"ছুটকী ওঠরে,
কি খাতায় মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছিস?"
সেজদির ডাকে মাথা তুলে দেখি কখন জানি ঘুমিয়ে
পড়েছি। মেজদি দেখি কি সব খাবার কিনে এনেছে, বড়দি চা এনে দিলো। বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব। খুশী খুশী
হয়ে খাতাটা টানলাম। শমী পাঁপড়ির পরবর্তী পরিনতি অবশ্যই বিয়ে,
কাজেই তাদের প্রাক্ বৈবাহিক প্রেম,
তারপর বিয়ে তারও পরে ফুলসজ্জ্যে সেই সব
বিস্তারিত লিখবো, কারন আমার কলমে এই সবের বিশদ বিবরনের জন্য
পাঠক মুখিয়ে থাকেন। খাতাটা নিয়ে শেষটুকু আবার পড়ে তারপর লিখবো করে পড়তে গিয়ে দেখি
ওকি!!? শমী
সন্ধ্যারতির সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়া অবধি ঠিক আছে বাকিতো সম্পূর্ন আলাদা লেখা। মানে,
আমি এই শমীদের প্রেমকাহীনি স্বপ্নে দেখছিলাম?
আমার মন সেই একই ট্র্যাকে ঘোরে অথচ কলম
গিয়েছে অন্য পথে। তাহলে লেখায় আছে কি? পড়ে দেখি, ওই সন্ধ্যারতির আশিস দিতে আসে মা নয় পাঁপড়ি,
আর তখনই শমীর পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। চিনতে
পারে তার একমাত্র আদরের বোন পাঁপড়িকে। পাঁপড়ি নাকি দেখেই চিনেছিলো কিন্তু শমীর মনে
পড়ার অপেক্ষায় ছিলো। ভাবেনি শমীর এতো তাড়াতাড়ি মনে পড়ে যাবে। পাঁপড়ির পায়ের কাছে
লুটিয়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো শমী। চারদিকে অবাক সবাই, থেমে গেছে সন্ধ্যারতি।
পাঁপড়ি কে চোখের পালকে রাখত তার দাদা জাভেদ।
তখনকার দিনেও বিদেশ পাঠিয়েছিলো পড়াশোনা করাতে আরোও কিছু শেখাতে। পাঁপড়ি নিরাশ
করেনি। শুধু দেশে ফিরে সে তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে হিন্দুঘরে। জাভেদ মেনে
নিলেও তাদের সমাজ মেনে নিলোনা। পাঁপড়ির শ্বশুর বাড়িতে এমনিতে জাভেদরা সব সময়
স্বাগত কিন্তু বিয়ে করায় তারাও কেমন অচ্ছুৎ করে দেয়। একদিন সন্ধ্যারতির সময়ে
উপস্থিত ছিলো শুধু উপস্থিত নয় বাড়ীর বৌ হিসাবে পঞ্চপ্রদীপ ছুঁয়ে ছিলো পাঁপড়ি।
তাতেই পাঁপড়ির স্বামীর অনুপস্থিতিতে জাভেদের চোখের সামনে পাঁপড়িকে চূড়ান্ত অপমান
করে শ্বশুর বাড়ির সমাজের কিছু লোক। পাঁপড়ি মেয়ে হয়ে বিদেশ গেছে পড়াশোনা করতে এটা
নিয়েও তাদের সমাজে অনেক জবাবদিহির সামনা করে দুই ভাই বোন,
তারওপর বেজাতে বিয়ে। এরপর একদিন জাভেদের
অনুপস্থিতির সুযোগে কারা যেন নারীত্ব লুঠ করে মেরেই ফেলে পাঁপড়িকে। বোনকে বাঁচাতে
পারেনি এই দুঃখে প্রচন্ড মনের যন্ত্রনায় আকুল সমুদ্রে দিশাহীন সন্তরনের মতো ঘুরেছে,
মানসিক রুগী হয়ে অনেক বছর পাঁপড়িকে খুঁজে
বেড়িয়েছে আর তার উদ্দেশে্য জোড়হাত করে ক্ষমা চেয়েছে; সেদিনের অপমান আর পরেরদিনের বাড়ি উপস্থিত না
থাকার জন্য। পাঁপড়ির মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছে নিজেকে। এই জন্মে তাই পাঁপড়ি সোনামন
হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার দাদার সামনে। শমীন্দ্র হয়ে জাভেদ আজ কিনারা খুঁজে পেয়েছে,
আর তাই ই বোধহয় মউলি শমীন্দ্রকেই ধরলো
সোনামনের দায়িত্ব নেবার জন্য। পাঁপড়ি বুঝেছে তার দাদার কোনো কিছু করার ছিলোনা,
সেদিন ঘরে থাকলেও হয়ত বাঁচাতে পারতোনা
পাঁপড়িকে।
তার মানে আমার হাত দিয়ে সম্পূর্ন অন্য ধারার
চূড়ান্ত স্পর্শকাতর মর্মস্পশর্ী একটা গল্প বেরিয়েছিলো?
