>
>>
  • SriSuvro
  • >>
  • VERA DROZDOVA
  • >>
  • TILOTTAMA BOSE
  • >>
  • THADDEUS HUTYRA
  • >>
  • SUTAPA KHATUA
  • >>
  • SUMANA BHATTACHARJEE
  • >>
  • STEPHEN STONE
  • >>
  • STACIA LYNN REYNOLDS
  • >>
  • SOUMYA SEN SARMA
  • >>
  • SIAMIR MARULAFAU
  • >>
  • SHARMILA DASGUPTA
  • >>
  • RUMA CHAKRAVARTI
  • >>
  • ROULA POLLARD
  • >>
  • RINITA MAZUMDAR
  • >>
  • RIMI PATI
  • >>
  • RANIA ANGELAKOUDI
  • >>
  • PRERNA SINGLA
  • >>
  • PHILLIP
  • >>
  • PAPIA ROY
  • >>
  • NUPUR LAHIRI
  • >>
  • NILANJANA BANERJEE
  • >>
  • NANDITA SAMANTA
  • >>
  • NANDITA BHATTACHARYA
  • >>
  • MITRA GHOSH CHATTOPADHYAY
  • >>
  • MITA CHAKRABORTI
  • >>
  • MICHAEL MILLER
  • >>
  • MASSIMILIANO RASO
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • MARY L PALERMO
  • >>
  • MARIETA MAGLAS
  • >>
  • MANISH MITRA
  • >>
  • LaDean Birkhead
  • >>
  • KOLPITA BASU
  • >>
  • KALYAN MUKHOPADHYAY
  • >>
  • JYOTI BISWAS
  • >>
  • JULIE ANNA
  • >>
  • JAYANTHI SEN
  • >>
  • GITA ASSEFI
  • >>
  • EFTICHIA KAPARDELI
  • >>
  • DEBORAH BROOKS LANGFORD
  • >>
  • CLIFF GOGH
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • >>
  • BRITTA HOFFMANN
  • >>
  • BENEDICTA RUIZ
  • >>
  • ASIM RANJAN PATI
  • >>
  • ARONI
  • >>
  • ANURADHA BHATTACHARYYA
  • >>
  • ANTORA
  • >>
  • ANNA ZAPALSKA
  • >>
  • ANINDA GHOSH
  • >>
  • ANCHITA GHATAK
  • >>
  • ANCA MIHAELA BRUMA
  • >>
  • AMRITA KANGLE
  • >>
  • ADRIJ
  • >>
  • SUBHODEV DAS
  • >>
  • MARY SCULLY
  • >>
  • LIPIKA DEY
  • >>
  • CHRYSSA VELISSARIOU
  • কেয়া মুখোপাধ্যায়





    সংশপ্তক:  অধিকাংশ বাঙালিরই রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচয় সহজ পাঠের পাতায়! তারপর সেই পর সূত্র ধরে তাঁর সাথে প্রথম আলাপ যার যার নিজস্ব পরিসরে এক এক রকম ভাবে গড়ে ওঠে। আপনার ক্ষেত্রে সেই প্রথম আলাপ গড়ে ওঠার গল্পটা যদি একটু বলেন আমাদের!
    কেয়া মুখোপাধ্যায়: ছোটবেলায় প্রচলিত ঘুম-পাড়ানি গানের থেকেও মায়ের কাছে বেশি শুনেছি রবি ঠাকুরের গান আর কবিতা। মায়ের খালি গলার মৃদু সুরের গান মনে আরামের তুলি বুলিয়ে দিত। মা গাইতেন "মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা, মনে মনে" আর আমি মনে মনে পেরিয়ে যেতাম তেপান্তর। মায়ের কাছেই শুনেছিলাম: 'আমি যদি দুষ্টুমি করে/ চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি/ভোরের বেলা মা গো, ডালের পরে/ কচি পাতায় করি লুটোপুটি
    কখনো নিজেকে চাঁপার গাছে লুকিয়ে থাকা শিশুটি, কখনো কানাইমাস্টার, আবার কখনো টগবগিয়ে রাঙা ঘোড়ার পরে  চড়ে মায়ের পাল্কীর পাশে পাশে যাওয়ার ছবিটা কল্পনা করতে করতে পাড়ি দিতাম ঘুমের দেশে। আর একটু বড়ো হতে বাবা আবৃত্তি করে শোনাতেন রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা/  ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা/ কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।' আর একটু একটু করে ছবিটা যেন ফুটে উঠত চোখের সামনে। রোববারের সকালবেলা রেডিওতে সঙ্গীত শিক্ষার আসর হত। সামনে গীতবিতান। সুর মেলাতেন কাকু। আমিও গুনগুন করার চেষ্টা করতাম। লং প্লেয়িং রেকর্ডে বাজতো তাঁর গান, গীতিনাট্য। বুঝি না- বুঝি, খুব ভালো লাগত। সহজ পাঠ হাতে পাবার আগে, এভাবেই ছবিতে দেখা জোব্বা পড়া, লম্বা দাড়িওলা সৌম্য মানুষটির সঙ্গে আমার খুব চেনাজানা হয়ে গিয়েছিল।

