সংশপ্তক: অধিকাংশ বাঙালিরই
রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম পরিচয় সহজ পাঠের পাতায়! তারপর সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে
তাঁর সাথে প্রথম আলাপ যার যার নিজস্ব পরিসরে এক এক রকম ভাবে গড়ে ওঠে। আপনার
ক্ষেত্রে সেই প্রথম আলাপ গড়ে ওঠার গল্পটা যদি একটু বলেন আমাদের!
রত্নদীপা: রবিবাবুর
সাথে আমার প্রথম আলাপ ‘দেবতার গ্রাস ” কবিতার হাত ধরে । কেউ বিশ্বাস করবে কিনা
জানি না ... আমি সাড়ে চার বছর বয়েসে প্রথম আবৃত্তি করি এই কবিতাটি । এবং এখন ভাবলে নিজেরই খুব অবাক লাগে যে বাবার কাছ থেকে শুনে শুনে কবিতাটি মুখস্ত হয়েছিল আমার ।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন আবৃত্তি করতাম , স্টেজ থেকে নেমে আসতাম ... অনেকে কোলে নিয়ে
আদর করতো ... তারপর ধীরে ধীরে ... আমি ... শঙ্খ , পৃথিবী , হঠাৎ দেখা ... এদের
সাথে আলাপন ... তারপর ... উপন্যাস ... রবিবাবু , তুমি আমার একমাত্র যন্ত্রণাশোষক
যন্ত্র ...
সংশপ্তক: একটু গভীর ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের যার যার জীবনে
শৈশবের রবীন্দ্রনাথ কৈশোরের রবীন্দ্রনাথ যৌবনের রবীন্দ্রনাথ আসলেই ক্রমশ প্রকাশ্য
রবীন্দ্রনাথের একটা ধারাবাহিক পর্বই! আমরা যার জন্যে ঠিক প্রস্তুত থাকি না, অথচ এই
ধারাবাহিক ভাবেই কবি যেন আমাদেরকেই প্রস্তুত করে তোলেন আমাদের জীবনের পূর্ণ
উদ্বোধনের জন্যেই! আপনার ব্যক্তি জীবনের গড়ে ওঠার পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রভাব
বিস্তার করেছিলেন সেই গল্পটা যদি বলেন।
রত্নদীপা: রবিঠাকুর
আমার কাছে আবির্ভূত হয়ে থেকেছেন একজন আপ্ত দার্শনিক , মহামানবের মহাসাগরিক
মিলনক্ষেত্রের রচয়িতা । আমার হিসেবে তিনি পৃথিবীর নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক যিনি জাতি
ধর্ম ভাষা এবং রাষ্ট্র নির্বিশেষে একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন
গঠন করেছিলেন । আমি শান্তিনিকেতনে পড়িনি কিন্তু বরাবর মনের মাঝারে ধারণাটি লালন
করেছি ...
সংশপ্তক: রবীন্দ্র-প্রতিভার
ঠিক কোন দিকটি, আপনার যৌবনের পর্বে বেশি মাত্রায় আন্দোলিত করেছিল আপনাকে?
রত্নদীপা: অবশ্যই
প্রেম । প্রেম এবং পূজা রবিবাবুর ঠিকানায় চিঠি হয়ে মিশে গেছে । পূজার সাথে প্রেম ,
প্রেমের সাথে পূজা এক অনিন্দ্য আলাপন , আমার
যুবতীকালীন বিরহ-বাতাস ... নদী নদ পাখি চরাচর ... ‘ তোমার শঙ্খ ধূলায় পরে ,
কেমন করে সইব ... ’ কণা কণা প্রেম বর্ষার সবুঝ ধারার মত অঝোরে ভিজেছে আমার
প্রেমপরিণয়ের রসাতলে ...
সংশপ্তক: এই
যে জীবনের বিভিন্ন পর্যায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিত্য নতুন নানা ভাবে আবিষ্কার করি,
এই বিষয়টি আপনি কি ভাবে ব্যাখা করবেন? আমাদের এই ধারাবাহিক ভাবে রবীন্দ্রমানস
আবিস্কার আসলেই রবীন্দ্রনাথেরই সাথে পথ চলা নয় কি? না কি এই আবিস্কারের সাথে
আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের আত্মিক যোগ ততটা নেই যতটা মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির যোগ
আছে?
রত্নদীপা: আমার
মনে হয় রবিবাবু আমাদের অণুচক্রিকার রক্তসঙ্গমে মিশে আছে ... তাঁর বিশ্বব্যাপি
প্রভাব থেকে মুক্ত করা মুশকিল , মুগ্ধতার সমারোহে যেভাবে বিলীন হয়ে আছে ... জয়ের
আনন্দ , পরাজয়ের বেদনা ... মিথিলার কুরুক্ষেত্র , যুদ্ধের সমবেদনা ... তিনি
একমাত্র আলপথ যেন ... আমাদের কৃষিকাজের ভেতর , কৃষকের ভেতর জ্যোৎস্না-মারীচের
ব্রিহন্নলা পাখি ... তাঁর পথেই বানাচ্ছি রাস্তা , তাঁর রথেই বেজেছে বিহংগ বাঁশরী
... তাঁর সেতারে প্রাকৃতিক হারমোনিয়াম ... তাঁর পসারে আমাদের গদ্যপদ্যের সুমধু
মধুমূর্ছনা ... তাঁর জৌলুসে যাবতীয় অলঙ্কার নিবিয়ে দিয়েছে আমাদের প্রাত্যহিক
অহঙ্কার ...
রত্নদীপা: রবীন্দ্র
প্রতিভার দার্শনিক দিকটি আমাকে আকর্ষণ করে সব চেয়ে বেশি ।
সংশপ্তক: বর্তমানে আপনার ব্যক্তিগত
জীবন যাপন ও সংস্কৃতি চর্চার পরিসরে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির চিত্রটির স্বরূপ ও
বিকাশ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।
রত্নদীপা: রবিবাবু
তো আমাদের ঘরেরই অধিবাসী ... তিনি তো আলাদা হননি কোনোদিন । ভালবাসায় নিরাশ হলে
রবিঠাকুর । মৃত্যুশোকে রবিঠাকুর । বন্ধুবিচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ ... ঘর ভর্তি তাঁরি
বাড়ি , তাঁর সঞ্চয়িতা ... তাঁর গীতবিতান ... তাঁর নৌকাডুবি ... তাঁর বিমলা আর
নিখিলেশের পদসঞ্চার ... তিনি আদি এবং অনাদিবৃক্ষ ... আমরা শুধু তাঁর আঁকা পাতাগুলি
স্পর্শ করে বেঁচেছি পাখিজীবন ...
সংশপ্তক: আধুনিক বাঙালির সমাজ জীবনে
রবীন্দ্রনাথের অপরিসীম প্রভাব সম্বন্ধে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল, তবু তিনি যে
সমাজ-ভাবনার দিশা দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সমাজ আদৌ সেই পথে এগোয়নি। তিনি জোর
দিয়েছিলেন গ্রামীণ অর্থনীতির স্বনির্ভরতার উপর। তিনি চেয়েছিলেন ধনতান্ত্রিক
অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সমবায় প্রথার বিকাশ সাধন। আমরা কবির সমাজ-ভাবনার এই
দিকগুলিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছি।এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রত্নদীপা: রবীন্দ্রনাথ সমাজ চেতনায় গান্ধী এবং তলস্তয়বাদী ছিলেন । কিন্তু পৃথিবীর
ইতিহাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আগিয়েছিল দুই পথে , সমাজতান্ত্রিক এবং
ধনতান্ত্রিক । সোভিয়েতের পতনের পর ধনতন্ত্রই আজ তৃতীয় বিশ্বেরও মুক্তির সোপান ।
সেখানে রাবীন্দ্রিক স্বশাসনের মূল্য নেহাতই নগণ্য ...
সংশপ্তক: আরও একটি বিষয়কে কবি দ্ব্যর্থহীন
ভাবে তুলে ধরেছিলেন, সে হল শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব! তিনি খুব সুস্পষ্ট করেই
বলেছিলেন বারো বছর বয়স অব্দি শিশুদের শুধুমাত্র মাতৃভাষাতেই শিক্ষা দেওয়া উচিৎ।
অথচ আজকের দুই বাংলায় নার্সারি থেকেই স্বছ্বল পরিবারের শিশুদের ইংরেজী মাধ্যমের
স্কুলগুলিতেই ভর্ত্তি করার জন্যে অভিভাবকরা আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লাগেন। এই বিষয়ে
আপনার অভিমত কি?
রত্নদীপা: না , আমি একমত নই । মাতৃভাষা অন্যতম , কিন্তু একমাত্র নয় । ভাষাকে কোন
বেড়াজালে বন্দী রাখতে আমি রাজি নই । আমরা সবাই ছড়িয়ে গেছি । বিশ্বের উঠোন আর
প্রাঙ্গনে ... পৃথিবীর সাড়ায় সাড়া দিয়েছি ... তাই শুধু মা-ভাষাই কেন , ভালোবাসার
ভাষায় সুদীক্ষিত হোক , স্বশিক্ষিত হোক মহামানবের সাগরতীর ...
সংশপ্তক: বর্তমান শতাব্দীতে বিশ্বায়ন
নিয়ে আমরা সবাই বিপুল ভাবে উৎসাহিত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কোণে কোণে ছড়িয়ে
দেওয়ার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ততটা উৎসাহ নেই বলেই মনে হয়। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
কি ভাবে ও কারা এই বিষয়ে সঠিক দায়িত্ব নিতে পারে বলে মনে করেন আপনি?
রত্নদীপা: রবীন্দ্রনাথের
কোন প্রচারের দরকার আছে কি ? পৃথিবীর কোণে কোণে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন ... বেঁছে আছেন
টগবগিয়ে ... সাহিত্যে শিল্পের কথাকলিতে ... তাঁর সৃষ্টিই তাঁর সঞ্চয় । তাঁর আগমনী
আমাদের অমৃতফাল্গুনী ...
সংশপ্তক: আমাদের বাঙালি সমাজের তরুণতর
প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কি ক্রমহ্রাসমান? যদি তাই হয়, তবে তার
মূলগত কারণ কি বলে আপনার মনে হয়?
রত্নদীপা: কিছু
অংশে হলেও বাঙালীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে । তার কারণ অনেক । এক,
উত্তর আধুনিক কবিতার জগতে ক্রমশ জীবনানন্দ অথবা শক্তি সুনীল ও অনাধুনিক হয়ে পড়েছেন
। দুই , নাটক এবং উপন্যাসেও গোরকি ব্রেখট এবং অন্যান্য বামপন্থী ধারার আগমন এবং
বাজার পত্রিকার তরফ থেকে সুনীল সমরেশ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে সৃজন রাবীন্দ্রিক মূল্যবোধকে ক্রমশ ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে । গল্পের বেলাতেও
চিত্রটা প্রায় এক । বাম এবং অতিবাম এবং হিপি সংস্কৃতির পরবর্তী গণসঙ্গীত এবং উত্তরকালের ব্যান্ডসঙ্গীত এবং সেই ধারায় বেড়ে ওঠা কৈশোর
রবীন্দ্রনাথের সাথে একাত্বতা অনুভব করতে পারছে না ...
সংশপ্তক: রবীন্দ্রনাথ
বলেছিলেন ছোট আমি থেকে বড়ো আমি হয়ে ওঠার গুরুত্বের কথা, “আপন হতে বাহির হয়ে
বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”; তবু যেন আমরা ক্রমেই ছোট ছোট
আমির দুর্ভেদ্য খোলসের মধ্যেই ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা আহত করে
বা বিচলিত করে?
রত্নদীপা: তাঁর
স্বপ্ন সফল হয়নি সত্যি ... আমরা ছোট হতে হতে ভেঙে গেছি ক্রমশ ... ছোট ছোট নৌকো
ভেঙে তরী , নক্ষত্র ভেঙে গ্রহ হয়ে গিয়েছি ... নিজস্ব খোলসের মধ্যে ঢুকে গিয়ে মুখে
বেঁধে নিচ্ছি মুখোশ ... চারদিকে এত ধুলো , ধোঁয়ার মিথেন ... আমাদের বেঁধে নিয়েছে
চরম একাকীত্ব ...
সংশপ্তক: আগামী
প্রজন্মের ভবিষ্যতের বাংলায় রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু থাকবে বলে আপনি
আশাবাদী?
রত্নদীপা: রবীন্দ্রনাথ
চিরতরুণ। সর্বাধুনিক। তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম হাত ধরে থাকবেন। আমি বিশ্বাস করি। তিনি সর্বমুহূর্তের আলোকবর্তিকা ... সন্দেহ নেই ... আগুনের পরশমণি তিনি কপালে ছুঁইয়ে দেবেন ... আমরা তাঁর
পায়েই রেখে যাবো ‘ কয়েক মুঠি ধুলি , আমাদের সব সুখ দুঃখের শেষ পরিণাম ’’
[বিশিষ্ট
কবি ও সমাজসেবী]
onyorokom. valo laglo tumpa
ReplyDelete