>

অলোক ভঞ্জ

SongSoptok | 5/15/2015 |




সব বড় মানুষেরই বিশেষত্বের কিছু না কিছু দিক থাকে, কেউ ভালো গল্প লেখেন, কেউ ভালো কবিতা, কেউবা ভালো ছবি আঁকেন তো কেউ গান, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেই রকম কোনো দিকই ছিল না, ওঁনার বিশেষত্ব আসুমুদ্র হিমাচলেরই  মত বিস্তৃত কেউ ভাবেন রবীন্দ্রনাথ বড় কবি, কেউ ভাবেন বড় সাহিত্যিক,  কেউবা ভাবেন বড় নাট্যকার কিম্বা বড় শিল্পী 
তখন ওঁনারই একটি কবিতার কথা মনে পড়ে যায় -  
রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসেন অন্তর্যামী
রবিঠাকুর তখন মনে মনে হয়তো বলে উঠেন, ওরে তোরা কেউ আমায় বুঝলি নারে -
বড় মানুষ নইরে আমি, বড় মানুষ নই
আমার সঙ্গে আছিস তোরা, আমি তোদের সঙ্গে রই

সত্যি তিনি আমদের বড্ড কাছের মানুষ, উনি আমাদের বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে সদা বিরাজমান এতো আর নোবেল প্রাইজ নয় যে সুরক্ষার অভাবে চুরি হয়ে যাবে, রবিঠাকুর আমাদের হৃদয়ে চিরদিনই সুরক্ষিত থাকবেন নোবেলজয়ীর স্বীকৃতি নিয়েই, কেউ তাকে কেড়ে নিতে পারবে না স্বীকৃতি কখনো চুরি হয় না, তাই তার মৃত্যুর এতো বছর পরেও  আমরা সেই একই ভালবাসা নিয়ে তাকে স্মরণ করি, তার জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালন করি তাকে শ্রদ্ধা জানাই
তবু  বিষ্ণু  দের  সেই  কবিতার  কথা  মনে  পড়ে  যায়
তুমি কি কেবলি স্মৃতি, সুধু এক উপলক্ষ্য কবি ?
হরেক উৎসবে হৈ হৈ, মঞ্চে মঞ্চে কেবলি ছবি -
তুমি শুধু ২৫শে বৈশাখ আর ২২শে শ্রাবণ!
তাই মাঝে মধ্যে ভয় হয় আমাদের লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য যেন বড়ো না হয়ে যায়

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সত্য সুন্দরের উপাসক - সত্য সব সময় সুন্দর হয় না, অনেক সময় তা কঠিন রূপে দেখা দেয় তবুও তাকে বরণ করে নিতেই হয়  
তাই তিনি মধ্য জীবনে লিখেছিলেন -
ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে

ঈশ্বর মাঝে মধ্যে দুঃখের বেশে দেখা দেন - তাই তিনি লিখেছিলেন -
দুঃখের বেশে এসেছো বলে তোমায় নাহি ডরিব হে,
যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় করে ধরিব হে

আবার জীবনের প্রায় সায়াহ্নে লিখেছিলেন -  
চিনিলাম আপনারে আঘাতে, আঘাতে - বেদনায়, বেদনায়, সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালবাসিলাম - সে কখনও করে না বঞ্চনা

আবার কখনো ঈশ্বরের কাছে তার প্রাথর্না -
অন্তর মম বিকশিত কর, অন্তরতর হে
নির্মল করো, উজ্জল করো, সুন্দর করো হে
জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ

আজ থেকে ১০০ বছর আগেও রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি নারীকে তার প্রাপ্য সন্মান দিয়ে বাধা-নিষেধের খাঁচা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আজও আমরা তা করে উঠতে পারিনি, আধুনিকতার আর বিশ্বায়নের সুবাদে খাঁচার আয়তনটাকে  বড় করতে সক্ষম হয়েছি বটে কিন্তু আজও তাদেরকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে খোলা আকাশে উড়িয়ে দিতে পারিনি