    সংশপ্তক:   একটু গভীর ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের যার যার জীবনে শৈশবের রবীন্দ্রনাথ কৈশরের রবীন্দ্রনাথ যৌবনের রবীন্দ্রনাথ আসলেই ক্রমশ প্রকাশ্য রবীন্দ্রনাথের একটা ধারাবাহিক পর্বই! আমরা যার জন্যে ঠিক প্রস্তুত থাকি না, অথচ এই ধারাবাহিক ভাবেই কবি যেন আমাদেরকেই প্রস্তুত করে তোলেন আমাদের জীবনের পূর্ণ উদ্বোধনের জন্যেই! আপনার ব্যক্তি জীবনের গড়ে ওঠার পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন সেই গল্পটা যদি বলেন।
     কেয়া মুখোপাধ্যায়:  আমার এক কাকাকে আমি কখনও দেখিনি, শুধু তাঁর গল্প শুনেছি। পেশায় আর্কিটেক্ট ছিলেন।  চমৎকার গান গাইতেন। খুব তরুণ বয়সে, অকালে চলে গিয়েছিলেন। স্মৃতি হিসেবে আর সব কিছুর সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল তাঁর  কালো রেক্সিনে বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা গীতবিতানটি। ওই গীতবিতানে কিছু গানের পাশে আঁকা তারা চিহ্ন। বাবা বলতেন, সেগুলো ছিল কাকার সবচেয়ে প্রিয় গান। তখন আমি স্কুলে পড়ি। হঠাৎ হঠাৎ রবি ঠাকুরের এক একটা গানের কলি মনে দোলা দিয়ে যায়, সারাদিন সেই গানটাই গুন গুন করি আর তারপর ছুটে যাই ওই গীতবিতানের কাছে। পুরো গানটি পড়তে, হয়তো বা বোঝার চেষ্টা করতে, আর সেইসঙ্গে খুঁজে দেখতে সেই গানটি কাকারও প্রিয় ছিল কিনা! বেশির ভাগ সময়েই মিলে যেতো। কতবার ভেবেছি: কি আশ্চর্য! এই গানটাও মিলে গেলো! তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি- মিলিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। যাঁকে কখনও দেখিনি, যাঁর ভালো-লাগা স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে শুধু ওই তারা-চিহ্নতে, তাঁর সঙ্গে আমার ভাবনা আর ভালো লাগা-কে মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। এক সুরে বেঁধে দিয়েছেন। বই পড়ার ওপর বাড়িতে বিধিনিষেধ না থাকায় অনেক ছোট থেকেই রবীন্দ্র রচনাবলী আমার সঙ্গেএ। আমার মায়ের খালি গলায় গাওয়া রবি ঠাকুরের গানে, বাবার গীটারের সুরে কি আবৃত্তিতে, অজস্র লং-প্লেয়িং রেকর্ডে, কাকুর আলমারি-জোড়া রবীন্দ্র-রচনাবলীর একচ্ছত্র আধিপত্যে আর আমার না-দেখা কাকার ওই বাঁধানো কালো গীতবিতানের উত্তরাধিকারে শৈশব থেকে পরবর্তী পর্বগুলোতে  আমার মন জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
    গীতবিতানের পাতা উল্টোতে উল্টোতে হঠাৎ অচেনা, অপ্রচলিত শব্দ খুঁজে পেলে ছুটে যেতাম মায়ের কাছে। মা হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত। তার মধ্যেই প্রশ্ন। "'অগমপার" মানে কী গো!  যেখানে যাওয়া যায় না তাই হল 'অগম'..""একেবারেই যাওয়া যাবে না? তাহলে লিখলেন কেন 'যাব অগমপারে'?" এমনি করে অপরিচিত শব্দ পেয়ে মানে বোঝার, তাকে চেনার খেলা খেলতাম। আমার ভালো ভাষার শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। 
    পরিবারের বাইরে আর একটি মানুষ আমাকে রবীন্দ্রনাথ চিনিয়েছিলেন। গল্প-কবিতা-গান- উপন্যাসের বাইরে তাঁর প্রবন্ধের সোনার ভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পড়ে শুনিয়ে। সেই সোনার ভাণ্ডারের চাবিটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমার স্কুলের বাংলার শিক্ষক কমলাদি। রবি ঠাকুরকে নিয়ে শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখার সঙ্গেও প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন কমলাদিই। 
    আমার জীবনের প্রতিটি পর্বে, সব সুর-তাল-ছন্দে তিনি আছেন বড়ো অনিবার্যভাবে। 

