>

মিতুল দত্ত

SongSoptok | 5/15/2015 |




পর্ব - এগারো

বেলগাছিয়া ট্রামডিপোর উল্টোদিকে একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। সেখান থেকে মাল কিনে নিজের দোকানে এনে...রাখতেন ঠাকুরদা। মুদিখানা কোনওরকমে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চললেও তার আয় থেকে সংসারটা মোটামুটি চলে যাচ্ছিল।সেই সময়ে বাবা, আশুতোষ ইনস্টিটিউশনে ক্লাস টু-তে ভর্তি হয়।

চিত্তরঞ্জন তখন তৈরি হচ্ছে। ওই অঞ্চলের নাম তখন ছিল মিহিজাম, আগাগোড়া ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেই জঙ্গল কেটেরেলইঞ্জিন কারখানা আর কারখানাকে ঘিরে জনবসতি তৈরির কাজ পুরোদমে চলছে তখন। প্রচুর ভ্যাকেন্সি।আত্মীয়স্বজনের চেষ্টায় সেখানে ঠাকুরদার একটা চাকরির ব্যবস্থা হল, কিন্তু কাজে বহাল হওয়ার ঠিক আগের দিন,দামোদরের বন্যায় গোটা এলাকাটাই ভেসে গেল। ঠাকুরদার চাকরিটাও ভেসে গেল সেইসঙ্গে। আরও বড় বিপর্যয় নেমে এলসংসারে। বাবারা তখন চার ভাইবোন। তাদের মধ্যে সবচাইতে সুন্দর আর ছটফটে ছিল বাবার মোজোভাই মুকুল, মাত্রচার বছর বয়েসে পৃথিবীর মায়া নামক মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে সে চলে গেল। কালাজ্বর। বাবার মেজোবোন অঞ্জু, টানাএগারো দিন জ্বরে অজ্ঞান হয়ে রইল। ঠাকুরদা কলকাতা ছাড়বেন ঠিক করলেন।

মানুষের ভাগ্য সবটাই সে নিজে গড়ে না, কিছুটা বোধহয় নিয়ন্ত্রিতও হয়। কে নিয়ন্ত্রণ করে, কার হাতের কড়ে আঙুলেবাঁধা অদৃশ্য সুতোর টানে ক্রমাগত বদলে যায় মানুষের বেঁচে থাকার ইতিহাস, সে এক রহস্য। মানুষ গল্প থেকে গল্পান্তরেযায়। কেন যায়, কীভাবে যায়, খানিকটা সে নিজে জানে, খানিকটা জানে না। এই যাত্রাটাই তখন অন্য এক গল্প হয়ে ওঠে।

ছেলের মৃত্যুশোকের বুকে পাথর চাপা দিয়ে যমের দক্ষিণ দুয়ার থেকে মেয়েকে যখন ফিরিয়ে আনছেন ঠাকুরদা, সংসারেরবাদবাকি জ্যান্ত লোকগুলোর মুখে ভাত জোগাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়, দত্তবাগানের মোড়ে একটা চায়েরদোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন ঠাকুমার মেজোমামা আর তার বন্ধু নীরদচন্দ্র চন্দ্র। কথায় কথায় ভাগ্নীর দুঃখদুর্দশার কথাউঠে এল। নীরদবাবু বললেন, তাদের গ্রামের হাইস্কুলে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার নেওয়া হবে। ঠাকুরদাকে সেকথাজানানো হল। ঠাকুরদা গোপালপুর গেলেন আর চাকরিটা হয়ে গেল।