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে ভীষনভাবে ভালবাসতেন, তাই গর্ব করে লিখেছিলেন -
অকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
প্রকৃতির সব রূপ-রস তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করে তা থেকে জীবনদর্শনের শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন, তাই তিনি তথাকথিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি চাইতেন শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বড় হোক, শিশুমনের গগনচুম্বী চিন্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটুক এবং তারা সত্যিকারের মানুষ হয়ে দেশকে শক্তিশালী করুক কিন্তু আজও তা আমরা করে উঠতে পারিনি, বরং ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইঁদুর-দৌড়ে ঠেলে দিয়ে তাদের স্বপ্নের আকাশটাকেই চুরমার করে প্রায় যন্ত্রমানব বানিয়ে ফেলেছি

রবীন্দ্রনাথ  প্রেমের  পুজারী  ছিলেন  – তিনি  জানতেন  প্রেম  শব্দটা  ছোট  হলেও  তার  পরিধি  বিশ্বব্যাপী, জীবনে প্রেমের মূল্য অপরিসীম সব মানুষই কোনো না কোনো সময়ে প্রেমে পড়ে - সে মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম কিম্বা ঈশ্বরপ্রেম যাই হোক না কেন, তাইতো কবি লিখেছিলেন -
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে , কে কখন ধরা পড়ে কে জানে
আবার কখনও প্রেমের জোয়ারে ভেসে যেতে চেয়েছিলেন -
প্রেমের জোয়ারে ভাসাবো দোহারে - বাঁধন খুলে দাও, দাও  দাও  দাও
ভুলিব ভাবনা পেছনে চাবনা - পাল তুলে দাও, দাও  দাও  দাও
আর প্রেমহীন জীবনের মূল্যইবা কি, তাই কবি লিখছিলেন - যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

মানুষের জীবনে প্রেম যেমন জরুরী তেমনই জরুরী ভয়কে জয় করা - মানুষ মরে একবার কিন্তু ভয়ে মরে চিরটাকাল, তাই তিনি লিখেছিলেন -
চিত্ত যেথা ভয় শুন্য উচ যেথা শির  - আবার এও লিখলেন -
বিপদে মোরে রক্ষা করো নহে মোর পার্থনা - বিপদে আমি না যেন করি ভয়

আমরা জন্মসূত্রে মানুষ হলেও সত্যিকারের মানুষ হয়তো হতে পারিনি, তাই তিনি লিখেছিলেন -ভালো মানুষ নইরে মোরা ভালো মানুষ নই, আবার এও বলেছিলেন
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো সেইতো তোমার আলো
সেই আলো সকলের মধ্যে বিলিয়ে দাও
অন্ধজনে দেহ আলো মৃতজানে দেহ প্রাণ 
তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে চাইতেন তাই শুচি-অশুচির বাঁধন ভেঙ্গে চন্ডালীকাকে বলতে পেরেছিলেন - যে মানব তুমি আমি, সেই মানব, তুমি কন্যা - আমায় জল দাওজল দাও

রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন আমাদেরকে পথ দেখায় - আশার বাণী শোনায়, যখন দুঃখ-কষ্ট আমাদেরকে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে ফেলে তখন তার কবিতা মনে করিয়ে দেয় -
দুঃখ যদি না পাবেতো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে
কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়, বিষে বিষক্ষয় হয় আর দুঃখই দুঃখ মোচন করে
আমাদের জীবনের নানান পরিস্থিতে রবিঠাকুরের কবিতা, গান সমাধানের সুত্র নিয়ে হাজির হয় নিজেকে যখন বড্ড অসহায় লাগে, তখন ওঁনার সেই বিখ্যাত গান
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে - আমাদেরকে সাহস জোগায়

রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের সব চেয়ে বড় উপলব্ধি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন -
আছে দুঃখ আছে মৃত্যূ বিরহ দহন লাগে - তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে

রবীন্দ্রনাথ তুমি সত্যিই অন্তহীন
আমরা চাই তোমারই আর্দশে দীক্ষিত হয়ে প্রেমের বাণীকে পাথেয় করে, ভয়কে জয় করে, মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতেআর সেটাই হবে তোমার প্রতি আমাদের সর্বশ্রেষ্ট শ্রাদ্ধাঞ্জলি



[অলোক ভঞ্জ]

Comments
0 Comments

No comments:

Blogger Widgets
Powered by Blogger.