অর্ধসমাপ্ত পড়ে আছে সেই গল্প,
শমী সোনামন কি পাঁপড়ি জাভেদ হয়ে শোধ তুলবে?
নাকি শমী সোনামনকে নিয়ে এই সমাজ থেকে অনেক
দূর চলে যাবে? দু'ভাইবোনে অন্য ভাবে জীবন কাটাবে?
কি হওয়া উচিত? নাকি ওই খানেই সমাপ্ত বলে দেবো?
নাঃ খুব ভালো করে চিন্তা করতে হবে,
হুড়োমুড়ি করে লেখা যাবেনা;
আরোও বেশ কয়েকবার পড়তে হবে,
তারপর শেষটুকুন গুছিয়ে লিখতে হবে। আরোও একটু
চা ইত্যাদি চাইবো কিনা ভাবছি, বেশ মৌজ করে লিখতে বসবো; ইতোমধ্যে শুনি বেল বাজালো কেউ।
শুনতে পাচ্ছি সেজদি দরজা খুলে দেখি বেশ
সানন্দে কাকে জানি ঘরে বসাচ্ছে। বড়দি চট্ করে ভেতরে এসে জানালো অনিরুদ্ধ এসেছে,
কি নাকি খুব দরকার। এখনতো দৌড়ে যেতে পারিনা,
উঠতে যেতে সময় লাগে।
অসচেতন ভাবেই চুলে হাত বোলালাম,
আমার অ্যাক্সিডেন্ট যে এতো মারাত্মক জানানো
হয়নি অনিরুদ্ধকে। তখন প্রবল মান অভিমান আর থাকতে চাইনা যার সাথে সে জেনেই বা
কিকরবে? তবে আজ এতোদিন পর এই অবস্থায় অনির সামনে যেতে
একটু দ্বিধা হচ্ছে বৈকি। আমার সেই বিশাল চুল কেটে ফেলা হয়েছে নাহলে মেন্টেন করতে
খুব ঝামেলা হচ্ছিলো। সেই চুল, যা নাকি আমার শরীর খারাপে তেল দিয়ে বেঁধে টেধে ঠিক রাখত
অনি। আমার পোশাক কেমন; এখন সেই কোলবালিশের খোলের মতো নাইটডে্রস
সর্বক্ষনের পরিধেয়। শাড়ীতো দূর অন্য পোশাকও পরতে পারিনা শরীরের এমন হাল। অনি চাইত
সেজেগুজে না থাকলেও যেন ভদ্র পোশাকে পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকি। আমার তেমন কষ্ট হলে একবার
নাইটির ওপর শাড়ী পরার বুদ্ধি দিয়েছিলো অনি। ভাবছি এখন কি তাই করবো?