অবশ্য  গোপালপুর, সে গোপালপুর মানে উড়িষ্যার সমুদ্রসৈকত নয়।  গোপালপুর উত্তর চব্বিশ পরগণার নেহাৎইএকটা অজপাড়াগাঁ। বসিরহাটের কিছু আগে মালতীপুর স্টেশনে নেমে সাইকেলভ্যানে চেপে বলতে হবে গোপালপুরহাটখোলা, নয়তো গোপালপুর মিত্তিরবাড়ি, অথবা কাওড়াপাড়া। ঠাকুরদা যখন গোপালপুর পপুলার অ্যাকাডেমিতেঅ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার হিসেবে জয়েন করলেন, তখন ওই মালতীপুর স্টেশনটার নাম ভারতীয় রেলের ম্যাপবইতে ছিল না।মার্টিন বার্ন কোম্পানির ন্যারোগেজ রেললাইন ছিল বেলগাছিয়া থেকে বসিরহাট অব্দি। সেই মার্টিন রেলে চেপে আরবেলিয়াস্টেশনে এসে নামলেন ঠাকুরদা, বউ আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে। আরবেলিয়া স্টেশনের পাশেই ছিল বিদ্যাধরীর একটাশাখানদী। সেই নদীকেও বিদ্যাধরী নামেই ডাকা হত। বিদ্যাধরীর ভাঁটার টানে আরবেলিয়া থেকে নৌকোয় গোপালপুর।গোপালপুরে জমিদারবাড়ির পাশে স্কুলেরই এক কর্মচারী কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে উঠলেন ঠাকুরদা। সেই বাড়িতে বছরতিনেক ছিলেন তিনি।

গোপালপুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন সুনীতিকুমার ভট্টাচার্য। পরে তিনি বসিরহাটে একটা নতুন স্কুল খুলে সেখানকারহেডমাস্টার হয়ে চলে যান। তিনি বিখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে একটি ব্যাকরণ বইলিখেছিলেন। গোপালপুর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাসম্পাদক ছিলেন নরেন্দ্রকালী মিত্র, আমার মায়ের দাদু। গোপালপুরের শেষজমিদার। তিনি ডাঃ বিপিনবিহারী পাড়ুই, ভূদেব দাস প্রমুখের সহায়তায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলে মেয়েরাও যাতেপড়তে পারে, তার জন্য পরে কোএডুকেশন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তিনি। সুনীতি ভট্টাচার্য বসিরহাট চলে যাওয়ার পর,প্রাণকুমার মজুমদার এই স্কুলের হেডমাস্টার হন। আমার ঠাকুরদা তখনও আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। ওই স্কুলে পড়াতে পড়াতেইতিনি বি এ, বি টি, আর বাংলায় এম  পাশ করেন। একষট্টি বছর বয়েসে ইংরেজিতে এম  পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আমারমায়ের তখন বিয়ে হয়েছে। আমার ছোটকাকা তখন ছোট্ট খোকাটি। মার কাছে শুনেছি, ছোটকাকাকে ট্যাঁকে নিয়ে এম এপরীক্ষার বই মুখস্থ করতে করতে সারা উঠোনে পায়চারি করতেন ঠাকুরদা। তার মৃত্যুর পর এম এর মার্কশিট ডাকেএসেছিল আমার দাদুর অফিসে। আমার দাদু তখন গোপালপুরের পোস্টমাস্টার। সেই মার্কশিট আর খোলা হয়নি।শেষজীবনে ঠাকুরদা গোপালপুর হাইস্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হয়েছিলেন।

কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে থাকতে, বাবাকে প্রথমে দক্ষিণপাড়ার গুরুমশায়ের পাঠশালায় ক্লাস থ্রিতে আর তার পরেরবছর উত্তরপাড়ার প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি করা হয়। সেই প্রাইমারি স্কুলে পড়ত ঝন্টু মিত্তির। বারীন্দ্র কালী মিত্র।জমিদার নরেন্দ্র কালী মিত্রের ন'ভাই ভূপেন্দ্র কালী মিত্রের ছেলে ঝন্টু মিত্তির বাবার প্রাণের বন্ধু ছিল। আমরা বলতাম,মণিদাদু। মণিদাদুর মতো কিপ্টে আর হাড়বজ্জাত লোক আমি খুব কম দেখেছি। অবশ্য মিত্তিরবাড়ির প্রতিটি চরিত্রই ছিলবাঁধিয়ে রাখার মতো। সে কথায় পরে আসছি। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমার শৈশবের অনেকখানি জুড়ে আছেমিত্তিরবাড়ির ধ্বংসস্তূপে জমে থাকা ইট, কাঠ, মরা ব্যাঙ, গোসাপ, বনবেড়াল, শ্বেতকরবীর চারা, বুড়োশিবের থান,অবগাহন করার মতো পুকুর আর সেই পুকুর ঘিরে জন্ম নেওয়া অজস্র রূপকথা। সে গল্প এত সহজে শেষ হবার নয়।

(ক্রমশ)
[মিতুল দত্ত]



Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.