    সংশপ্তক:   রবীন্দ্র-প্রতিভার ঠিক কোন দিকটি, আপনার যৌবনের পর্বে বেশি মাত্রায় আন্দোলিত করেছিল আপনাকে?
     কেয়া মুখোপাধ্যায়:  বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে আর ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ এক অনিঃশেষ অনির্বাণ শিখা। রবীন্দ্রনাথ যখন সাহিত্য রচনায় এসেছিলেন তখনও বাংলাভাষা তার নিজস্ব ভাব ও আকার নিয়ে নিজস্ব ছন্দ খুঁজে পায়নি। তিনি ভাষায় আনলেন বিপ্লব। বাংলাভাষা হয়ে উঠল বাঙালির মনের ভাষা। প্রাণের ভাষা। প্রাদেশিক ভাষাটিকে যিনি তুলে ধরলেন বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে। গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নাটকে, গানের নতুন সুরে ও কথার গভীর ব্যঞ্জনায় তিনি মুগ্ধ করে চলেন আজীবন। অসাধারণ দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধ কিংবা সমাজ, দেশ, শিক্ষা সম্পর্কে গভীরতর চিন্তাজাগানিয়া জীবনবাদী নিবন্ধ, এমনকি ব্যক্তিগত চিঠি নিয়ে 'ছিন্নপত্র'- সবই আমাকে ভীষণ প্রভাবিত করেছে। তাঁর চিত্রকলাও। কোনও একটি দিককে এভাবে চিহ্নিত করা অসম্ভব। কোনও বিশেষ মুহূর্তে হয়তো তাঁর একটি গান আমার নিজের কথা হয়ে উঠেছে। আবার কখনো প্রভাবিত হয়েছি একটি বিশেষ কবিতায় কি প্রবন্ধে। এভাবেই নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা আমাকে বিস্মিত, আন্দোলিত করে চলেছে বরাবর। 

    সংশপ্তক:  এই যে জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিত্য নতুন নানা ভাবে আবিষ্কার করি, এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আমাদের এই ধারাবাহিক ভাবে রবীন্দ্রমানস আবিস্কার আসলেই রবীন্দ্রনাথেরই সাথে পথ চলা নয় কি? না কি এই আবিস্কারের সাথে আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আত্মিক যোগ ততটা নেই যতটা মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির যোগ আছে?
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:  ছোটবেলার শিশু-র কবিতার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তারপর কানাইমাস্টার, অমল, সুধা, ফটিক পেরিয়ে কখন যেন নন্দিনী, রাজা আর বিশু পাগলের সঙ্গে চেনাজানা হয়ে যায়। এ যেন এক ধারাবাহিক উন্মোচন।  বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন গান আর কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয়। এক একটা নতুন দরজা খুলে যায়। ভালো লাগার বিবর্তন ঘটতে থাকে। কিন্তু সব মিলিয়ে জীবনের নানা পর্বে এই পথ চলা সামগ্রিক একটা বড় পথ চলার অংশ। যে পথ চলায় অনিবার্যভাবে আমার হাত ধরে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। 
    আমার কাছে মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তি নিয়েই তো আমাদের সার্বিক ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। তাই মেধা মনন আর ব্যক্তিত্ব- সবই এই আবিষ্কারে প্রভাবিত।