চুল ছোটো হলেও সেটা আঁচড়ানো কিনা,
সেই জন্যই বোধহয় চুলের ওপর হাত বোলালাম।
"কিরে?
কতোক্ষন বসিয়ে রাখবি?
কি এতো আকাশ পাতাল ভাবছিস বলতো?
মিটিয়ে নিতে এসেছে হয়ত,
মিটিয়েনে" বড়দি সব কথা না জেনে না বুঝে নিজের রায় দিয়ে
চলে গেল। ওয়াকারটা নিয়ে শ্লথ গতিতে চললাম বসার ঘরের দিকে। ভাবছি একেই কি বলে
টেলিপ্যাথি? এই মাত্র আবিষ্কার করলাম আমার অন্য ধারার
গল্প আর অমনি অনি উপস্থিত? ওকে কি বলবো আমার গল্পটার কথা?
বলবো রাত্রে থেকে যেতে?
'পড়ে শোনাবো নতুন গল্প,
এমন গল্প যা তুমি ভালোবাসবে?'
অন্যমনস্ক হয়ে বসার ঘরে পৌঁছতেই আমায় দেখে
প্রচন্ড চমকে গেলো অনি। চুপ দুজনেই। একটা খাম বাড়িয়ে দিলো। আমার নামে চিঠি এসেছে,
একটা নামী পত্রিকা তাদের তরুন সাহিতি্যক
পুরষ্কার ঘোষনা করেছে আমার নামে। চিঠিটা পড়তে গিয়ে কিছুতেই পারলামনা। চোখ কেন যে
ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মাথা নীচু করে বসে রইলাম কতো সময়। টের পাচ্ছি অনি এসে পাশে বসল।
আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল "কি হাল করেছো নিজের? খবর পাবার যোগ্যতাও হারিয়েছি আমি?
আজ এই চিঠিটা দিতে না এলে জানতেই পারতাম না"
"আজ এই চিঠিটা
না এলে এমনি খোঁজ নিতে আসা যায়নি তো এতদিন।"
"নাঃ একটা
শক্তপোক্ত যুক্তি না হলে তুমি পাত্তা দিতে কেন? আমি কি আর জানতাম তুমি এমন কান্ড ঘটিয়েছ?
অ্যাক্সিডেন্ট জানিয়েছিলে সে যে এমন মেজর তা
তো জানাওনি না? তা' জানলে কি আর___"
"দেখলে তো খুব
খারাপ লিখিনা আমি"
"খারাপ কে বলল?
আমি তো শুধু চাইতাম তুমি বিভিন্ন ধরনের গল্প
লেখো; ভেবেছিলাম বিশ্রী করে বললে হয়ত বা তুমি
চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে লিখে দেখিয়ে দেবে। তুমি তো তার বদলে কি সব করে ঘরই ছেড়ে এলে"
"আজ রাতটা থাকবে
এখানে? অনেক দিন পর একটা গল্প খুঁজে পেয়েছি,
এটা একদম আলাদা টাইপের,
পড়ে শোনাতাম তোমায়,
শুনবে?"
"নাঃ আজ এখানে
থাকা হবেনা, বাড়ী যেতে হবে। তোমার মাছগুলো,
তোমার মেনি সব তোমার পথ চেয়ে বসে আছে,
ওদের কথা দিয়ে এসেছি তো। প্লাস এই অবস্থায় আর
তোমায় ফেলে রাখব নাকি এখানে?"
অনি জোর খাটাচ্ছে আমার ওপর?
এতোদিন পর আমিওকি এটাই আশা করছিলাম না?
এখন যে অনুভূতিটা হচ্ছে আমার সেটাকে কি বলে?
আনন্দ? প্রেম? নির্ভরশীলতা? নাকি স্বস্তি? আমার লেখা অন্য আঙ্গিকের গল্প আর আমার জীবন ভেবেছিলাম দুটোই
অর্ধসমাপ্ত হয়েই রয়ে গেলো বুঝি!!
সমাপ্ত
[মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী]