রভাব বিস্তার করেছেন যা আমকেও
ধারাবাহিকভাবে আমাকে বদলে দিয়েছে ।এটা কোনো গবেষকের মত নিবিষ্টতা নিয়ে বিভিন্ন
কালপর্বে চিহ্নিত করতে নাই পারি কিন্তু তা যে এক থাকেনি তা বলাই বাহুল্য। ছোট
একটা উদাহরণ দিই, শিশুতোষ
নির্মল ছড়া পড়ে মুগ্ধ এই আমি যখন প্রথম রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়া আরম্ভ করলাম তখন
তো তা নতুন এক বিস্ময় হিসেবে দেখা দিল। জীবনের এক নিবিড় নিপূণ চালচিত্র এঁকে তার
ভেতর মানবিক স্বপ্ন আকাংখা জুড়ে দিয়ে ছোট গল্পের ফ্রেমে তাকে বন্দী করতে পারা সে
এক বিস্ময়। এ
যেন এক নতুন রবীন্দ্রনাথ। পরে রবীন্দ্রনাথের গানের ভূবনে যখন যাই তখন
সেখানে অপেক্ষা করে ছিল আরেক বিস্ময়। এমন বিপুল বিস্তারী বিস্ময় রবীন্দ্রনাথ কোনো
মানুষের জীবনে জাগাতে পারেন ।রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এড়িয়ে আমাদের সময়ের
সংবেদনশীল মানুষদের জীবন-যাপন বস্তুত সম্ভব ছিলনা ।
সংশপ্তক: রবীন্দ্র-প্রতিভার ঠিক কোন দিকটি, আপনার যৌবনের পর্বে বেশি মাত্রায় আন্দোলিত
করেছিল আপনাকে?
মনোরমা বিশ্বাস:
সত্য ও সুন্দরের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ ও আস্থা এবং ভালোবাসার প্রতি অবিচলিত হয়ে
নিবেদিত থাকার এ বৈশিষ্ট্য শুধু যৌবনের কালপর্বে নয় সারাটি জীবন আমাকে আন্দোলিত
করে এসেছে।
আর
এই বোধ রবীন্দ্রনাথের গানে বোধকরি সবচেয়ে নিবিড়ভাবে মূর্ত হয়েছে । তাই এককভাবে
দেখতে গেলে মনে হয় রবীন্দ্রপ্রতিভার গানের
দিকটিই আমাকে আন্দোলিত করেছে বেশি ।
সংশপ্তক: এই যে জীবনের বিভিন্ন
পর্যায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিত্য নতুন নানা ভাবে আবিষ্কার করি, এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আমাদের এই ধারাবাহিক ভাবে রবীন্দ্রমানস
আবিস্কার আসলেই রবীন্দ্রনাথেরই সাথে পথ চলা নয় কি? না
কি এই আবিস্কারের সাথে আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আত্মিক যোগ ততটা নেই যতটা মেধা
ও বুদ্ধিবৃত্তির যোগ আছে?
মনোরমা বিশ্বাস:
অবশ্যই।
সারাটি
জীবন জুড়ে এই যে রবীন্দ্রনাথকে বিভিন্ন আঙ্গিকে আবিস্কার করেছি, ছুঁতে চেয়েছি তার অন্তর্ভুবন, এতো তাকে সঙ্গী করে পথ চলা।
কখনো
তাঁকে হারিয়ে ফেলিনি বরং ব্যক্তিমানসে যখনই নানা টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয়েছি তখনই
ফিরে গেছি তার কাছে। তিনি উজ্জল উদ্ধার হিসেবে এসে আমাকে আবার
দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন । তাঁর সাথে যোগটা তাই মূলতঃ আত্মিক মনে হলেও মেধা বুদ্ধিবৃত্তিক
যোগও তাতে মিশে যায়নি তা কিন্তু নয়। যুগপত দুই অনুভব দিয়েই তাঁকে খুঁজেছি , পেয়েওছি।
সংশপ্তক: রবীন্দ্রপ্রতিভার কোন
দিকটি আপনাকে বেশি করে টানে ও কেন?
মনোরমা বিশ্বাস: রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প আমাকে টানে বেশি।
বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাস যেটুকু পড়েছি তাতে আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সময়ে বাংলা
সাহিত্যে উপন্যাস যতখানি জায়গা জুড়ে ছিল ছোটগল্ত ততখানি ছিলনা।
রবীন্দ্রনাথ
সে অভাবটি পূরণ করেন। সত্যি বলতে কী আজ এত বছর পর বাংলা সাহিত্য
দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এলেও ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ এখনও অদ্বিতীয়। ব্যক্তি মানুষের
আবেগের, স্বপ্নের, তার হৃদয়ের
গভীর আন্দোলনের এমন নিখুঁত চিত্র রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে পাই যা যে কোনো মনস্তাত্ত্বিকের
কাছে ঈর্ষনীয় হবার কথা। শুধু তাই নয় সামান্য আপাতঃ তুচ্ছ ছোট ছোট
ঘটনাও ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের হাতের ছোঁয়ায় অসামান্য হয়ে যায়। রেখে যায় চিরকালীন এক সত্য
অনুসন্ধান।
সংশপ্তক: বর্তমানে আপনার ব্যক্তিগত
জীবন যাপন ও সংস্কৃতি চর্চার পরিসরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির চিত্রটির স্বরূপ ও
বিকাশ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।
মনোরমা বিশ্বাস:
আপনার এ প্রশ্নের সুখকর উত্তর দিতে পারলে ভালো লাগত আমার নিজেরই কিন্তু তা পারছি
কই।
আমেরিকার
প্রবাসী জীবন বেছে নেবার পর সর্বোপরি পেশাটি ডাক্তারী হওয়ায় ব্যক্তিজীবনের
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের যোগ নেই বললেই চলে। বাড়িতে যেটুকু অবসর জোটে রবীন্দ্রনাথের গানে
ডুবে থাকি অথবা টেনে নিই রবীন্দ্র রচনাবলীর কোন অংশ। নিউইয়র্কে প্রবাসী
বাঙ্গালীর সংখ্যাধিক্যের কারণে ওদের আয়োজিত নানান অনুষ্ঠানে কখনো কখনো সক্রিয় হই
এই পর্যন্ত ।
সংশপ্তক: আধুনিক বাঙালির সমাজ জীবনে রবীন্দ্রনাথের
অপরিসীম প্রভাব সম্বন্ধে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল, তবু
তিনি যে সমাজ-ভাবনার দিশা দিয়ে
গিয়েছিলেন আমাদের সমাজ আদৌ সেই পথে এগোয়নি। তিনি জোর দিয়েছিলেন গ্রামীন অর্থনীতির
স্বনির্ভরতার উপর। তিনি চেয়েছিলেন ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সমবায়
প্রথার বিকাশ সাধন। আমরা কবির সমাজ-ভাবনার
এই দিকগুলিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছি।এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মনোরমা বিশ্বাস: রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতের সীমাবদ্ধতার কথা
মনে রেখে রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকেও ভারতের নিজস্ব উন্নয়ন কৌশল যে গ্রামীণ
অর্থনীতির উপর দাঁড় করাতে হবে এ উপলব্ধির কথা শুনিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় আপন সন্তানকে
কৃষি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাদান করা ছাড়াও প্রান্তিক কৃষকের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের
সংস্থান করতে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার যুগান্তকারী পদক্ষেপও নিয়েছিলেন ।সঙ্গতঃ
করণে তা ছিল একান্তভাবে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ। আজকের যুগে তার
প্রাসঙ্গিকতা দেখে মনে হয় কী অসামান্য দূরদর্শী ছিলেন তিনি। বলাবাহুল্য স্বাধীন ভারত
পরবর্তী পর্যায়ে আর তার পথে এগোইনি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে শুধু
ভারত কেন তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশই তার নিজস্ব অর্থনৈতিক কৌশল নিতে পারেনি। এটাই
বাস্তবতা ।
সংশপ্তক: আরও একটি বিষয়কে কবি
দ্ব্যার্থহীন ভাবে তুলে ধরেছিলেন, সে
হল শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব! তিনি
খুব সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন বারো বছর বয়স অব্দি শিশুদের শুধুমাত্র মাতৃভাষাতেই
শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। অথচ আজকের দুই বাংলায় নার্সারি থেকেই স্বছ্বল পরিবারের শিশুদের
ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই ভর্ত্তি করার জন্যে অভিভাবকরা আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে
লাগেন। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি ?
মনোরমা বিশ্বাস: মাতৃভাষায় শিক্ষা নিয়ে
কোনো বিতর্ক থাকা উচিৎ নয়। আজকে বিশ্বজনীন যোগাযোগ বাড়ায়, অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত
বাংলা অনুদিত বই না থাকায় ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষা যে কেউ শিখতে পারেন কিন্তু
শিক্ষার প্রাথমিক ভিতটি অবশ্যই মাতৃভাষায় হতে হবে। এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ
শিক্ষার মূল উদ্দশ্যই ব্যাহত করবে নিসন্দেহে। তাছাড়া এককেন্দ্রিক
বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষাও থাকা দরকার। আরেকটি কথা রবীন্দ্রনাথ
যেভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলও তেমনি
শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা দানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছলেন।
আমিও
তাঁদের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই মাতৃভাষায় শিক্ষা কেবল নয় আমাদের দরকার সেকুলার
শিক্ষাও।
সংশপ্তক: বর্তমান শতাব্দিতে
বিশ্বায়ন নিয়ে আমরা সবাই বিপুল ভাবে উৎসাহিত, কিন্তু
রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কোনে কোনে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ততটা উৎসাহ নেই
বলেই মনে হয়। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি? কি
ভাবে ও কারা এই বিষয়ে সঠিক দায়িত্ব নিতে পারে বলে মনে করেন আপনি?
মনোরমা বিশ্বাস: রবীন্দ্রনাথ তো এখন গোটা বিশ্বেরই।
পৃথিবীর
বিভিন্ন ভাষায় তাঁর রচনাবলী অনুদিত হয়েছে এখনো হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী রবীন্দ্রনাথকে
আরো বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সরকারী বেসরকারী উভয় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ
করতে হবে । ভারত ও বাংলাদেশের দূতাবাসসমুহ এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিভিন্ন
দেশের আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়িয়ে রবীন্দ্র চেয়ার খোলা , স্কলারশীপ দেওয়া ইত্যাদি কার্যক্রম নেয়া যেতে
পারে।
আমাদের
দুদেশের শিক্ষানুরাগী বিদগ্ধজনদের এমন কাজে সংশ্লিষ্ট করলে সুফল পাওয়া যাবে
সংশপ্তক: আমাদের বাঙালি সমাজের তরুণতর প্রজন্মের কাছে
রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কি ক্রমহ্রাসমান? যদি
তাই হয়, তবে
তার মূলগত কারণ কি বলে আপনার মনে হয়?
মনোরমা বিশ্বাস: হ্যাঁ, দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের তরুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ একটু
একটু করে যেন অচেনা হয়ে পড়ছেন। একটা সময় ছিল লোকায়ত গ্রাম সমাজেও কখনো কখনো সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। রবীন্দ্র-নজরুল
জয়ন্তী হতো ফি বছর। প্রাসঙ্গিক
থাকতেন তাঁরা। সেসব
উদ্যোগ আয়োজন তেমন দেখা যায়না আজকাল। যে মাধ্যমগুলো তরুনদের কাছে রবীন্দ্রনাথকে
হাজির করাতে পারত তা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সংস্কৃতিচর্চা থেকে তরুণ সমাজ দৃশ্যতঃ মুখ
ফিরিয়ে নিয়েছে। বাড়িতে
বাড়িতে ঐভাবে আর গানের রেওয়াজ হয়না ,মহল্লা
থেকে উধাও হয়ে গেছে নাটক, আবৃত্তি সংগঠনের অফিস, সুস্থ সিনেমা তো সুদূর অতীত। রবীন্দ্রনাথ
কিভাবে প্রাসঙ্গিক থাকেন তাহলে? মাদক, অপরাজনীতির শিকার তরুনদের কাছে মোটামুটি টিকে
যাওয়া বলতে আছে ক্রিকেট। রবীন্দ্রনাথ নজরুল কালে ভদ্রে তবু তরুনদের
কাছে পোঁছুতে পারেন, টিভি নাটকে, গানের অনুষ্ঠানে, রুচিশীল সিনেমায় কিন্তু আমাদের আরো যে
সকল মহৎ প্রতিভা রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ বা ডিএল রায়, তরুন সমাজ এদের সম্পূর্ণ
বিস্মৃত হয়েছে।
সন্দেহ
হয় আজকের প্রজন্ম এদের নাম আদৌ জানেন কিনা।
সংশপ্তক: রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ছোট
আমি থেকে বড়ো আমি হয়ে ওঠার গুরুত্বের কথা, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের
পাবি সাড়া”; তবু যেন আমরা ক্রমেই ছোট ছোট আমির দূর্ভেদ্যে
খোলসের মধ্যেই ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা আহত করে বা বিচলিত করে?
মনোরমা বিশ্বাস:
প্রযুক্তির অভাবিত উন্নয়ন বিশ্বজনীন সহজ যোগাযোগই শুধু সম্ভবপর করে তুলেনি বরং বলা
যায় আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ব যেন হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে আজ। রবীন্দ্রনাথ বাইরে এসে
দাঁড়াবার যে তাগিদ দিয়েছিলেন একদা, সত্যি
তা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু
বিশ্বজনীন বোধ কতটুকু অর্জন করেছি আমরা, হৃদয়ে বিশ্বলোকের সাড়া কী পড়েছে? না, বিশ্বমানব
আজো হতে পারিনি আমরা। বৈশ্বিক অর্থনীতি অসম উন্নয়নের চিরাচরিত পথ
ধরে হাঁটছে, মানুষে মানুষে ধর্ম ও
জাতিগত বিভাজন রেখা আজো মুছে দেয়া যায়নি, হঠাৎ
উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে এসে পড়া মানুষ তার অস্থিত্ত্ব বাঁচাতে যেন বৃহত্তর ‘আমরা’ থেকে ক্ষুদ্রতর ‘আমি’ তে রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।
এই
বাধা তো ব্যক্তিমানসকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে বা ফেলছেও। খোলসে আটকে পড়া মানুষ দেখে
কষ্ট তো পাই।
বেদনাহতও
হই।
সংশপ্তক:আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের
বাংলায় রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু থাকবে বলে আপনি আশাবাদী?
মনোরমা বিশ্বাস: তুমুল আশাবাদ নেই তবে
একেবারে আশাহীন হয়ে পড়িনি এখনো। বাংলাভাষী দুই ভূখন্ডের লক্ষ কোটি মানুষের
কাছে তো বটেই রবীন্দ্রনাথের গান বাংলাদেশ ভারত উভয় দেশেই জাতীয় সংগীত হিসেবে
স্বীকৃত বলে অন্ততঃ এ দুটো দেশে রাষ্ট্রিক প্রয়োজনেই রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক
থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ
নয় , এ
দুটো দেশকে শেকড়ের টানে ফিরতে হবে রবীন্দ্রনাথের কাছে।
[মনোরমা
বিশ্বাস: প্রবাসী চিকিৎসক]