    সংশপ্তক:  রবীন্দ্রপ্রতিভার কোন দিকটি আপনাকে বেশি করে টানে ও কেন?
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:   কোন দিকটা বাদ দেব! রবীন্দ্র প্রতিভার বিভায় বিমোহিত। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এমনকি ছবি। এক কথায় সব-ই। তবু যদি একটি দিক বেছে নিতে হয়, সঙ্গীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের কথাই মনে হয়। আর সব কিছু বাদ দিয়ে, শুধু গীতবিতানকে সঙ্গী করে নিয়ে জীবন কাটানো যায়। ধরা যাক, শিক্ষার আলো থেকে অনেক দূরে একটি মানুষের অবস্থান।  অথচ সামাজিক পরিবেশে তাঁর মানবিক বৃত্তিগুলির বিকাশ হয়েছে। সেই মানুষটিও শুধু কানে শুনে রবীন্দ্রনাথের গান থেকে জীবন সম্পর্কে প্রেরণা পেতে পারেন।  উৎসবে, অনুষ্ঠানে, কিংবা জনারণ্যে অথবা একান্ত বিজনে তাঁর গান আমাদের প্রাণের ভাষা, নির্জনতার সঙ্গী। আমাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ। এখানেই তাঁর গানের প্রভাব অন্য আর সব সৃষ্টিকে যেন ছাপিয়ে যায়। বিস্মিত করে।

    সংশপ্তক:  বর্তমানে আপনার ব্যক্তিগত জীবন যাপন ও সংস্কৃতি চর্চার পরিসরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির চিত্রটির স্বরূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:   বিজ্ঞানচর্চার বাইরে সুযোগ পেলেই লেখালেখি করি। কখনো গল্প, কখনো নানা বিষয়ে  বিনোদনী কি স্মৃতিচারণী প্রবন্ধ, টুকরো গদ্য। সাহিত্য -সংস্কৃতি চর্চায় রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতি অস্বীকার করা অসম্ভব। রবীন্দ্র-উত্তর কালের কবিদের অনেকে এক সময় তাঁর কবিতার প্রবল বিরোধিতা করেছেন। তাঁর কবিতাকে আধুনিক বলতে রাজি হননি। যেমন বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু পরে মেনে নিয়েছেন তাঁর উপস্থিতি সশ্রদ্ধ চিত্তে।  তাঁকে অস্বীকার করা বা অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব হয়নি কারোর। 
    আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ খুব জরুরি একটা কম্পাস। যিনি আমাকে দিকনির্দেশ করে দেন। সাহিত্য থেকে সংস্কৃতি- সবকিছুতে। "এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে,/ তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।/ এখনো স্বগত ভাবাবেগে,/ মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।" 
    তবে আমার মনে হয় অনুগত প্রজার মনোভাব নিয়ে রবীন্দ্রচর্চা করা উচিত নয়। মননে, ভাবনায় তিনি আমাদের থেকে অনেক বড় নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর সাহিত্য পড়লে বোঝা যায় তিনি আমাদের বন্ধু,  আপনজন। তাঁর সৃষ্টি আমাদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁর সঙ্গেও অনায়াসেই তর্ক করতে পারি- মনে মনে। প্রশ্ন তুলতে পারি। এক গভীর নৈকট্য আর আত্মীয়তাবোধে তাঁর সঙ্গে বাঁধা পড়ে আছি।

    সংশপ্তক:  আধুনিক বাঙালির সমাজ জীবনে রবীন্দ্রনাথের অপরিসীম প্রভাব সম্বন্ধে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল, তবু তিনি যে সমাজ-ভাবনার দিশা দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সমাজ আদৌ সেই পথে এগোয়নি। তিনি জোর দিয়েছিলেন গ্রামীন অর্থনীতির স্বনির্ভরতার উপর। তিনি চেয়েছিলেন ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সমবায় প্রথার বিকাশ সাধন। আমরা কবির সমাজ-ভাবনার এই দিকগুলিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছি।এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:  রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এক  সমাজবিজ্ঞানীর। তাঁর ভাবনাকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে বললে ঠিক বলা হয় না। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং সমবায় প্রথার প্রসার তো অনেকটাই সেই পথে। হ্যাঁ, পুরোটা হয়তো নেওয়া হয়নি। উত্তরসূরীদের একটা প্রবণতা থাকে পূর্বসূরীদের ওপর কলম চালানোর, দক্ষতা দেখানোর। এও তার ব্যতিক্রম নয়।

    সংশপ্তক:  আরও একটি বিষয়কে কবি দ্ব্যার্থহীন ভাবে তুলে ধরেছিলেন, সে হল শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব! তিনি খুব সুস্পষ্ট করেই বলেছিলেন বারো বছর বয়স অব্দি শিশুদের শুধুমাত্র মাতৃভাষাতেই শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। অথচ আজকের দুই বাংলায় নার্সারি থেকেই স্বছ্বল পরিবারের শিশুদের ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই ভর্ত্তি করার জন্যে অভিভাবকরা আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লাগেন। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
     কেয়া মুখোপাধ্যায়:  ভাষাবিজ্ঞানের কাছে সব ভাষাই সমান। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কোন কোন ভাষা অন্যদের তুলনায়  বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কারণ সে ভাষা বিশ্বজোড়া উচ্চশিক্ষার ভাষা, অর্থনীতির ভাষা, বিজ্ঞানচর্চার ভাষা, এমনকি ভবিষ্যতে ভাল চাকরি পাবার ভাষাও বটে। এ ব্যাপারে ইংরেজির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ছোট থেকেই অভিভাবকরা সন্তানকে সেই আন্তর্জাতিকতার পাঠ দিতে চান।  তাছাড়া বিশ্বায়ন আর উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ধারায় বাংলা বইয়ের অসম্পূর্ণতা আর অপ্রাপ্তিও তো এর জন্যে একরকম দায়ী বই কি! শুধু অভিভাবককে দায়ী করাটা ঠিক নয়। 
    আর বারো বছর অবধি একটি শিশু শুধু মাতৃভাষাই পড়বে- এ ব্যাপারে আমার মত একটু আলাদা। ভাষাবিদরা অনেক গবেষণা করে দেখেছেন, বারো বছর পর্যন্ত যে কোন শিশুর নতুন ভাষা গ্রহণ করার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। সেই সময়ে অনায়াসে সে একাধিক মুখের ভাষা শিখে ফেলতে পারে। মাতৃভাষা ছাড়াও। এটা তার অসচেতন অর্জন। ব্যাপারটা তার কাছে জলের মত সোজা।  কিন্তু বয়ঃসন্ধি পেরোনোর পরে নতুন ভাষা শিক্ষা একটা সচেতন শিক্ষা। তখন শেখাটা আর অতটা স্বচ্ছন্দ থাকে না। কারণ শৈশবের সেই ক্ষমতাটা তখন কমে গেছে। তাই অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে দুটো ভাষাই যদি অভিভাবকরা শিখতে উত্সাহ দেন, ভাষার প্রতি ভালবাসা তৈরি করে দিতে পারেন- তাহলে অনায়াসেই শিশুরা শিখে ফেলতে পারবে একাধিক ভাষা। 

    সংশপ্তক:  বর্তমান শতাব্দিতে বিশ্বায়ন নিয়ে আমরা সবাই বিপুল ভাবে উৎসাহিত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কোনে কোনে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ততটা উৎসাহ নেই বলেই মনে হয়। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি? কি ভাবে ও কারা এই বিষয়ে সঠিক দায়িত্ব নিতে পারে বলে মনে করেন আপনি?
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:  খুব সত্যি। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিই তো একমাত্র তাঁর  শ্রেষ্ঠ কীর্তি নয়!  একটা অংশ মাত্র। অথচ গীতাঞ্জলি ছাড়া সেভাবে রবীন্দ্র সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বেশি পৌঁছল কই!  গল্পগুচ্ছ অনুবাদের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে গেলে আর একখানি নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত হত নোবেল কমিটি। 
    রবীন্দ্রবিদ এবং গবেষকরা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হোন। বাংলা এবং কেন্দ্রীয় সরকারেরও বিশেষ দায়িত্ব আছে নিশ্চয়ই। একটি প্রাদেশিক ভাষাকে পৃথিবীর দরবারে তুলে ধরা দেশের প্রথম নোবেল লরিয়েট তিনি! এ কাজ করতে পারাটা হবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার, ভালবাসার অভিজ্ঞান।

    সংশপ্তক:  আমাদের বাঙালি সমাজের তরুণতর প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কি ক্রমহ্রাসমান? যদি তাই হয়, তবে তার মূলগত কারণ কি বলে আপনার মনে হয়?
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:  ক্রমহ্রাসমান মনে করি না। পাশ্চাত্য প্রবণতার পাশাপাশি রবীন্দ্রচর্চাও হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে জানছে। তাঁদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। জনপ্রিয় সিনেমা এবং টিভি ধারাবাহিকে যেভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং কাহিনি ব্যবহৃত হচ্ছে এখন, আগে এত হত না। প্রত্যন্ত গ্রামে সাক্ষরতার আলো থেকে দূরে থাকা মানুষের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে। ছবিটা আশাপ্রদই মনে হয়।

    সংশপ্তক:   রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ছোট আমি থেকে বড়ো আমি হয়ে ওঠার গুরুত্বের কথা, আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”; তবু যেন আমরা ক্রমেই ছোট ছোট আমির দূর্ভেদ্যে খোলসের মধ্যেই ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা আহত করে বা বিচলিত করে?
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:  বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কল্যাণে গোটা পৃথিবীটাই ছোট হয়ে এসেছে, আসছে। অন্যের সাহায্য ছাড়াই বিবিধ গ্যাজেটস এর মধ্যমে মানুষ নিজে নিজেই প্রায় সব কিছু জেনে নিচ্ছে, শিখে যাচ্ছে, করে ফেলছে। কিন্তু সব কিছু একা করতে গিয়ে মানুষ সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।  আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর হয়ে পড়ছে। নিজের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির বাইরে বেরোতে পারছে না। ক্ষুদ্র ভাবনা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের প্রান্তে অনির্বচনীয় সূর্যাস্ত দেখছে, কিন্তু সঙ্কুচিত করছে মনের প্রসারতা- এ সত্যিই নির্মম।
    আমি ঠিক, অন্যে ভুল। আমি যা জানি সেটাই শেষ কথা। আমি যা করেছি সেটাই সেরা। এই চরম আত্মসন্তুষ্টি, আর আত্মসমালোচনার একান্ত অভাব পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তোলে। বোঝাতে গেলে হিতে বিপরীত। তিনি আগে ভাববেন আপনার কোন দুরভিসন্ধি আছে। কুয়োর দখলটুকু নিয়ে হানাহানি করে জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষগুলো সমুদ্র কী বুঝতে পারে না। চায়ও না। এইভাবে 'ক্ষুদ্র আমি'-তে আটকে পড়া খুব দুর্ভাগ্যজনক। 
    ষাট বছরের জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- 'সংসারের মধ্যে মানুষের দুটি জন্ম। একটি হচ্ছে নিজের দেশের মধ্যে, আরেকটি সকল দেশে। এই দুটি জন্মের সামঞ্জস্যেই মানুষের সার্থকতা। নিজের হৃদয়ে দেশের সঙ্গে বিশ্বের মিলন সাধন করাতে পারলে তবেই হৃদয়ের মুক্তি।' 
    তাঁর ভাবনার খানিকটাও যদি আমরা  গ্রহণ করতে পারতাম, এভাবে যদি আমরা হৃদয়ের মুক্তি খুঁজে নিতাম তাহলে দেশ নিয়ে,  জাতি নিয়ে,  সম্প্রদায় নিয়ে এত ভেদাভেদ, এত জীবনক্ষয় হয়তো ঘটত না। মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্যের জীবন কাটানো সম্ভব হত।

    সংশপ্তক:  আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের বাংলায় রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু থাকবে বলে আপনি আশাবাদী?
    কেয়া মুখোপাধ্যায়:  রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে আরোও অনেক সময় লাগবে। ওঁর নিজের সময় থেকে উনি এতটাই এগিয়ে ছিলেন, তাঁর সব ভাবনাকে আত্মস্থ করা সহজ নয়। বাঙালির অস্তিত্বের সিংহভাগ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্য, সঙ্গীত, গবেষণা, এমনকি মুদ্রণ ও প্রকাশন ব্যবস্থা - সবেতে বড় অনিবার্যভাবে তিনি আছেন। বাঙালির সারস্বত নির্ভরতার প্রধান ভরসা রবীন্দ্রনাথ। চারপাশের অস্থির জীবন আর তার আর যন্ত্রণা মুছে যায় তাঁর গানে। তাঁর সাহিত্য, তাঁর শিক্ষার আদর্শ, তাঁর  সমাজভাবনা- কোনও কিছুই বাতিল হয়ে যায়নি আমাদের জীবনে। বরং দিনে দিনে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে আমাদের জীবনচর্যার পরতে পরতে জড়িয়ে যাচ্ছে। মিলে যাচ্ছে সুখে আর দুঃখে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। 
    যতদিন বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে ততদিনই রবীন্দ্রনাথ। প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নিঃসংশয়।



    Comments
    1 Comments

    1 comment:

    Blogger Widgets
    Powered by Blogger.